শরদিন্দু সাহা
লেখক পরিচিতি
বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।
বিষয় পরিচিতি
(নিত্য সমাজ সংসারের যে স্রোত আমরা চাক্ষুষ করছি তার অন্দরমহল জুড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে কত তো কথাকাহিনী, যার পরতে পরতে তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে গোপনে কত তো নারীর জীবনযন্ত্রনা, ধারক বাহক হয়ে গোটা সমাজকে যাঁরা ছাতার মতো আগলে রেখেছে, নিজের পরিচয় খুঁজে নিয়েছে, সকল ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে দিচ্ছে মুক্তি যুগ যুগ ধরে। কয়জনের কথাই বা আমরা মনে রাখি। তাঁদের গোপন ব্যথা, অনুচ্চারিত কথা গুমড়ে মরে যায়, চোখের জল কেউ মুছিয়ে দেয় না, গণ্ডীবদ্ধ শৃঙ্খলিত জীবনই তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এমনই এক সাধারণ গ্রাম্য নারীর কথকতা ও চেতনায় চেনা জীবন ও সমাজপিষ্ট অব্যক্ত যন্ত্রনার পাঁচালি ‘দেশের গর্ভে স্বদেশ ‘ উপন্যাস।)
ওরে আঁর কথা হুন
কান্দস কেন, এরকম করি কাঁদতী নাই। হাউমাউ করি কাঁইদলে লোকেরা কইব কী পঞ্চমী! তবুও আঁই ভেউভেউ করি অনেকক্ষণ ধরি কাঁইদলাম। বুকটা ফাটি গেল। বুকফাটা কান্দনটা এই ওঠে এই থামে। একটু পরেই বুক চাপড়ায়। আঁই জড়াই ধরি কাঁদি, শোকটা কমি গেলে জল্পনা’র মা’র হাত দুটো চেপে ধরে ডুকরে ওঠে কই, ‘কী হবে লা দিদি, ‘মাথা গোঁজার ঠাঁইটাও শেষমেষ হুইড়ে দিল। ভিটের উপর পড়ে রইল পোড়া পোড়া ছাই,পোড়া কাঠের টুকরো। মরণ হইলে পোড়ানোর পরে পোড়াকাঠরা ছত্রখান হয়ে শ্মশানে মশানে যেমন হড়ি থাকে। এত যে কেন জ্বালা! এই জ্বালাটা টের হাইছিল বাপ মায়ের বাড়ির চৌকাঠ ডিঙ্গাইবার কালে। ‘ কান্দস ক্যান মা, হুনছি তোর বাপের মুখে মেলা ঘর, এত্ত বড় বাড়ি, কত মানুষ জন, আদরযত্নের কমতি হবে না। স্বামি তোর এলাকার মান্যিগন্যি লোক দশ মাইল দূরে দূরের লোক এক ডাকে চেনে, মান সম্মানে অনেক উঁচু দরের।’
তিরিশ তিরিশটা বছর বিয়াশাদি হওয়ার পর থেকেই এই বাড়িতে সুখে দুঃখে কাটাইছি দিনরাত। সেই দিনটার কথা ভুলি কেমনে। ঢাকঢোল বাজিয়ে সানাইয়ের সুর হুইনতে হুইনতে পালকি তুন নামছিল। শ্বশুর শাশুড়ি দেওর ননদ নন্দাই, ভাশুর জা সক্বলে কেমন ফ্যালফেল করে তাকাইছিল । সেই ঘর আড়েবহরে কেবল কম ছিল না। কথায় কথায় নানা গল্পই জড়াই যাইত। কোথায় তার শুরু কোথায় তার শেষ কে কইব। ভাইবলাম এমন না হলে সংসার। এ ডাকে তো ও শোনে, ও ডাকে তো এ শোনে। কত গল্পগাছা লাগি থাকে। সুখ দুঃখের বান ডেকে যায়। জোড়া উঠোনে কত ধান দূর্বার খেলা। অতীতও আছে, বর্তমানও আছে, ভবিষ্যৎও যেন কত কথা কই কই আসর জমাইতে চায়। আঁর অতীত জ্বালা যন্ত্রণায় খান খান হইছে কিনা সে আর কে জানতে চায়, না সে কাউকে জানাতে চায়, তবুও চিন চিন করে তো থেকে থেকে। চিন্তারও কি অন্ত আছে! এই ঘর থেকে ওঘরে যাইতে ফাঁকা জায়গাগুলা যে নড়িচড়ি বসে, কেমন করে বসে সে কথা বোঝানো দায়। না না এরকমটা ছিল না, ভাঙাচোরা টিনগুলো মচমচ শব্দে কোন আওয়াজও করে নি। সেই সুযোগগুলো জন্মাবার মুহূর্তে নিঃশেষ হইছে নিজের মতো করি। এই কাহিনীগুলো সবই ঘটনার জালে আটকা হড়ি আছে। খুলতি গেলেই এর প্রতি গাঁটে গাঁটে ঘুমিয়ে থাকা অতীত এসে দরজাগুলো ধাক্কা মেরে খুলি যাইব। ওই যে মাটির ঢিপিটা দেখছেন, দোল পূর্ণিমার বেদী বলে। মাটির স্তূপই ছিল, কারও নজরই ছিল না, আপন ঢঙেই বাড়ি উঠছে কুলগাছটা, নেংটা হয়ে তালিমারা পেন্ট পরে পোঁদ ঘষতে ঘষতে চড়চড় করে মগডালে উঠে যাইত খোকারা। ডাক দিলেও কি শোনা যাইত। পুকুরের মাটি তখন ঝুরঝুর করে গড়াই হড়ছে। ইঁদুরগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে চলি যাচ্ছে অনেক দূরে, আবার ঢুকি যাচ্ছে কোন খোঁদলে, ওরা ছুঁচলো মুখগুলো এর তার সঙ্গে ঘষে দেয়। ছরছর করে নামতে থাকে পকেট ভর্তি করে। খলসে আর চাঁদা মাছগুলো সারি বেঁধে ডান বাঁ করে ছুটতি থাকলে গামছা হাতে খলুই পাড়ে রেখে নামি হড়ে, সামান্য কটাও যদি গামছায় তুলইত হারে, তবে যদি মান বাঁচে। ভাসতে ভাসতে সাঁকোটা পার করি চলি যায়। ডুব দেবে কী, এক নিঃশ্বাসে মাটি ছোঁয়, থকথকে কাদা মাটি। কী একটা যেন ফুঁড়ে বারই আই কাঁটা ফুটাই টুক করি মাটির নিচে ঢুকে হড়ে। ত্রাহি ত্রাহি চিৎকারে ও মাগো, গেলাম গো। আঁই ছুটি আই ডান পায়ের কেনে আঙুলের গোড়ায় চাপি ধরি চিৎকারই জুড়ে দিই, কী এমন রাজকার্য করি আইলেন আঁর হোলা। খলুইটা অর্ধেক ভর্তি হয়েছে দেখে আনন্দ আর ধরে না। ফুঁ দিই মন্ত্র হড়ি বিষ নামাই হোলার চোখের জল থামাই তবে না হলো শান্তি।
ডোবার কাছে জল করে ছল ছল। কচুরিপানা গায়ে গা লাগাই চোখ চাই বসি থাকে। পাতার উপর মহানন্দে খেলি বেড়ায় জলপোকারা। মৃদু ঢেউয়ের দোলনায় দোল খাইতে খাইতে কচুরিপানাগুলো সরে সরে যায়, জল এসে ছিটাই দেয় ওদের মাথায়, নীলচে সবুজ রঙটা ছিটকে বাইর হয়। ওদের যাত্রা শুরু হয়েছিল যেদিক তুন, পুকুর পারের উঁচু জমিটা পূব দিকে বাঁক খেয়েছে, ছেলেগুলো ডুব সাঁতার কাটি তাড়াই মারে। আঁই উনুনে হর্মুলের (পাটকাঠি) আঁচে ভাত ফোটাতে গিয়ে ফাঁকে ফাঁকে দেখি ওদের লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি। এরা না হয় খালের জলে, বিলের জলে দাপাদাপি করার গল্প যে এখনও ভুলতে হারেনি, প্রতি পদে পদে। টের পায় কারা যেন কাঁচারি বাড়ির পাশ কাটি ধপাস ধপাস করে পা ফেলে যেন আগাই যাচ্ছে। ওরা কেমন সুন্দর কমলারঙের গামছা দিই মাথায় পাগড়ি বাঁইধছে। জিবে দাঁত কেটে লাজে মরে মাথায় ঘোমটা টানে। কেউ দেখল কি দেখল না, অত ভাবাভাবির অবসর কোথায়! ভাতের গন্ধটা ধোঁয়ায় মিশে গিয়ে কুণ্ডলী পাকায়। দু’একটা কুমড়ি পোকা উড়ে উড়ে আসে। কাঠিগুলো নিভতে শুরু করলে আবার নাড়িয়ে দিয়ে উনুনের ভেতরে ঠেলি দেয়। আগুনটা দগদগিয়ে ওঠে। উনুনের আঁচ থেকে উত্তাপটা ছড়াই গেলে লালে লাল হয়ে যায় মুখটা। মাথার চুলের খোঁপাটা খুলি যাই পিঠের চারপাশে ছড়িয়ে হড়লি দু’একটা চুল ছিঁড়েমিড়ে যদি আঢাকা কড়াইয়ে হড়ি যাই সর্বনাশ। তখন কে আর কার কথা শোনে। গলার জোরে ভালো মন্দ কথা কইলেও শোনবার আকাঙ্খাটুকু নিঃশেষ হতি থাকে নিজের মতো। ছোট্ট ছেলেটি হয়তো একটু পরেই চেঁচামেচি শুরু করে, ‘ খিদে তো লাইগছে, পেট চোঁ চোঁ করে’। ‘তোর এত চাই চাই ভাব কেন?’ মা’র কথা হাত্তা না দিই টিনের চালার পাশ দিয়ে যাইতে যাইতে কই যায়, ‘পুঁটি মাছ ধরে আনছি মা, ভাজা খামু।’
কদ্দিন হল রসুইঘরের মাটির দাওয়ার পাশে যে ভিটাটা ছিল, বড় বড় মাইরা গাছ (কাটোয়ার,ডাঁটা) আর ঢুল্লার শাকের (নটে শাক) ডাল গজাইছে, কী মজা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে, পরানটায় আনন্দর ঢেউ ওঠে, এই ঢেউ যেই সেই ঢেউ নয়, বুকের মাঝে নাচন কোদন লেগেই আছে। হাতে পয়সা কড়ির বড্ড অভাব, দু’চার গোছা বিক্রিবাটা কইরলে ঘরে দুটো পয়সাকড়ি তো আসবে, মাইয়া লোকের হাতে দুটো পয়সা না হলি চলে! কৌটাটা ফাঁকা থাইকলে নিজেরে বড় অসহায় লাগে আঁর, শুধু কী কেবল দিনেদুপুরে, মাঝরাতে স্বপ্নের ঘোরে, গাছের পাতাগুলো যখন নড়িচড়ি ওঠে। কষ্ট তো লাগে, দিন গুজরানের হিসাবটা বড় গোলমেলে লাগে। চেহারা সুরত সব কেমন পাল্টি গেছে। তবু মই বাই ওঠার মতো সিঁড়ি ভাঙি। কোমরে শাড়ি পেঁচাই থপ থপ করে ওঠি। টঙের উপরে উঠলেই থরে থরে সাজানো সাত পুরুষের ঘর-গেরস্থালি ছড়াই ছিটায় আছে। সংসারের টানাপোড়েনে দম বন্ধ হলি ওই এত্ত বড় টঙটার কাছেই ঘুরি ফিরি চলি আসি। এই ছাড়া যে নিস্তার নাই। এইখান থেকেই শুরু হয় নানা গল্প, সঙ্গে জুটেও যায় ছয় মাসে নয় মাসে নাইয়ুর হয়ে আসা খুড়তোতো ভাশুর ঘরের মেজ ননদ চন্দ্রা, ডাকাডাকির তের রকমের বহরে হয়েছে চন্দরা যদিও শাশুড়ি ডাকে চন্দু, কর্তা বড় মাইয়া ফুলির নাম ধরে ডাকে ফুলির মা, গ্যাতিগুষ্টির মুখেমুখে চন্দরা নামই যেন হাড়ে আসি নৌকা ভেড়ানোর মতোই মুখে মুখে হেরে। বলরামপুরের জাত ব্যবসায়ী অখিল সাহার বড় বউ। কামকাজ আর এত বড় সংসারের দায়দায়িত্ব ফেলে কেমন করি আর আসে। তাই তো সব উগড়ে দেওয়া। সে কী আর থামে, না থামার ফুরসত মেলে। তাই তো ভাবখানা গলায় গলায়। এতোদিন পরে পাই এ ওকে জাপটে ধরে তো ও একে ধরি হাতে হাত ঘষে। ঠোঁট দুটো ধরে নাড়াই দেয়। এমন করে ননদ ভাজ বলার কথাগুলা উড়াই দেয় যেন কালই নোয়া বউ হই চৌকাঠে পা রাইখছে।
তুই তো সোন্দর সোন্দর কথা কস আঁই কিছু কুলকিনারা হাই না। শিখছস কত্তুন। এমনি এমনি লড়াই কইরতে কইরতে জীবনের হক্বল কিছু শিখন যাই, এটা বুঝিনা এমনটা ভাবস কেন। হাঁড়িটা কন্নাই যে ছিল। এই হাঁড়িটাই তো আঁই খুঁজছিলাম। কবে কোন দিদিশাশুড়ি যাইবার আগের দিন মেজেঘষে রাইখছিল, সে আর কোন জনে জানে, হাতের ছোঁয়া অনও লাগি রইছে। কে আর খোঁজ রাখছে ক। পৃথিবীতে কত ঘটনাই ঘটে, যে যার মতো চলে, খোঁজ রাখলিও তো চোখের জল ফেইলতে হইব, অত আর সুযোগ কই! চন্দরা নানান কথার ফাঁকে আঁর মুখের দিকে চায়। তুই এত পুরুষের সবকিছু কেমন আগলাই আগলাই রাখোস অনও পঞ্চমী, এট্টুও হাল্টাস ন।ধন্যি বাপের বেটি। এমন কথা কইস না ঠাকুরঝি, তুই কিসে কম যাস লা। এতগুন বছর হৌর হৌরির মন যোগাই চলা চাট্টিখানি কথা ন। হুনছি ওরা হক্বলে তো তোর হসংসায় হঞ্চমুখ। জল্পনার মা দিদিও নিজের কানে হুনি আইছে। তুই জাদু জানিস লা। জীবন যে আঙ্গ লই কত খেলাই খেলে। টঙে মচর মচর শব্দ হয়। হাসিতে ঢলে হড়ে। শব্দ শোনার এত যে সুখ, কয়জনেইবা জানে। শব্দে আছে কত রকমের শোক দুঃখ রাগ বিরাগ মান অভিমান আর যদি ঝঙ্কার শুরু হয়, তাহলে তো নিস্তার নেই। মনা’র মা আঁর ছোট জা’র কিছুতেই যেন আশ মেটে না। কাজ বইলতে পঞ্চাশ জনের সংসারে আর বাকি পাঁচ জনে মিলে বেলনচাকি দিয়ে এক এক জনে ত্রিশ-চল্লিশখানা রুটি বেলার। বাপের বাড়ি কুটুটি নাড়াইনি বোধ হয়। এইমাত্র এক চোট হয়ে গেল। হল্লাটা তো কম নয়। ঝগড়াঝাঁটি তো লাগিই আছে। হোলাটারে এমন পিটান পিটাইছে না, পিঠে কালসিটে দাগ হড়ি গেছে। ফল ভালো হইত না, এই কই রাইখলাম, মিলাই নিস। আবার কিসের ঝনঝন শব্দ হইল। পিতলের কলসিটা গড়াই গড়াই এদিকে আই আঁর পায়ের কাছে আসি থামি যায়। আর একটু হলেই সর্বনাশটা হয়েছিল আর কি। বিপদ যখন আসে এমন করিই আসে, বারোগ্ৰাম জানিয়ে আসে। না হয় কি দুধেলা গরু এমন করি মরি যাইত। লোকে বলে, যেমন তেমন সাপ তো নয়, কেউটের কামড়। দিনে সাত আট কিলো দুধ, দোহাবার সময় লাথি তো দেয়নি, মা যেমন বাচ্চাকে দুধ দেয়, বালতি ভর্তি করে দেয় পাটনাইয়া গরু। আলি মিঞা গরুর হাট তুন কিনে আনি দিছিল বছরের দুয়েক আগে। বেশ মনে আছে নতুন বউয়ের ঢঙে আরতি করি ঘরে তুইলছিল। দু’দুবার গরু চোরের খপ্পরেও হড়েছিল। খোঁজ খোঁজ, সেই গরু দশ মাইল পথ পার করি মাঠের পর মাঠ, জলা জমি ডিঙিয়ে, কাদা পথ পাড়ি দিই গোধূলি বেলায় সোজা জাবনার কাছাকাছি আসি হাজির। কত তো জানাশোনা, কত তো আবদার। দেখে তো আঁর চোখ দিই টস টস করে জল হড়ে। তাই দেখে কী গরুটার চোখের কোণা ভেজে! আঁই ওর শুকনো মুখ আর খালি পেটটা ধরি আদর করি দিই। কী করে ভুলব সেই সব কথা। গোয়াল ঘরটা মজবুত ছিল না। খড়ের চাল, ভাঙা বেড়া, বৃষ্টির ছাঁট এসে ওর শরীরটা ভিজিই যেত। কে আর সেই সব খেয়াল রাখে। মনটা ভার হয়ে আসে। কাঁধে করে বাঁশে চার পা বেঁধে পাঁচ ছয় জন মিলি ওকে নিতে এলে আঁই কথা হারাই তাকাই থাকি। এতগুলো কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে এত বড় সংসার, সকল মমতা উজাড় করি কত আর অবশিষ্ট থাকে, তবুও সযত্নে রাখি দিছি গরু গোতানের জন্য। চিনতে হারে নি। চেনা সহজ কথা নয়। এটা নাকি শেষ গ্ৰামের শেষ বাড়ি। সেই বাড়ির জেঠতুতো, খুড়তুতো মিলিয়ে বড় ভাইয়ের বড় বউ। আঁর সেই নিয়ে গুমোড়ও নেই, মাথাব্যথাও নেই। কত জনে যে কতভাবে ডাকখোঁজ করে, কত সুরে ডাকে, আঁর প্রাণটা তখন উসখুশ করে, কেমন করি কথার পিঠে কথা কইলে সঠিক জবাব দেওয়া হইব।
আঁর মনে হয় কোন এক সকালে মাঝখানের সময়টা শূন্য হই দশ বছরের কোন এক অতি পরিচিত সকাল আই সামনে আসি হাজির হইছে। সবকিছু যেমন ছিল তেমনই আছে। শাশুড়ি এসে যেমন সুরে ডাক দিত,ও পঞ্চু, ভাতের ফেন গালা হইছে? হোলাপাইনগুন সুর করি হড়ের, অ-এ অজগর আসছে তেড়ে। বড় পিসী উনুনের ছাইগুলো টেনে বার করি এক পাশে জড় করে। কেঁড়াপোকাগুলো দলবেঁধে বনআঁইটগা গাছের ফাঁকে সুড়ুৎ করি ঢুকে হড়ে। ঠাকুমা উঠান ঝাড় দেয় আর গীত গায় ‘গিরি এবার আমার উমা এলে আর উমা পাঠামু না। বলে বলবে লোকে মন্দ কারো কথা হুনইব না।…’ ওঘরের ঠানদির কথা কী আর থামে, ‘আঁর মাথা খা, হাঁচা(সত্য) কথা ক হাঙ্গলগুন (জামরুল) কে চুরি করি নিচস সাতসকালে।’ খাঁচার বাঁধনটা খুলি দিলে হাঁসগুলো প্যাঁক প্যাঁক করে চেঁচায়। গুটি গুটি পায়ে পেছনের পানাপুকুরে নামি ডানা নাড়তি থাকে। হক্বালের (ভোরের) আলোটা খুনসুটি খেইলতে খেইলতে মাটির দাওয়ায় এসে মিশি যায়। মইদুল চাচা লাঠি খেলাই গরুগুলোকে গোয়ালঘর থেকে বের কইরলে খামার বাড়ির পাশ কাটাই ওরা নাদ ছাড়াই মাঠের দিকে ছুটতে থাকে। ‘ওলো, তোরা কন্নাই যাস, ছান (স্নান) করি আই পুজাআচ্চা সারি হালা। ফেনী, বেনী, রতু, শিখুরে লই আঁইঢা বাসনগুন মাজি হালা, হুইনচত নি।’ দু’একটা ব্যাঙ থপথপ করে খড়ের গাদার নিচে চলি যায়। জলে ভেজা খড়ের সঙ্গে পচা গোবর মিলেমিশে একাকার হলি বিদঘুটে গন্ধটা ঘোরাফেরা করে চঞ্চল হাওয়ায়। বিড়ার তলা তুন সাপের ফোঁসফোঁস শব্দ আসি বাতাসে পাক খায়। ঠানদি নিজের মনে বিড়বিড় করে। অত লম্বা চওড়া ঘরে বাসনপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। হোলা-মাইয়ারা কম উৎপাত তো করেনা। ঘর সাজগোজ করি না রাখলে সে আবার কেমন লাগে। লোকজনের আনাগোনাও কম নেই। কে বলতি হারে কে কখন এসে হড়ে, আত্মীয় স্বজনের অভাব নেই। খিলপাড়া, বজরা, নেমাতপুর, লক্ষ্মীপুর থেকে নানা সুসংবাদ দুঃসংবাদ নিই হাত-পা-মুখ নাচিয়ে ঘটা করি কওয়ার লোকের অভাব আছে নাকি! আরশোলা টিকটিকি মরে পড়ি থাইকলে ঠানদিকেই তো খেয়াল রাইখতে হয়। কওয়া তো যায় না কে কখন হামাগুড়ি দিতে গিয়ে মুখে পুরে দেবে আর অতিথরা গালভরা দূর্নাম কইরতে পিছপা হইত ন। খুরশৌয়রের মেঝমাইয়ার ঘরের বড় নাতনি জবা বিধবা হয়ে তিন হোলা আর এক মাইয়ার হাত ধরে আসি হাজির। কে আর ঠাঁই দেবে? পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে ঢুকলে বাপের বাড়ি তুন বার করি দেবে কোন মুখে। উপোস থেকে মরতে দেবে কোন মুখে। এত বড় সংসারে কিন্তু কিন্তু করার লোকের অভাব তো নেই। আঁই আর ঠানদি টেনে তুইললাম। ভাতের ডেকচির ঢাকনার গায়ে উপুড় হয়ে পড়ে আর কী! জল্পনা’র মা চেঁচিয়ে বাড়ি মাত করে। ‘কীলো তোরা হক্বলে চোখের মাথা খাইচছ নাকিরে, মুখপুড়িরা। জলমতি না হয় চিরকালের বেখাইল্লা, সংসারের আটঘাট লই কোন শোধবোধ নাই, ওর কথা ছাড়ান দে, তোরা তো…মাইয়াগুলা চিমসে যায়, ডরাই যাই বুক দুর দুর করে। মাদের কানে গেলে চুলের মুঠি ধরি ঘুরাইব।
ধানে ধানে সোনা রঙ। মাঠের এধার ওধার কোন আনন্দে মাতি আছে। উল্লাসে ফেটে পড়ছে জন্মের ক্ষণে। আঁই সময়ের সুযোগ নিই এক দৃষ্টিতে তাকাই থাই। পাঞ্চালী আসি পাশে বসলেও টের পাই ন কোন পথের প্রতি ওর এত মায়া। কী এত ভাবিস লা। ঘরে তোর মন টিকে না বুঝি। একটু আগেই গয়ামের বাগানের পাতাগুলো ঝাঁট দিতে গেলি মচমচ শব্দে চুরচুর হয়ে যায়। কনকনে ঠান্ডায় তুষের আগুনের তাপ নিয়ে শরীরটাকে একটু তাতাই নিল। ঘাসের উপরে পা ছড়াই বসতি না বসতিই আম গাছের মগডাল থেকে হালকা বাতাসের দুলুনিতে কচি ডালটা নাচতে নাচতে হড়বি তো হড়, আঁর আর পাঞ্চালীর মাঝখানের খালি জায়গাটা দখল করি নিল। পাতার গোড়ায় গোড়ায় কাঁচা আমের ঘ্রাণ। আমরা দুই জা সেই ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতেই উড়ো উড়ো মেঘের খেলা দেখি। অমনি সময় ঘাঁই মারে সরু নালার ঘোলা জলে শাল শোল মাছের দল। খৈইলশা মাছগুলো ছিটকে চলি যায়। ডিঙি নৌকোর মাঝি ঢেউয়ের তালে তালে লগি দিয়ে টানি নিই গিয়ে বড় খালের দিকে এগোয়। পাঞ্চালী পাঁচ আঙুলে ঠেলা মারি কয়, তুই কি চোয়ের মাথা খাইছোস নি, কিচ্ছু দেইখতে হাস না, নজর খালি ওই ধানের ছড়ার দিকে। ওই যে ঢেউয়া গাছের হাকনা ঢেউয়া কেমন টস টস করে, হাতাগুন নড়েচড়ে, দেখিনি একবার। আঁর চোখ কখন যে কোনদিকে ধায়, বুইঝতে হারলেই তো হইছিল। গালগপ্প ছাড়, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হড়ের, মাথাটা ভিজল বলে। আঁই বাঁ হাতে পাঞ্চালীর মাথার কাপড় টেনে দিই, বাঁ কাধ আর ডান কাঁধের পাশ দিই উড়ে উড়ে যায় দু’এক গোছা চুল। হাত দিই টানি দিই। চল চল ঘর চল, হোলা-মাইয়াদের খায়ন দিতে হইব, খিদা লেইগে গেছে রে ওগো। তোর কত দিকে নজর, তোর শাউরি তার লাইগাই ত তোরে এত আদর করে, কয় লক্ষ্মী পিতিমার মতো আঁর বউ, কটা বউয়ের ভাগ্যে জোটে এমন ক দেখি। তোর বুঝি কানে কানে কইছে, তোর যত ছেলে ভুলানো কথা। ঝিরঝিরে বৃষ্টি পাগল ছাগল করা দমকা হাওয়ার সঙ্গে মিলেমিশে হঠাৎই জ্ঞান হারাই লাফালাফি শুরু করে। এমন খেলার তোড়জোড় ওরা কম দেখে নি। মাঝে মাঝেই আছড়ে পড়ে। শাউরি ডাকে, ও বউ, কন্ডাই গেলি, উঠানের ধান ছড়াই ছিটায় যায়, হুকনা ধান বৃষ্টির জলে ভিজি যায়, পা চালিয়ে আয়, তোদের গলা জড়াজড়ি করা কথা শুরু হলে আর থামতি চায় না, এই পাঞ্চালীটা মত নষ্টের গোড়া। আঁর সাদাসিধে বউটার মাথা খায়। তোর শাউরির কথাখান হুইনছস, আঁর নাম তুলি খোঁটা দেয়। পাঞ্চালী নামের লাগি এত বদনাম। ঝাঁটা দিই জড় করে টুকরিতে রাখার আগেই ভিজে উঠছে ঘিগজ ধান। অত বড় উঠানে জুড়ি ছড়ানো ধান তোলা কি সহজ কথা! ওরা মেয়েরা ঘরের চৌকাঠের আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাগলা বৃষ্টির ছাঁট দেখে আর খুশিতে ডগমগ হয়। ঘরের ধান ঘরে থাক, নাইরকল আর তাল টোকাই লই আঁই। ঘরের বউঝিদের এমন বাহাত্তুরেপনা জেঠিশাউরি, কাকিশাউরিরা নানা কথা কয়। এই বউগুলা আঙ্গ মাইয়াগুলার মাথা খায়ের। পরের ঘরে যাই এদের মরণ হইব, শাউরির গালমন্দ হুইনব, গ্যাতিগুষ্টির বদনাম কইরব, ফেরত পাঠাই দিব এই কই দিলুম। বড় মাইনসের ঘরের সুনাম ধুলায় গড়াগড়ি খাইব। মানুষের কথার ভিতরে কত কথা থাকে। ভেবে ভেবে অবাকই হয় আঁই। কোথা থেকে যে কথার জন্ম শুরু হয়েছে, ভেবে ভেবে অস্থির হয়। কত দূর গ্ৰাম থেইকা যে এনারা ধার করে আইনছে। একটা কি গ্ৰাম, দূর দূর থেকে ওর চিহ্নগুলো ভাসি ভাসি আইছে, শুভঙ্করী আর্যা দিয়ে যোগ বিয়োগ খেলার মতো, দিনে দিনে যোগ হইছে এতগুলো বছর ধরে। তারপর তো এই ভাব-ভাবনা জুড়ি গেছে কখন, কে কইবে!
চিন্তারও তো একটা সময় গময় থাকে। আঁর চিন্তাগুলো নিজের মতোই ঘোরাফেরা করে। সময় তো কিছু ওঠাপড়ার যোগফল মাত্র। শূন্য থেকে ছুটি চলের অসীমের দিকে, তাকে ধরি ফেইলবে এমন সাধ্য আছে কার! আঁর বিশ্বাসের মাত্রাটা চড়া। সময়ের কড়ানাড়ায় আঁই টের পাই যায় তাল আর নারকেল গাছের ফাঁক দিই আলোর রশ্মীটা আসি লুকোচুরি খেলে, মাঠঘাটের শিশির ধোয়া শাকসবজি চনমনে হই ওঠে, আঁই বুঝতে হারি কী কী ঘটতে পারে কিম্বা ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। ঘুম ভাঙানো পাখির ডাকেই টের পাই আঁর চারপাশটা সাজি উঠছে নতুন ঢঙে, নতুন রঙে। পুরা বাড়িটা প্রদক্ষিণ করি আঁই চেনা মানুষের অপেক্ষায় প্রহর গুনি। মনে হয় সময়কে এক ঝটকায় গিলে নিই। বলার কথা অনেকেই বলে ফেলবে ক্ষণেক পরেই। কাঁচারি বাড়ির ডান দিক দিয়ে নাক বরাবর যেতেই মনে হয় আতা ফল গাছের ডালটা ঢলি হড়েছে। কারা যেন দুমড়েমুচড়ে হিংসেয় জ্বলে পুড়ে মরে গাছটার দফারফা করেছে। এমনটা না করলি চলছিল না। আঁই ডাল দুটো জোড়া লাগাই, হাঁড়ভাঙা মানুষদের স্বস্তি পাবার মতোই হাতাগুলো সুখের ভাবে এপাশ ওপাশ করে। আঁই ওদের জড়াই ধরি টানটান করি এমন করি বাঁধি দিই শয়তানদের বাপের সাধ্য নেই ওদের কাত করে। কেন যে আঁর ভেতরটা জ্বলি পুড়ি যায়, আঁই নিজেও বুঝি হারি না। এমন নরম মন নিয়ে কি বাঁচা যায়? নিজের ভেতর থেকে উত্তরটা পাবার জন্য উসখুস করি। কত প্রশ্নের উত্তরই আঁই খুঁজি, কেউ দেয় না, দিতে চায় না, নিজেরা জানেনা বলে। তেমন প্রশ্নটা এমনও হতে পারত, সূর্যের আলো ফুটতে না ফুটতেই দলিল মিঞা বেতের গামলায় গোবর আর গোমূত্রের মাখামাখি হওয়া মণ্ড মাথায় চাপাই নিই যায় কেন? ওর শরীরে কোনও ঘিন্নাপেত্তা নেই! মন্টু কেন ওকে দেখে লেজ দোলায়? বড় আজব প্রশ্ন তো! প্রভুকে দেখে তো ভক্ত লেজ দোলাবেই। পরকালের ভয়ে গুরুদেব কই পায়ে পড়ে যায় নাকি মানুষ! ওরা না হয় ইহকালের ভাবনাটা ভাবল, এতে দোষের কী আছে? আঁই এরকমই নানা চিন্তায় অতিষ্ঠ হই। একবার ঢুঁ মারি আসি সদর দরজায়। পেন্নাম ঠুকি। দূরে ঘুমিয়ে আছে মঠ ঘরে মৃত মানুষের শরীর সারি সারি হয়ে। মাটি আর ছাইয়ের উপর কেমন সুন্দর সবুজ ঘাস গজিয়েছে। মন চায় তো আগলে ধরি, পোড়া কপাল আঁর কাকে আগলে ধরব, ওরা যে বাঁশের চোঙায় বন্দী হই ঝুলছে। মন্টু আই আঁর শাড়ির আঁচল ধরি টান মারে। ওর চুলগুলা উসকুখুসকু, কানের দুপাশ দিয়ে গড়াচ্ছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। কে মাইরছে ওরে, এরা কী মাইনষের হোলা ?
বুক ফাঁটি যায় কথায় কথায়
সংসারের জোয়াল টাইনতে টাইনতে দিন গুজরান হয়, দিন আলগা হয়। কোথাও যাবার কথা মনে হলেই কোন ফাঁকে যে আঁর মনটা ঘরের মাঝে আটকা হড়ি যায়, মন টানাটানির খেলায় মাতি ওঠি, দিনক্ষণ ঠিকই করতি হারিনা। গরু-গোতান দেখার ভার দিয়ে গেলি তো হইত ন, দলিল মিঞা এমনিতে জুতসই লোক, তবু হরান মানে না। মাঠের ধান ঘরে উঠবে, বৃষ্টিবাদলার দিনে ঝক্কি তো কেবল কম নাই। গৃহস্থের চোখ হরালেই গোলমালটা বাড়বে বই কইমবে না। তাই বলে কি আত্মীয় স্বজনেরে একবার চোয়ের দেয়া দেই আইসব না, তাও কী হয়! ঘরদোর যেমন সত্যি, জলা-জঙ্গল তেমন সত্যি, মানুষের মুখগুলোও তো ফেলনার নয়, আজ আছে কাল নাই। মরি আছে না বাঁচি আছে, কে আর কইব, হালসন যাইতাম হারি ন, মনটা আনচান আনচান করতি লাগের। কত দূরের হত(পথ), চল্লিশ-পঞ্চাশ মাইল কি মুখের কথা নি। ইনাই-বিনাই কত কথাই না হুনাইব। আনারস আর হুয়ারি(সুপারি) বাগানটা যেন চোখ বড় বড় করে চায়। বড় পুকুর ঘাটে যাওয়া আসার পথে একবারের জন্য চোয়ের দেয়া দেখে। কাঁচা সবজে গায়ের রঙটা পেকে টসটসে হয়ে উইঠলে কেমন হলদে হই যায়, চোখ না জুড়াই কী হারে! ভালো লাগার লগে কষ্টটা যে লেপটাই থাকে। ফল ছিঁড়তি গেলেই মায়ের মতো মন তো, উথলাই ওঠে। উঠানের ধুলাগুলা পায়ে পায়ে লাগি থাকে। নৌকায় উঠলেই ভেতরটা ধুকপুক করে। কত যতন করেই না লম্বা সবুজ লাউটাকে জলার ধারে মাচার উপর পাতার পর পাতা দিয়ে ঢেকেঢুকে রাখা। হাড়ি আর বাসন-কোসনে লাগি টন করি শব্দ হলি মনে হয় ‘ আহারে লাইগল বুঝি।’ মেঘনার খালের জল তির তির করলিই মনে ঘোর নামে। রসুই ঘরের কিনারে গাছের গুঁড়ির সিঁড়ি টপকালেই জল আসি পাড় ছুঁই যায়, খাবার লোভে হুঁটি (পুঁটি) মাছগুলো ঘুরিফিরি আঁর হাতের কাছে চলি আয়ে। থালা গ্লাসগুলো জল ঠেলে ঠেলে ধুয়ে নিতি গেলেই আঁইঢা (এঁটোকাটা) খাইতে ছুটি চলি আয়ে দলে দলে। কী গাঢ় যে আত্মীয়তা, সে কী আর মুয়ে কওয়া যায়! বাসনকোসন ডান হাতের তালুতে নিই ধাপে ধাপে উপরে চলি আসলেই গয়াম (পেয়ারা) গাছের ডালে বসে হালিখ (শালিখ), চড়াই, টিয়ারা ডাক দিলেই আঁই দাঁড়াই দাঁড়াই খোঁজার চেষ্টা করি কোন ছায়ার ফাঁকে ওদের শরীর দোল খার। ওদের ঠোঁট নাড়ানো, লেজ দোলানো দেইখলে মনটা উচাটন হয়। বেলা হড়ি আইলে একা হই যাই, অন্ধ মাইনষের মতোই চুপ থায়নই চেনাজানার সম্বল হই ওঠে, বনবন করি চিনচিনে বাতাসে দোলা লাগলেই বাসা ছাড়ি আঁর দিকে বোলতারা ছুটি আসে। নাতিনাতকুর হোলাপাইনদের কান্দন চেঁচানি লম্বা উঠোনটা টপকে কানের কাছে আইলে হূন্যতা ভাঙি খান খান হয়, পরক্ষণেই শব্দ নিঃশব্দ আড়ি করি দেয়। আঁর আঙুলগুলো জলে জলে হাজার মতো হইলে কই ফেলি কী সব্বনাশ! অন আঁই সংসারের কামকাজ সামলাইয়ুম ক্যান্যে! নিজের ছেলেমেয়েদের ঘুম থেকে জাগানো, খাওয়ানো দাওয়ানো, কাপর-চোপর কাঁচাকাচি করে ভাশুরের হোলা, দেওরের হোলাদের মাষ্টারি সারি তবে না ডেগমাষ্টারি। কত কথাই না মনের মধ্যে আনাগোনা করে। এতগুলা মানুষজন নিয়ে ঘর করা কি চাট্টিখানি কথা! এই গোস্সা হয় তো ও চুপ মারি যাই। ও ডাক হুনি কয় যদি ‘আইয়ের’, তবে গিয়ে গরু ছাগলের লেজ ধরি নাচে। কেউ আবার দিনদুপুরে মনের সুখে গান ধরে। এমনও অবস্থা হয়, ঘর গেরস্তি নিই টান মারে। ছুটি চলি যাই দেখি চার পুরুষ আগের পুরান বাড়ির দুই ঘরের জোয়ান হোলাপাইনরা করে কিলাকিলি, লাঠিসোটা নিয়ে তাড়ি আয়ে, ঘুসোঘুসি, রক্তারক্তি। এই পুকুর আর ওই পুকুরের মাঝামাঝি খালের ঘোলা জল দু’বাড়ির লোকজনকে চোখ পাকাই দেখে। এক জনমের কথা কইলেই তো সব কথা হুরোয় যায় না, কত কথা বাকি থাকি যায়। রাজেন ডাক্তার বড় রাস্তা বরাবর হাঁক দিয়ে যায় ভরদুপুরে, কীগো বড়বৌদী কী কাম করেনের, আমনেরে যন দেখি, খালি ঘাড় গুঁজে কাম করেনের। কন্নান তুন আয়েনের ঠায়ুরপো। আর কইয়েন না, শীলবাড়ির ছোট হোলাটার হেট ছাড়ছে। অবস্থাখান ভালো নয়। পথ্যি দি আইছি, ঈশ্বর জানে। অন চইললেন কনডাই? অধিকারী বাড়ি যাইত হইব, ডাক হইড়ছে। যান যান, সাবধানে যাইয়েন, জলাজমি ডিঙাই যাইত হইব। হুইনলাম, ওদের বাড়ির পোয়াতি বৌয়ের মাথা ঘুরি হড়ি গেছে, তড়িঘড়ি সন্তোষ কবিরাজ গেল, আমনেরেও দেখাইব আর কি। আমনে এত খবর হান কত্তুন বড়বৌদী। কী যে কন, নিজের লোকজনের খবর না রাখলি চইলব কেমন করি।
ঘন মেঘ শাদা হই গেলে আলগুলো আস্তে আস্তে কথা কই ওঠে। ওরা আঁর সঙ্গে চুপি চুপি কথা কয়। কষ্ট হয়, বুক ফাটি যায়। বোরো ধানে পোকা ধইরলে ছিবড়ে হয়ে যায়। মাথার ঘাম পায়ে হেলি ধানের ছড়ার গজানোর পরে যদি এই দশা হয়, তখন মাথা খুঁড়ে মরা ছাড়া আর কি কোনো উপায় থাকে! কড়া রোদে মাঠঘাট ফেটে চৌচির হয়। তবুও রোদের প্রতি আঁর মায়া কমে না। কত দূরের ওই আকাশ, চাই চাই দেখি। এমন যে ভাবনা হয় না, কই কেমন করে। আহা, সূয্যিমামাটা যদি তাল-সুপুরির মগডাল ছুঁয়ে লম্বালম্বি হয়ে সদর দরজা থেকে ভেতরবাড়ির খড়ের গাদা অব্দী ছুঁয়ে থাকত। দু’হাতে জাপটে ধরে কইত, চলি যাও কেন, দুদিন থাকতি হারো না বুঝি, যা চাও তাই দিমু, ধান-দূব্বা-কলা দিই হুজা দিমু। সূয্যিদেব আঁর কথা হুনি হাসে, নিজের খুশিমতো চলি যায়। আঁর ঘরবাড়ি নিজের মতো হড়ি থাকে। খেঁজুর গাছের আগাটা যে চাঁছা হয়েছিল, কেমন শুঁকিয়ে আমসি হয়ে যায়। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। কত কষ্টই না ওরা সহ্য করে। মাইনষের এত্তুন মায়াদয়া নেই গো। নিজের জীবনের সঙ্গে মিলাই মিলাই দেখি। হইলা যেদিন গভ্ভে কেউ আইল, হোলা না মাইয়া এত ভাইববার অবসর কোথায়। সন্তান সুখের মায়ায় মজে থাকি। চন্দু রসিয়ে রসিয়ে গল্পের পর গল্প ফাঁদে। রামায়ণ মহাভারতের গল্পগুলো হুনাই হুনাই আঁর আনন্দের ভাগটাকে কয়েক গুণ বাড়াই দেয়। ঢেঁকিতে ঘিগজ ধান ভাঙে ওর শাউরি। হুনি তো আহ্লাদে আটখানা। হাতের কাজ টেনে নিয়ে গোছগাছ করে। বউরে, পাইগলামি করতি আছে, যে আইতে আছে তার কথা ভাইবতে হইত না। ফিক করে হাসি ফেলাই, শরমও লাগে। স্বামী হপ্তাহ ফুরলে বাড়ি ফেরে। ধানে ভাপ দিও নি বউ, আগুনের তাপের তুন বিপদ হইলে ঘোর বিপদ। ধানের গোলা তুন ধান বাইর না করলি ভাঙাইবতো হইব তো, এতজন লোক খাইব কী? আসমতির মা শাড়িটা কোমরে পেঁচাই খুঁটি খুঁটি উঠান তুন ধান তোলে, ঝাঁট দিই এত্ত বড় উঠোনটার ধানগুলো কুইরে বাইরে আনে।
বাড়ির পাশে বাড়ি। এঁকেবেঁকে চলি গেছে খালের পরে খাল, বিলের পরে বিল। বাঁশের পাশে বাঁশ ফেলে সাঁকোর উপরে পা ফেললেই নড়েচড়ে ওঠে, ভয়ে বুক ধরাশ ধরাশ করে। এই বাড়ি পার হয়ে ওবাড়ি এলেই ছমছম করে গা। জঙ্গলের পাশ কাটাই ডান দিকে ঘুরলেই অঘোরি, শান্তি, মৃদুলারা বালতি বালতি কাপড়চোপড় নিই খালের ধারে যায় নাঙ্গা হায়ে। কাঠের গুঁড়িতে ধপাস ধপাস আওয়াজে কান ফাঁটে। ওরা পরস্পরে সুখ দুঃখের কথা কয়। মরতে কেমন করি হয়, বাঁচার মন্তর কোনোটাই যে জানা অজানার বাইরে। কী একটা যেন জলে ভেসে আসলি মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। দূরহ পাগল, কোনটা দেখতে কোনটা দেখস। জলে তো কত কিছুই ভাসে, অত ভাবলি কেমনে হয়, অত তাকাতি নাই। ধোপার বাড়ির মাইয়াদের সময় গময়ের বালাই নাই। বড় বাড়ির মেজো কত্তার মাইয়ার বিয়া সামনের হপ্তাহে, যেমনে হোক, দিতে তো হইবোই। নতুন বাড়ির বড় গিন্নি হলি না ক্ষমা ঘেন্না করি নিত, মায়ার শরীল, পরের দুঃখে জ্বলিপুড়ি মরে। এমন ব্যাটি চক্ষে হড়ে না। জলের মধ্যে ডোবে আর ভাসে। শাড়ির আঁচলটার একটুখানি ঢেউয়ের তালে তালে দোলে যেন। শান্তি, মাইয়া মাইনষের শরীল, বাঁচাইত হইব, ঝাঁপ দে, কাদের মাইয়া কি জানি। ওরা যত আগায়, শরীরটা ঢেউয়ের ধাক্কায় জলে মাথা ডোবে তো পিঠ ভাসে, পায়ের গোড়ালি নাচায়। কেমনে ভাসল কি জানি। তাল সামলাইতে হারেন ন। শান্তি আর আঘোরি জোরে জোরে সাঁতার কাটে। হানাগুলো (কচুরিপানা) গায়ে পিঠে মুখে লাগি গেলেও ওরা থামে না। আঁই রোজকার নিয়মেই গরীবগুরবোদের খবরাখবর নিব বলেই বাঁশ বাগান ডিঙিয়ে সজনা ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে সাঁকোর দিকে আগাই। এমন দৃশ্য দেখে তো হকচকিয়ে যাই । দুইজন মেয়ে কসরত করছে আর একটা মেয়ের প্রাণ বাঁচানোর লাগি। আঁর এখন কী করা উচিত ও বুঝে উঠতে হারি না। আম গাছের গোড়া পাড়েই পড়েছিল। গায়ের জোরে ঠেলতে শুরু করি মৃদুলাকে সঙ্গে নিয়ে। অঘোরি আর শান্তি শরীরটাকে গোড়ার উপর আগাপাথালি হুইতে দিই ঠেইলতে ঠেইলতে হাড়ে নিয়ে আসে। ও মা এ তো নাপিত বাড়ির বউ। অসজ হড়ইলে নখ কাটি দি যাই। কেন রে মরতে গেছিলি নাপিত বউ? রূপা বেবোল হয়ে চোখ পিটপিট করে, উদাস হই আঁর দিকে চাই থাকে। মনের কথা মনেই থাকে, ঠোঁটের ফাঁকে কথাগুলো ফেটে বের হয়। আঁর সান্ত্বনা বাক্যগুলো গায়ে মাখি নেয় নিজের মতো। এত অসময়ে মরণেরে ডাকি আনার ফল দেইখচস। এত দুঃখ কীসের লা। আঙ্গ বারো বাড়ির লোকজন তো বেঁচে আছে নাকি। রূপার চোখের জলে গোধূলির আলো হইড়লে চিকচিক করে। হোলামাইয়ার মার এত কাইনলে চলে, শক্ত করি সংসারটাকে আঁকড়াই ধরতি হয়, তবেই না নিজেও বাঁচবি, অন্যেরেও বাঁচাবি, ঠিক কথাকান কইছি নি,ক?
জোকারের (উলুধ্বনি) শব্দ পুরো বাড়িটার আনাচে কানাচে ছড়াই যায়। সকাল না হতেই যে আয়োজনের ঘটা শুরু হয়েছিল, তা যেন দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই বেড়ে চলে। সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে পূজার বাসনকোসন এক এক করে মাইয়াগুলানরে বলি নামাই আইনতে। বাড়িময় হৈ চৈ, আজ যেন বাকি কামকাজের ছুটি। কে কাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে কে জানে। ওরা গান জানে, ওরা অন্তরের খোঁজ করে। আঁই ওদের নাম ধরে ডাকি ডাকি হয়রান হয়। ওদের মুখগুলো ঘিরে পূজার ডালা সাজাই। আঁই আসন পেতে বসি। হরির লুটের বাতাসা বিলায়। আঁধারের শরীরে আলোর পরীরা আসি ভিড় করে। সকলে মিলে যখন গান ধরে ‘হরি হে মাধব,গৌর নিতাই বলো হে, কানহা মিলবে যবে রাধার সনে, চলো সকলে মথুরাতে কৃষ্ণ সকাশে। কাঁসর ঘন্টা তো বাজে, করতাল বাজে, বাঁসির সুরে মন দোলে, শাঁখ বাজাই, হৃদয়ের দরজাগুলো খুইলতে খুইলতে যায়। প্রদীপের সইলতে সারি সারি আলো ছড়ালে কোথায় ছায়া কোথায় মায়া এসে বাসা বাঁধে। ঘরের আনাচে কানাচে যারা ছড়াই ছিটায় ছিল কাজের ফিরিস্তি সাজিয়ে, পাইলটে দেয় তুবড়ি মারি, এ যেন নাটকের আর এক অঙ্ক, মুখের আদল ভক্তিতে লুটাই যায়। আঁর চোখে জল গড়ালে আড়ালে ঘটে চলে ভাবসমাধি। মুখগুলো এক এক করে সামনে চলি আয়ে। মুহূর্তগুলোকে ঘিরে নতুন নতুন মানুষের জন্ম হচ্ছে। আঁর চোখ খুলি যায়। ইচ্ছে হয় ও়দের ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি। জড়িয়ে ধরি জিগাই, কন্নাই ছিলি তোরা এদ্দিন? হক্বলে যে যার ঘরে হিরি গেলে একলা হই আঁই ভাইবতে থাকি কত কিছুই না দিতে হাইরত। ওরা একটু পরেই ঘুমের দেশে চলি যাইব। কত স্বপ্নরা ওদের ঘিরে ধরি সৃষ্টি করে চইলবে নতুন জগত। আঁর উপস্থিতি হইব হিয়ানে নগন্য, সম্পর্কের নিবিড় বন্ধনগুলা ভাঙিচুরি যাইব।
আঁর কত কথাই তো মনে হড়ি যায়। নিজের কথাখান নিজের মুয়ে বলার জন্য মনে ছটফটানি শুরু হয়। স্বপ্নে ঘুরে বেড়ায় সে সব কথা। দিনগুলি চলি যায় নিজের মতো, সময় কী কারো জন্য হড়ি থায়। খুড়তোতো দেওরের অংশটা শক্তপোক্ত ছিল। এত্ত বড্ডা ঘরের দেয়াল ছিল টিনের, চালখানাও টিনের। খুঁটি ছিল শাল কাঠের, আলকাতরায় মোড়ানো। দু’তিন বছর পার হলে রঙ করা হইতো। এমন বাস বের হইতো, ঘরের কোনায় কোনায় লেগে থাইকত হপ্তাহ খানেক। হোলামাইয়া নাতিনাতকুররা দৌড়ি চলি যাইত, খেইলত সকলে মনের সুখে। ওদের মুখে কথার ফুলঝুরি ফুইটত। ওই জা ছিল একবারে অন্যরকম। এমনিতে কম কথা কইত। চুপ করি বারান্দায় টুলের উপর বসি থাইকত। হক্কলে যে তাকাইব সে সময় কনডাই। কোন সাতেপাঁচে থাইকত না। মাছির মতো কানের কাছে ভ্যান ভ্যান কইরত, কুমন্তর দিত। দিচ্ছে দিক, অমন কথায় কান দেওয়ার দরকার কী! মনের আনন্দ আর ধরে না। আনন্দটা নিজের মনেই পুষে রাখত। অত উল্লাসে ফাটি পইড়তে মন চাইত না। তিন সাড়েতিন মাইল দূর তুন রিকশা করি স্বামী আই সরাসরি বাড়ি না ঢুকি সদর দরজায় পাক খাইত। জমির পর জমি। এক দেড় মাইল পথ ঘুরি ঘুরি পরখ কইরত কোন ক্ষেতে ফসল কী অবস্থায় আছে। পোকায় কাইটছে কিনা, জমিতে সার লাইগব কিনা। চাষীদের কথা মন দি হুইনত। কয় বাবু ওই কনডিয়ার হুরের লাগোয়া জমিনে পাট চাষ করলি মন্দ হয় না। তাহলি এক কাম কর লাগাই হালাও। জেলেরা জাল ফালাই মাছ ধরে। দেইখলে দু’চোখ জুইড়ে যায়। কত রকমের মাছ – চাঁদা, পুঁটি, কাচকি,তেলচাপাটি, কৈ, খলসে, চিংড়ি, মেনা, বেলে, টেংরা, সিং, মাগুর গজার, আরও কত। বাবু পছন্দ হইছেনি। ফজল যাই আমনের বাড়ি হৌঁচাই দিব। চন্দনের বাপ ঘাড় নাড়ে। গট গট করি হাঁটি চলি যাই আর এক জমির দিকে।
জলমতির সেইদিকে নজর নাই। পঞ্চমী জিগাই ‘তুই এত বেখেয়ালি কেন রে। হোলামাইয়াগুলা যে গোল্লায় যার, সেইদিকে খেয়াল আছে। দিদি, তুঁই তো পড়ালেখা শিখছ, কত সোন্দর গোটা গোটা হাতের লেখাখান তোমার, ও তুমি শিখাও আঁর ছোট হোলা আর মাইয়াডারে। এইটা কোন কথা হইল। চন্দন আর চন্দনার বাপও তাতে সায় দিল। দুনিয়াশুদ্ধ লোক একদিকে আর আত্মভোলা জলমতি একদিকে। কেউ কেউ তো ডাকে, দিদি, একটু সাজগোজ কর, কত সোন্দর লাগে তোমারে সাইজলে গুইজলে, ছোট-ঠাকুর বাড়ি আইছে, নজর দিবা না? মানুষটা জমিজমা দেখভাল করি ঘরে আইছে, একটুখানি যত্নআত্তি তো কর। জলমতির ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি। আঁই ওদের বকাঝকা করি। ওরে ওর মতো থাকতি দে লা, তোরা কেন মস্করা করতি লাইগচস। চন্দন আর চন্দনা আঁর কোলের কাছে পাটিতে শ্লেট পেন্সিল নিয়ে বসি হড়ে। অ আ ক খ এক দুই মুখে মুখে হড়ি ফালায়। চোখের আনন্দ মনের আনন্দে যোগ হইলে বইয়ের পাতায় চোখ বুলাই দে ছুট। ওদের ওই কান্ডকারখানা দেখি হাসুম না কাঁদুম বুঝি উঠতি হারি না। পরের হোলারে নিজের করি লওয়া এত সহজ কথা নয়। মাঝে মাঝে মনে হয় যেদিকে দুচোখ যায় চলি যামু। সংসারের জ্বালা যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না। কদ্দিন হইল সেজো জায়ের ছোট মাইয়াটার ধনুষ্টংকার রোগটা যেন সারছেই না। কত বদ্যি কবিরাজি তাবিজ জলপড়া তুকতাকও করেছে, শেষমেষ পাশ করা ডাক্তার ধনঞ্জয় ছদ্রিকে ডাক কইরছে। হপ্তাহে একদিন বাজারের ঔষধের দোকানে বসে। রোগীর লম্বা লাইন লাগি যায়। হাতেপায়ে ধরি বাড়িতে আনা। কইল এই রোগ নাকি সাইরবার নয়। হক্কলে মিলি আঁরে আসি ধইরল। আঁর ধনেশ পাখির ঠোঁট দিই ঝারফুকে জাদু আছে, চার গ্ৰামের লোকের মুখে মুখে হিরে। আঁর নিজের বিশ্বাসটার চেয়েও ওদের বিশ্বাসটা চতুর্গুণ বেশি। অগত্যা মাইয়াটার মাথা কোলে নিই মাথার চুলে হাত বুলাই নিজের বিদ্যা জাহির করি। কোনও সুরাহা হইল না, যেই কে সেই। এত বড় রোগ কী আর মন্ত্রে হারে! সাঁঝের বেলায় কান্নার রোল। গ্ৰামশুদ্ধ লোকের চোখের জলে বুক ভাসল। কচি মাইয়ার দেহ তো আর পোড়ানো যায় না, মাটির নিচেই চাপা দিল। কদ্দিন ধরি মনের জ্বালায় জ্বলি পুড়ি মইরলাম। শ্মশানের দিকেই চোখটা হড়ি ছিল। নাওয়া খাওয়া ছিল এই কথা কই কী করে, শত হইলেও মাইয়ারই তো মতো, চোখের জল সামলানো কী আর এত সোজা কথা!
যে ঘরে মাইয়াটা খেলনাবাটি লই ঘুরি ঘুরি বেড়াইত, সবকিছু কেমন ঝিম মারি আছে। ভাই বোনরা তেমন আর উঁকিঝুঁকি মারে না। ওরা ঘরের দরজায় পা রাখতি যাই চোদ্দবার চিন্তা করে। শিউলি ফুলের গাছটাও মাটিতে ফুল ছড়ায় না। ডালগুলো মাথা নোয়াই হড়ি থাকে। গাছটা দিনের মধ্যে একবার অন্তত জড়াই ধরি আদর কইরত। বড়রা, খুড়তোতো, জেঠতুতো দাদা দিদিরা নরম নরম হাত ধরি পুকুর পারে দুই তিনটে ঘাটের কাছে লই চটকাইতো, ওরা আর আদুরে কথায় ডাকাডাকি করে না। দুই দিন হইল মামা মামি আইছে। ওর ঘরের পাশে ঘরটায় কোন শোয়ার মতো চই নাই, মেঝেতে পাটি পাতি বই থায়। খোঁজ করি দেইখলো মাইয়াটার একটাও ফটো নাই। বড় আপশোস কইরল, মনের দুঃখে কাঁদাকাটিও কইরল, স্মৃতি উস্কাই নানা কথা বিলাপের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরি আওড়াইল। ঘরের জানালার পাশে একটা গলি, পেছনের রসুইঘর থুন রান্নার ছ্যাঁতছুঁত আওয়াজ আইতে লাগল, সঙ্গে গলগল করি কাঠের জালের ধোঁয়া দুটো ঘরের দখল নিয়ে নিল, ফাঁকফোকর দিই আঙ্গ ঘরেও ঢুকল। টিনের চালের লম্বাচওড়া ঘরে বাইশ চব্বিশখানা ঘর। কোন ঘরের কোনায় কত কিছু লুকাই আছে, কেউ খবর রাখে না। কত পুরুষের হালাইনা ছড়াইনা জিনিস অনাদরে অবহেলায় হড়ি আছে, খোঁজ তো হড়েনি অনেককাল। বড়বাড়ি, উত্তরবাড়ি,নোয়াবাড়ির নোকজন যন পাত পাড়ি খায়, রক্তের সম্পর্কটা তখন গা ঘেষাঘেষি করে। মেয়েটার ছেরাদ্দ হইল, মৎসমুখি হইল, উঠোন জুড়ে লম্বালম্বি কলাপাতার পাত পইড়ল। পুকুরে জাল ফেলাইলে ধরা পইড়ল রুই কাতলা। তাইতে এত বড় ভোজ হইল, মিষ্টি দই রসগোল্লা হক্কলে চেটেপুটে খাইল। ইনাইবিনাই অনেক কথা কইল, ঢেকুর তুলি যে যার ঘরে ফিরি গেল। খাওন তো দূরের কথা, মাইয়াটার মুখটার ছবি ভাসি ভাসি চোখের কোনায় এমনভাবে ধাক্বা দিতে লাইগল, মনের যন্তণাটা ঘাই মাইরতে মাইরতে সিং মাছের আল ফুটাইল যেন। বেহুঁশ হইলে ওরা নাকি ও পঞ্চমী ও পঞ্চমী করি ডাইকল, সাড়া না পাই ধরাধরি করি বিছানায় শোয়াই দিল। দুনিয়াটা এমন করি বানাইছে ঈশ্বর।
একথা ওকথায় দিন কাটি যায়। স্বামীর জেঠতুতো দাদার বড় হোলা সাদাসিধে শান্তিপ্রিয় লোক। একেবারে কোনার ঘরে কোনরকমে থাকে। রোজগারপাতি তেমন নাই। বাজারের মধ্যিখানে ভাড়া লই মুদি দোকান দিছে। দোকানের সামনে লেখা ‘বাকির নাম ফাঁকি’। সেই যে সক্বাল সক্বাল ঘর তুন বার হই যায় হন্ধ্যের পরে ঘরে ফিরি আয়ে। নতুন বউ, নরোত্তমপুরের মাইয়া। বাপের বাড়ি এলাহি কারবার। দিনেরাতে দু-কুড়ি পাত পড়ে। কাপড়ের ব্যবসা করি ফুলিফাঁপি উঠছে। সে মাইয়ার ইয়ানে কি মন টেঁকে। আঁই কত করে বুঝাই, মন খারাপ করি কী লাভ, ধীরে ধীরে সব মানানসই হই যাইব। মাইয়া আঁরে ধরি খালি কাঁদে। খালি কয় বাপের বাড়ি চলি যাইব। বাপের এত বড় বাড়ি, একসঙ্গে এত লোকজন দেই বিয়া দিছে। বাপ আই বুঝাই গেছে, পাগলামি করতি নাই। হইলা হইলা এমন লাগে, কোলে খোকা আইলেই তারে লই দিন কাটি যাইব। পঞ্চমীদি একটু বুঝাইয়া কইবেন তো। শেফালির মা বউয়ের এমন অবস্থা দেখি চিন্তাই হড়ি যায়। ভাবে, বড়লোকের মাইয়া বউ করি আনি কী ভুলটাই না কইরছে। মাইয়া দিন দিন শুকায় যার। মাইয়ার বাপ কী ছাড়ি কথা কইব। জগা দোকান তুন আইলে একটা হেস্তনেস্ত করি ছাইড়ব। মাইয়ার মুয়ে হাজার জিগাইলেও রা বার হয় না। ঘরের হিছনে একটা ঢেঁকির ঘর, দুইটা জোড়া কাঁঠাল গাছ ঢিপির উপরে। ওই দিকে তেমন কেউ একটা সচরাচর যায় না। কাঁঠাল গাছ তুন মুচি বার হইছে। সবুজ সবুজ গা’র তুন কেমন সোন্দর ঘ্রাণ। মাইয়াটা কিয়ার লাগি হিয়ানে যায় আর আয়। গাছের সঙ্গে কথা কয়। জগারে কইলাম, বউটার দিকে নজর দে, কি হইতে কি হয় কওয়া তো যায় না। কাকিমা, ব্যবসাপত্তরের গতিক ভালা ন। চড়া দামে মাল কিনি জলের দরে বিক্রি করি কদ্দিন আর চলে, পুঁজিতে টান ধরছে। চিন্তায় চিন্তায় রাইতের বেলা ঘুম আসে না। হক্বলে একলগে আছি বলে চলি যাচ্ছে, না হইলে যে কী দশা হইত। পরের মাইয়ারে বিয়া যখন করি আইনছস, তেল সাবান স্নো পাউডার তো কিনি দিত হইব, এই কথাখান তো বোঝস। জগা হুনিও যেন হোনে না। বোগলের নিচে চামড়ার থলিটা নিই গুটি গুটি পায়ে চলি যায়। বাড়ির কুকুর কালু তালগাছ পয্যন্ত আগাই দিই আসে। তাকাই থাকে যতক্ষণ জগার যাওয়ার রাস্তাটা বাজারের দিকে বাঁক না নেয়। জগার বউ দু-এক কলম পড়ালিখা জানে। কইলাম তুই আইও না আঁর ঘরে, চন্দন আর চন্দনার সঙ্গে বই হইড়বা। বই হড়ার যে কী মজা, যে হড়ে সেই জানে।
চোয়ের জলে বুক ভাসি যায়
প্রজাপতির মলিন চেহারা দেই মনে হইল এমন দশা কেমন করে হইল! গলার স্বর দিই কোনও কথা বার হইতেছে না। হরনের ছেঁড়া কাপর দেই বুঝতি হাইরলাম কদ্দিন হইল মনের বেদনায় দিন কাটাইছে। হোলাটারে ঘরে রাই মাইয়াটারে দিই বাপের বাড়ি হাডাই দিছে হোয়রবাড়ির লোকজনেরা। গার রঙ কালা দেই ওরা বোধ হয় মানতি হারে ন। মুখটা তো লক্ষ্মী পিতিমার মতো, তাও কেন এত গোসসা আর অপছন্দ। ওরা নাকি আত্মীয় স্বজনের কাছে মুখ দেখাইতে হারে না। কয়, এ মা কালীরে কত্তুন ধরি লই আইছ? যিয়ান তুন আইনছ হিয়ানে হেরত পাঠাই দাও। কেন বাপু, দেখি শুনি তো মাইয়া নিচ, এয়ন কেন এত রাগ অভিযোগ, মাইয়া কি আঙ্গ হেলনার, রঙটাই কাল হইল, গুনটা নজরে হড়ে নি। ওই হোলাটারে দেইখলে জিগাইতাম, হোলামাইয়া জন্ম দিবার সময় এসব কথা মনে হড়ে ন! একবার আইয়ুক না আঙ্গ বাড়ি, কানে ধরি উঠবস যদি না করাই তো আঁর নামও পঞ্চমী না, এই কই দিলাম, হক্বলে হুনি রাখ। গার রঙ রোদে পুড়ি আরও যেন আলকাতরার মতো হই গেছে। বুকটা কষ্টে দুভাগ হয়। বইঠাকুরঝি দুঃখ হাইস না, এত বড় সংসারে এক কোনে একটা জায়গা ঠিক হই যাইব তোর, ওই রায়ের ব্যাটার যদি মনটা এত পাথরের মতো শক্ত হয়, তুই এত ভাঙি হরতিচস কিয়ের লাই। ঠাউরঝিরে আগে কিছু মুড়ি চিড়া যা ঘরে আছে খাওন দে, হরের কথা হরে হইব। মাইয়াটারে এক গেলাস গরম দুধ দে। তুই যে এতটা পথ ভাঙ্গি আইছস বাচ্চাটার হাত ধরি, কষ্ট হইছে তো। হ্যাঁগো বৌদি। চোয়ের জলে মাটি ভেজে। কোনরকমে তিন মাইল গাঁয়ের পথ ধরি হাঁটি বাকি সাত মাইল নৌকায় করি আবার হাঁটি আইছি।
ন-দেওরের ঘরের হাসে ঘরখানা খুড়ি-শাউরির মরার হরে খালিই হড়ি ছিল। ঘর বইলতে দশ বছরের পুরনো ভাঙা চকি। মচমচ করে। এখনও মরার গন্ধ লাগি আছে। ওই ঘরে ঠাঁই হলো প্রজাপতির। লজ্জাবতী, দূর সম্পর্কের দিদা বিছানা নিছে সেও তো কম দিন হয়নি। তাঁকেই সেবা শুশ্রূষার দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলি লইছে প্রজাপতি। লজ্জাবতীর ঘর ছিল হোনাইমুড়ী। হোলাটা অকালে চলি যাইবার পর মাইয়ার বাড়ি ছাড়া যাইবার তো আর কোন জায়গা নাই। বুড়াবুড়িরে কেইবা আর যত্নআত্তি করে। এক গ্লাস জল গড়াই দিব, তেমন কে আর আছে। বুড়ি হারাদিন হড়ি হড়ি চেঁচায়। প্রজাপতি হইছে একমাত্তর ভরসা। তাও কি আর হক্বল সময় ডাইকলে আইত হারে। হরের সংসারে আশ্রয় হাইছে তাই না কত, মাথা গুঁজি কত কামই না করতি হয়। ঘরদোর পয়-পরিষ্কার করা, লেপাপোছা, থালাবাসন মাজা, আরও কত ফাইফরমাস খাটা, নিজের মাইয়াটারেও দেখার সময় নাই। হোলাটার মুখখান তো দিনদিন ঝাপসা হই যাচ্ছে। কার কাছে আর দুঃখের কথা কইব। আঁই হুইরের হাড়ে যাই বসলি ইনিয়ে বিনিয়ে মনের কথা কয়। কারে আর বুঝাই কমু, যে যার তালে চলে, আঁর কথা কে আর হুইনব। প্রজাপতির মাথায় তেল না হড়ি চুলে জট ধরছে, চোখ দুইটা ভিতরে ঢুকি গেছে। তো এক কাম করলি হয় না। হুনছিস কেমন সুন্দর বাজনা বাইজছে। প্রজাপতির কানে যায় নি কথাখান। হুইরের জলে মাছেদের ঘাই মারা দেখছে। রুই কাতলা লাফায় ঝাপায়, ডুব মারে, লেজ উল্টাইলে প্রজাপতি মজা পায়, হাততালি দেয়, হরীরটা নাচায় খুশি মতো। ওইখানে শূণ্য হই তার। শূণ্য কি ভরাট আঁই কিচ্ছুই ভাবিয়ের না, খালি ওর নাচন দেই।
জল ছল ছল, মন ছল ছল, কোন দিকে যাই চল, ঢাক ঢোলের বাজনা বাজে, মাইনষের কথার সাজে, চল যাই চল। প্রজাপতি আঁর ডান হাতটাকে শক্ত মুঠোয় ধরি হুকনা হাতা মাড়াইতে মাড়াইতে কন যে পশ্চিম বাড়ির মঠ মন্দিরের সামনে আনি হাজির কইরল কইতাম হারাতাম ন। কদ্দিন বাদে আইলাম। হক্বল কিছু নতুন লাগে। কত কত ভিটে, আর কত কত ঘর। নেপাপোছা ঘরগুলা এটা ওটার দিকে চাই থাকে। ফাঁকা রাস্তার কোনায় কোনায় ছায়াগুলো দোল খায়। ওরা যেন চুপ করি বই থায়। হাখিরা ডালের ফাঁকে ফাঁকে ডানা ঝাপটায়। কত্ত বড় বাড়ি। গমগম করি ওঠে। ইয়ান তুন ঐয়ানে ঘরের বউঝিরা কান পাতি হোনে কত রাজ্যের কথা। নিজের কথা নিজে কয়, অন্যদের হোনায় ঢঙ করি করি। ওদের কথাগুলা নিজের মতো করি জন্মায়। কখন যে জন্মায়, নিজেরাও জানে না। সকাল সন্ধ্যায় কাজের ঝনঝনানিতে উঠি আসে গল্পগাছার বলাবলি। এমনটা হয়, কারা যেন এক একটা ওই কবে তুন ঝোলায় হুরি রাখইছে, আর বউঝিরা খুলি খুলি বাতাসে উড়াচ্ছে। কেউ কেউ শুনছে, কেউ দলামোচড়া করি কইছে ‘হুশ’। মিলাইতে হারেন না নিজের লগে। নরেন জেঠাহৌরের বয়স আশি হার করি গেছে। উনি কোন পুরুষের বংশধর আঁই কেমন করি জানুম, আঁর হৌউরি জাইনলে জানতি হারে। তবে এইটা কইতি হারি উনি যন আঁরে বৌমা কই ডাকে হরানটা জুড়াই যায়। উনি হাশ দিই চলি যাইবার সময় ঘোমটাটা টানি দি। উনি ঠিক চিনতে পারি কয়, কদ্দিন বাদে দেইখলাম। এই বুড়া হোলাটার খোঁজ তো নিতি পার, মরি আছি, না বাঁচি আছি। দেইখছ প্রজাপতি মাইনষের মনে কত রকমের সাধ হয়, মনের সঙ্গে মন জুড়ি দিতি চায়। নাড়ির টানটা কেমনে যে লতাপাতা ধরি টান মারে এর কোন উত্তর আছে তোর কাছে। মানুষটা চলি যায় আর কবুতরটা পতপত শব্দ করি উড়ে এই ঘরের চাল তুন অন্য ঘরের চালে, আঁই যে ওই ঘরগুন চিনত হারি না, ঘরের মাইনষে তো দূর অস্ত। খুঁইজতে থাকি, খুঁইজতে থাকি, ওরা এই ঘর তুন অন্য ঘরের দিকে দৌড় মারে। দরজাগুনের ফটফট করি আওয়াজ হয়, জানালাগুন খুলি যায়, ওরা আঙ্গরে দেয়, না আমরা ওগরে দেই, কইতে হারিনা, মনটা খালি নাচে। কন যে মনের ভেতর তুন ডাক আয়ে, ওরে তোরা কন্নাই যাস, মুখ ঘুরাই দেখ, ঐটুকুনি দেখছি, কত বড্ডা হই গেছস, ওরা হাখির মতো চিঁ চিঁ আওয়াজ করে, আরও যেন হুনি, আরো যেন হুনি।
কারা যে কীত্তন গায়, প্রজাপতি কান খাড়া করি হোনে। সুরের টানে মজি যায়। কনান তুন আইছে কী জানি। মা মাসীমারা হান সুপারি চিবায়। ওই ঘর তুন এই ঘর তুন ঘোমটা মাথায় শামিয়ানার তলায় দু’পা ভাঁজ করি, কেউ হাঁটুতে মুখ গুঁজি ঘাড় নাড়ে। চোয়ের জল ঝরায়, ঘন হয়ে ডুব দিলে এমনটা হয়। জীবনের রকম সকম সামনে চলি আয়ে। ওরা তালে তাল মিলাই সুরগুন ধরি নিজের নিজের মনটারে ঝাঁকায়। কন্নাই ছিল, কেমনে ছিল কে জানে, মাইনষের কথাগুলো চোয়ের নিমেষে বাতাসে ভাসে। কেউ জিজ্ঞেস করে, তোরা কে লা, কেউ কইতি হারথি ন, খালি না কওয়া কথা কেমনে সামাল দিব, হক্বলে দু’হাতের তালুতে তালি বাজাই ওই কথাই তো ভাবে। ত্রিনাথের আসর জমেছে মাঝ উঠোনে – আম, ক্ষিরাই, ফুটি, কলা, কাঁঠাল দিয়ে ভোগের এলাহি আয়োজন। সিন্নির দিকে হোলাপাইনদের নজর, কন হস্যাদের থালায় হইড়ব, আহ্লাদে আটখানা। বুড়া বুড়িরা মনে মনে ইষ্টনাম জপে। চোয়ে মুয়ের ভাষা হালটি যায়। কোন দিকে যাইব আর কোন ডাল ধরি বৈতরণী হার হইব, ওই চিন্তায় ভাবের ঘরে ডুব মারে। পাঞ্চালী কয় খুড়িমা জেঠিমা আমনেগ হাগুন দেন চাই, নম করি। হাগুন ফাটা ফাটা, ধুলায় আঙুলগুলো ভরি আছে, গুটাই আছে, মেলি আছে। খুড়া, জেঠারা সুরের জোয়ারে ভাসি যায়। হোটা হোটা চোয়ের জল ফেলে। শেষবেলায় আই কৃষ্ণের চরণ ছুঁতি চায়। মনে হড়ে কত কথা, এই বিরাট জগৎ সংসারের কথা। মায়া, হক্বল কথায় মায়া, কেউ আর হিরিও চায় না। কত ঘটনার সাক্ষী হই আছে, কই শেষ করতি হাইরত ন। মাঠ ঘাট জমিন হুকুর ঘরবাড়ি, কত মাইনষের আনাগোনা। কত উল্লাস, কত আনন্দ, সব এক এক করি হারাই গেল। মাথার ঘাম পায়ে হালায়নি, হালাইছে। বরষার জল ফুলিফাঁপি উঠলি হক্বলকিছু কেমন হই যায়। কীরম যে ছিল, এত লোক, এক চালের নিচে জড়াজড়ি। ভাঙি চুরমার হই গেল। ইয়ান তুন হিয়ানে গেল। নতুন নতুন গাছ গজাইল। খালি খালি হূন্য মাঠ মুছি যাই ঘর বানাইল। এক পিঁড়ির লোক যে চলি গেল, কতদিন পার হই গেল, স্মৃতি হই গেল দিনে দিনে। দেশগাঁয়ের ছবিটার অন্য আর এক রূপ আসি পালটাই দিল চেহারাখান। এই হোলাপাইনগুনোর মুখ যেন্ চেনার জো নাই। কীত্তন চইলতে থাকে, খোল, করতাল, কাঁসী বাজাই ওরা নাচি নাচি গান গায় – ও তিন পয়সাতে হয় তার মেলা, কলিতে ত্রিনাথের মেলা। এক পয়সার সিদ্ধি দিয়ে তিন কল্কি সাজাইয়া … …এক পয়সার তৈল দিয়ে তিন বাতি জ্বালাইয়া।
আঁর চেঁচাইয়া গলা ফাঁটে। রতু, বেণী, শিখুরা দৌড়াই দৌড়াই আসে। রসুইঘরের পাশ দিই দলবাঁধি হাঁসের দল প্যাঁক প্যাঁক করি হেছনের হুইলের জলে নাইমবার আগে চোখ পাকাই দেয় বড় বড় লোহার কড়াইগুন ছড়াই বড়াই হড়ি আছে। ওরা আঁর ধমক খাই নাইরকলের ছোবা দিই মাইজত হুরু করি দেয়। হাতও দোলে, মাথাও দোলে। এতগুলা লোকের রান্না হইছে, সময় লাগত না, কন চাই। হক্বলের কামকাজ ভাগ করা আছে। রান্নার ভার রইছে আঙ্গ উপরে। বউঝিরা ঘরদোর, উঠান ঝাঁট দিই, মন্দিরের কামে লাগি হইড়ব। পুরুষ মাইনষে দোকানদারির কামে যাইব, মাঠঘাটে চাষবাস দেখতে বদইলাদের সঙ্গে চলি যাইব। রোজের কাজের জনমজুররা গরুগোতান লাঙ্গল মই লই কেউ বীজতলার কামে হাত লাগাইব। মাঠে যাইবার কালে দলিল মিঞা কয়, বড়ভাবি দুপরের খানাটা দেন। পোটলা বাঁধি পান্তাভাত,আলু সিদ্ধ, ভাজা লঙ্কা। তাই দিনদুপরে খাটুনির পর তৃপ্তি করি খায় হক্বলে মিলি। আউশের বদলে পাট চাষ করে, জলা জমিতে নাইচ্যা, ডাঙ্গা জমিতে বগি পাট। আমনের জমিতে বীজ ছিটাইয়া খেসারীর ডাল চাষ করে। আমন ধান কাটা হলেই মরিচের চারা লাগায়। হাউরিরা, ঠাকুম্মারা, আঙ্গ এক ননদ বেড়াইতে আইলেই উইঠতে বইসতে হানের (পান) ডিব্বা সঙ্গে নিয়া চলে। মনোরঞ্জনদা ছিল আঙ্গ বাড়ির পূর্বদিকে। ওরা হলো বারুই। বিড়া বিড়া হান দিই যাইত। মিষ্টি, ঝাল, ছোট বড় কত রকমের হান। অনেকের হান চাষের সঙ্গে ধান চাষও হয়, ওদের আবার সুখের অন্ত নাই। মুসলমানদের বউ মেয়েরা পুরুষমানুষেরা এক কথায় হানখোর। অঢেল সুপারীর গাছ থাকায় হস্তায় চুন কিনলেই পান চিবান যায়। আবার কেউ আছে গোঁফখেজুরে গোছের, সরকারে খায় ম’জিদে আজান দেয়। একদল লোক তো লাগিহড়ি শুকনা গাঙ সিঁচি হালায়। কম কষ্টের কাজ ন কিন্তু।
কামকাজের খাটাখাটনিতে কন যে সকাল গড়াই দুপর হয়, সূয্য আই মাঝআকাশে পকপক করে, গায়েগতরে জ্বালা ধরে, হাওয়ায় আগুন ছড়ায়। কোথায় গেলে যে শান্তি পামু। হরীলে বড় কষ্ট। হোলাপাইনগুন গরমের জ্বালায় আম জাম বরই(কুল) গয়াম (পেয়ারা) ডেউয়া গাছের নিচে ঘুরঘুর করে, দাপাদাপি করে, ঢক ঢক করি জল খায়, হুক্বাদের (শিশু) তালপাতার পাখায় হাওয়া কইরতে কইরতে পরাণ যায়, কারো কারও হেট (পেট) ছাড়ে। কি আর করুম, আদামননি (থানকুনি) হাতা হুতায় (শিলনড়া) বাটি খাওয়াইলে পেট ধরে বটে, ছেড়ানি কি আর এত সহজে কমে! হক্বল ঘরের বউরা ছুটি আই ভাঙি হইড়লে সন্তোষ কবিরাজের হাতে পায়ে ধরি ডাক করতি হয়। তাও না কইমলে ভরসা সেই হোমিওপ্যাথি রাজেন ডাক্তার আর এলোপ্যাথি ধনঞ্জয় ডাক্তার, ওনারা হইলেন গিয়ে অমাবস্যার চাঁদ। রোগী দেখতি কলে যায় এক গেরাম ছাড়ি অন্য গেরামে, মাঝপথ তুন ধরি লই যাই, কইতে গেলে তুলি লই যাই। এক হপ্তাহ ডাক্তারের দেয়াই হাওয়া যায় না, রোগী তন যমের দূয়ারে। পীরের দরগায়, দরবেশের ডেরায় রোগের তুন বাঁচার লাই মাথা খুঁড়ে মরে। দুঃখের কথা কারে আর কমু, পাঁচ সাত দিন কাতরানি বিছানায় হড়ি হড়ি যেগুন বাঁচি রইল, লোকের মুড়ে মুড়ে ওই এক কথা – কৈমাছের হরান। বিচি-পাঁচড়ার তুন রক্ষা পাওনের লাই ভাদি গাছের গোটা গিলি খায়, মেতী কাঁচা হলুদ আর নিমহাতা মাই সান করে। আম হাঁকে, জাম হাঁকে, কাঁদি কাঁদি কলা হাঁকে, টুক্বুর করি তাল গাছ তুন তাল হইড়লে, হুরু হই যায় কাড়াকাড়ি, কে আগে টোকাই হাইল, কথা কাটাকাটি তো কম হয় না। বৈরাগী বোষ্টমী একতারা খঞ্জনি বাজাই দূর দূর তন আই এই অবসরে মঠ শ্মশানের হাশ দিই সুরে সুরে তালে তাল ঠোকে। কোথায় আর ঝগড়া কোথায় আর ঝাঁটি, ওদের পেছন পেছন ঘোরে সক্বলে। গেরামের পর গেরাম হার করি দুনিয়াদারির খবর লই মন্দিরের সিঁড়িতে পা ছড়াই বসে, জল বাতাসা খাই ঠাণ্ডা হয়,। জিরায়। বউ-মাইয়াদের অনুরোধে দু’চার কলি গানও ধরে – রাধার ঋণে হয়ে ঋণী, হয়েছি ভাই দেশান্তরী,ভাই রে রাধার নামে দন্ডধারী, ভিক্ষা মেগে খাই। …. সাজাইয়ে মা নন্দরানী ননী দেগো খাই; নাচিতে নাচিতে দাদা বলাইর আগে যাই।
এই তো সেদিনও জলে ছিল টলমল। এক বিন্দু জলও চোয়ে হড়ে না অন। এই আছে এই নেই। তেঁতুল গাছের ছায়ায় বসি বসি দেই খাঁ খাঁ কইরছে চারধার, কাউয়ারা কা কা করে, বক কিয়ের লাই চাই বই থায়, চোখ পাকাই পাকাই দেয় কচুরিপানার ফাঁকে কোন মাছ ঘাঁই মারে নি, বই থায় তো, বই থায় শিকারের আশায় আশায়। গাছের তুন পাকা তেঁতুল দুই একটা খসি হড়ে। কাইলা তো টেমবইচা মাছ আর তেঁতুলের হাতা দিই টক রান্না করি খাইচি। পুকুরের তুন লক্ষণ রাম গোপাল কৃষ্ণ ধনারা গামছা দিই তেলচাপাটি, পুঁটি,চাঁদা ধরি এক খলুই হমান উঠানে ঢাললেই কল্পনা চঞ্চলা চলন্তিকারা দুই তিন খান বটি লই মাছ কাটতি লাগি হড়ে। কলমি শাক, মাষকলাইর ডাইল হোলাপাইনগুন পেট ভরি খাইছে, বাড়ির কত্তারাও খাইছে, হাঁড়ি কড়াইতে যেটুক বাকি ছিল মাইয়ালোকের পেটে হইড়ছে। মাইয়ারা খাইল কি খাইল না, কে আর খোঁজ রাখে। ওনাদের আর দোষের ভাগী করি না, নজর দেওনের কি আর সময় আছে? নাই, কারওই সময় নাই। হক্ষিরা মাঠ খালবিলের আকাশ জুড়ি চক্বর মারে, দেইখতে গেলে কত না ভাব, কতনা ডানায় ডানা ঘষা, কত না ভালোবাসা, ছানাপোনার জন্ম দিচ্ছে, যত গণ্ডগোল শিকার নিই কাড়াকাড়ির বেলায়। কত দুঃখ শোকের জন্ম নিচ্ছে মনের ভেতরে। বিলের কচুরিপানা থকথকে মাটির সঙ্গে মিশি যায়, নীলচে রং এর ফুলগুলোও মিলাই যায় অন্য কোথায় কইতে হারি না। মানুষও তো আসি আর যায়। ঋতু হালটাইতে হালটাইতে একদিন রং ঢং সব পালটি যায়, কেউ অকালে হুয়াই যায়, হাড়গোড় নড়বড়ে হয়, ক্ষইতে হুরু করে। বেগ্গাইন আজ হুকনা, পচা গন্ধ ভাসি আসে মাঠঘাট তুন। আঁচল দিই নাক চাপা দিলেও রেহাই মেলে কই। আগুনে বৈশাখ খেলাই তো করে নিজের মনে। এই বুঝি কেউ আই জপটাই ধইরল, গলা টিপি শেষ কইরব,রাস্তা আছে নি যে মিলব। পোকামাকড়ের বিষ, সে আর কম কী! শত্রুর দমন করা তো চাই। বাড়ির সামনে কাস্তে দিই মাটির উপর চৌকণা ছক কাটি চিড়া খই লাবনী খেসারীর ডাইল ছড়াই দেয় কত্তারা আর ছকের মাঝখানে দিই বড় কাঁচা আম হোয়াই এক কোপে দুই টুকরা করি তার হরে কাঁচা আম খায় সক্বলে সঙ্গে খই মুড়ী চিড়া ছাতু দই লাবন গুড় নাইরকল দিই মাখি ফলার করি। ছুরি দা নিই বাইর হয় হোলাপাইনরা হিঞচে, লতি, বনাইটগা কাটি আইনলে কুমড়ার ডাঁটা, কাঁঠালের ইচঁড়, নিম,উচ্ছে, হিয়ালের মুথরা, লাল আলু, নাইরকল কুচি ভাজি, বড়ি মিশাই পাচন রান্না করি। জীবনের কত রঙ। কত গান যে ঘুরি ঘু্রি মুয়ে মুয়ে হেরে। জমির উপর স্বত্ত স্বামীত্ব বজায় রাখার গান। ওই দেইখছনি চেঁয়ডি গাছের টুকরার মাথায় একখান খড় পাগড়ীর মতো বাঁধা কাঠি পুঁতি দেয়। গিরস্থরা মাথায় জল ঢালি কয় – জাগো জাগো জাগো, যাবৎ জীবন তাবৎ থাকো।
আঙ্গ বাড়ির হন্মুখে অশ্বত্থ বট নিম গাছের গোড়ায় হক্বলে মিলি নম কইরত। কিয়ের লাই কইরত জিগাইলে বড়ঠাম্মা পিঠ ঝুঁকাই মাথা নাড়াই কত কথাই মনে মনে কয়, মথামুণ্ড বুঝি উঠতি হারি না, তবুও খোঁচাইতে ছাড়ি না। কয়, আর একবার যদি জিগাইস্ ভালা হইত ন, মাইয়ার বাড় বাড়ছে। আঁই অনও বুঝি উঠতি হারি না, এত লুকাই রায় কিয়ের লাই। এই সংসারে কত গোপন কথাই না আছে, ঝিম মারি রায়। এই ওর কথায় সায় না দিলে বাড়ি শুদ্ধ মাথায় করে। কাইজ্যা শুরু হই যায়, এক কথার তুন আর এক কথায়। ঝুড়ি ঝুড়ি সুয়ারী গাছ তুন হাড়ি লই কাচারিবাড়ির সামনের খালি জায়গায় বস্তায় হোরে। সারা দুপর ভরি হাড়ে, বিয়ালে নাওতে ভর্তি করি হাটের দিকে ছোটে, সঙ্গে পঞ্চাশ ষাটখান ঝুনা নাইরকলও থায়। হাট তো কম নাই, গরু হাটা, ছাগল হাঁটা,ধান চালের হাটা, নৌকা বেচার হাটা, যোগী হাটা, হাস-মুরগী হাঁটা, হাঁটে আবার লাঙ্গল জোয়াল, খড়ম,কামারশালা বাইন্যা পট্টিও আছে। আঁর দেওর ভাসুর আর বাড়ির হোলারা এসব লই নাওয়ে চাপি হাটে যায়। নৌকায় ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করি বৈঠা বাই ছোটে, কেউ কেউ গলুইয়ে বই হাওয়া খায়। দুদিকে চাষের জমি মুখ তুলি চাই থায়। মাইয়ারা মেলইনা ধান হুয়াই ঘরে তোলে। মাটির চুলায় রান্না চাপায়। কেউ কেউ হুজার ঘরে কাঁসর ঘন্টা বাজাই হুজার কামে লাগি যায়। সুর তুলি হাঁচালি হড়ে। পূজার আয়োজন শেষ হইলে কৃত্তিবাসী রামায়ন ব্যাসদেবের মহাভারত লই চইয়ের উপরে বসে। রাম-সীতার বিরহ আর পঞ্চপান্ডবের অজ্ঞাতবাস পর্বে দ্রৌপদীর লাই চোয়ের জল ফালায় আর চোখ মোছে, বুড়ো বুড়িরা ওদের ঘিরে বই থায়, ওদের ভাবনাচিন্তা গুলান মহাকাব্যের গল্পে হাঁটাহাঁটি করে, বুঝতে হারে কিনা তিন কাল যাই, এক কাল ঠেইকছে। উদাস হই যায়, তারপর লাঠি ভর দিই খোড়াইতে খোড়াইতে যার যার বিছানায় যাই লম্বালম্বি হই হুইয়া পড়ে। কেউ ডাইকলে উঠি চাইট্টা ভাত না হয় দুইখান রুটি খাই ঢক ঢক করি জল গিলি হালায়। মাইয়াগুলান রসুই ঘরের দিকে ছোটে। বাবা কাকা জেঠাদের লাই খানা দিত হইব তো। ওরা বিয়ার লায়েক হইছ, পনের ষোল বছর বয়স। দূর দূর গেরাম তুন বিয়ার সম্বন্ধ আয়ে। হণের(পণ) ট্যাঁয়া (টাকা) বাজারের জিনিস দরাদরি করার মতো করিও না পোসাইলে গটগট করি চলি তাই। গা’র রঙ কালা হইলে, মাইয়ার হরিলে কোন খুঁত থাইকলে হণের ট্যাঁয়া চারগুণ বাড়ি যায়। মাইয়া দেখানো তো নয়, এই যেন বাড়িতে এক মোচ্ছব লাগি যাই, সোলার বাপের চওড়া হাসি দেই পিত্তি জ্বলি যাই। শুভপুর, নরোত্তমপুর, বিজয়নগর, লক্ষীপুর কত জায়গার তুন টোয়াই টোয়াই কত্তারা হীরের টুকরা হোলা খুঁজি আনে। জমিদারবংশ হইলে তো কথাই নয়।
কতবার ভাইবছি যে এমন নিয়ম কে বানাইছে। এটা নাকি দস্তুর। তবে আঁর বিয়ার সময় আঁর হৌরমশাই এমন দাবিদাওয়া করে নাই। দেইখতে শুইনতে মন্দ তো ছিলাম না, লোকে বইলত, ফর্সা টুকটুকে কইত, কত বড় ঘরের হোলার লগে বিয়া দিছে। হবু বর আইন নিই ঘাটাঘাটি করে, এসব লই কিছুই মাথায় আসেনি। হুইনছি দূর সম্পর্কের এক মাসীর মুয়ে, হবু স্বামীর আমার গায়ের রঙ কালা হইলেও বিদ্যাবুদ্ধিতে বারো-গেরাম জোড়া নাম, হক্বলের মুয়ে মুয়ে ফেরে, বাঘে গরুতে নাকি এক ঘাটে জল খায়। ডরে কাবু হই গেলাম। কারে আই মনের কথা কই। আঙ্গ বাড়ি ছিল সংরাইশ। পরের ঘরে যাইত হইব। ইসকুলে হেডমাষ্টার মশাই হুনি তো থম মারি গেলেন। হড়াশুনায় পেথথ্ম ছিলাম তো। পাঁচ কেলাসে হড়ি তন। উনি ঘাড় নাড়ি কইলেন, ‘এইটা কি ঠিক হইল। তোর বাপ মা তো ইসকুলে পাঠাইতে চায় না। মাইয়া মানুষের হড়ালেখা করি কী হইব! শেষমেষ বোঝাই সোনাই তো পেথথম কেলাসে ভর্তি করি দিল কিন্তু কিন্তু করি। হুইনতাম আঁই, হক্বলে প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তাতে আঁর কিছু মনে হইত না। হড়ালেখা শুধু হোলারাই কইরত, মাইয়াদের ভাগ্যে তো জুটত না। অনও মনে হড়ে যেদিন কেলাস টুতে শ্লেট পেন্সিল লই টেবিলের এক কোনে বই কালা রঙের দেয়ালে সাঁটানো চৌকোনা জিনিসটার দিকে তাকাইলাম, মাষ্টার লিখি লিখি বুঝাচ্ছিল কারে কয় কবিতা। চক ডাষ্টার হাতে লিখছে আর মুইচছে – ওঁর যদি সেই পুতুল নিয়ে ভাঙেন কেহ রাগে, বল দেখি মা, ওঁর মনে তা কেমনতরো লাগে। কইল, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম হুইনচস। এইটা হলো ‘শিশু ভোলানাথ’-এর ‘পুতুল ভাঙা’ কবিতার পঙক্তি। পঙক্তি কারে কয় কী জানি! ভেতরটা নড়েচড়ে ওঠে। যত হুনি, মনে হয় আরও হুনি। মাষ্টারটাও তেমন, গড়গড় করি কত কবিতার কত লাইন মুখস্ত কই যায়। এমন করি কেউ কথা কইতে হারে! দুয়োরানী, তালগাছ, পথহারা কতবার করি যে হোনায়, ভুইলতে যেন না হারি। ‘ওই যে রাতের তারা, জানিস কি মা, কারা? সারাটি খন ঘুম না জানে, চেয়ে থাকে মাটির টানে। জ্যোতিষী কবিতা এতবার করি হুইনছি, মনের মধ্যে গাঁথি গেলে হারাক্ষণ ঘুরিফিরি ঘরের মধ্যে আওড়াইলে আঁর মা ভাইবত মাইয়াটার বোধ হয় মাথা খারাপ হইছে, না হইলে এমন বিড়বিড় করে কেন! এর উত্তরখানা আঁরও জানা ছিল না। শুধু কইতাম আমনে বুঝতেন না। ইসকুলে না পাঠানোর ব্যাপারে বাড়ির হক্বলে মিলে মনস্থির কইরল। আঁই তো ইসকুলে যাইয়ুমই, জিদ ধরছি। হক্বলে তাইতে হার মানল। যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ সবই তো শিখছিলাম, আরও কত কিছু যে শিখা হয়নি এয়ন বুঝি।
হৌরবাড়ির গুণকীর্তনে নিজের ঘর বাঁধি
হরে মুরারে মধুকৈটবারে, গোপাল গোবিন্দ মুকুন্দ সুরে – এই লাইনগুলো উনি আওড়াতেন বার বার। কী সুখ যে লাইগত শব্দগুন হুইনতে, ভেতরটা কেমন করি উঠত। চাই থাকতাম কন ঘরে ফেরে। বুইঝতাম হক্বল কিছু। কোর্ট-কাচারির ঝক্বি সামলাই, শহরের বাসা গোছাই-গাছাই হাঁটি হাঁটি যন গাড়ি ধইরবার লাই ইস্টিশনে আইত, রেলগাড়ি চোয়ের সামনে দিই বারৈ যাইত। তীর্থের কাকের মতো বই থাইকত, কন হরের ট্রেন আইব। ডাউন ট্রেনটা যাইলে এনা আপ ট্রেনটা আইব। ডিগির ডিগির করি আয় ট্রেন। কত নিচে প্ল্যাটফর্ম। তেনারে হক্বলে চেনে। মর্জিমাফিক চলে। ছোটোমোটো ষ্টেশন। কেউ যেন গেরাহ্যি করে না। স্টেশনমাস্টার কইতও হারে না, কোন ট্রেন থাইমব, আর কোন ট্রেন থাইমত ন। চাই থায়। বাবু দৌড়ান, জোরে দৌড়ান। উনি কাঁধে ব্যাগ লই ছুটি যায়। জেলা কোর্ট পেছনে হড়ি তাই। তেনার কথা যত কই শেষ হইত ন। গিজগিজ করে লোকজন। গেরামের বাড়িতে হিরনের লাই হপ্তাহের হেস হইলেই মন করে আনচান। দুনিয়েটা কেমনে যেন ক্ষণে ক্ষণে হালটি যায়। তাকাই দেহেন মাইনষের তেমন আনাগোনা নাই। যে যার ঘরে চলি গেছে। সওয়াল জবাব নাই, জেল জরিমানাও নাই, পুলিশের হাতকড়াও নাই, উকিল মোক্তারদের মুসাবিদা নাই, জজ সাহেবদের হুকুম জারি নাই, রায় নাই। অন্যদিন কত আশা ভরসা লই চর জমিনের গেরস্তরা কত দূর তুন আই মামলা লড়ে। জোর জবরদস্তি করি ওদের জমি কাড়ি লই পথে বসাইছে শত্রুহক্ষের লোক। হাতে পয়সাকড়ি নাই, ধারদেনা করি আইছে বিচারের আশায়। পায়ে চটি নাই, গায়ে ফতুয়া, ধোয়াফালা হয়নি, গায়ের তুন ঘামের গন্ধ বের হয়। হাত জোড় করি আই কয়, বাবু বাঁচান। চোয়ের কোনায় জল গড়ায়। বাঁচি থাকার কষ্ট ওদের কথাবার্তায় বার হই আসে। আঁর স্বামীর চেহারাটা উপর উপর দেইখলে মনে হইব ফুটিফাটা জমিনের মতো হুকনা, উল্টা কথা কইলে দুটো ধমক খাই যাইতে হারেন, বুঝাইয়া যদি কওন যায়, আমনের কথাগুন মনে হইব হুইনতেছে না, আসলে আমনে যদি জিগাইন, বেগগাইন আমনেরে গড়গড় করি কই দিব। মুসাবিদার ফিটাও লইত ন। শহর আর গেরামের লোকগুলোর মধ্যে আকাশ পাতাল হারাক। ওরা ওই তেলচুলোহীন চাষিভুষা নোকগুনোর দিকে আড়চোখে চায়। ওরাও অত ভাবাভাবির ধার ধারে না। নিজের মতো ওই ইসকুলবাড়ি, ডাক্তারের ঘর, খাজনা অফিস, কোতোয়ালির দারোগার দিকে ডরে ডরে হাঁইটতে হাঁইটতে মুহুরির টুলের কাছে যাই কাকুতি মিনতি করি কয়, বাবু কিছু করেন। ওরা কতরমের ফন্দিফিকির করে, টুপি হরানোর মাষ্টার, হক্বলে নয়। মক্বেলরা আইতেই থায়। জেলা ত কম বড়া নয়। দেওয়ানী ফৌজদারি মামলা নিই কাইজ্জা তো লাগিই আছে। হারজিতের খেলা। মামলায় হারি তাই কারও চোয়ের জল হড়ে, কেউ রাগে দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়ে, কারও জেতার আনন্দে মাটিতে হা হড়ে না। গাছের নিচে জিরাইবার লাই বইলে কারও মাথায় কাউয়া হাগি দিলে ভাবে আজ একটা সব্বনাশ হইবই হইব। এ হকল কাহিনী আঁর স্বামীর কাছ তুন হোনা।
আঁর স্বামীর জীবনটা আঁর পাঁচজন মাইনষের তুন ভেন্ন। হকাল সন্ধে নিজেরে নিয়মের সুতায় যেন বাঁধি রায়, একটুও নড়চড় হয় না। নিয়ম ভাইঙলে কয়ালে সে ব্যাটার দুঃখ আছে। ভাগ্যে জুটবই জুটব দু’চারটা কানমলা, বেতের বাড়ি আর উঠবস। তেনার তর্জন গর্জনে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়। এলাহার হোলাপাইনরা ডরে হলায়। একটু যদি কামকাজের সময়ের নড়চড় হইছে, তাইলে আর রক্ষা নাই। এমন মাইনষের সঙ্গে ঘর করতি গেলি তটস্থ থাকতে হয়, কি জানি কন ভুল ধরি বসে। হাখির ডায়ে ঘুম যন ভাঙ্গি যায়, চিকচিক করি রোজ আই ঘরের দুয়ারে হড়ে, গাছেরা জাগি যাইবার আগেই উনি জাগি যায়। ঝড় বাদলের তোয়াক্বা না করি হাঁটা হুরু করে, থামাইতে কইলেও থামায় না, চইলতেই থায়। নিজের হাতে ছই, আলু, বেইগুন, মরিচের গাছ লাগায়। এমন মানুষ জন্মে দেই নাই। সময়ের আগে উনি ছোটেন না। সময় ওনার হঙ্গে হঙ্গে চলে। সময়কে ডাক দিই কয়, নিজেরে নিই এত ভাঙচুর কি তোমারে মানায়! কইতে চায় মাইনষের মতো মানুষ হইত হইব। জগতটাকে একবারের লাই খেয়াল করি চা, কনডাই যাই থাইমবি, আর কনডাইরতুন হুরু করবি। মাইনষে যন মাইনষেরে গলা টিপি ধরি কথা বন্ধ করি দিতি চায়, আঁর স্বামী তন গর্জি উঠি কয় সত্যি কথা কও, গলা ফাটাইয়া কন, হোজা হথে চল, বাঁকা কথা কইও না। দেশটার কথা ভাইবতে ভাইবতে দিন যায়, কী হইব এ দেশের! রসাতলে যাইব। বিয়াল্লিশের আন্দোলনে ভাইকে গরাদে ঢুকাইছে, ছোড়াই আইনল। কিন্তু মনে মনে প্রশ্ন জাইগল মাইনষের উপর এই অত্যাচার কবে থাইমব ? কোন দিকে যাচ্ছে? গাড়িতে উঠি বসে। কয়লার ইঞ্জিনের গাড়ির ধোঁয়া গলগল করি ছাড়ে। গন্ধটা নায়ের কাছে আই ঘুরঘুর করে। ভোঁ ভোঁ করি গাড়ি এক ইষ্টিশন তুন অন্য ইষ্টেশনে দৌড়য়। চাই থায়, গাছের আগাগুন নড়ে, সিটের হাশে শক্ত করি থলিটা ধরি রায়। ছইয়ে ভর্তি, আলু, কাঁচামরিচ তো কম নাই। কত কষ্ট করি লই আইয়ের। নিজের হাতে লাগাইনা গাছ তুন ছিঁড়ি ছিঁড়ি আইনছে। এমন ভালোবাসা জম্মে দেখিনি। ওর ভেতরের মানুষটার হদিশ হাইতে কম চেষ্টা তো করি নি। হাইলাম কই। কত কষ্টই তো করে। মুখ বুজি সহ্য করে। কাউরে বুইঝতে দেয় না। মাইনষের লাই কত দরদ। কোনগাইন আঁই জানি, কতগাইন আঁই জানি না। মাইনষের মুয়ে মুয়ে আঁই হুনি। ঘরণী হই বুকটা ভরি যাই। এমন দিনে বাড়ি আইলে হকল দুঃখ ভুলি তীর্থের কাকের মতো বই থাই, কন মানুষটার মুখ দেখুম। ইষ্টেশনের পর ইষ্টেশন যায়, জলা জমিন কত কিছু পার হই যায়। মানিক আঙ্গ শহরের বাড়ির কাজকাম দিনরাত দেখভাল করে, মাসের পর মাস যায়। নিজের হোলাদের চাই কম তো নয়ই, বেশি বেশি করে দেয়, হুধু কি মাণিক, ওর ঘরের লোকদের লাইও তেনার চিন্তার শেষ নাই। ভালা ভালা জামাকাপড়গাইন ওদের লাই তুলি রাখে, কেউ জাইনতে চাইলে কয়, তোঙ্গ লাই তো আঁই আছি, বাপ মরা মাণিকের মা বইনের কে আছে। এমন কতার পরে আর কতা হয়। যেমন ভাবি চলি মনের শান্তি হায় চলুক না, হক্বলেরে তো সমানতালে বাঁধন যায় না। নদীর জলের স্রোত তেমন করি চলে আর কি।
গাছ চলি যায়, ঘর চলি যায়। কন্নাই যে যায়, কেউ কইত হারেন না। গাড়ির যাত্রীরা দু’চোখ মেলি চাই থায়। আঁর স্বামীও চাই থায়। কী জানি কিসব ভাবনাচিন্তা করে। গরু-গোতান ছাগলগুলোর দিকে তাকাইলে মনে হয়, ওগো চোখ দিয়ে কত যে জল হড়ে, গাছের ডালগুন হেলিদুলি কত যে পাগলামি করে, খালবিলের জলের কথা আর কইয়েন না, এট্টু এট্টু ঢেউ তুলি বিলের হর বিল ধরি নাচে, কেউ তো হিরেও চায় না। মাঠের ধারে বিল, বিলের ধারে মাঠ, ইঁদুর ছুঁচোর গোল গোল খেলা, তাল খেজুরের কথা বলাবলি, কেউ হোনে তো কেউ হোনে না, ঝোঁপঝাড়ের ফিসফিসানি, সুখ দুঃখের কথা কয়, রোদে হুড়ি খাঁক হয়, ইচ্ছাটা গলগলিয়ে ওঠে, দৌড়ে ফালাইতে চায়, বিধির বিধান, কন্নাই আর যাইব, মাটি কামড়াই হৌড়ি থান ছাড়া আর কি কোন উপায় আছে! ওরা গাড়ির যাত্রীগুনেরে চোখ পিটপিট করি দেখে, পাখির মতো যেন উড়ি চলি যায় হক্বলে, মুখগুলো এই দেয় তো এই নাই। একবার কথায় কথায় কইছিল, হক্কলে রোজ রোজ কত মাইনষের মুখ দেয়ে, আছা মাইনষের মুখ কয়জন দেয়ে। উনি মানুষটা কেমন হক্বলেরে ধরা দেন না, কারো কাছে সোয়াভাগ, কারো কাছে আধা, হের লাগি আসলে বুঝতেই হারেনা, পুরা মানুষটা কেমন। আঁইও তো এতদিন ঘর কইরলাম, অনও বুইঝতাম হারি ন, ওনার দুনিয়াটা চাইরপাশে কেমন করি ঘুরের – বনবন করি না সোজাসাপটা। কি যে কইতে চাই, আর কি কই হালাই, তার কোন হিসাব আছে আঁর কাছে, আমনেরাই কন, এর মধ্যে আঁর কোনো দোষ ! ভাবের ঘরে মজি থাকলে এই জীবনটার সকল কথা ভেন্ন ধরনের হই যায়। উনি তো চাই থায়, স্টেশনের হর স্টেশন চলি যায়। গাড়ি থাইমলে কাঁধের থলিটা দোলাইতে দোলাইতে বুট জুতা পা দিই হাঁইটতে হাঁইটতে কন যে নদীর ঘাটে চলি আয়ে নিজেও জাইনতে হারে না। এই যন অবস্থা, মাঝি কয়, ‘বাবু একখান কথা কই, বাকিরা আইয়া পড়ে, আমনের কেন এত দেরি হয়?’ উনি ঠোঁট দুইটা নাড়েচাড়ে, কথা আর কয় না। মাঝি কয়, ‘ আচ্ছা কথা আর কইত হইত না, আমনে বয়েন। আমনে হইলেন গ্যারামের মাথা, হক্বলের তুন সেরা হড়াশোনা জানা বিদ্বান লোক, এসব কথা কওয়া কী আঁর সাজে!’ নৌকার ভেতরটা গামছা দিই মুছি দেয়। ‘সেই আঁধার রাইতে নৌকা লই বাইর হইছি, ঘাটে খুঁটি পুঁতছি, গাড়ির তো আর দেখা নাই।’ নৌকাখান চলে তেনার প্রানটা আনচান করে, কন ছোট ছোট হোলাপাইনগুনের মুখ দেইখব। মাঝি নৌকা বায় আর খালের জল ছলাৎ ছলাৎ করে। মাঝি বেয়াল জাল বালাই বই থায়, কন হুটি, খৈলসা, টেমবৈচা, মেনা, ভেদা, বাইলা, টেংরা, বাইন মাছ আই জলে ধরা দিব। সূর্য ঢলি হড়ে হুব আকাশে, আলো খাবি খাইতে খাইতে আঁধার নামে। ঘরের জানালার ফাঁক তুন হ্যারিক্যান আর কুপির আলো ছিটকাই আই আম, বরই, জাম্বুরা, হাইঙ্গল গাছের আগায় হড়ি হাওয়ার খেয়ালে লাফানি ঝাঁপানি হুরু করে। উনি দেখনের লাই মন টানে। ছইয়ের তুন বারৈ আই গলুইয়ের কাছে বয়। সময় গড়াইলে, গ্যারামের পর গ্যারাম চলি যাই, নিজের গ্যারাম যত কাছে আসে, মনে মনে কয়, ‘ওই তো জমি, ওই তো আল, ওই তো হসল, ওই তো পুল, ওই তো বাজার, ওই তো ইসকুল, একটু হরেই তো মঠ মন্দির, খেজুর আর তাল গাছ, সদর দরজা, কী আনন্দ ! কী আনন্দ!
আঁরও তো খেমতার একটা সীমানা আছে! শুধু মাঝে সাঝে কীসের যেন গন্ধ পাই, খুব পচা পচা বাসি বাসি গন্ধ, ভেতর থেকেও ঠেলে, বার তুনও ঠেলে। ভাবি ওই নিই আবার মাথা ঘামানোর কী আছে! যা ঘইটবার তা তো ঘইটবেই, দুনিয়াদারি যে কোনদিকে চইলছে, কোনদিকে যে যাইব, কে জানে! সময়টা যে আগাই যার, পাক খার, এইটুকুনি বুইঝতে হারি, দিনগুন তো চলি যার, হকাল হয়, আঁধার নাইমতে নাইমতে জগতের ভেতরে ভেতরে চলে কত খেলা। আঁই যন এই ঘরের জিনিস ওই ঘরে লই যাই, ওই ফাঁকেই আঁর এসব কথা মনে হয়। বুকের ভেতর ঠনঠন করি আওয়াজ হয়। না জানি কখন কি ঘটে। ঘর বার করি খালি। অস্থির অস্থির লাগে। রসুই ঘরের দিকে যাওনের সময় হাতের তুন থালা গেলাস হড়ি গড়াই গড়াই বড় ঘরের তুন মাঝের ঘরের দিকে চলি যায়। মনটা উসখুস করে ওঠে, কী জানি কী হয়! মেঘনার খালে তেমন তো উথাল পাথাল ঢেউ তো নাই, দখনে বাতাসে একটু আধটু পাগলামি আছে। নৌকাটা দুলতে দুলতে না কোন সব্বনাশ না হই যায়। জালের হোলামাইয়াগুলান এদিক তুন ওদিক দৌড়ায়। ঘরের চৌকাঠের কাছে জল ভর্তি বদনা রাখি দিই। এতদূর পার করি আই হাত-পা ধুই তবে না ঘরে উঠইব। হুরা বাড়িটার মধ্যে থমথম করে। কোন বেচাল দেইখলে কখন যে কে ধমক খাবে কে জানে ! নিজের সোয়ামিরে আঁই তো ভালা করি জানি। ওই কয় না নাইরকলের মালার মতো, ভেতরটা ঢক ঢক করি নড়ে, উপরটা দেইখলে মনে হয় ঊরি বাপরে এই মাইনষের ছাল ছাড়াই ভেতরে ঢোকা তো সহজ ব্যাপার নয়, চল চল হলাই যায়। কিন্তু আঁরে তো হলাই গেইলে চইলত ন। মাটি কামড়াই হড়ি থাইকত হইব, হৌড়বাড়ির ঘর কইরত হইরত ন! ভাঙ্গনের একটু আধটু বাজনার আবাজ কানের কাছে ঘুসঘুস করতি হুরু করি দিছে। কেন, কেমন আবাজ, এটা বুইঝবার লাই কত চেষ্টাচরিত্রই না কইরছি, কে দেবে তার সন্ধান? সোয়ামিরে জিগাইলে কয়, এইসব আবাজে কান দিও না, এর অর্থখান বুঝতি গেলে অনেক বিদ্যেবুদ্ধি লাগে, বইপত্তরের পাতা উইলটাতে হয়। মাথাটারে ঝাঁকাই নিজেরেই নিজে কইলাম, হায় ভগবান তুমি আঁরে বেশি করে হড়াশুনার সুযোগ করি দিলাম না কেন, তাহইলে তো দুনিয়াদারির হালচাল ধরি ফালাইতে হাইরতাম সহজে। কী ভালাটাই না লাইগত, মনের মধ্যে এতকিছু ভাবনাচিন্তা আই বাসা বাঁইধত না। ঘরও চিনতাম, বাহরও চিনতাম। ঘরের ফিসফিসানি বড় তিতকুটে। চারধারের মুখগুলো কেমন করে। হক্বলকিছু কেমন আলগা আলগা। একটা এত্ত বড় রসুইঘর, জায়ে জায়ে মিলেমিশি পাক করে, ভাড়ার ঘরে মজুত থাকে দুই মাসের চাইল ডাইল, চিন্তা নেই, ধান্তা নেই, গল্পগাছা করি সুখদুঃখের কথা কই জড়াজড়ি করি থাই, এঘর তুন অন্যঘরে যাইবার লাই কত দরজা, লোহার শিক আর কাঠের কপাট বিয়াল হইলে বন্ধ করার লাই কম বয়সী মাইয়াগুলার তোড়জোড় হুরু হই যায়। আহা কত তো ভাব ভালোবাসা। এ ওর চুল বাঁধি দেয় তো আর একজন উকুন বাছি দেয়, শোলক বলার ধূম লাগি যায়, আর ধাঁধার উত্তর লই বাজি ধরা, এক পয়সা লই কাড়াকাড়ি লাগি যায় ত্রিশ চল্লিশটা মাইয়ার, চুলোচুলি খামচাখামচি তো কম হয় না। ওরা ফিসফিস করি কানে কানে কত গোপন কথা কয়। মাইয়াবেলার কথা। দাদু ঠাকুরমার রসিকতা ‘ আঁরে পছন্দ হইছে নি?’ ‘ থুড়থুড়ে বুড়া বিয়া করার সখ হইছে। জলে ডুবি মরুম।’ ‘ আচ্ছা, বিয়া না করিস না করিস, দু’একখান হাঁকা চুল বাছি দে।’ আমনের ফোকলা দাঁত, চোয়ে ছানি হইড়ছে দেখতি হাও না।’ ওদের কথা হুনি হাসিতে পেট ফাটি যায়। কদ্দিন বাদেই তো বিয়া হইব, পালকি চড়ি হৌরবাড়ি যাইব। এই বাড়িটা তো আঁর হৌড়বাড়ি, হত্তম দিনের কথাটা ভুইলতি তো হারি না। আইছি তো একলা, নিজের আর অন দেঅর ভাশুরদের হোলাপাইন লই ভরা সংসার।
সময়ের কি আর মা বাপ আছে। ঘড়ি আর কই? সময় তো গুনি আন্দাজে আন্দাজে। খাওনের সময় অন। ছেঁড়া কাপড় দুই ভাঁজ করি লম্বালম্বি পাতি আগে বাড়ির ছেলে আর কাকা জেঠা আর দাদুরা বই যায়, হক্বলের শেষে ঘরের বউঝিদের খাওয়ার পালা। হাড়ি কড়াইয়ে ভাত তরকারি কিছু হড়ি রইল কি রইল না, কে আর ভাবে। কেউ আধপেটা খায়, কারো পেট খালি রাখি জল গিলে শোয়ার ঘরের দিকে দৌড়ি চলি যায়। দিনভর খাটাখাটনি করি এন্নেই চোখ দুটো ঢুলু ঢুলু। মাটির মেঝেতে মাইয়ারা চাটাই পাতি দিলে এমাথা ওমাথা ছেলেগুলা সটান হুই পড়ে, মাইয়াগুলা চলি যায় যার যার ঘরে। ঘরের তুন অনেক দূরে পায়খানা, রাত বিরেতে দাস্ত বমি হইলে সেই কষ্টের কোন মা বাপ নাই, মাইয়াদের নাজশরম কইরলে চইলব কেমন করি, ওদের কষ্টের বহর চার গুণ বেশি। কইত তো হারে না কারো কাছে, গুমড়ে মরে। শাড়ি ব্লাউজ ছিঁড়ি গেলে সেলাই করি করি হলে, সে আর কদ্দিন চলে। বছরে দুই প্রস্ত কাপড় চোপড় কিনি দেয়। আলতা সিঁদুর কাজল দূর দূর তুন এ গেরাম তুন হে গেরাম ফেরি করি যারা ঘুরি ঘুরি আয়, ওদের ঘিরে ধরি কথার ঝর তুলি দেয়, মনে হয় যেন আকাশের চাঁদ হাতে হাইল। এক দল মাইয়া লাগি হড়ি এত্ত বড় লম্বা উঠোনটা ঝাড় দেয়। হোলাদের লগে খেলছি গেলে কেউ কেউ তো কই হালায় ‘ দামড়ি মাইয়ারা ওই দামড়া ছেলেগুনের লগে সমান তালে চলে, একটুও লাজশরম নেই। মাসিকের যন্ত্রণা সে তো আর কহতব্য নয়। কি আর কইমু সময়টা কত না কষ্টের। হড়াশুনা মাথায় উঠছে। মাইয়াদের ওই পাঠ কোনমতেই থাকতি নাই। শুধু হোলাদের হড়ার ঘরে কেউ উঁকিঝুঁকি মারে আর তাড়া খায়। তবে কিনা একটা জিনিস চোয়ে হড়ার মতো। হক্বাল না হইতেই দলে দলে গাছে গাছে মাইয়াগুলা ছুটি বেড়ায়, কত জাতের ফুল তোলে, টগর, জুঁই, মালতি, করবি, শেফালি সাজি ভর্তি করি লয়, কে কত বেশি তুইলতে পারে, হেই নিয়া ঝগড়াঝাঁটিও কম হয় না। দু’একজন আবার গানের কলি ছোটায় – ওই ফুলেরা ঘরে আয়, সুগন্ধীতে মন ভরায়। ঠাকুর আমার মনের কোনে, হৃদয় হরণ ভক্তি ভরে। যাব আমরা পরের ঘরে, কাঁটার বোঝা সঙ্গে করে….।
কালা আর ধলা আসি ঘেউ ঘেউ করে। আঁর আঁচল ধরি টান মারে। আঁই বুঝি ফেলাই উনি সদর দরজায় হা রাইখছেন। মন্দিরে প্রণাম সারি গুটি গুটি হায়ে ঘরের সামনে উঠানে পা রাখেন। উনি পাঞ্জাবি আর কুঁচি দিই ধূতি হরেন, ফিতা ছাড়া কালা রং এর জুতা হরেন। ওই কালা ধলার মতলবখানা বুঝি উঠতি হারি না। ওরা ওনার হায়ের নিচে লুটাই হড়ি কুঁই কুঁই করে। আঁর হোলামাইয়ারা ওগো বাবা আয়নের খুশিতে ওনার হাতের তুন ছাতা টানি লই চলি আয়ে। এবার শহর তুন গ্ৰামে ফিরতে দেরি করি ফালাইছে। তাই বাবার সঙ্গে হাইবার লাই তীর্থের কাঁকের মতোই দিন গুইনছিল কবে ঘরে আইব। ওদের তাড়া মারনের জ্বালায় আঁই নিজেই অস্থির হই যায়। আঁর ছায়েরা উচাটন হই দেই ঠাট্টা মশকরা তো কম করে না – এবার ভাশুর তোমারে হারাদিন ধরি নাচাইব চড়কির মতো। ওদের কথায় আঁই হাসি আর থামাইতে হারি না। আঙ্গ জায়ে জায়ে কথা কাটাকাটি হয়, ভাব ভালোবাসা ওতো কম নাই। ভালো মন্দ খাওনের ইচ্ছা হইলে ওদের আবদারের শেষ নাই। মাথায় ঘোমটা টানি ওনার সামনের তুন ফলাই যায়। কী জানি কখন কী জিগাই, না কইত হারলি লজ্জার কী শেষ আছে। আঁরে আই কইব কত কথা। সেসব কথা একবার সুরু হইলি কোনমতে শেষ হতি চায় না। দিনরাত তো কাটি যায় ঘরবার করতেই। কামকাজ তো ছড়াই আছে আনাচে কানাচে, আমোদ আহ্লাদ যে একটুখানি করি মনের শান্তি কইরব, ভাইববার অবসর কোথায়। যেমনি পা চালাবার তেমনি পা চালায়, রসকস কারে কয় কেউ জানে না। তবে এতদিনে আঁই বুইঝছি জীবনের যে একটা ধম্ম আছে, এটা বুইঝতে তেমন আর কষ্ট হয়না। ওরা ভাবে দু’এক কলম পড়ালিখা শিখছি ভুগলে গোটা দুনিয়াটা আঁর হাতের মুঠোয়। ওরা ভাবে আঁই যেরকম ভাইবতে পারি, ওরা সেরকম করি ভাবতি হারে না। ওরা কয়, কত নাকি মণিমুক্তা আছে আঁর জীবনের গল্পে। আসল কথা হইল নতুন নতুন কথা হোনার ওগো আগ্ৰহ দেখি আঁইও স্মৃতির হুকুরে ডুব দিবার সুযোগ পাই। তাই তো ইনিয়ে বিনিয়ে কত গালগল্প করি। ওরা ভাবে আঙ্গ বড়জা কন্নাই পায় এসব গল্পকথা! তাই আঁর স্বামী বাড়ি ফিরলেই ওদের জানার ইচ্ছাটা বাড়তেই থাকে। আর ওইটা লই সপ্তাহের পর সপ্তাহ নাড়াচাড়া করে। কামকাজ ফেলি থালাবাসনের ঝনঝন শব্দ করি ছুটি চলি আয় আঁর চারধারে জড় হয়। গনগনে লাকড়ির আগুন ধোঁয়া ছড়াইলেও ওদের ভ্রূক্ষেপ থাকে না। গোগ্ৰাসে হক্বল কথা গেলে। হুই ছিল মাইল দশেক দূর, মনে হইতে হারে এই তো কাছে কিনারে, আসলে তো নয়, মনের দরজাটা বন্ধ করি রাখি দিছে কতকাল। চারদিকের রঙটা সাদা না কালো জানতি তো হারে না। শোনাই যখন গল্পটা, চমকি উঠি কয়, ওরে বাপরে, এর কন্নাই শুরু, কন্নাই শেষ কে কইব, এত্ত বড় লম্বা একটা অজগর, মানুষ ছাগল খপ করি গিলি নেয়, কোন দেশ তুন আইল, না কে আনি ছাড়ি দিল, কেউ জানে না। ওরা দিনরাত খালি চোখ কচলায় আর স্বপন দেখে। সাহস করি কয় না ‘ আঙ্গরে একবার দেখাইতে নিয়া যাইবা গো দিদি।’ কী ভয়ঙ্কর কথা, গণ্ডি কাটি যে রাইখছে বাড়ির কর্তারা, ওরা কী সব ভুলি বসি আছে! হাউড়ি, ঠাকুরমা- হাউড়ি, বড় ঠাকুরমা, ঠানদি ওরা যে উঠানবাড়ি করি করি পরকালে ঘর বাঁইধছে, সে জীবন কী বাসি হই গেছে। তবু কত আশা, গল্প হুনি হুনি জগতের সন্ধান লইব, নিজেদেরও চিনব, হরেদের লগে নিজেদেরও মিলাইব। হায়ে হা মিলাই। ওঁয়া ওঁয়া শব্দ হুনি ঘরের মাঝখান দিই ছুটি চলি যায়। আঙ্গ খুড়তোতো জা পোয়াতি কিনা, তার আবার প্রসববেদনা উইঠল, তাই তো আঁতুড়ঘরের বাইরে মাইয়া বউদের এত কানাকানি জানাজানি। নতুন জীবনের গন্ধ। যেন দাইয়ের হাতে জীবনের নতুন রঙ লাইগছে, সে রঙ বাতাসে ছড়ায়, আকাশের রামধুনর কাছ তুন ধার করি মাইয়া মানুষের গভ্ভে চলি আয়ে। কেন চলি আয়ে কেউ একবারও জিগাই না।
আঁর উনি হত্যেকবার যন বাড়ি আয়ে, মানুষটারে যেন আর এক রকমের চিনি। নিজেরেই নিজে প্রশ্ন করি কেমনে এটা হয়! মানুষটা নিজেরে এমন পাল্টায় কেমন করে, কে রসদ জোগান দেয়। শত হইলেও আঁর স্বামী তো, আঁর জানার অধিকার তো আছে। কতবার ওনার মুখের দিকে চাই বসি রই, কয়, ‘কী এমন দেখো? তোঁর বয়স বাইড়ছে না কইমছে?’ না, হাইসতে তো আর হারি না। মানুষটা আঁর মনের ভাবখানাই বুঝল না। আসলে ওনার দোষের কিছু নাই, রোজের নিত্যনতুন ঘটনা ওনারে ধাক্বা মাইরছে, সে তো আর আঁর গায়ে আই আঁচ লাগছে না। উনি ওনার মতো করি হাল্টার, আঁই আঁর মতো করি কেমন যেন হই যাইয়ের। সংসারের হক্বলে যেন কয় তুই আগের মতো থাকছি হারথি ন, হরির আর মনের ভারটা যেন হমানতালে ভার হই যার, যত নিজেরে হালকা কইরতে চাই না কেন, ভারটা যেন চাপি বসে। আঁর স্বামী আঁরে কত কিছু শিখাইতে চায়, আবার আঁর বুদ্ধির তারিফও করে। উনি আবার নিয়মের গোঁসাই, সামনে কইবার সাহস নাই, ওনার স্বভাব নিই কথা কওয়াটা মানানসই নয়। কেউ হুনি ফেইললে লজ্জার মাথা কাটা যাইব। তবু জায়েরা যত নষ্টের গোড়া, খুঁটি খুঁটি জাইনত চায়, মানের কথা টানি বার করে। এমনিতে হারাদিনে কামকাজ করি ফুরসত পাই না, তবুও ওনার ফাইফরমাইস তো হুনতি হয়। সাহস করি ওনার কামকাজ নিই জিগাইব আঁর ঘাড়ে কটা মাথা। তবে কিনা সময় লই বড় কড়া। হাঁটা শোয়া বসা কবিতার ছন্দের মতো চলে, এইটা আঁর মন্দ লাগে না। কড়া কড়া কথায় আঁর হোলারা মাইয়ারা তটস্থ হই থায়। বাপের কাছে আবদার কইরব সেই জো নাই। শাসনের খড়গ হস্ত যন তন নামি আইত হারে একটু এদিক সেদিক হইলেই। আদর ভালোবাসাটা উনি দেয়াইতে চান না, কর্তব্যের আড়ালেই লুকাই রায়। মানুষটার লাই আঁর গর্ব হয় যন চার গ্ৰামর লোক ওনার জমি জিরেত লই সমস্যার লাই হারা দুপুর ধরি কাঁচারি বাড়িতে ভিড় করে, মুসাবিদা করে। পায়ে হাত দিই নমষ্কার করি কয়, ‘ মোক্তারবাবু আমনে আছেন বলেই এই যাত্রায় বাঁচি গেলাম’। হিন্দু মুসলমানের ভেদাভেদ তো করেন না। ডাক্তার বদ্যি, ঔষধ পথ্যি না কিনত হাইরলে এক দুটাকা হাতে দিয়ে কন, ‘যাও এইটা লই যাও, হরে দেইথুই একটা বন্দোবস্ত হবে।’ গ্যাতিগুষ্টি ঝগড়া লাইগলে উনি তো মুশকিল আসান। নিয়ামত আলি চোয়ের জল ফেইলতে ফেইলতে পা দুখান জড়াই ধরি কয়, ‘ আঁরে বাঁচান বাবু মায়ের পেটের ভাই হুমকি দিছে, ঘরের তুন বার হনের রাস্তাখান নাকি বন্ধ করি দিব। সালিশি সভায় আঁরে কী অপমানটাই না কইরল’ ‘শওকত রে কও গিয়া, আঁর কথা যেন হুনি যায়। চিন্তা করিও না, সমাধান একটা হইবই হইব। ঘর যাও অন।’ এমন স্বামীরে লই গর্ব কইরতে কার মন চায়। ভালা তো লাগে, যন বড় গলায় কয়, ‘ কৈ মাছের হাতুরি আর কাঁচকি মাছের ঝাল যা রান্না করছ কমলের মা, হারা হপ্তাহ ধরি যা মধু খাওয়ায়, মুখে রোচে না।’ হুনি মনটা কাঁদি ওঠে। মন চায় রোজ শহরে যাই ওনারে ভালো মন্দ খাওয়াই। ইয়ানে এত্ত বড় সংসারের গিন্নির দায় সামলাইব কে। আর স্বামী এই কথাখান ভালো করে বোঝেন। উনি নিজেই যে গোটা সংসারটারে শক্ত হাতে ধরি রাইখছেন বাপ মারা যাওনের হরে, সেও তো কম দিন হয় নি। তবুও মনের সান্ত্বনা হাইবার লাই সেই যাইবার বেলায় থলিতে হুরি বেগুন, মূলো, লাউ, কাঁচকলা লাউ নৌকায় তুলি দিই এমন করি তাতে দেখতি না হায়। রাখি গেলেও হলে মনটা ঠাণ্ডা হই যায়, এক সময়।
মনের হদিস মেলা তো এত সহজ কথা নয়। উনি যখন বাড়ির সদর দরজা ছাড়ি ধীরে ধীরে চোখের আড়াল হই যান, মনের ভেতরটা কেমন মোচড় দিই ওঠে। আই হ্যারিক্যানটা লই খালের হাড় হর্যন্ত আই, গাছগাছালির পাতারা মনের সুখে ঘুমায়, আঁধার লেপটি থায় গায়ে গায়ে। হিয়ালরা বনেবাদাড়ে ছোটাছুটি করে মনের সুখে। গরুগোতানরা ছানাপোনা লই লেজ মুড়াই গুটিসুটি মারি হুই থায়। ঘন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ হোনা যায়। গাইগরুরা শরীর মোচড়ায়। দিনেমানে লাঙ্গল দিই জমি চষার লাই গায়েগতরে টান ধরে। কাঁকেরা ডাল নাচাই হকলেরে কয় ‘উঠি যাও গো উঠি যাও’। সাপেদের হামির ঘ্রাণ নাকের হাশে আই ঘোরাফেরা করে। বাড়ির লোকজন জাইনতেও হারে না, আঁর স্বামীর নৌকাটা বাঁশের সাঁকোর হর সাঁকো পার হই ততক্ষণে অনেকদূর চলি গেছে। মেঝ দেঅর, সেঝ দেঅর, ছোট দেখার, না দেয়ার, খুড়তোতোরা মিলিমিশি অনেকে আছে বটে, ওদের হারাদিনে কত কাজ। নিজের বল ভরসা নিজের ভিতর তুন যোগাড় করি লইতে হয়। একা একা হাঁইটতে হাঁইটতে আকাশের দিকে তাকাইলে মনে হয় রঙ পাল্টাইবার লাই ওরাও কেমন তাড়াহুড়া করি লেগেছে। ঘরে ফিরতি হবে, জানালা কপাট গুলতি হবে। হাঁকডাক তো করছি হবে – ও মাইয়ারা ওঠ, গোবরের জল ছিইটাতে হইত না ঘর দূয়ারে। আঁইডা বাসনকোসন গুন মাজি হালাইতে হইব তো। ওরা চোখ কচলাই সাড়া দেয়, বিছানা গোটায় – ‘ আই গো দেখি, হাতমুখখান ধুই আয়। কচি কচি হোলামাইয়ারা চাটাই বিছাই আঁর বলার আগেই আদর্শলিপি, বাল্যশিক্ষা, নামতার বই, ছড়ার বই লই আঁর ভয়ে চেঁচাই চেঁচায় হড়তি লাগে। ওদের হড়ার ঢঙ দেখি মজাও লাগে। সারা বাড়ি গমগম করে। বাড়ির তুন একটু দূরের ইসকুলটায় চৌদ্দ গাঁয়ের হোলারা হড়ে। মাইয়াদের হড়ার কোন ইসকুল নাই। ওরা বাঁইচল কি মইরল, বিদ্যেবুদ্ধি হইল কি হইল না, তাতে কার কি আয়ে যায়, বোকা মূর্খ বানাই রাইখলে হক্বলের মঙ্গল। বিদ্যাসাগর জন্মেছিল বলেই না মাইয়ালোকদের লই প্রাণপাত করেছিল, না হয় এই হোড়া দেশে কে আর এমন করি ভাইবত। হোলাদের ইসকুলটার চারধারে জঙ্গল। মশারা ভ্যান ভ্যান করে, রোগের ডিপো, কত যে হোকামাকড়ের বাসা, সে আর কইবার নয়। পাশ দিই চলি যাওয়া খালটায় পাল তৌলা নৌকা, ডিঙি নৌকা, গুণ টানা নৌকা কলকল শব্দে চলি গেলে মাষ্টারের কথা না হুনি ওই খাল আর খালের হাশে মাটির ঢিপির দিকে চাই থায়। দূর তুন দেয়া যায় বড় বড় গ্ৰাম, সবুজের মেলা বইছে যেন। এইসকল কথা ওদের মুখেই হোনা। ইসকুলের হাশেই পুল, পুলের হাশে দোকান। হিয়ানে লজেন্স, ছোলা ভাজা, বাদাম ভাজা, চানাচুর – টক মিষ্টি ঝাল। রাস্তার উপর নাড়া পাতা। মচর মচর শব্দে মাড়াইতে মাড়াইতে ওরা ঘরে ফেরে। কত তো ভাবনা হয় বাপের দেশের মতো হৌড় বাড়ির দেশেও যদি একখান ইসকুল থাইকত আর ঘরের বউদের হড়ার অনুমতি থাইকত একবারের লই হলেও ইসকুলে ভরতি হই যাইতাম।
হুক্বাহুয়া শব্দ ভাসে বনবাদাড়ে
গুমরায় কারা যেন অলি আর গলি
কিচিরমিচির শব্দটা হুইনছিলাম কবের তুন মনে তো হড়েন না, কিন্তু একী হইলো কেউ যেন কন্নাইও নাই, চোয়ের নিমিষে চুপ মারি গেল, এ কেমন কথা! কারও ডাক আঁই চিনি, আপন লাগে, কারোগে চিনিনা। এরা আঙ্গ ঘরের হাশেই থাকে। মনে কয় ডাকি আনি কোলে তুলে লই। রোদের তেজে গা হুড়ি যায়, তবু কী ওরা ডাক থামায়! মনের সুখের তুন ডাকে। কত তো মনে আনন্দ। দুনিয়া ভাঙিচুরি চুরমার হই যাক, গাঙের কলকল শব্দ থামি থাক, গাছগাছালির হাগলামি শান্ত হই যাক, ওরা উরি উরি যাইব, শক্ত ঠোঁট দুইটা ঘষি ঘষি জানান দিব, ওরা আছে, ওরা থাইকব, এই ভবে কারা এমন আছে ওদের ঠেকায়। মাইনষের মুখ তুন এমন কথা আর হুনিনা, মুখটা কেমন হুকনা হুকনা, মুখের চোয়াল ভাঙি কেমন ভিতরে ঢুকি গেছে, কথা কইতে চাইলেও কইতে হারে না, কেন এমনটা হইল? আমার স্বামী কয়, ‘ কী হইল পাঞ্চালী তুমি আজকাল ভালা করি কথা কও না কেন? খালি কাম আর কাম। ধান সিদ্ধ করি রোদে শুকাও, বৃষ্টি বাদল আইলে সাততাড়াতাড়ি গোটাইবার লাই ছুটি যাও আর গোলা ভর্তি কর।’ ‘আমনে বুঝি কিচ্ছু হুইনতে হান না?’ আঁর স্বামী কথা হুনি অবাকও হন না, চমকাইও যান না, এমন একটা ভাব করেন এ আর এমন কী কথা। কী আশ্চর্য রোজ রোজ ঘটি যাওয়া গল্প আঁই ওনার মুখ তুন হুনি আর ভাবি কী হইতেছে এইসব। মাইনষে তো এরকম ছিল না। ভাবখানা তো অন্যরকমই ছিল, কত সুন্দর কথা কইত, আজ কেন এত ফিসফিসানি, গুনগুনানি। কত কথাই না নদীর জলের উপরে কাঠের টুকরার মতন ভাইসতে ভাইসতে চলি আয়ে, মনের মাঝে আই ধাক্বা খায়। ঘরে ঘরে এর আঁচ লাইগতে শুরু হই গেছে। এক গ্ৰামের তুন আর এক গ্ৰামে দলে দলে লোক আইসতে লেগেছে। আঁর মামাহৌর মামাহৌরি হোলামাইয়া নাতি নাতকুর লই যেদিন আঙ্গ বাড়ি উঠল, বুইঝতে হারলাম অভাবের সংসারে আগুন লাইগছে। পেছনের ঘরখান ওদের জন্য হকলের সঙ্গে হলা পরামর্শ করি ছাড়ি দিলাম। এই দুঃসময়ে বেচারিরা যাইব আর কোথায়। কেন এমন দশা হইল ভাইবলে গা শিউরে উঠে। কি আর কইমু, মুখের দিকে চাওন যায় না। আঁই আগ বাড়াই কইলাম, কোন কিছু চাইতে সংকোচ করিওনা। সম্পর্কে বড় হইলেও বয়সে আঁর ছোট। ঘাড় নাড়ি মাথা নাইড়ল। কোন কিছু কইবার আগেই ঘরদোরের কামে লাগি গেল। বুইঝলাম সুসময়ে আগে ওরা কতবার অতিথির মতন আইছে আর গেছে, এমন ভাবটি হয় নাই। নিজেরাও ভাইবল সময়টা পালটি গেছে, এখন ওরা একটুখানি ঠাঁই পাবার লোভেই আইছে, দুইবেলা দুমুঠো যদি জুটে যায়। ঘরে পা দিই কইল, ‘বৌ আঁর হোলামাইয়াগুনরে বাঁচা।’ আঙ্গ জ্ঞাতি উত্তর দিকের বাড়ির দরজায় জড় হইল গরীবগুরবো আত্মীয়স্বজনরা। এমন একটা দশায় মাথায় বাজ ভাঙি পইড়ল যন দেইখলাম আঁর খুড়তোতো জা’র মাসীরা পোটলাপুটলি লই ঘরের চৌকাঠে পা রাইখল। দু’একদিন যাইতে না যাইতেই হক্বল খালি ঘরগুলো ভরতি হই গেলে চিন্তা কইরলাম, কেমন করি এই অবস্থার সামাল দিমু। আঁর প্যাটে ছয় মাসের বাচ্চা। নিজের মাথার চুল নিজে ছিঁড়ব এই ভাবি মুঠো করি ধইরলাম। আঁর স্বামী বেগতিক বুঝি আঁর মাথায় আচমকাই এতগুন আত্মীয়ের সামনে মাথায় হাত রাইখল। আরে করতেছ কী! এরা কী কইব। হক্বলে চোখ টাটাই তাকায় আছে। ‘এদিকে আইও, একখান কথা আছে।’ স্বামীর পকেটের অবস্থা আঁই জানি। কিছু টাকা আঁর হাতে গুঁজি দিই কইল, ‘হপ্তাখান এই কটা টাকায় চলি যাইব। তারপরে হালাতবরাত করি কিছু যোগারপাতি করছি পারি কিনা দেইখছি। কিছু চিন্তা করিও না।’ জীবন যে এমন শিক্ষা দিই যাইব, সে কি আর এমন করি ভাইবছি কখনও। আঁর স্বামী কইছিল বটে, ‘জীবনে দেইখবা এমন সময়ও কখনও আইব, সকল হিসাবকিতাব সকল পালটি দিই চলি যাইব। তুই হয়ত মনে কইরবা, এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না।’ ঠিকই কইছিল বটে। এটাও কথা বটে আঙ্গ স্বামীরা কোনো খোঁজ রান না সংসারটা চইলছে কেমন কইরে, ঘরে চাইল ডাইল আনাজপাতি তেল সাবান সিঁদুর আছে কি নেই। ধারনা এমনই বাড়ির বউরা যা হোক করি চাইলে নিব। কী আর করি ! লক্ষ্মীর ঝাঁপিটা হাড়ি ধপাস করি মাটিতে আঁছাড় মাইরলাম। চার আনি, দশ আনি, পাঁচ আনি গড়াই গড়াই সারা ঘরের কোণাই কোণাই যাই থামি গেল। বাড়ির বড় গিন্নির ভাঁড়ারে যে এত জমানো পয়সা ছিল কে জানত। হক্বলে মুড়ে কিছু কইল না বটে, কিন্তু মনে মনে অনেক কথাই কইল।
আগুন নাকি আইয়ের ঝড়ের মতন। কেন আইয়ের, কীসের জন্য আইয়ের আঙ্গ মতো গ্ৰামের মাইনষের জানার কথা নয়। এত দূর তুন আইয়ের যে চোয়ে দেইখছিনা ঠিক কথা কিন্তু মনের ভেতরে যে ডেগচিতে ভাত ফুটানোর মত শব্দ হর, সেটুকুনি টের হাইয়ের। আঁর স্বামীরে জিগাইলে যেমন করি উত্তর দেয় মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে হারি না। তবে কিছু একটা গন্ডগোল যে হর, বাতাসের ফোঁসফোঁসানি কানের কাছে আই ধাক্বা মারের। আঙ্গ ওনার চোখমুখ যে ভালা ঠেইকছে না, হারাক্ষন ভার হই তাই মুখটা দেই বুইঝতাম হারিয়ের। হুইনতে আছি আঙ্গ হাসের গ্ৰামের মাইনষের জীবনেও নামি আইছে বিপদের উপর বিপদ, খালি নাই আর নাই। এক বেলা দানাপানি জোটে তো, আর এক বেলা উপোস। রোজে কাম করি যে দু’পয়সা কামাই করে, তাতে আর সংসার চলে না। কোনদিকে যে যাইব বুঝি উঠতে হারেন না। কুতুব মিঞা ওর ছোট হোলারে পাঠাইছে আঁর কাছে বড় আশা করি যদি সের খানিক চাল আর একখান লাউয়ের বন্দোবস্ত করি দিতে হারি। এদিকে আঙ্গ ঘরে এতগুন বাড়তি লোক, কোন দিক যে সামলাই। হোলামাইয়াগুলার মুয়ের দিকে চাইতাম হারি না। গামছা লই আছিল, চালের কোলার তুন পোয়ায় মাপি দিলাম পুঁটলি বানাই। কী খুশি যে হইল, নাইচতে নাইচতে চলি গেল। মাইনষে কখন যে কীয়ের লাই কন খুশি হয় কে কইব। জনে জনে জিগাইছি, কেউ ঠিক করি উত্তর দিতে হারে ন। এত চেষ্টা করিও আঁই মাইনষের দুঃখ কষ্টের হিসাবনিকাশ কইরতাম হারি না। আঁর হেটের ভেতরে বাচ্চাটা নড়েচড়ে। এত অসময়ে বাইর হইত চায়, কি জানি ওর মনের গতি। পেটের মধ্যে হাত বুলাইলে ফের শান্ত হই যায়। হায়, বিধির কী খেলা! এ যেন নতুন এক খেলা, গোটা গ্ৰামটায় থমথমে ভাব, দেশের কথা বুইঝব কেমন করে, আপন লোকের যন্ত্রণাই হজম কইরতে হারছি না। বিদেশের সরকার আঙ্গ দেশটারে কব্জা করি রাইখছে। হুইনতেছি জমিদার জোতদাররা ওগো তাবেদারী করে রাতদিন। চাষীভুষা মাইনষে ভাতে মরুক, তাতে কি আর আইল গেল। ওগো কে আর মানুষ জ্ঞান করে। যদ্দিন চাইল ডাইল ঘরে ছিল দিছি, দুঃখ যন্ত্রণা আর কত সহ্য করা যায়। মাগ্গিগণ্ডার বাজারে ঘরদোর ছাড়ি হালাইতে পারলে বাঁচে। জেলে, কামার, কুমোর, তাঁতিরা পয়সাকড়ি আছে এমন আত্মীয়স্বজনের ঠিকানা খোঁজে, যদি সাতকুলে কেউ থাকে আর কি। এমনও হুইনতে আছি মাঝিমাল্লারা শেষ সম্বল নৌকাখান বিক্রিবাটা করি ঘর ছাড়ের। জাতপাত হিন্দু মোছলমান কে আর অত বাছাবাছি করে, পেটের জ্বালা, বড় জ্বালা, এই জ্বালায় যে জ্বলিপুড়ি মরে, তার কি মান ইজ্জত বলি কিছু থাকে! ঘরের বউঝিরাও লাজ শরমের মাথা খাই হুইনতেছি হরিল বিকাই দের। নিজেরে ওই জায়গায় বসাই দেইখলে গা-টা রি রি করে। আঙ্গ ঘরেও তো যুবতী মাইয়া আছে। গ্ৰামের এই মাইনষে কত সময় আদর করি ডাইকত মা-মাসী-জেঠি-কাকি বলে। ভাবি আর কাঁদি আসমতিরমা, রাজিয়া, মোস্তানের বাপ, হারান অধিকারী, অজয় শীলরাও ওই দলে আছে। অর্ধেক লোক গ্ৰামছাড়া হয়েছে। খাঁ খাঁ কইরছে চারধারে। মাঠে চাষা নাই, লাঙ্গল নাই, বলদ নাই, হাঁস মুরগির ডাকাডাকি নাই। আঁর জা আই কয়, ‘দিদি গো এত চিন্তা আর কিয়ের লাগি করো, যে আসতেছে তার কথাও তো ভাইবতে হইব, নাকি।
হাতা ঝরের, মানুষও ঝরের, হুকনা পাতা, মরা মানুষ। ঝইরতে ঝইরতে কন্নাই যে চলি যাইব, কেউ জানে না। পথের মধ্যিখানে হড়ি মরি থাইকব, না আরও অচেনা হথের খোঁজে চইলতে চইলতে কত ঠিকানার ভাঙচুর হইব, এই কথা আঁই শুধু ভাইবতে থাকি আর মনের আঁকিবুঁকি চেহারার লগে মেলাই। কালা ধলা শ্যামলা লম্বা বাইড্যা, নাক বোঁচা ধ্যাবড়া চোখা হক্বলে নিজের মতন চলে, কনডাই এই পথচলা শেষ হইব কেউ জানে না, খালি জাইনত চায় কোথায় গেলি হেট ভরি ভাত খাইত হাইরব। খবর আইয়ের পথের মধ্যিখানে কাহিল হই গড়াই হড়ি মাইনষে নাকি কাতরায়। কী যে উপায় হইব, কী জানি। তেনার রোজগারপাতি গেছি কমি। কি কইব আর কি না কইব বুঝি উইটত হারে না। নিজের দুঃখের লাইও চোখ দিই জল হড়ে, অন্যের দুঃখেও হরান কাঁদে। কতগুলান নতুন নতুন শব্দ কানে ভাসি ভাসি আইয়ে। আগে তো কোনদিন হুনি ন। আঁর স্বামী কথায় কথায় ওই শব্দগুলান মুখ দিই বার হই যায়। ‘আমনে এগুলা কী কন, একটু বুঝাই কন চায়। কারফিউ, কামান, বোমা, ব্ল্যাক আউট ঘুরি ফিরি আইয়ে। এই তো দেখছি গোদের উপর বিষফোঁড়া। কখন যে কার সব্বনাশ হইব, কেউ কইত হাইরত ন। কে যে কাম দিব, কার কাছে যে কাম চাইব! সুযোগ বুঝি জমিদার জোতদাররা ওই ছাপোষা লোকগুলারে টাকাপয়সা দেওয়া দূরে থাক, একবেলা খাওয়ানের শর্তে গুদাম ভর্তি করি রায়। মনে মনে কি কারসাজি করের ওরাই জানে। তবে একটা সার কথা বুঝি ফালাইছি আঙ্গ দেশের মাথাওয়ালারা গরীবগুরবোদের মানুষ বলি গন্য করে না। আঙ্গ গোটা হরিবারের কেউ কেউ যারা ব্যবসাবাণিজ্য করে, তাদের কোনো মাথাব্যথা নাই। দশ বার মাইল দূর দূর তুন বড় বড় নৌকা ভর্তি করি কাপড়চোপড় লই আনে। মনের ভেতরে দাগ লাগে। হোলা কোলে নি উদোম গায়ে ছেঁড়া কাপড় হরি থালা লই দোরে দোরে ঘোরে, আঙ্গ ভাসুর দেওররা যন মজুত করে বুকটা হাঁডি যায়। আঁর হেডের ভেতরে যেটা পরে পরে বাড়ের ওকি হোনের হক্বল কথা। অভিমুন্যের মতন হয়ত জাগে আর ঘুমায়। ওর আর দোষ কেমনে দি। দামড়া দামড়া লোকগুলান রে জাগি ঘুমায়। এখন আবার ঘরের এমাথা ওমাথা ইঁদুরের দৌড়াদৌড়ি।
কী বলে যে লোকে দু’একঘর লোকের পোলারা মাষ্টার হইছে। ওরাই কয়,’ জেঠি মিত্রশক্তি অক্ষশক্তির নাম হুইনছেন? অত হুনি আঙ্গ কাম নাই। অত দূর লাগত ন, চল না চল ওই মাঠে চল, ঘাসের বুকে বই থাই কান পাতি হুন, কী হুইনবি কত কথার কচকচানি, গ্যাতিগুষ্টির উঠানের ঝগড়া হুন, এক হাত জমির লাই দিনেরাতে মাথা খোঁড়াখুঁড়ি, রক্তারক্তি চইলছে, কে কার মাথা ফাটাইব, কারে এক ঘরে করি রাইখব, বামুনের হোলার পা ধরি পাধোয়া জল খাইব, ষোল আনা লাভ লোকশানের ভাগ বসাইব, বংশে নিব্বংশ কইরব, কেইবা তখন কার শত্তুর, কে দোসর কেমনে কইবি ক তো ? কার কাছে আঁই উত্তর হাইয়ুম, জীবনটা আসলে কী? সম্পর্কটাই বা কেমন করি দানা বাঁধে। ওই যে বনবিহারী আর রসিকলালের আঁকচাআঁকচি তিন পুরুষ ধরি চইলছে, ওরা কি জানে হুতাটা কোন হুঁইচের, সোনামুখি না কাঁথা সিলাইয়ের হুঁইচের ফুটোয় কেন্নে গাঁথা আছে। কোন গাছের গোড়ায় কত মাটি ছিল, মূলটা ছড়াই কত নিচ দিই এঘর ওঘর করেছে কেউ জানে না। খালি কয় কিল ঘুসি চড়থাপ্পর যত খুশি মার, ভিটে দখল করি ঘর ছাড়া কর, হায় হায় রে, কোন দিকে গেলে, কোন পথ দিই হাঁইটলে মাইনষের ঘর খুঁজি হাইয়ুম, কইতি হারস ? মগজের মধ্যিখানে খালি গিজগিজ করে শয়তানি বুদ্ধি, কে কারে টপকাই যাইব, এদিকে কত মাইনষের পেটে ভাত জুটছে না, সে খেয়াল আছে ? সব রসাতলে চলি যাইব, আইজ না হয় কাইল, অনও সময় আছে খুঁজি বার কর না, তোরা তো মাষ্টার, কোন পথ দিই গেলি হা’র মধ্যে কাঁটা ফুইটত ন। মাষ্টার তো আঁর কথা হুনি খেই হারায় হালায় ‘জেঠি এইসব কী কয়!’ ও মাষ্টার এদিকে আয়, দেখ দেখ, দেখতি হাইরচস, ঢেঁকি ঘরের হামনের রাস্তায় গোখরো আর বেজির লড়াই দেইখবার লাই কত লোক জড় হইছে, মজা দেইখছে হক্বলে, এই নাচন বড় মজার নাচন, কেউ জানে না কে জিইতবে, আর কে হাইরবে, সোন্দর তো লাইগছে, কারও মনের মধ্যে এই কথাটা তো একবারের তরেও জাইগছে না, কেউ না কেউ তো মইরব। মাইনষের মরাটাই মরা, আর সাপ বেজির মরাটা মরা নয়। গরু ভেড়া মোষের লাই চোয়ের জল হড়ুক, তাতে কষ্টে মন হুড়ুক, মাইনষের লাই হরান কাঁদি উইটত ন, হেইডা কেমন করি হয়। কথাটা হাঁচা, এই বিশ্বাসে আঁইও চলি। তাইর লাগি ফোঁপাই ফোঁপাই কাঁইদিছিলাম তো কিছুক্ষণ, আঁর দুধেলা গাঁইটা যন মরি গেল, পুরা হরিলটা কনডিয়ার হুইরের হারের এক কোনে হরিছিল, কাঁকেরা ঠোকরাই ঠোকরাই মাংস খাই শেষ করি দিছে, খাঁচাটা যে হরি আছিল, বুকের মোচড়টা কত কথা কই উইঠল, সেদিনই বুইঝলাম, চোয়েরও অন্যরকম ভাষার জন্ম হইছে গোপনে গোপনে। ভাষার কথা এইভাবেই উঠি আসে কিনা। ওর কত দুধের স্রোত তো বইছে আঁর হোলামাইয়ার হরীলে, সইতে হারি ন, ওর জ্যান্ত হরীলটা বসাই দিলাম হাড্ডির কোনায় কোনায়। মাষ্টাররে কইলাম বাপ আঁই তো কিছু বুঝিনা ওগো শক্তির দাপট, কে রে এমন নামগুন বানাইছে, ওরা কি আঙ্গ দেশের চাষাভুষার মতন না জুড়ি গাড়ি চড়ি বাবু লোকরা আয় যায় ওগো মতন। ওরা কি কাতারে কাতারে মরে, না নাখাই মরে, মরার আগেই যদি মরি যায়, তাইলে তো আর মরার ভয় থায় না। যা মাষ্টার ইস্কুলে যা, ছাত্ররগুনেরে তোর অনেককিছু হড়াইত হইব। ঝমঝম করি বৃষ্টি হড়ের, আকাশের মেঘেরা উড়ি উড়ি চলি যার। তোর তো মাথায় ছাতিও নেই, যাইবি কেমন করি। ‘জেঠি, আমনেরে যে কত কিছু কওয়ার ছিল, কিছুই বুঝাইতে হারালাম না, দেশটা যে হুড়ি যার।’ মাষ্টারের কথা খান হুনি হাসিখানা আর চাপি রাখতে হাইরলাম না।
চিল্লাচিল্লি কইরব না শব্দের গোঙানি কোনটা কইলে ভালা হয় না বুইঝতে হারি কান হাতি রইলাম। কেউ কয় জাপান, কেউ কয় রাশিয়া আরও কত কত কত নাম, অধ্বেক বুঝি তো অধ্বেক বুঝি না। ওদের গলার জোর এত বেশি, মাইল খানেক দূর তন, খেলার মাঠে মাচা বাঁধি লম্বাচওড়া বক্তৃতা মারে, মাঝখানে বিয়াল বিয়াল হাঁট বইয়ে, লোকে লোকারণ্য, কথাগুলান উড়ি উড়ি চলি আইয়ে তবুও গা’র রোম খাড়া হই যায়। কেন যায় আঁই নিজেও জানি না। ওরা নিজেরাও কি জানে, কেন বক্তৃতা মারে! মন কয় জিগাই আই, কোথা তুন শিইখল ওরা এমন কথার বাঁধন? কেউ কি কানে ওদের ফুসমন্তর দিছে। ওরা কি মাইনষের ভালা কইরত চায়, ভালা কইরবার লাই এত লোভ কিসের লাই? ফয়জল মিঞা ধানের গাঁইট মাথায় চাপি কাস্তে বোঝার মধ্যে গুঁজি আনমনে কোমর নাচাইতে নাচাইতে মাঠ তুন কাঁচারিবাড়ির দিকে ছোটে, ধুত্তরি কা ওর খাই দাই কাম নাই ওগো গরম গরম কথা হুনি মাথা চুইলকাইব। একটা গাঁইট নামাই রাই আবার মাঠের দিকে ছোটে। কত ধানের গাঁইট না মাঠ জুড়ি ছড়াই রইছে ঠাঁ ঠাঁ রোদ্দুরে। গায়ের তুন ঝরি ঝরি হরে ঘাম হই। মাথায় পেঁচানো গামছা দিই মুখচোখের ঘামটা মুছি নি লুঙ্গিটা গুটাই আর এক বোঝা মাথায় চাপায়। এইভাবেই সূর্যের আলো যন ডুইবতে লাগে, মাঠের পর মাঠের চেহারাটা কেমন পালটি যায়। ফয়জল মিঞা, আনারুল, মুকবুল মিঞারা গলাগলি করি মাঠের আইল ধরি হাঁইটতে থায়। বলাবলি করে, ‘কিছু বুঝিস, ওরা কী কয়?’ ‘ওই সকল ঢঙের কথায় আঙ্গ কী কামে আইব, কও দেখি!’ ‘এই দিন দুনিয়ায় কত কিছুই না ঘটে, সকল কথায় কান দিলে চলে!’ ‘আঙ্গ পেটে ভাত জোটে না, কত লোক চাষবাস ছাড়ি বাঁচার লাই মাথা চাপড়ার, বালবাচ্চার মুখে কী করি ভাত তুলি দিব, সেই চিন্তায় ঘুম নাই। আচ্ছা ক চাইন, এমন গজব লাগিল কেমন কইরে, হক্বল জিনিসের দাম এত মাঙ্গা, এমনটা আল্লাহ তাআলার কারসাজি হইতে পারে! শয়তান লোকজনেরা হরের ধনে পোদ্দারি করের, আঙ্গ ভাত মারের। নিয়ামত আলী কাইল্লা বোঁচকা বাঁধি হোলামাইয়া লই হৌরবাড়ি চলি গেছে।’ আঙ্গ তো যাইবার মতো জায়গাও নাই, কনডাই যাইমু। ঘরেই হড়ি হড়ি মইরত হইব। মালিকদের গোলায় ধান আছে, আঙ্গ গোলাও নাই, ধানও নাই’ । ‘জিল্লুরের মন ভাঙ্গি গেছে, বেয়াল হালাই মাছ যা ধরে, বিক্রির হয়সায় সংসার টাইনত হারেন না। মুদি দোকানদার বাগাদা আর কত বাকিতে নুন, ডাইল, মরিচ, পেঁয়াজ রসুন দিব। চক্ষুলজ্জায় না বইলত হারে না।’ ওদের কথা আর কে কানে তোলে। ওরা খালি কয়, দেশ নাকি স্বাধীন হইলে হক্বল দুঃখকষ্ট দূর হই যাইব। আরে ওরা তো জানে না, হক্বলে যা জানে , সেইসব কথা হোনাই কোন কামে আইব, যা জানে না সেই সকল কথা কও, যে পথ মানুষ চেনে না সেই পথ দেখাও।
আইজকাল আবার মাইনষের মনটা কেমন জানি হই যার। যুদ্ধ যুদ্ধ খেইলতে চায়। এইসব ভাবনাচিন্তা আঁর স্বামী আঁর কানে ঢোকায়। কত নতুন নতুন কথা কয়। কোর্টে মুসাবিদা করার সময় আইনের কচকচানির ফাঁকে দেশের হালচাল লই চিন্তার একশেষ নাই তেনার। ধর্ম আনে, ইতিহাসও টানি আনে, জাতপাতের কথাও আনে। নেতাদের লগে পুরান পুঁথির নায়কদের লগে মিলাই দেয়। ওনার মুখে বারে বারে গান্ধী, নেতাজি, নেহেরু, জিন্নাহ’র কাহিনী হুনি। জানার সাহস করি নি এনারা কন্নাই থায়। অবশ্যি এসব জানি আঁর কি কামে আইব। গাঁয়ের বউ ঘরদোর উঠোনবাড়িতে দিন চলি যায়, রাত ফুরায়। এত্ত বিরাট দেশের বিরাট লোকেরা কীসব লই ঘাটাঘাটি করের আঁর মাথা ঘামাই কী হইব। হারাক্ষণ মনের মধ্যে সেই এক চিন্তা গোটা সংসারটারে হর্মূলের আঁটির মতো বাঁধি সাঁধি রাখতে হারুম তো! কে যে কন কোনদিকে ছিটকে যায় কে কইতে হারে। মন প্রাণের টানটায় চির ধইরলে এমনটা হইলেও হইতে পারে। মনের ভাঙনটা ঘরের কোনা তুন হুরু হয়। বেড়ার ভাঙনটা এক চিলতে সরু সুতার মতো আলগা হইতে থাকলেও দেখা যায় না, কারও মুখ দিয়ে কথা সরে না, একদিন এমন আইয়ে কথার ঝাঁঝ ফুলকির মতো চারধারে সরায়, যত জল ঢাল, সেই কথার আগুন নিভতেয় চায় না। এই বুঝি এতদিনের জমানো ভালোবাসার খড়কুটো হুড়ি ছাই হই যায় চোয়ের নিমিষে। তন আর হুশ থায় না, কারে কি কইয়ুম, কারে কোন কথার মলম মাখাইয়ুম। তুচ্ছ ঘটনা, কার হোলার ভাগে দুধের সর কম হইরছে, এই লই যত রাজ্যের কথা কাটাকাটি। হিয়ান তুন হুরু হই কোথায় যাই থাইমল জানেন, ছোট জায়ে আর বড় জায়ে কথা বলা বন্ধ, ভায়ে ভায়ে মুখ দেখাদেখি নাই, ভেতরের কথা ঘরের বার হইল, চার কাইন হইল দুই কান তুন, বাতাসে বাতাসে ভাইসতে ভাইসতে এই বাড়ির তুন ওই বাড়ি গেল, এই গ্ৰাম তুন ওই গ্ৰাম গেল, রসিয়ে রসিয়ে একখান দুইখান গালগপ্পো হই এমন টক ঝাল মিশল, এমন হইল মাইনষের কাছে মুখ দেখানো যায় না। কুমোর পাড়ার জগার মা আগবাড়ি জিগাইল, ‘এমনটা যে হইব, কোনদিন ভাবি নাই, আমরা আরও কইতাম, আকাশ ভাঙ্গি দুইভাগ হইব বিশ্বাস করন যায়, নতুন বাড়ির চুলোচুলি এইটা হইত হারে না, বাদি গাছের আঠা যে, ছাইড়ব কেমন করি! উপায়ন্তর না দেখি কি হইলে ছিপ ফেলি বরইয়ে গাঁথা যায় সেই চিন্তায় মাথার চুল ছিঁড়লাম। হক্বলেরে ডাকি কইলাম, তোঙ্গ মনের ভাবখানা কও দেখি। ওমা উল্টি এক দেবর আঁরে গালভরা যুদ্ধের গালগপ্পই হুনাই কত বাহাদুরি মাইরল। আঁই কইলাম, আগে নিজেদের ঘরের যুদ্ধ সামলাও, তবে না হয়….। ওমা ফিরতি উত্তরখানা মন্দ দিল না। কত কিছু যে চটকাই ইংরেজদের ভারত ছাড়ো, যুদ্ধের লগে বিশ্ব জুইড়ল, দুর্ভিক্ষের কথা কইল, হুনছি তো আঁই । হক্বলকথা জগাখিচুড়ি হই সদর দরজায় আই যে হাজির হইব ভাইবতই হারি ন।
দেশ স্বাধীন হইব ভালা কথা। কাদের লাই স্বাধীন হইব? পরাধীন কারে কয় এর অর্থটাই তো জানি না। কই আঙ্গ গ্ৰামের কুমারবাড়ি, কুমোরবাড়ি, তাঁতিবাড়ি, অধিকারী বাড়ি, জেলেহাড়া, মোছলমান ধোপা নমঃশূদ্র কারও মুখ দেই তো বুইঝতে হারি না চারদিকে এমন ঝড়তুফান লাইগছে। কালবৈশাখী’র তান্ডবে চারদিক ভাঙিচুরি সব একশেষ করি দেয়, সে কথা আর কে না জানে। গরীব মানুষদের ঘরবাড়ি উড়াই লই যাই। সনের চালের বাড়িঘর, চেনার কোন জো নাই। খড়বিচালির লাই আঙ্গ জ্ঞাতিগুষ্টিদের কাছে আই হাত পাতে। আঙ্গ নিকট আত্মীয়স্বজন দু’একঘর ঢাকা, কুমিল্লা আর কইলকাতা শহরে থায়। কামকাজ হড়ালেখা করে। ওরা উৎকন্ঠায় চিঠিচাপাটি করে, চিন্তায় ঘুম চলি যায়। নদীর কাছে ঘর, দূরে দূরে চর, চিন্তায় চিন্তায় মর, বাঁচার এমন বহর। নেতারা নাকি গ্ৰামে গঞ্জে গোপনে ডেরা বাঁইধছে, যুবক পোলাদের তাঁতার, কানে কানে গোপন মন্তর দের বিয়াল্লিশের আন্দোলনে ঝাঁপাই হড়ার লাই। ওদের না তাড়াইলে নাকি দেশের মুক্তি হইত ন। কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক, কে কইব। হেটে ভাত নাই, এই কথাখান অস্বীকার কইরব, কার সাধ্য আছে। কারো মুখ দিই ত কথা বার হয় না, আকাল আইছে, কেমন কইরে বাঁইচব ছাপোষা মানুষগুন। হঠাৎ চাইল ডাইল উধাও হইল ক্যান? এই দেশটা কি খালি বড় বড় শহরের লোকজনের, বাকিরা কি বানের জলে ভাসি আইছে। কারা এই অবস্থার লাগি দায়ি, শুধুই ব্রিটিশরা, আঙ্গ দেশের বাবু লোকরা কী মুখে ঘোমটা হড়ি বই রইছে? রাস্তাঘাটের মানুষ গরু ছাগলের কঙ্কালরা এরা কী চোখে দেখতে হায় না? নাকি ইংরেজ তাড়াই কখন গদিতে বইসব সেই ফন্দি আঁটছে। আঁর স্বামী আঁরে কয়, ‘ তুমি এসব লই শুধু শুধু মাথা ঘামাও ক্যান? পূজাআচ্চা কর, ঘর সামলাও, দেশের এখন টালমাটাল অবস্থা, অনেক গোলমাল, এসব মাথার তুন তাড়াও।’ তিনি তো বুঝছেন না, স্বাধীন হইবার তাড়া আঙ্গ ঘরের মাইনষের মধ্যেও লাইগছে, ভালা কি মন্দ আঁই বুঝি উইঠতে হারছি না, কোনটা আগে চাই ? হোলাপাইনদের মুয়ে মুয়ে ভাসে কত কথা। দ্বীপান্তর, জেল, ফাঁসি, স্বদেশী গান, কেমনে কেমনে চলি আইয়ের! বুঝি না এই অবস্থাটারে কী কয়? হাগলামি! ভালোবাসারে হাগলামিই তো কয়। মাটির টান, এমন টান পেটে ধরা মায়ের মুখটা ভুলাই দিত হারে! এমন শক্তি! আচ্ছা, দেশের সীমানা বাঁধব কেমন করি? কোন রঙ আছে নি তার ? পূবের লোক পশ্চিমের মাইনষেরে কেমন চেহারায় দেখে? উত্তরের মাইনষে দক্ষিণের মাইনষেরে কেমন করে মেলায়? কোন মন্তর জানেনি এরা, নাকি চাপিচুপি বস্তায় পুরছে? দেশটা ভাঙ্গিভুঙ্গি কোনদিন টুকরো টাকরা হই যাইত ন ত?
চুপিচুপি কথা আয় আর যায়। গুঞ্জন ভাসে। কে কয় আর কে না কয়, কে জানে। কারা যেন ভাসাই দিই চলি যায়। ওগো চেহারার মিলও নাই, আবার অমিলও নাই। এই বড় কষ্টের কথা, মন জুড়ি থায়, এমন করি, পাথরচাপা দিই রাইখছে বুকের উপর। হক্বল কথার অর্থ তো বুঝি না। তবে কিনা একদিকে লই যাইত চাই কিছু লোক, এই তো হাডুডু খেলা, আর এক দলের ভাবখানা যাইতান ন, দেই না কেমনে নি যাস। আন্ধার জমাট বাঁধি আয়, আলোরা ভয়ে ছুট লাগায়, হামনে হাজার ছায়ার চু কিত কিত খেলা। এই খেলায় জাত বেজাত হয়, রঙ বেরঙ হয়, ডাকনের ঢঙ পাল্টি যায়। ক্যান যে গোপন শলা পরামর্শ! আঁচ কইরতাম হারিয়ের। যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ লসাগু গসাগু অঙ্কের নিয়ম কোন কিছু মাইনত ন ওরা। ধম্মেরে লই লোফালুফি কইরব। আহা কী আহ্লাদ! দে উচিত শিক্ষা। দেশ জমি লই টানাটানি। আঁর স্বামী কয়, ‘কইও না কারো কাছে। লোকে বলাবলি করের ওরা আঙ্গরে হত্তুর ঠাওরাইছে। সহজ হইব না। জল গড়াইব অনেক দূর। নেতাদের কথার হুইলঝুরিতে দল পাকার এক দল। মোতালেব মিঞা কইল, বাবু সাবধানে থাইকবেন, বউঝিদের ঘরের বাইরে হইত দিয়েন না। কানাঘুষা যা চইলছে পুলের গোড়ায়, হাটে বাজারে, ভাব ভালোবাসা আর আগের মতো রাখা যাইত ন। উস্কানি দের ধর্মের নামে।’ তবে কী মুসলমান হই যাইত হইব ইয়ানের থাকতি গেলে। হক্বল কথাই হোনা। ‘হক্বলটা নেতাদের হাতে। ইংরাজরা এইসব লই খেইলতে আছে।’ কই আলাউদ্দিন, খলিল, চাঁদেদের হাবেভাবে তো টের হাই না। একবার জিগাইব নাকি? ‘খবরদার কইতে যাইও না, মনের কথা মনেই রাখ। সবে বীজতলা তৈরি করছে সাহেবসুবোরা, নেতারা, আগের তুন জল ঢালি লাভ আছে। কত পুরুষ ধরি হাশাহাশি বসবাস, ওরা আঙ্গ জমি চাষবাস করে, এত সহজে বেঈমানি কইরত ন।’ মাইনষের স্বভাবচরিত্র কন যে কোনদিকে মোড় নেয়, কোন ভাবের কাছে মাথা ঝোঁকায়, কে কইত হারে। হায়রে জীবন, তোরে লই যে এত জনের যে এত ভাবনা, তুই নিজেও তো জানস না, যদি জানতি মাইনষে এত চক্বর খায়! কয় কেমনে, ‘আমরা যেমন করি দেই, তেমন করে দেহ, যেমন করি শিখাইতে চাই, তেমন করি শিখ, বুইঝলা না। তাইলেই ইহকাল পরকাল দুটাই সমান তালে চইলব। অন্য দলে নাম লিখাইয়া লাভ নাই, তোমার জ্ঞানগম্মি আর কতটুকুন, ঐটুকুনির উপর ভরসা করি বাঁচা যায় না। আঙ্গ পথেই যত মুক্তি, গিয়া পড়, বাকি পথে চইললে ঠ্যাং ভাইঙ্গব, হুইনচ মুখ ভ্যাংচানি, জাত বেজাতের কুকাম, আঙ্গ ইয়ানের হক্বলে হমান হমান, ভালা কথা কইচি, যদি না হোন, অন্য দাওয়াই।’ কেউ কেউ হুইনচে, কেউ হোনেন। নিচু জাতের মগজে চলে জিন পরির খেলা। তাই বলে মান সম্মান নিয়া টানাটানি, ফুসলানি! ‘ যায় যাক হরান, ধম্ম পালটাই অন্য ধম্মে নাম লেখাইব, তা হইত ন।’ যুগি পাড়ার দু’এক ঘর মুসলমান হইছে, হিন্দুর মাইয়া ভালোবাসা করি, মোসলমানদের পোলারে বিয়া করি ধম্ম পালটাইছৈ, কার কি কন আছে, মাইয়ারে বাপ মা ত্যাজ্য কইরছে, হিন্দুর দোকান তুন কেনাকাটি বন্ধের ফতোয়া দিই দেশ ছাড়া কইরব, কান হাতলেই এসব কথা হিন্দুদের গ্ৰামে গ্ৰামে ঘোরে। এসকল কথা আঙ্গ মুসলমান বদললাইরাই হোনাই যায়, কানাকানি করে। কথায় কথায় ভালোবাসি কয় না লীগের নেতাদের চমকানিতে ভয় দেখাইবার লাই কয় কে জানে। উঁচু নিচুদের মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগাই দিতে হারলি তো ষোল আনা মজা। সম্পত্তি দখল করার লোভ কার না আছে, তন কি হিন্দু কি মোসলমান অত বাছাবাছি কইরলে চলে, হক্বলে তন ভাই ভাই। আঁর স্বামী কয়, ‘ আসল খেলা চইলছে অন্য জায়গায়। দেশটা মোসলমানদের কইরত হাইরলে তবে না মজা।’ মোয়াজ্জেম মিঞা কয়, ‘দিদি গো, মাইনষের মন বিষাইবার লাই কন তুন যে কোন কথা গুলি খাওয়ার কে জানে, ভাষাটাও বুঝিনা, উদ্দেশ্যও বুঝি না। তবে এটা বুঝি, দেশটা ভাগ হইল বলে, আর বেশিদিন নাই।’
মাইয়া মানুষ না পুরুষ মানুষ
জন্ম কেমনে দিই তোরে
গভ্যযন্তনাটা চাগাড় দি উইঠলে মনের ভেতরে কত কথার জম্ম হয়, কথাখান বুইঝাইতাম হাইরতাম ন, উপলব্ধি কইরলে টের হাওন যায় শরীলের ভিতর আর একখানা শরীর বাড়ের দিনে দিনে। হ্যাতের কী হ্যাতির পরানটা হেটের তুন বাইরে আওনের লাই ছটফট করের। আঁই আর কী কইরত হারুম। কেউ কয় ঘরের ভেতরে হায়চারি কর। ডাক্তার বদ্যির কী আর কাম, মাইয়ালোকের প্রসব করানো তো তেনাগ কাম নয়। দশ গ্ৰাম ধরে কাত্যায়নীই ভরসা। খবর দিলে মাঝে মাঝে আই নাড়িচাড়ি দেখে হেটেরটার অবস্থাটা ঠিকঠাক আছেনি। কাত্যায়নী ঠিক মনে হইলে কয়, ‘চিন্তা করার কিচ্ছু নাই, তেনার সৃষ্টি তিনি ঠিক রাইখবেন, অস্থির হইও না বাছা, লক্ষণ দেই মনে হর, হোলা হইব।’ হক্বলে আঁর ঘরে উঁকিঝুঁকি মারের। আঁর হোলামাইয়ারা তো মনের আনন্দে লাফার তিরিং বিড়িং করি। আঁর জায়েরা দাইয়ের কানে কানে কী যেন শুধায়। কোনো গোপন কথা নাকি যা আঁই হুইনতাম হাইরতাম ন। বিপদের গন্ধ হাইয়ের। হেটের যন্তন্নায় কাবু হই কাতরাইলে নিজেরে এই কতা কই সামলাইতাম, বেটি সবুর কর আর তো মোটে কটা দিন, হরে তো হোলার মুখ দেইখবি, তন সব কষ্ট দূর হই যাইব। দাই কত কতা কইল, কী খাইয়ুম, কেননে বইয়ুম, কেননে হুইয়ুম, কী রঙের, কী ধরনের কাপড় হরুম, কনডাই হরুম। তবুও ক্যান যে এত কানাকানি, ভয়ে চুপসে যাইলাম যদি ঠিকঠাক জম্ম দিতে না হারি, সকলে মিলি আরে না দুইসব। নিজেরে ঘরের মাঝে একরকম বন্দী করি ফালাইলাম। হক্বলে উপদেশের পর উপদেশ দিল, ‘সাবধানের মার নাই।’ কু্ঁচোটা থাকি থাকি গুঁতো মারে। কি জানি ওর কী চাই, বুইঝতে তো হারি না, নিজের হেটে নিজে হাত বুলাই যদি মা’র আদরটা বুইঝত হারে, অবুঝ মন মানতি চায় না। বাঁ দিকে কাত হই চোখ বুঝি থাই, শান্তিতে ঘুমাই গেলি নিশ্চিন্তি হই, বেটা আবার গুঁতোয়, দুষ্ট হোলা না হই যায় না, দাই ঠিকই কইছে, মাইয়া হইলে এমন শতান হইত ন। খালি কেন খাই খাই ভাব হর, অন এ এত, তার মা’র হেট তুন বার হইলৈ আর দেইখতে হইত ন। দিদি হাউরি কয়, এই সময় দেবদেবীর স্মরণ ল, বুইঝলি না, মনটা শান্ত হইব। কথাটা যে মন্দ কয় নি, সেটা টের হাইলাম, কুলগুরুর স্মরণ লইলে খালি মনে হয়, উনি সামনে দাঁড়াই আছেন। আগেও আঁর কোলে হোলামাইয়া আইছে, সে তো বছর ছয়েক আগে, হরীলটা তরতাজা ছিল মনে আছে, মনের অবস্থা কেমনে ছিল, দুনিয়ার অবস্থা কেমনে ছিল, বাড়িঘরের অবস্থা কেমনে ছিল, অতশত আর মনে নাই। তবে এই নতুন বউঝিরা লই এখন তেমন ঘর ভর্তি ছিল না। এই বয়সে মা হওয়া মাগো সামনে শরম শরম লাগে। শেষবার মাইয়া হইছিল, তাতে কে কতটা খুশি হইছিল জানি না, তবে আঁর উনির কী আনন্দ হইছিল সে আঁই বুইঝতে ভুল করি না। এইবারের ব্যাপারখানা যে আলাদা সে কী আর বুঝি না, অসময়ে হোলা জগতের মুখ দেইখবে। দুনিয়াজোড়া বোমা বারুদের খেলা। চারদিকে গা ছমছমে ভাব। ক্ষুধার জ্বালায় মাইনষে জ্বলি পুড়ি মইরছে। কারো কোনও দিকে তাকানোর সময় নাই, মইরল কি বাঁইচল কার কি আই যায়। এই তো গেল মাইনষের কথা, গরুগোতানের খড় খৈল জোটে না। আঁর হোলাখান আইবার লাই কত ছটফটানি কি মানুষের কোলে উইঠব, গাছগাছালির হাওয়া খাইব, কত সখ হোলার। আঁর হরীলের মধ্যে ছোট্ট হরাণঢা খেলা করে। ওর চোখ ফোটের আস্তে আস্তে, ওর ঠোঁট নাড়েড়,মাথার চুল গজার। দাই কয় আঁর গভ্ভে হোলা বাড়ের। আঁই মানুষটা তা হইলে কী ! মাইয়া মানুষ, আর পুরুষ মাইনষের মেশানো মন লই হাঁটিচলি বেড়ানো আর এক অন্য মানুষ। আঁর হোলা জম্ম দেওয়ার আগের ভাবখানা কাম কইরতেছে কিনা। দাইয়ের কওনের তুন ভাইবতে থাকি আঁই মানুষটা আসলে অন কোন জাতের! আঁর মাইয়াটা আই ঘুরি ঘুরি যার। ইশারা করি কইলাম, কন্নাই যাস, হুনি যা, ভাইরে দেইখবি আয়, এইখানে কান পাত, আদর কর, ইয়ানেই তো নাক ডাকি ঘুমায়। মাইয়াটা আঁর খিল খিল করি হাসে। ভাই হইব হুনি হোলাটা কাছে ঘেষে না, শরম লাগে না হিংসা করে, কে জান!
মা আইছে কতদিন বাদে নাতির সঙ্গে লই। হাঁড়ি পাতিলে মন্ডামিঠাই, নাইরকেলের নাড়ু, তেঁতুলের আচার আমের আচার মুড়ির মোয়া, খইয়ের মোয়া। মারে পেন্নাম করতি গেলে হা সরাই কয়, ‘ কী করছ, কী করছ, তোর হেটে অন ভগবানের বাস, আঁর পাপ হইত না, দুই হোলামাইয়ার মা হইচস, এয়নও আক্বল হয় ন ।’ কত নিয়ম কানুনই না সময়ে সময়ে হাল্টি যায়, তার কোন ইয়ত্তা আছে। মা’র চেহারাখান দেখি বড় কষ্ট হইল, কেমন বুড়া হই গেছে। গালটা ভাঙি গেছে, হরীল চলে না। মাইয়ারে দেইখতে আসা চাই।
হক্বলে আই ঘিরি ধইরছে, পেন্নাম ঠুইকত লাগে।
‘ আমনে আইছেন খুব ভাল লাগের। আমনের মাইয়া তো খালি মা মা করে।’ ‘তোমরা আছ হক্বলে, আঁর আর চিন্তা কিয়ের লাই।’ ‘ আয়েন মাইয়মা বয়েন, দু’চারখান সুখ দুঃখের কথা কই।’ ঝুলির তুন এক লগে কত শত গল্প ফুরফারাইয়া বাইর হই আইয়ে। ঝাল নোনতা মিষ্টি কত স্বাদ মিলাই লই মা কইতে থাকে। বাপের দেশের কথা হুনি ন তাও তো কম দিন হয় নাই। কত লোক স্বগ্গে গেল, কত লোকেরা ব্যামো হই বিছানা নিল, কত মাইয়া হৌরবাড়ি গেল, কতজন ব্যবসাপাতি করি বড়লোক হইল, কত লোক বিদেশ বিভুঁইয়ে গেল, কত লোকের নাতিপুতি হইল, কত গ্ৰাম ছারখার হইল। যতক্ষণ না থামাই, মা তো গড়গড়িয়ে বইলতেই থাইকবে। জীবনের তুন কত কিছুই না শিখনের আছে, এই কথাখান কার কাছে কই, কারেই বা বোঝাই। আঁই তো জীবনের জম্মই দিতে চলছি, বড্ড ভয় ভয় করের, এমন ভয় কোনো কালেই তো করে নাই। এক ভেন্ন ধরনের অনুভূতি। পরানটা মচর মচর করের কেন মা, ধুকপুকানি বাড়েড় কেন গো, ভেতরটায় এত আনন্দ হর কেন, খুশির ঝমঝমানি থামাইতে হারিয়েন না কেন ? ‘দূর অ পাগলি সকল কতার কী জবাব হয়, সকল ভাবের ব্যখ্যা গাইন দেওয়া কি এত সহজ, কত কঠিন কঠিন আনন্দের ব্যথার সামাল দিতি হয়। যত দিন যাইব, তত বুইঝবি, হক্বল সময়ের সমান ওলটপালট হয় না, কোনটা সোজা, কোনটা বেঁকা, কোনটা মনের আধেক জায়গায় যাই পৌঁছায়, কোনটা আরও গভীরে। কর্তব্যের আড়ালে চাপা হড়ি যায়, আবার কোনটা জাগি ওঠে হঠাৎ হঠাৎ, টেরই তো হাওন যায় না।’ মা আমনে এত কতা শিখলেন কেমনে? ‘ তুইও শিখি যাবি পঞ্চমী, মাইনষের জম্ম দিতি আছস, কতার জম্ম দিতি হাইরতি ন, এ ক্যামন কতা!’ মারে যত দেই আঁই অবাক হই যাই। মাইয়ারা মার কাছ তুন যত শেখে, অন্তরের কাছ তুন তত শিইখতে হারে না, সে যত মুখস্ত বিদ্যা করুক না ক্যান। সাধ হয়, মারে আঁর কাছে চিরজীবনের লাই রাখি দিই, আত্মীয়স্বজনরা যদি নিন্দেমন্দ করে। মা’র হোলাপাইন আছে, নাতি নাতকুর আছে, বৌমারা আছে, চার কথা হুনাই দিব। কী জানি কার মনে কী আছে, কে ক্যামনে নেয়, ভাইবত হইব তো সেই সব কথা। মাইয়ার হৌরবাড়ির ঝঞ্ঝাটে জড়াইয়া হুদা হুদা মারে কষ্ট দিই লাভ কি। নিজের স্বার্থের লাই এই অনুরোধ আঁই কইরতাম হাইরতাম ন।
নতুন নতুন মানুষ, নতুন নতুন কতা, টের পাইয়ের । মনটা আঁর আগের মতো নাই। কত কতা আই ভিড় করের। নিজের ভিতর তুন জন্মার, নিজের ভিতরেই মরি যার, কিছু অর্থ ধইরত হারিয়ের, কিছু আবার জ্যান্ত হই উড়ি যার। হরীলটা ভারি হই যার দিনে দিনে। মাঝে মাঝে মনে হয়, হোলাডা হাত পা নাড়ে চাড়ে নিজের খুশি মতো, ধমকাইব তার কি জো আছে। স্বামীর তো আনন্দে হেট ভরে না। আঁর হেটেরটা যতদিন বাড়ে ততদিন উনার উচাটন হয়। ছোট ঠাউরঝি আইছে লক্ষ্মীপুর তুন। আঁর হোলামাইয়ারে জড়াই ধরি কী আদরটাই না কইরল। কতদিন বাদে দেইখছে দাদার হোলাপাইনগুনেরে, চোয়েমুয়ে সেই কী আনন্দ। পোটলাপুটলি ঘরের এক কোনায় রাই আঁর কাছে ছুটি চলি আয়ে। ‘বৌদি গ, কেননে বুঝামু কত কাম হালাই আমনেরে এক নজর দেইখবার লাই আইছি। আমনেগো জামাইয়ের বাতের ব্যামো, নড়ত চইরত হারেন না।’ ‘তা হইলে এত কষ্ট করি আইছ কেন? “এটা কী কন বৌদী, এক নজর না দেইখলে যে মন মানে না। হাশের ঘরের বৌমারে কইলাম, তোমার হৌরেরে একটু চোখে চোখে রাইখ। মাইয়াটা খুব ভালা ‘কয় আমনে কিচ্ছু চিন্তা করিয়েন না, আঁই আছি তো, আমনের যদ্দিন খুশি বাপের বাড়ি তুন ঘুরি আসেন।’ মাইয়ার কথায় ভরসা করি সংসার হালাই চলি আইলাম।” তোমার হোলামাইয়ারে আন ন। ‘না আইনলে আঁর রক্ষা আছে। কয়, মামাতো ভাই বোনদের সঙ্গে খেলবে। ওই তো উঠানে লাফাইতে আছে। যেই না হুইনছে ভাই হইব, মাথা খাই ফালার কন দেইখব। কইলাম, সে তো অনও মায়ের হেটে।’ ওদের ডাকি আন, একটু আদর করি। ওই তো আইয়া পড়ছে, আর তর সয়। আয় আয়, তোগো সোনামুখখানা দেখি। ‘ আরে, চকি তুন নাইমত আছ কেন, কন কী বিপদ ঘটি যাইব কওন যায়।’ তোমরা আঁর লাগি কত চিন্তা কর। ওই দেখ দিনি আর দেওরের হোলামাইয়াগুনও আইয়া পড়ছে। আয় বয় বয, দূরে দূরে ক্যান, আঁর হাশে বয়। দেখ দেখি কত কতা হোনে। ‘আওনের সময় দেইখলাম কত পাখনা বরই গাছের নিচে বিছাই রইছে। তোমার লাই কুড়াই আইনছি। খাই দেখ, এইসময় স্বাদ লাইগব। আঙ্গ হোলাডাও হৃষ্টপুষ্ট হইব। পাটনাইয়া গরুর দুধের সন্দেশ বানাই আনছি। হত্যেক দিন দুইভাগ কইরে খাইও। কাওরে দিও না। হক্বলরে না দিই তোমার তো খাইবার অভ্যাস নাই। কড়া পাক। টিনের বাক্সখান তোমার বিছানার কাছে ঝুলাই রাখি যাইয়ের, খাইও মনে কইরে।’ খামু, খামু, চিন্তা করিও না।
মনের নাম মহাশয়, তেমন সইছে না, যেমন সওয়াতে চাইছি। মনটা এমন আনচান করে যে তার কুলকিনারা খুঁজি হাই না। যন হক্বলে নিজের নিজের কাজে চলি যায়, কেউ আর কাছে ঘেষে না, আঁই যেন ভেন্ন জীব, হেঢেরটারে লই একলা থাওনই লাইগব এই সময়। কারা যেন নিয়মের জালে জড়াই দিছে। খোড়াইতে খোড়াইতে ঘরের দূয়ারে আইলাম। কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালে কাকটা লেজ দোলার, চোখ ঘুরাই আঁরে দেইখল, কা কা কইরল, তেষ্টা হাইছে বোধ হয়। আঁই নড়চি না চড়ছি না দেইখে বুইঝতে চায় মনের কষ্টটা আঁরে কতটা কাবু করি হালাইছে। মনের কী ইচ্ছা হইল মাটির কলসির তুন এক গেলাস জল আনি শিউলি গাছের নিচে রাখা মালসার মধ্যে ঢালি দিলাম। ঢোক ঢোক করি গিলি খাইল। হায় হায় রে কেউ বোঝে না ওর কষ্টটা। মাইনষের লাই নাকি মাইনষের হরান জ্বলি যাই, সাত সতেরো বন্দোবস্ত যেন সকল মাইনষে পৃথিবীটাকে কব্জা করি রাইখছে, কত মাথা পিটাপিটি করের, জমিজোতের লাই মামলা মোকদ্দমা করের অথচ এই অবলা জীবজন্তু গাছগাছালি এরা আঙ্গ লগে থায়, এদের ওতো হরান আছে, হিরে দেইখত ন একবার। আঙ্গ গ্যাঁতি ভাসুর, হিছনের বাড়িতে পেল্লাই ঘর বাঁধি আছে। বিঘা বিঘা জমি, কত না ফসল হয়। আউস আমন বরো ধান, পাট, নারকেল বাগান, সুপারি বাগান, কোন কিছুর কি অভাব আছে, তবু লোভ যায় না, আরও আরও চাই, খুঁজি খুঁজি বেড়ায় কন্নাই বেনামি জমি হড়ি রইছে, কোনও বেধবার সম্পত্তি ক্যান্নে নিজের নামে করি নিব। তর সয় না, ছলে বলে কৌশলে বেগ্গাইন দখল কইরত না হাইরলে ওনার ঘুম হইত ন। শাগরেদরাও একই গোয়ালের গরু। লাঠি উঁচাই এগ্ৰাম তুন ওগ্ৰাম ঘুরি ঘুরি বেড়ায়। দূর দূর মাঠে যিয়ানে কারো দু’চোখ যায় না, হিয়ানে খুঁইজলে ওনার জমি হাওন যাইব। ঘরে খাওনের লোক নাই, লোভের হাড়িতে টস টস করি রস হড়ে। কারও আইলের সীমানায় এক আঙুল জমি চলি যাইলে মামলা মোকদ্দমা করি জুতার শুকতারা খই হালাইব। কেউ যদি জিগায়, ‘এত যে দৌড়ান, খাইব কেবা।’ তাড়াতাড়ি আই কয়, ‘ তোর বাপেরে খাওয়ামু, তোর চৌদ্দগুষ্টিরে খাওয়ামু, আর বেশি কইলে তোরেও জেলের ভাত খাওয়ামু।’ তবুও মাইনষের কথা মাইনষেরে না কই কারে কমু। যত হুকুম খবরদারি বেবাক ধম্মের দোহাই দিই মাইনষে সান্ত্বনা খোঁজে। মাইনষের উপর দোষ চাপাই আর কি করুম। মাইয়ালোকের কতা কে আর কবে হুইনছে। হোলামাইয়া জম্ম দিই মানুষ করি দিতে হারলেই কত সুনাম, কত ডাকখোঁজ – সুন্দরী বউ, ভালা মা, পাকিয়সী, লক্ষ্মী ঘরনী। বদনাম ও কি কপালে কম জোটে। কতায় কতায় গায়ের রঙ লই খোটা ‘কালুটনি’। আঙ্গ এক মাইয়ারে তো হোলামাইয়ার মা হইতে হারেন বলি ‘বাজা’ বদনাম দিই বাপের বাড়ি পাঠাই দিল, দেইখল না একবারের লয় হেথাগো হোলার খুঁত আছে কিনা। এই জগতে যত দাপট পুরুষ মাইনষের, মাইয়া মাইনষের আর কিয়ের দাম। আঁর কথাই ধরেন না, যেই না দাই কইল আঁর হোলা হইব, দেইখতে না দেইখতে কদর গেল বাড়ি, আদর যত্ম, চোয়ে চোয়ে রায়ন, যেন হোলা তো নয়, সাত রাজার ধন এক মানিক। মাইয়ার জম্মের কথা হুইনলে মরুক ধরুক, যমের দূয়ারে যাক, কার কি এত নজর দিবার সময় আছে, রক্তের ঢেলা ছাড়া আর কি কোন দাম আছে! এমন সব সাতপাঁচ ভাইবতে ভাইবতে দিন যায়। স্বামী আই কইলেন, ‘তোঁর হইছেটা কি? এত যে দুশ্চিন্তা করর, হোলাটার কী দশা হইবে, ভাইবা দেইখছ কি ?’ আঁর স্বামী খালি হোলার কথা চিন্তা করে, একবারও ভাবে না, দুই বাচ্চার পর তিন বাচ্ছার মা হইতে চইলছি, বিপদ আপদে যে কিছুখান হইত হারে, তন কী হইব !
আঁর স্বামী আঁর মনখান শান্ত রাইখতে চায়। বাড়ি আইলে হোলামাইয়ারে লই গোল হই চাটাইয়ের উপর বই জলচকির উপর লাল শালু দিই মোড়াই কৃত্তিবাস ওঝা’র রামায়ণ না হয় কাশীরাম দাস-এর মহাভারত, সময়ে সময়ে তুলসীদাস-এর রামচরিতমানস হড়ে সুর করি আবার ব্যাখ্যা করি ওদের বুঝাইও দেয়। আঁর মাইয়াটার ধম্মকম্ম আর ধম্মপুস্তকের হতি মন আছে। সরসর করি সপ্তকাণ্ড রামায়ণের চরিত্রগাইন মুখস্ত বলি দেয়। তাই ওর বাবা নিয়ম করি বসায়। আঙ্গ গ্ৰামে মাইয়াদের ইসকুলে পাঠাবার রেওয়াজ নাই। আধা মাইল দূরে ছেলেদের প্রাইমারি আর হাই ইসকুল আছে বটে। কোনরকমে চলে যায়। হিন্দু মুসলমানের কোন ভেদাভেদ নাই। মাইয়ারা ইসকুলে যাইবই বা কেন, যদি বেশি পন্ডিত হই ছেলেদের উপর ছড়ি ঘোরায়, অধিকার চাইয়া বসে। কিন্তু আঁর মাইয়াটার পড়ালেখা শিখবার খুব শখ। আঁর কাছেই হাতেখড়ি, ক্লাস থ্রি ফোরের বাংলা ইংরেজি অঙ্ক আঁই শিখাই দিছি। মাইয়া নিজের আগ্ৰহে সকাল সন্ধ্যায় আঁর হোলার দেখাদেখি বইপত্র উলটাই পাল্টাই দেহে। পরে কেমনে কেমনে চুপি চুপি বিদ্যাসাগর আর শরৎচন্দ্রের লেখা বই পড়া শিখি হালাইছে। আর বিয়ার আগে যেইটুকানি পড়া শিখছি, সেই শিখনের লাগি অনও বাঁচি আছি। ওদের দেখি থাকি থাকি চাগাড় দেয়। মনের দুঃখটা চাপি রাই, নিজের কথা এত ভাইবলে এগুনরে মানুষ করুম কেমনে। আঁর ঘাড়েই তো সব, কেননে কি করুম। উপরওয়ালারে কই আঁরে শক্তি দাও ঠাকুর, আঁই যেন সংসারের জ্বালা যন্তন্না সামলাই বেগুনের মন রাই চলতি হারি। বইগুলান আঁরে যেন ডাকি কয় ‘ আয় আয় আঙ্গরে লই নাড়িচাড়ি দেখ, দেইখবি হড়ালেখায় কী মজা।’ আঁই যেন ওদের কথাখান হুনতি হাই। কেন এইকথা কর, কি ওগো উদ্দেশ্য, না বুইঝলে চইলব কেমনে! এই জগতটা নাকি লোকে কয়, জ্ঞানের সাগর। কত মণিমুক্তা ছড়াই রইছে চাইরপাশে, কে আর এমন আছে যে খুঁজি আনি দিব। আঁই তো চাই মুঠো মুঠো করি নি, মন ভরাই আর হাইরলে লোকেরে বিলাই, লইবার লোক তো চাই, খালি দিলে তো হইত ন, উলুবনে মুক্তা ছড়াই লাভ কী আছে! মনে মনে বাসনা জাগে পিথিবী একদিন মাইয়াদের কতা হুইনব, ওদের ঠিক জায়গায় লই বসাইব। আঙ্গ দেশে কবে পুরুষরা মন থেইকে চাইব মাইয়া লোকেরা একই আসনে বসি পাত পাড়ি খাক। কত যে হাজারো উদ্ভট চিন্তা মাথায় আসে, কেন আসে কইতে হারি না, গরম জল ফোটার মতো ফুইটতে থাকে। যদি কথা গুলান লিখি ফালাইতে হাইরতাম, তবে মনের শান্তি হইত। আঁরে কে যে শিখায় এসব কথা! যার হরীল শক্তপোক্ত হর আঁর গভ্ভে, ওই পাগলা শতানটা না তো! ওর তা হইলে একটা মন আছে। তাই কেমনে হইত হারে! জীবনই যে দেইখল না। মন লই ও কী কইরব। হইত হারে মার হেটের ভেতর একটা জীবন আছে, সে খুঁটি খুঁটি জীবন দেইখতে চায়, ঘুমাই ঘুমাই জীবন দেখে, সে জীবনের ভেন্ন মাধুর্য। এই শব্দটা আঁর স্বামীর কাছ তুন শিখছি। আরও কত যে নতুন নতুন শব্দ ওনার কাছ তুন শিখছি। শব্দগুলারে লই খেইলতে আঁর কী যে ভালা লাগে। আঁর স্বামী না বুইঝলে আঁরে ধমকায়। ওই ধমকানির একটা ভার আছে। মাঝে মাঝে জিগাই এই শব্দগুলা আমনে শিখলেন কত্তুন। উনি সচরাচর হাসেন না, গম্ভীর ভাবের লোক। আঁর কথা হুনি হো হো করি হাসি হালায়। হয়তো আঁরে পাগলি ভাবে। কত লোকই তো ভাবে আঁর এসব ভাবসাব দেখি। আঙ্গ বাড়ির হোলামাইয়ারা কয়, ‘ আঙ্গ জেঠি একটি হাগল, কেমন যেন ঘুরে থাকে।’
চরিত্রগুলা কেমন ছবির মতো যায় আর আসে। বড্ড সাধ হয় ওগো ঘরবাড়ি দেখি আসি। উইয়ের ঢিপিটা চোয়ের দেখা দেখি। সরযূ নদীর জল কেমন কলকল করি যায়, টলটলে জল, মন কাড়ি লয়। কবির এলেম ছিল আঙ্গ মনের কথা জানি হালাই চরচর করি লিখছে। আঁর উনি সুর করি করি আওড়ায় আর আই রসুই ঘর তুন হুনতি পাই এমন সোন্দর সোন্দর কথা, নাই বা মিলল আঁর রোজের কামকাজের লগে কিন্তু এমন এক গল্পের জম্ম দেয় মনের ভেতরে যা চেনবার লাই মন উচাটন হয়। কেন যে আঁই কোন উত্তর খুঁজি হাই না। শব্দরা অর্থ হই মনডারে জোরে জোরে ধাক্কা মারে। কোনদিকে যাইয়ুম কোনদিকে যাইতাম ন, বুঝি উঠতি হারি না, হাগল হাগল লাগে। তাই হইলেই বা কী আছে, শব্দের বাঁক কী অস্বীকার করতি হারি! আঁর উনি হড়ি যায় – অর্জুন কহিলেন:- কর্ম হ’তে জ্ঞান শ্রেয়ঃ হ’লে জনার্দন। তবে কেন ঘোর কর্মে করিছ প্রেরণ।। কেন হে ব্যামিশ্র বাক্যে কর মোহময়। দেখাও একটি পথ যাতে শ্রেয়ঃ হয় ।। হত্যেক শনিবার হইড়তে হইড়তে বইটার বাঁধন ছিঁড়ি ছত্রখান হই গেছে। তবুও কী আনন্দ যে হায়, বার বার করি হড়ে। অত কথার অর্থ তো আঁই বুঝি না, চেষ্টা চরিত্র করিও খেই হারায় হালায়। কিন্তু এ কতা না জানাইলে কেমন করি হয় যে আঁরে ভাবখানা খুবই টানে, অথচ কেউ তার মর্ম বুঝতেই হারে না। হোলামাইয়া আর ভাইয়ের ফোলা মাইয়ারে গোল করি লই বসি রামায়ণ আর মহাভারতের গল্প শোনায় আঁরে একবারের লই ডায়ে না বলি মনে মনে হুশি রাখছি মেলা ক্ষোভ, ভাইবলাম একদিন না একদিন উগড়াই দিমু, হিয়ের লাই তৈরিও কইরছিলাম নিজেরে। ওমা উনি আঁরে সেই সুযোগ দিলেন না। ডায়ি কয় ‘হোন তোঁর লগে আজ আঁর অনেক কথা আছে, বিয়ালে কোন কাজ রাইও না।’ হুনি তো ভয়ে বুক দূরু দুরু, কি জানি বাবা কি কয়, যা মেজাজ গরমের মানুষ, কোনো অন্যায় কাম করি ফালাইছি না তো! না হয় নিশ্চয়ই কোন গুঢ় কতার খোঁজ হাইছে, আঁর লগে ভাগাভাগি কইরত চায়। ওমা কে আর জাইনত এমন একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটাইব। সময় আর কাটতি চায় না, গোপন কতারও তো সময় গময় থাকে, তাই বলে সূর্যের আলো ডুবু ডুবু হইলে, এই আবার কিয়ের কতা! হ্যারিকেনের দশিখান হরিষ্কার করি কেরোসিন তেল ঢুকাই নিভু নিভু করি জ্বালাই রাইখলাম সামনের ঘরে। উনি কাঁচারি বাড়িতে বই মামলা মকদ্দমার মুসাবিদা করার হরে চার গ্ৰামের মক্বেলরা বিদায় লইলে খড়ম হায়ে ঠক ঠক কইরতে কইরতে ঘরের দিকে আয়ে। ‘ কয়, এতক্ষণ মক্বেলদের হড়াইছি, এবারে তোমারে হড়াইয়ুম।’ কী যে কন আঁই কবে তুন আমনের ছাত্রী হইলাম। ‘ আরে ছিলা না, হইবা। তোঁর কোনও আপত্তি আছে?’ এই অসময়ে আবার কে আইল? নিয়ামত আলির ছোট হোলা আনোয়ার। ‘জেঠি, মা কইছে দুই কেজি চাল উধার দিতে।’ এত ভর সন্ধ্যাবেলায় কেমনে দি, আইছস যখন ফিরাইতে তো হাইরতাম ন। যা তুই ঘর যা, আঁই পাঠাইবার বন্দোবস্ত করুম। ‘কীগো তোঁর হরের উপকার করা হইল ?’ কী যে কন! মানুষ হই মাইনষের কামে না লাগইলে এই জীবন লই কী করুম। ‘ আচ্ছা, তুমি এত কতা শিখলা কোথা তুন! এই আমনেগ মুয়ে হুনি হুনি। ‘তোঁর বুদ্ধির তারিফ করতি হয়। কতাখান কন্নাই তুন কন্নাই লই যাও।’ হক্বলটাই ভাগ্যের খেল, আঁই আর কী করি, কেউ আঁরে দি করাই লয়। ‘ ভারি সুন্দর কথা কইছ তো।’ আমনের ভাল লাইগছে? তাইলে আরো কথা কমু। ‘হোন তবে বিজ্ঞান-যোগের কতা। সহস্র নরের মধ্যে কোন ভাগ্যবান। আত্মজ্ঞান লভিবারে হ’ন যত্নবান।’ আহা এই জ্ঞান কোথা তুন পামু। ‘ তাইলে আরও দুইটা লাইন শোনাই। অসুখে পীড়িত যার অন্তরে কাতর। আত্মজ্ঞান-লাভে তার সাধ নিরন্তর।’ আঁর ইচ্ছা হইল ওনারে একটা পেন্নাম করি। ‘ আহা এই অসময়ে কেন পেন্নাম কর। এই লাইনগুলান আঁর নয়।’ আমনের মুয়ের তুন বার হইছে, এইটা কী কম কথা নি! ‘ কতাখান বড় কথা নয়, এর অর্থটাই বড় কথা। তুঁই কতটা রস নিতে হাইচ্ছ, এটাই হল আসল।’ আঙ্গ মতো বোকাসোকা মানুষ বুঝব এত জ্ঞানের কতা। আঁই হক্বলের আগে আঁর মনের কতা হুইনতাম চাই। যত রকমভাবে হুইনতাম চাই, হারি না তো, কত কিছু আই ধাক্বা মারে, চুরমার করে, তন আঁই হোলামাইয়ার মুখ দেই, আমনেরে দেই সামনে আই দাঁড়াই আছেন। গ্ৰামের মাইনষের মুখ দেই, কারা যে আত্মীয়, কারা যে অনাত্মীয় বুইঝতাম হারি না।
অন খালি ইচ্ছা হয় হক্বল মানুষেরে আপন করি লই,ওদের মনের কথা বুইঝবার চেষ্টা করি। হুরা দুনিয়াটা ওই মাইনষের মনের মধ্যে ঘুমাই আছে। কী আশ্চর্য কেউ তা জানে না। খালি খালি হাত কামড়ায়। শুধুই কী মানুষ, পশু পাখির লইও তো মন কাঁদে। এত কাঁদাকাটির শব্দ কেন যে বুকের মধ্যে বাজে, আমনেরা বিশ্বাস করেন আঁর অস্থির অস্থির লাগে। অন্য কনানে চলি যাইবার লাই মন চায়। এমন যদি হইত হক্বলের দুঃখ দূর করি দিতে হাইরতাম। শাউরি, দিদিশাউরিদের বাক্যি তো হেলাইতাম হারি না। এই সময় ভালা ভালা কথা চিন্তা করতি হয়। হোলাটা আরে অন জ্বালায় না, মার কষ্টটা খুব বুঝতে হারে। হারাক্ষণ খালি ঘুমাই থায়, এধার ওধার করে বটে, আঁধার তুন আলোর দিকে টানে। তাই কী মনের এত উদাস উদাস ভাব। ও আঁর মতো, না আঁই ওর মতো হই যাইয়ের, কে জানে। কিন্তু হরিবর্তন যে একটা হর এটা হাঁচা কথা। আঙ্গ বাড়িতে আঁর এক ননদ আইছে, বাজা বলি তাড়াই দিছে হৌর বাড়ি তুন। মনে বড় দুঃখ, সারাক্ষণ মন মরা হই থায়। আঁর গভ্ভের সন্তানের দিকে চাই থায়। কয়, ‘বৌদি তোঁর হেটেরটারে আঁরে দিবা, আঁই মানুষ করুম। তোঁর তো দুইটা আছে, আঁরে নয় একটা দিলা।’ আবদার কইরল বটে, মনে মনে একটা ভয়ও হইল। লোকে কয় না নজর লাগি যায়। মুয়ে হেথির কিছু আঁটকাল না। নিজের হেটটারে আরও বেশি করি জাইপটে ধইরলাম, আদর করি চুমু খাইলাম। মা’র মুখখানা ওর অনও দেখা হইল না। আঙ্গ অনেকগুলা জমিজমা আছে, ফসলাদি কিচ্ছু হয় না। হারা মাঠে হুধু ইঁদুরের গর্তে নিচের মাটি উপরে। হায় হায়রে আঁর ননদের এরকমই কষ্ট, কইত হারে না, ভেতরটা ছিঁড়ি যায়। কিন্তু আঁই তো এইটা কইতে হারলাম না তোরে দিমু। মাইনষের কত তো হরান কাঁদে, কইত হারে না মন খুলি, নাড়ি কাটি যাই, একবারের লই বিয়োগ হইলে আর যোগ হয় না। জমিগুলার দিকে আঁই চাই থাই, কিছু করতি হারি না, দু চার খান আলের ধারের তুন হিয়ালমুত্রা তুলি আনি মাঝে মাঝে। ননদেরে সান্ত্বনা দিতে যামু, অমনি কান্নার তোড় ভাসি আইয়ে। কী হইল রে বাপু, হঠাৎ করি এমন অঘটন! দাদা শৌউর কদ্দিন ধরি ছিল বিছানায়, সান্নিপাতিক হইছে, কিছু সব্বনাশ হই গেল কিনা কি জানি। ধনঞ্জয় ডাক্তার, সন্তোষ কবিরাজ মিলিই তো চিকিৎসা কইরছিল। পিত্ত বায়ু কফ তো সারবার নয়। কাঁদাকঁটির জোর বাড়ি গেল অল্পক্ষণের মধ্যে। শর্বরী আই খবর দিল চোখ উল্টাই হালাইছে। হক্বলে ওইদিকে হানেপ্রাণে ছুটি চলি গেল। কেন যে আঁর ব্যথাটা ঠিক এই সময়ে মাথা চাড়া দিই উইঠল কে জানে। আগে আগে বেটা বার হই আসতে চায়। গলা ফাটাই জানান দিলাম তোরা কে কোথায় আছস, দাইরে খবর দে। কী আশ্চর্য বেটা আমনে আমনে বার হই আইল, একটুক্ষণ সবুর কইরল না। আঁর শাউরি এত লোকের মধ্যেও বইলতে ছাড়ল না ‘আঁর শৌউর মরেনি গো, ফেরত আইছে, তোরা কাঁদাকাটি থামা, যায় ত ন, ভগবানের খেলটা দেখ।’
ভালা খবর মন্দ খবর দুইটা খবরের বোঝা মাথায় করি আঁর উনি ঘরে ফিরল। চোয়ে জল, ঠোঁট ফুলাই কাঁধে থলে ঝুলাই ঢুকিই দেইখল উঠান ঘিরি লোকে লোকারণ্য। আঁই বুইঝতে হাইরলাম না কোথায় হাসির ফুটকি ছিল কিনা, থাইকবার কতাও তো নয়। শুধু মুখে বইলল, ‘যাইবার সময় হলি কারও কি সাধ্য আছে, ধরি রাখতে পারে।’ বিকাল হলি দাহকার্য করি ঘরে ফিরল। তুলশিহাতা মুয়ে দিল, হুইরে যাই ডুব দিল, লোহা আর আগুন ছুঁইল। শাউরি কইল, ‘হোলার মুখখানা দেইখবি না, তুই কেমন বাপ রে।’ ‘ দেইখব না এই হোলার মুখ, এর লাই আঁর ঠাকুরদা চলি গেল, বাপ তো আগেই গেছে, আঁর মাথার উপর আর কেউ রইল না।’ ‘ তুই কস কীরে? আক্বেল নাই, কওনের আগে জিবে লাগাম তো দিবি। মাইনছি, তোর দুঃখ হইছে। দুদিনের হোলার ঘরে দোষ চাপাইলি, একটু উল্টা করি ভাইবলে বুঝতি পারবি, তোর ভাবনা ভুলে ভরা। এত জ্ঞানগম্মিয়ালা মানুষ তুই, তোর মুয়ে এমন কতা !’ ‘মন মেজাজ ভালা নাই মা, কী কইতে কী কই ফালাইছি, মাফ করি দিও।’ আঁর কতা হোন, তোর জানা কতা তবুও স্মরণ করাই ‘অহঙ্কার বিরহিত নিষ্কাম হৃদয়ে। কর্ম যদি হয় রাগ দ্বেষহীন হয়ে ।। ঠান্ডা মাথায় ভাব, জম্ম আর মরণ দুটাই আপন নিয়মে চলে, হিয়ানে কারো হাত নাই।’ কথাখান হুনি উনি খানিক মাথায় হাত দিই বসি হড়ে। আঁতুড়ঘরের দিকে হা বাড়ায়। হোলার ওঁয়া ওঁয়া কাঁদা হোনে। এ যেন সত্যির কাছে মাথা নোয়ানো, নিজের কাছে হিরি হিরি আসা। নিজের কথার লাই নিজেরই লজ্জ্বায় মুখটা লাল হই যায়। হোলামাইয়া আই বাবার কোলে চাপি বসে। শ্মশানের হোড়া কাঠ আর অস্তির চূর্ণ ইয়ান তুন অনেক দূরে। ধোঁয়া তনও কী গলগল করি ওঠে!
আঙ্গ দেশ, আঙ্গ ঘর, আঙ্গ মানুষ
ছাড়ি আবার যাইব কোন চুলায়
ধিকি ধিকি আগুন জ্বলা শুরু হই গেছিল এধার ওধার। কেউ খবর রাখের আর কেউ খবর রাখের না। কামকাজ হালাই কে আর কত মাথা ঘামায়। ঘামানোর দরকার তো আছে এ কতা কে আর অস্বীকার করের। দুনিয়াদারির যা হালচাল কে যে কোনমুই যাইব কইতে হারেন না। অভাব অনটনে মানুষজন দিশাহারা হই যা অবস্থা হইছে সামলে সুমইলে উঠইতে কত যে সময় হার হইব কে জানে। দিনদয়ালের মুখ চাই মাইনষে বাঁচি রইছে। চোখের দিকে চাওনি যায় না। ঝরঝর করি জল হড়ে। কার কাছে কইয়ুম, কে আর হোনে। তবুও লোক দেইখলে জিগাই এতদিন কনডাই আছিলা, ক্যমনে দিন কাডাইছ। কইত হারে না, কতাগাইন মুয়ের কাছে আই আটটি যাই। আঁই ভাবি এমনটা কেন হয়? ঘটনা গাইন সময়ে সময়ে হাল্টি হাল্টি যায়। কারা দায়ী এর লাগি। রাজিয়ার বাপ, ফাতেমার মা আঙ্গ উঠানে হিড়ি হাতি দিলে বয়। মনটা ওগলাই ওগলাই ওঠে। হেটের জ্বালা বড় জ্বালা। অন দেশ গাঁয়ের অবস্থা ভালা হইলে, আনাজপাতির দাম কইমলে আশা জাগে। এতদিন তো ঘরে দানাপানি ছিল না, দিনমজুরি ছিল না। আঙ্গ ঘরেও তো এমন বন্দোবস্ত ছিল না যে ওদের বাড়ি বাড়ি খাওয়ামু। আঁই মাথার উপর হাত রাখলেন হাত দুটি ধরি কয়, ‘দিদি গো, অভাবের সংসার, হোলামাইয়াগুনরে লই কেমনে যে বাঁচুম, ভাইবলে দুই চোয়ে ঘুম আয়ে না।’ এত মন্দার কালেও মাইনষের মধ্যে ভাব ভালোবাসার কমতি হয় নি। মনের টানটানি লই হিসাব কইষতে হয়নি, দোষারোপ করেনি কেউ কারোরে। এ হক্বলটা ঠিকই তো ছিল। ‘খোদার গজব লাইগলে কে কারে আগ্রায়, কন দেখি, আত্মীয়স্বজন বইলতে দূর সম্পর্কের খালা খালু, ফুফা ফুফু, ওরাও তো অভাব অনটনের জ্বালায় জ্বলি হুড়ি মরে। অন্যদের আশ্রয় দিব, তার জো আছে।’ কী আর কমু, জ্বলে পুড়ে মরি আর কি। চালের কোলার তুন থালায় করি এক সের খানেক চাল আইনল আঁচলে ধরি লয়। রাজিয়ার বাপের হাতে পাঁচটা ট্যাঁয়া দিয়া কইলাম বাজার তুন চাইল ফাইল কিনি খাইও, হোলামাইয়ারে পাঠাই দিও, গাছে গাছে লাউ কুমড়া ধইরছে, দিব একটা দুইটা। বেগুন, মাইরালা বাটা নিবা নি ফাতেমার মা। কাইন্দ না, দেশের হাল কিছুটা ফিরছে, তোঙ্গ দেখা কইছে এই অভাব থাইকত ন, সরকার নাকি ব্যবস্থা করের। এসকল তোঙ্গ জেঠার কাছেই হুনছি। সব নাকি ঠিক হইয়া যাইব গা, ফের হেট ভরি দু’বেলা খাইতে পরবা। ‘ সবই উপরওয়ালার ইচ্ছা।’ আচ্ছা, মনের মধ্যে কোনও খেদ রাইও না, আবার আগের মতো যাওয়া আসা কর। চাষবাস ঠিক মতো হইলে মনমেজাজ ঠিক হই যাইব। হক্বল সময় কি সমান চলে, কোন না। এই যে দেখইছ দিনের আলো, আর কিছুক্ষণ পরেই আঁধার নামি আইব। কোনঢার উপরে কি আঙ্গ হাত আছে, কও না। যাও ঘরে যাও, সাপখোপের যা উৎপাত, টুক করি ছোবল মারি দিব। খালের জল টইটম্বুর, বাঁশের সাঁকোটাও ল্যাকপ্যাক ল্যাকপ্যাক করে, সাবধানের মার নাই। ও একখান কথা কইতে ভুলি গেছি, মুরগি ডিম দিলে, দশ বারটা পাঠাই দিতে ভুলি মাগো না। ওই সুযোগে রাজিয়া আর ফাতেমার লগে দেখা হই যাইব, ওগোরে কদ্দিন হইল, দেই না। আকবরের বাপ হুনছি খোঁড়াই খোঁড়াই হাঁটে। হেতাগো ঘরবাড়িও তেমন আর মজবুত নাই হুনিয়ের, ভাঙ্গি ভাঙ্গি হড়ের। ‘কন তুন যে কী হই গেল। টানাটানির সংসারে কোনরকমে ডাইল ভাত খাই খাইখরচা হাই কাঢি গেছিল, খোদার গজব লাইগল, হক্বলকিছু ওলটপালট হই গেল।’ ভগবানের দোষ কেন দিতে আছ রাজিয়ার বাপ, এই যা কিছু আকাম কুকাম দেইখছ, বেগ্গাইন বেআক্বেল মাইনষের কাম। পিছা মারি ওদের খোয়ারে। ‘ আমনে ইয়ান হাঁচা কতা কইছেন। শতানের বাচ্চা ফজলের বাপ, আঙ্গ চুষি চুষি খার। গ্ৰামের মুরুব্বি সাজি বই রইছে, ঝোপ বুঝি কোপ মারে। দিব নি একদিন মাথা হাঢাই, তন বুইঝব ছোটলোকরা চেতি গেলে কেমন হয়। দুষ্ট গরুর চাই হূন্য গোয়াল ভালা। ওই বেটা নেমকহারাম, বুরবুক। পানিতে ডুবি যাচ্ছিল ওর হোলা, আঁই তো বাঁচাইছি।’ কি কও রাজিয়ার বাপ! ‘ আঁই কি আর সাধে কইয়ের। ভেতরে ভেতরে ঘোঁট পাকার। হুইনতেছি মৌলবি সাব আর হাজি মোতালেব মিঞার লগে যোগসাজশ করি হিন্দু মুসলমানের মধ্যে গন্ডগোল লাগাইবার ফন্দি আঁটতেছে। জম্ম ইস্তক আঙ্গ হাশাহাশি ঘর গেরস্তি। পুরা দেশে নাকি কানাকানি ফুসুর ফাসুর চইলতেছে ভাই ভাইয়ের কাম আর চইলতন, আরও যে কত কতা, কানে আঙ্গুল দেনের কাম।’ এসব কী হুইনতেছি রাজিয়ার বাপ! ‘ আমনেরা কিচ্ছু ভাবিয়েন না, আমরা আছি তো। আঙ্গ হরান থাইকতে কেউ আমনেগ টিকিটিও ছুঁইত হাইরত ন, এই কসম খাইলাম। ওই হালার বেটাদের আমরা দেইখা লমু। আমনেরা নিশ্চিত হই ঘুমান গিয়া। বকলম, মক্বায় তাই হাজি হইছে, মাইনষের দাম দিত জানে না। এই দেশটার কী হইল, ধম্ম ধম্ম করি সব মইরব। মুখে আগুন দিবার আর গোর দিবার লাগি কেউ রইত ন।’
ফিসফিসানি গুনগুনানি এত তাড়াতাড়ি যে ঘরে ঘরে চলি আইব তা আর কে জাইনত। লোকে ভাইবছিল হক্বলটাই কতার কতা। হায়রে জীবন কী খেলটাই না খেইলতে আছস আঙ্গ লগে। হুইনছি ইয়ানে দশ পুরুষের বাস। ইয়ানের মাটির লগে জীবন মিশি আছে, দিনরাইত ওঠাবসা। এই গাছগাছালি, পাখিদের কিচিরমিচির, ভরা বর্ষায় খালবিলের জলের কলকলানি নাড়ি ধরি টান মারে। বড় সুখদুঃখের ঘর, হোলামাইয়া লই সংসার। যত্ন আত্মীর খামতি তো নাই। রোজের কথা রোদে কই। কদ্দিন হইল বড় হোলাটা শহর তুন বাড়ি আইছে। হিয়ানে ইসকুলে হড়ে বাপের কাছে থাই। গ্ৰামে লেখাপড়ার তেমন ব্যবস্থা নাই। অঙ্কের মাষ্টার ভালা তো, বিজ্ঞানের ভালা ন, বাংলার মাষ্টার ভালা তো, ইংরাজির ভালা ন। হোলার মাথাটা ভালা, চট করি বুঝি হালায়, বাপের তদারকিতে যদি আর একটু আগাইত হারে, এই চিন্তায় গ্ৰাম ছাড়া। হিয়ান তুন কত কতা হুনি আইছে। ধমকাই দিলাম – আজারইগা কথা কইচ্ছা। হুদা কথা কান পাইততে নাই। হড়ালেখায় মন দে। ক্লাসে হক্বল বিষয়ে ভালা কইরলে না মাষ্টারমশাইরা সুনাম কইরব। আঁর হোলা কথাখান হুইনল বটে, মনটা যেন অন্য কথায় ঘুরঘুর করের। ‘মা এক দেশের মধ্যে দুইঢা দেশ থায়ে। এই কথার উত্তর আঁই দিবার লাই ভাববার আগেই আর একটা প্রশ্ন করি বইসল। আচ্ছা আমরা মন্দিরে কাঁসর ঘন্টা বাজাই, পূজা দিই ক্যান? বন্ধুরা মসজিদে আজান দেয়া ক্যান, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হড়ে ক্যান? উত্তরটা ভাইবতে চিন্তা করতি লাগে ন। যার যার ধর্ম তারা হালন করে। ‘ এত ধম্ম কেন গো?’
ভারি কঠিন প্রশ্ন আঁর হোলা করি বইসল, যার উত্তর আঁর কাছে জানা নাই, আঁরও খুঁইজত হইব। কি জানি এই প্রশ্নও ও আঁরে করছি পারে – ‘এত রকমের মানুষ কেন?’ এত প্রশ্ন ওর মাথায় আইল কেন! বিদ্যা যত শিখব, প্রশ্ন তত আইব। হোলাটা তো আর মাথা খাই ফালাইল। আঁই জানি না বিধায় ওরে কইলাম, তুই তোর কামে যা, বেশি হন্ডিতি ফলাইস না।
আঁই হত্যেকদিন দুপুরে স্নান সারি ঠাকুরের আসনের সামনে বই কৃষ্ণের ‘অষ্টোত্তর শতনাম’ পাঠ করি। আসন ভর্তি কত ঠাকুর – শ্রীচৈতন্য, জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা, লক্ষ্মী নারায়ণ, গোপাল, সরস্বতী, শিব, গণেশ, লোকনাথ বাবা, তিরুপতি, রামকৃষ্ণ সারদা মা, কুলগুরু রামঠাকুর আসন জুড়ে বসি আছে। হৌড়বাড়ি আইবার সময় দু’একটা দেবতাদের হানের টানে লইও আইছি। এর লাগি হৌড়ি কোন আপত্তি করে ন। গীতা, রামায়ণ মহাভারত ভাগবত ও আসনের এক কোনায় জায়গা হাইছে। আঁর হৌড়ি ধর্মপুস্তক গুলারে বড় যত্ন করি রাইখছে। এগুলা আঁর হৌর গয়ায় পিন্ডদান সারি হিরার সময় লই আইছে। হুইনছি দেড়-দুইমাস ধরি নৌকায় চড়ি তবে না হিতৃপুরুষের আত্মার মুক্তি করি আইছিল। গয়া কাশী মথুরা বৃন্দাবন সব তীর্থ করি পুণ্য লাভ করেছিল নাকি। গ্ৰামের লোকে কইছিল ‘অগস্ত্য যাত্রা’ যদি আর ফিরি না আসে। দশ গ্ৰামের লোক দেইখতে আইছিল। হোলামাইয়া বুড়াবুড়ি বউঝি কেউ কি বাদ গেছিল। সেই সব কি আজকের কতা! কবে মরি স্বগ্গে গেছে। বুড়াবুড়িদের ফটোতে রোজই মালা দি আর পেন্নাম করি যদি আশীর্বাদের ছিঁটেফোঁটা মেলে তবে তো ভবনদী আরামসে পার হইতে হারূম আর আঁইও রোজ ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাই যাতে বাপের বংশ, হৌরের বংশের সাত কুল উদ্ধার হই যায়। আমনেরা কইতে হারেন সাতকুল কেন, বাকি বংশরা বাদ হড়ি গেল কেন? আসলে এর বেশি বংশপঞ্জি আঁর সংগ্ৰহে নাই যে। হক্বলে জিগায়, ‘ জেঠি, আমনে এরম গরীবের মতো থায়েন ক্যান?’ আঁই মাটিতে তাই বটে, চাঁদ আঁর ঘরবাড়ি, তোমরা দেখতি পাও না, একদিন তোঙ্গরে আঁর রাজবাড়ি দেখাইয়ুম।
এত কথা তো কইলাম কিন্তু একটা কথা মনের মধ্যে খচখচ করে। এই দুনিয়াদারির ব্যাপারস্যাপার লই আঁর মধ্যে আঁর হোলার মতো নানা প্রশ্নরা আসি কিলবিল করে। কেন দরজা জানালাগুলান আমরা ফটাস করি খুলতি চাই না? বাধাটা যে কন্নাই বুইঝতি হারি না। আঁর মনটা যেন ক্যামনে হারি বসি থাই। নিজেরে নিজে জিগাই হর্দাটা সরাইব কোন জাদুবলে? আঁই নিজেও কী হারিয়েননি মন তুন সরাই দিতে দেবদেবীর মূর্তিগুলান যা আঁই এতকাল হুজা করি আইছি, মনে মনে ভাবিই চলছি আঁই হিন্দুর মাইয়া, হিন্দুর বৌ, হিন্দুর সোলার মা। আমনেরা বিশ্বাস করেন আঁর যন্তনা হয়, কষ্টে বুকটা হাডি যায় কিন্তু কন্নাই যাই! আঁই কি আঁর ঘরের আসনের দেবদেবীর ফালাই দি এমন কাউদের বসাইতে হারি তারা খালি মাইনষের জয়গান গাইছে। বুক চাপি ধরি চেঁচায় কইবার আঁর কী সাহস আছে ‘ও রাজিয়ার বাপ, ফাতেমার মা তোমরা খালের ওপারের আলাদা কেউ নয় গো, আঙ্গ লোক। ওরাও তো কই তো হাইরত ন, ‘আইও হক্বলে এক জায়গায় হাত ধরাধরি করি থাকি, তোমরা আঙ্গ ঘরে আইও, আমরা তোঙ্গ ঘরে যাই। ভালোবাসি তো কও, হরানঢা দি ভালোবাসি, আমনেগো দুঃখে আঙ্গ দুঃখ হয়, তাহলি কন চাই কার কাছ তুন এই উত্তর হাইয়ুম, কেউ দিতে ন।’ একটা সোজা কতা তো বুঝতামই হারি না যার লাগি এই হাডুডু খেলা আর দড়ি টানাটানি তার দরকার কিয়ের লাই। এমন পৃথিবীর তো আঙ্গ দরকার নাই। প্রশ্ন তো জাগে কারা জিই রাখতি চায় এইঢা? আঁধার রাখতেও আঁই বিছানায় বই বই উত্তর খুঁজি, মনঢারে ঝাঁকাই জোরে জোরে একটুকুও আলোর দেখা হাই না, শুধুই আঁধার আর আঁধার, আঁর মনের অনেক ভেতরে এই আঁধার লুকাই আছে, আঁই তো তাড়াইতে হারিয়েন না। হক্বলটাই ভাঙিচুরি হালাইত হইব, নিজের লাই একখান নতুন ঘর বানাইত হইব, একই ঢঙের নতুন ঘর বানাইতে হইব, জমিন থাইকব, গাছগাছালি থাইকব, একটাই বাড়ি থাইকব, একটাই দেশ, একটাই পিথিবী থাইকব, ধম্ম চুলোয় যাক, মানুষ থাক, শুধুই মানুষ থাক। স্বপনটা ভাঙ্গি চায়, দেখি এক চুলও কেউ সরে না, যে তার জায়গায় দাঁড়াই আছে, সাঁকোটা গেছে হুড়মুড় করি ভাঙ্গি, মেঘনার খালটা টইটম্বুর, এপার ওপার আসার কোন নামগন্ধও নাই, উপায়ও নাই।
মারি হালারনি, কে কারে মারি হালার! চুপ চুপ, চুপ থাক হক্বলে, হারা দেশে মারামারি কাঢাকাঢি লাগি বইছে, যে যার ঘরে ঢুকি যাও, ইষ্টনাম জপ কর।
রহমত হালের গরু লই মাঠের দিকে যাইবার আগে দাবনা দেয়। বুঝি হুনি কয়, না, নাবুঝি কয়, ‘কেয়ামতের দিন আইছে, আর কেউ বাঁচাইতে হাইরত ন।’ মাইনষের মরণ আইছে, এ সময়টা কে ঠিক করি দিল, মানুষই ঠিক কইরছে, তা হইলে আর কী, মরণকুয়ায় ঝাঁপ দাও। রক্তের নেশা চাপি বইছে, কেউ আর রক্ষা কইরব, কারও হাতে রামদা,কাতান, কারো হাতে ছুরি, ভোজালি, কারও হাতে হেঁসো, কোতল কইরত হাইরলে, গলা নামাই দিতে হারলেই ধম্মের বড়াই। কোন শহরে কার কত মইরছে ওই নি তো আঙ্গ মাথা ব্যথা নেই। চল যাই মা বোনদের ইজ্জত লুটি, মৌলভির কাছে লই চল, ধম্ম পাল্টাই ওগো মাইয়া বিয়া করুম,বাড়িঘর লুটি, দোয়ান লুটি, ওগোরে তাড়াই ছাড়ি পাকিস্তান গড়ুম, আহা কী সুখ কী সুখ, আঙ্গ ধম্মের নিজের একখানা দেশ হইব। দেখিব ওরা এই দেশে কেমনে থায়। ‘বুইঝলেন না জেঠি, রক্তের নেশায় ওরা উন্মাদ হই গেছে, কানাঘুষায় কত কতা হুইনতেছি, কিচ্ছু ভয় কইরবেন না। আমরা আছি তো।’ ধম্ম ধম্ম করি দেশের লোক উচ্ছন্নে যাইব। হুইনতেছি আঙ্গ বাড়ি তুন মাইল দশেক দূরে মাইয়াগুলারে ঘর তুন বার করি আনি ইজ্জত লুইটছে, বিয়া করি নাম হাইলাইটস দিছে। কী যে কইরত চায় কিছুই বুঝি না। কেউ কেউ ধান পাট ক্ষেতের আলু ধরি ধরি কোমর সমান জল ডিঙ্গাই রাইতের বেলায় আঙ্গ গ্ৰামে ফ্লাইং আইছে। শরিলের যা কাহিল অবস্থা আর চেয়ারা হইছে, না দেইখলে বিশ্বাস কইরতে হাইরত ন। আঙ্গ গ্ৰামের মোসলমান হাড়ার আনোয়ার ফজলুল জিয়াদ ওসমানরাই রাতদিন পালা করি হায়ারা দিছে। ‘আঙ্গ গ্ৰামে ঢুকি আমনেদের ছুঁই দেখুক না আল্লার কীরা আঙ্গ তুন খারাপ মানুষ হইতন কেউ। পাকিস্তান ইন্ডিয়া লই আঙ্গ কাম নাই। রক্ত ঝরাইতে আইলে কেউ ফেরত যাইত ন। এই দেশটা আমনেদেরও, রান কিয়ের লাই,কন্নাই আর যাইবেন।’ ওগো এত কথা হুনিও অনেকে বিশ্বাস কইরত হারেন ন। হক্বল ঘরের এগ্গা দুগা যুবক হোলাপাইন দেশ ছাড়নের লাগি হোটলাহুটলি বাঁধা আরম্ভ করি দিল। আঁই কইলাম কইলকাতা যাই খামু কি, থায়নের জায়গা হাইয়ুম কন্নাই। কেউ আঁর কথা বিশ্বাস কইরল, কেউ করে ন। ভরসা যে কইরব তেমন অবস্থা কি আর আছে? ওপারের তুন দিল্লী কইলকাতার বাবুরা আওনের পর গোলমাল কিছুদিনের লাই থাইমল বটে, ওরাও চলি গেল আঙ্গ অবস্থা যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরে হড়ি থাইকল।
পাকিস্তান হিন্দুস্তান কেন হইল, এর উত্তর আঁই দিতি হাইরতাইন, কারা দিতি হাইরব, হেইঢাও আঁই কইতাম হাইরতামন। তবে দিল্লির দরবার তুন কথাগাইন ভাইসতে ভাইসতে চলি আয় আঙ্গ দরজায় আই ধাক্বা মাইরল। ভাইবলাইম এ আবার কীয়ের দশা, শনির দশা! রাহু আই একদিন আঙ্গরে আসি গ্ৰাস করি হালার। শিক্ষিত বাবুরা কি একবারের লাইও খবর রার, এই পোড়াকপাইলা মাইনষের দিন কাইটছে ক্যামন করের, নেংটি ইঁদুরের মতো আমরা যে মরার ভয়ে এক কলসি যন্তন্না লই দিন গুজরান করিয়ের একবারও কি জিগাইছে আঙ্গ দেশ কোনঢা। দলে দলে লোক গা-গঞ্জ ছাড়ি হাঁঢি হাঁচি চলি মাইয়ের, গাড়িঘোড়া কপালে জুইটব কিনা কে জানে। হাঁসের তো হাঁঢের। মুফতি মাইয়াগুন টানি লই মাইয়ের রাস্তার মধ্যিখান তুন। হাত জোড় করি পায়ে পইড়লেও রেহায় হায়ের না, ওরা ছিঁড়ি ছিঁড়ি খাইব, খাইব। বেশি কথা কইলে কল্লা দুই ভাগ করি দিয়ের। তবুও কি থামের, দলে দলে লোক যার তো যার। বুক ভরি রোদন, নিজের জন্মভূমি ছাড়ি চলি যাইত হর চিরজীবনের লাগি। এমন দৃশ্য কী মানি লওন যায়! কেউ যাইবার আগে শেষবারের মতো বাড়ির সামনের বাস্তব গাছের গোড়ায় যাই মাথা ঠেকায়। বছরের পর বছর ধরি কত পূজা আচ্চা কইরছে, কত মানত কইরছে রোগের তুন ভালা থাওনের লাই, সুখে শান্তিতে থাওনের লাই, গোবরের জল ছিটাই লেপাপোছা কইরছে, কত বিয়াসাদি, পূজা আচ্চা হইছে এই বাড়িঘরের উঠানে, কত দাপাই দাপাই এই হুইরের জলে সাঁতার কাটছে। কেউ কী জানতে একদিন এমন দশা হইব, সাধের ঘরের মায়া কাটাই চলি যাইত হইব। হায়রে জীবন, তোরে লই এত লীলা খেলা। কেউ এর শোক সামলাইতে হারে ন। বুক হাসি গেলে এক মাইল দুই মাইল যাই হেরত আইছে। কাঁদি কাঁদি কয়, ‘মারি হালাক ওরা, তবু দেশ ছাড়ি কুথায়ও যাইতাম ন।’ হিরি আই ধানের গোলার কাছে আই কিছুক্ষণ দাঁড়াই থায়, দুই দিন আগের কাটা ধানের ছড়াগুলি জড়াই ধরে, গন্ধ শোঁকে। ঘরদুয়ার খানৈর কাছে আই বেবোর হই দাঁড়াই থায়, কিছুক্ষণ চুপ করি তাই ঝরঝর করি কাঁদি হালায়। ঘরটা যাইবার কালে উদোম রাখি চলি গেছিল। ছুটি আই দড়াম করি দরজাটা খুলি ঢুকতেই এক বুক নিঃশ্বাস যেন ঘরের ভেতরে ঢুকি গেল। হিমড়ারা লাইনদি চইয়েয় হায়ার হাশ দিই কেমন সুন্দর এপাশ তুন ওপাশ চলি গেল, যেন নিজের ঘর হামলার। যিয়ানে আমরা ভয়ে ভয়ে মরি ঘর ছাড়তি বাধ্য হই, এগো কোন ভয় বরং নাই। ওগো বোধ হয় কোন ধম্মের বালাই নেই তাই ওগো লেজ গুটাইয়া হালাইবার চিন্তাও নাই। যত মাথাব্যথা চুলওয়ালা মাথা, দাড়ি গোঁফওয়ালা মাইনষের। হেথাগো দল ভারি করা চাই, একটা ভেন্ন দেশ চাই, ভেন্ন ধম্ম চাই, উঁচুনিচু নিয়া লড়াই চাই, রাজা উজির চাই, জবরদস্ত সৈন্নসামন্ত চাই, তাহইলেও কী শান্তি আছে ! মইরবার হড়েও তো সুখের আস্তানা চাই। আঁই খালা ভাবি মরি, হিয়ানে যাই কী লই কাদের লগে যুদ্ধ কইরব। এত যে চাই, একবারও কী ভাবি দেইখছে এর পাওনাগণ্ডার হিসাব কইষব কে ?
আঁর ঘর ছাড়ি যাইতে কিছুতেই মন চাইল না। আঁর স্বামী রাতের অন্ধকারে লুকাই বাড়ি আইছে শহর তুন। বুকটা ধুকপুক করের যে আঁর বুঝতে দেরি লাগেনি ন। কী হইছে, এরকম করেন ক্যান? বইয়েন আগে, জল খাই ঠাণ্ডা হন। হোন, দেশকালের অবস্থাখান ভালা ন। শহর তুন অশ্রসশ্র লই উগ্ৰ ধর্মান্ধ লোকগুলা হুইনলাম গ্ৰামে ঢুইকব। কী কইরতাম কও। কারো হাত কাঢি ফালাইছে, রামদার এক কোপে ধড় নামাই দিছে। ‘হক্বলে ঘর বাড়ি ছাড়ি চলি গেলেও মিটার টানে হেরত চলি আইছে। আঁর যাইবার ইচ্ছা নাই। আঙ্গ মোসলমান হাড়ার যোয়ান হোলাদের এক দল আই কই গেছে, ‘আঙ্গ জান থাইকতে কেউ আমনেগো পাড়ায় ঢুইকত হাইরত ন। আমরাও দেখি নিমু, তেমন দরকার হইড়লে ঠ্যাং কাঢি হালাই দিমু। আঙ্গ আপদ বিপদে আমনেগ তুন কত সাহায্য হাইছি ছোট তুন, সে সকল কতা কী ভুলিতে পারি! আমরা হইলাম ঘরের লোক, ওরা বাইরের লোক, একবার ঢুকি দেখুক, তবে না বুইঝব।’ ‘আমনে আঁর উপর বিশ্বাস রায়েন, হক্বল কিছু ঠাণ্ডা হই যাইব, ফের শান্তি আইব, এরমভাবে চইলতে হারে নি কখনও! নদীর জোয়ার ভাটার মতো সময়টা হালটি যাইব। ‘ তোঁর মনে সূরা বল আছে। তুমি হইলা বাপের বেটি। সাধে নি তোমারে গ্ৰাম শুদ্ধ লোক মানে।’ এসকল কতা কই আমনে লজ্জ্বা দেন ক্যান, লোকে হুইনলে কী কইব। আমনে বরঞ্চ আইনের মানুষ। দূর দূর গ্ৰামের তুন আই আমনের পরামর্শ লয়। আমনে হইলেন চার পাঁচ মাইলের মধ্যে পড়ালেখা জানা লোক। ফাষ্ট ডিভিসনে তিনটা লেটার নিই পাশ, আঁই হলাম ক অক্ষর গোমাংস। আমনে আঁর প্রশংসা করেছেন। ‘কইরব না আবার, তোমার হাতের লেখা খান মুক্তার মতো ঝকঝকে, তোমার মতো বুদ্ধি করি ঘর সংসার সামলাইতে কয়জন জানে। এত ঢঙের এত রঙের কাঁথা সিলাই কর, ডিজাইন করা, চোখ হিরান রায় না।’ চুপ করেন চাই। এখন ভাবেন গ্ৰামের মানুষগুনেরে কেমনে বাঁচাইবেন।
হুইনতি হাইলাম দেশটা শেষমেশ দুইভাগ হইই গেল। লোকজন বলাবলি কইরল দেশ নাকি স্বাধীন হইছে। স্বাধীনতার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না। আসলে আমরা গ্ৰামের মানুষ, এইসবের আমরা কিইবা বুইঝব, এইসবের কি দরকার বুইঝতেই তো হারালাম না। কেউ কেউ আসি বইলল, দেশটার নামও কি পাল্টাই গেছে। দুই দেশ নাকি হইছে। ভারত আর পাকিস্তান। এই দেশের নাম নাকি পূর্ব পাকিস্তান। বড় আশ্চর্যের কতা। আর এক অংশের নাম হইল পশ্চিম পাকিস্তান। তাই হইলে তিনটা দেশ হইল, দুইটা দেশ হইল কেমন করি। আবার ওরা নাকি আমাদের শাসন কইরব। এইঢা কইরে সম্ভব হইল! মনের মধ্যে খচখচানি রইয়েই গেল। আঁর স্বামীর কথায় বুঝলাম আঙ্গ ছোট্ট মাথার কাম না এটা বোঝা, বড় বড় মাথাওয়ালা নেতারা রইছে না, ওদের মাথায় কত বুদ্ধি। একটা কথা কিছুতেই বুঝি উঠতি হাইরলাম না, আঙ্গ ভাগ্য ওরা ঠিক কইরব ওরা, অথচ একবারও আঙ্গরে জিগাইল না। ভাগটা আসলে কোথায় হইল! আঙ্গ তো সেই ঘর, সেই বাড়ি, সেই গ্ৰাম, আঙ্গ গ্ৰাম তুন দশ মাইল, কুড়ি মাইল, একশ, দুইশ, পাঁচশ, তাহইলে ভাগটা ঠিক কোন জায়গায় হইল! কোন গাছ, কোন রাস্তা, কোন জমিন, কোন নদী, কোন রেললাইন, আঁই কী পাগল হই গেছি না কী অন্যরা? একবার সুযোগ হাইলে জিগাইতাম এই ভাগের কী কোন দরকার ছিল? লোকজনের এত উল্লাশই বা কিয়ের লাগি? এত পুলক জাইগল কেন? হিন্দুরা বেশি করে হিন্দু হইছে, আর মুসলমানরা বেশি করি মুসলমান হইছে, এই আনন্দে ? আঁর কয়দিন ধরে মনে হতি লাগিল, মানুষ তো আগে ছিল কাছাকাছি, অমানুষ হইছে বলে দূরে চলি গেল! তাইলে বোধহয় এটাই এখনকার বুদ্ধিমান মাইনষের ধর্ম! তাই হইব হয়তো! বর্বর হওয়াও একটা ধর্ম, না হ গলে দেশটা এমন করি ভাগ হয়! আঁই তো মূর্খ মাইয়া, মনে হইল, দেশটি ভাঙ্গি আরও টুকরো টাকলা হইব। অত দূর তুন কোনদিন দেশ চালানো যায়! আঁর স্বামী কুড়ি পঁচিশ মাইল দূরে শহরে রায়, তাইতেই আঁর কেমন খালি খালি লাগের, সংসারটা আরও কাছাকাছি থাইকলে কী ভালাই না লাগত, ঠিকঠাক চইলত আর কি।
কারে কয় স্বাধীন, মাইনষে হয় হরাধীন
বাঙালি আর কই, হিন্দু আর মুসলমান
দু’চোখ যদ্দুর যায়, হিন্দুস্তান আর পাকিস্তান
আমনেগো দু’চোখে জল হড়ে নি, আঁর চোখ দিই হড়ে। না, আঁই যাই ন, শত চেষ্টাতেও যাওনের লাই মন চায় ন। আঁই জানি না, এর জন্য কে দায়ী, কে ষড়যন্ত্র কইরছে, তবে এইটা জানি মাইনষে মাইনষে এই ভাগ মন তুন মানন যায় না, কিছুতেই মানন যায় না। দেশের লোকেদের লাই কি আমনেদের মনে একটুকু মায়া দয়া নাই, খালি হিন্দু মুসলমান দেইখলেন, আর কিছু দেয়েন ন। এখন যন দেয়ন ন, আর কোনোকালেও দেইখতেন ন। আঁই কই যাইয়ের, চাই চাই দেইখবেন, দেশটা এই ভাগাভাগির লাই একদিন রসাতলে যাইব। আমনেরা কি মনের দরজায় খিল দিই রাইখছেন, ধম্মের জন্য লড়াই করি মইরতে চান যন মরেন, কে আমনেদের বাঁচাইব, কেউ বাঁচাইতে আইত না। যাঁদের আমনেরা আপন ভাইবছেন, খোঁজ করি দেহেন, ওরা অনেক দূরের মানুষ, নিজেদের আখের গুছাইতে ভাই ভাই সাইজছে। মন তুন ভাগ হইতে দিয়েন না ভাই, অনও সময় আছে। আঙ্গ দেশের নাম তো এয়ন পূর্ব পাকিস্তান, হুইনলাম মহাত্মা গান্ধীরে কারা গুলি মারি হত্যা কইরছে, আঙ্গ জাতির পিতা জিন্নাহ আর হেতাগো জাতির পিতা মোহনচাঁদ করমচাঁদ গান্ধী। এই মানুষটাই তো বছর দুই আগে দাঙ্গা থামানোর লাই ইয়ানের আইছিল, দুই ধম্মের লোকদের এক হওয়ার মন্তর দিছিল। এমন নিঠুর হইতে হারাল ওরা। আমনেরা হয়তো কইবেন অন্য দেশের মাইনষের লাই আঁর এত দরদ কেন? এত চট করি হর করি দন যায় না যে। ভাইবলে কেমন লাগে না, ধরেন বছর দুই আগে আমনের হোলার এন্তেকাল হইছে, হাইরবেন মন তুন মুছি ফেলতে, হাইরতেন ন ত, ভালা মাইনষের লাই এমনটাই হয়। বিধির বিধান আঁর দেওরের যুবতী মাইয়াটার অসুখ নাই, বিসুখ নাই, মরার কথাও ছিল না, কিন্তু মরি গেল, কার উপর দোষ চাপাইয়ুম, ভাগ্যের উপর ছাড়ি দন ছাড়া উপায় আছে নি। জীবনটা তো অকালে চলি গেল। জলজ্যান্ত মাইয়া, হাসি খেলি এঘর ওঘর করি হুরা বাড়ির কোনায় কোনায় ঘুরি বেড়াইত। দাঙ্গার সময়, দেশভাগের সময় আগলাই আগলাই রাইখছি, শেষরক্ষা করতি হাইরলাম না। হক্বলে ভাগ্যের দোহাই দিল। এইভাবেই কি ভাগ্যের উপর সবকিছু উপর ছাড়ি দেওয়া যায়, না দেওয়া উচিত। আমরা তো ঠিক সময়ে চিকিৎসা করাইতে হারি ন, আগেই হয়তো রোগটা বাসা বাঁধি ছিল, আমরা বুঝতামই হারি ন, দেরি করি ফালাইছি। যন মরা শরীলটারে আত্মীয়রা মিলি কাঁধে করি লই যার, তন বুঝলাম হারানের জ্বালা কী ! আরও বুইঝলাম, যন মরা শরীরটা কাঠের আগুনে ঘিয়ের গন্ধে দাউ দাউ করে জ্বলের, জ্বালাটা আরও দ্বিগুন বাড়ি গেল, আর ত কোনোদিন হিরি হাইতাম ন। আঁর মনে তনই আর একটা কষ্ট আই জোরে জোরেই ধাক্বা মাইরল, আর তো পুরাতন দেশটা কোনোদিন হেরত আইত ন, নতুন একটা দেশ আইয়ের ঘাড়ে চাপি বইছে, এর চেহারা সুরত কী হইব আঁই কিচ্ছু জানি না। আচ্ছা যদি এরকমই কোন জাদুকর আই আঙ্গ গ্ৰামটারে কোনোদিন হালটি দিই চলি যাই তন আঙ্গ কী অবস্থা হইব।
আঙ্গ বাড়ির আঠারো ঊনিশ বছরের দু’তিন জন যুবক হোলাপাইন ভ্যাবাচ্যাকা খাই ঠিক করি হালাইল কইলকাতায় চলি যাইব, এইদেশে আর থাইকত ন, ওগো মনে এমন চিন্তা ঢুইকল যেন নিজেদের দেশে হরবাসী। বাড়ি বাড়ি ঘুরি ঘুরি কারা যেন একতারা বাজাই গান করে ‘ওরে আর রইত ন সোনার বাংলা, পালা পালা ওপারে পালা, চন্দ্র সূর্যের গ্ৰহণ লাইগছে, হিন্দু মুসলমান দুভাগ হইছে। আর তো বাঁচার উপায় নাই, না হয় কলমা হড়ি জাত খোয়াই। এসব কথা হুনি সঙ্গে মুড়ি চিড়ার হোটলা বাঁধি, দুই চাইরখান জামাকাপড় টিনের ট্রাঙ্কে লই ঘরে ট্যাঁয়া মা ছিল প্যান্টের পকেটে হুরি ওরা রাতের অন্ধকারে লুকাই দেশ ছাড়ে। হতে হতে বিপদ, কে কন ঘাপটি মারি বসি আছে, কন যে চোলাই লই যাইব কে জানে। মনে মনে ভাবে একবার যদি কোনরকমে ওদেশে যাই হৌঁছতে একবার হারি, হরে হরে বাবা মা ভাই বইনদের লই যামু। জমিজমা ঘরবাড়ি হড়ি থাক, হরানে বাঁচলে তো বাপের নাম। মনটা দুকুর দুকুর করের, কিছু করার তো নাই। দিনকাল যা হইড়ছে, চারদিকে খালি অবিশ্বাস, শুধুই হরষ্পরে ঘেন্নাপিত্তা, জানে মারি হালাইলে শান্তি, হিন্দূর মাইয়া ঘরে তুইলতে হারলে তো আরও শান্তি, এমন একটা হরিবেশে কতকাল বাস করা যায়! চলি যাইতে হারলেই হরানটাও বাঁইচব, ধম্মও বাঁইচব। আঙ্গ গ্ৰামে এত হিংসাহিংসি হুরু হয়নি, চারইধারের ঘটনা যা কানে আইয়ের, ইয়ানে আইতে কতক্ষণ, ছোঁয়াচে রোগের মতো বাতাসে ছড়ার, আজ একটা, কাল একটা, এরকম করি তো বাড়ের, থামার কোন জো নাই। উলটা কথাও হুনিয়ের। ওইদেশ তুন মোসলমানরাও চলি আইয়ের এই দেশে জমিজমা হালটাহালটি করি। কারে মে কী কমু, কে যে আত্মীয় আর কে যে অনাত্মীয়, কে যে শত্রু, কে রে মিত্র, বুঝতাম হারি না। মুসলমানরা ভাইবছে পাকিস্তানে আই জাতভাইদের হঙ্গে গলাগলি করি আরামে থাইকব, যা যা চাই বাঁচতি গেলে সব পাইব। আর হিন্দুরা ভাইবছে হিন্দুস্তানে গেলে সুখই সুখ। আবার নিজের দেশ ছাড়ি যাইবার যন্তন্নাও ষোল আনা, কিন্তু থাকিত না ডার্লিং কী আর কইরব, অসহায় এক অবস্থা দুপক্ষেরই। আঁর একটা প্রশ্ন আইয়ের মনে মনে দেশভাগের কষ্টটা কী খালি এইপার ওইপারের বাঙলা কথা কওয়া হিন্দু মুসলমানের, আর কারও না, খেসারত কি খালি এগোরই দিতে অর! এত বড় দেশ যে ছিল, হক্বলে কী আরামসে আছে। হুইনতেছি আঁর স্বামীর কাছ তুন পাঞ্জাবেও খুনোখুনি রক্তারক্তি করি দূর্দশার অন্ত নাই। বুইঝলাম, এই দেশের লোকেদের কপালে শান্তি নাই, লাফালাফি ঝাপাঝাপিই সার। কে কত বড় হিন্দু হইব, কে কত বড় মুসলমান হইব এসব নিয়াই মজি থাই হারাদিন। মাথার উপরে চাল নাই, হেঢের ভাতের জোগাড় কেমনে হইব, সে চিন্তা নাই, জ্বর জারির, কলেরা, বসন্তের ঔষধের আকাল চারদিকে, ডাক্তার বদ্যি নাই পাকিস্তান পাকিস্তান করি মাথা খাই হালার। আরে বাবা হিন্দু তাড়াইলে তো রাতারাতি সব সুখ আই চুঁইয়ে চুঁইয়ে হইড়ত ন। কী আমনেরা কন চাই হইড়ব নি? গরুর মাংস আর কাছিমের মাংস খাওন লই কত অশান্তি। এত তো গলা ফাটায়, কই কারও মুয়ে তো রবিঠাকুর আর নজরুলের কবিতার একটা লাইন বইলতে হুনি না। এরা কী সব হুদা হুদা লিখি গেছে। উলুবনে মুক্তা ছড়াই লাভ আছে নি, কন না।
আস্তে আস্তে একজন দুজন করি দেশ ছাইড়তে আরম্ভ করিল। আঁর এক দেওরও চলি যাইব ঠিক কইরল। কইল, ‘বড়বৌদি, আমনের বড় হোলারে আঁর লগে দিবেন নি।’ ভাইবলাম এত ছোট্ট হোলাঢারে ক্যামনে এত দূরদেশে পাঠাই। আঁর দেওর সরকারি কর্মচারী। চাকরি হাইলটায় এদেশ তুন ভারতে যাওনের সুযোগ আছে। কয়দিন ধরে ভাইবলাম, মনঢারে শক্ত কইরলাম। পোলারে জিগাইলাম, বাবুলের কাকার লগে যাইবি নি ভারতে? কিছুক্ষণ চিন্তা করি কইল, ‘যামু কিন্তু ওইদেশে কিয়ের লাই যামু?’ কত কিছু দেওনের আছে কইলকাতায়। চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আরও কত কী, আঁই যা হুইনছি, তাই কই, সব কী আঁই জানি। কইলকাতা নাকি অনেক বড্ডা শহর, বড্ডা বড্ডা দালানকোঠা, তাক লাগি যায়, চোখ হিরান যায় না। রাস্তার উপর দি ট্রাম যায়, ঘোড়ার গাড়ি ঠক ঠক করি ছোটে। তোর বাবা তো ওই শহরে আইন পড়ত। অন না হয় ওইটা ভেন্ন দেশ হইছে। ‘ক্যান হইছে?’ তুই অন বুইঝতি ন, বড় হইলে বুঝবি। তুই তোর বাবারে জিগাইস্, ভালা করি বুঝাই কইব, আঁই কি এত সব বুঝি। হোলার চোয়ে যেন স্বপ্নের ঘোরে লাইগল। ওর মন হিরাইবার লাই কতগাইন বানাই বানাইও কইলাম, হাঁচামিছা মিলাই মিলাই। দুনিয়ার লোক কয় এমন শহর আর নাকি নাই, মাইনষে কাঁদে, মাইনষে হাসে, কত কাম, কত চিল্লাচিল্লি, কত নাকি মাঠ ময়দান, খেলকুদের বিরাম নাই, কত যে পাগলামি কত যে মান অভিমান, খুনখারাবি দাঙ্গা হাঙ্গামা এসবের কতা যত কইয়ুম, শোকে দুঃখে হরান হাঁঢি যাই। মাইনষের ঢল রাস্তাঘাটে, ল্যাঙরা খোঁড়া কমতি নাই। তুই অনও ছোঢা হোলা, হক্বল কতার অর্থ বুইঝতিন, নিজের চোয়ে দেখগে যা। তোরে কী কুইয়ুম, নিজের চোয়ে তো দেই ন কিছু, এই সবই যা হোনাইলাম, সবই তোর বাবার চোখ দিই দেয়া। তাহইলে বোঝ নিজে দেখালি কত কিছু জানতি বুইঝতি হারবি। ‘ তাহলি আঁই যাইয়ুম, আঁর নতুন নতুন দেশ দেখইতে খুব ভাল লাগে।’ আঙ্গ লাই তোর কষ্ট হইত ন। বাড়ি ছাড়ি থাইকতি হারবি তো। ‘আচ্ছা মা মুসলমানরা হিন্দুর হোলাদের মালাওনের বাচ্চা কয় ক্যান?’ আমরাও তো কম যাই না, ওগোরে কত কতা কই। মুসলমান বলি ঘরে ঢুকতি দিই না। ভালোবাসার কথা উঠলি কই না, মোছলমানের মুরগি পোষা। আরও অনেক ঘেন্নার এমন কতা দুই সম্প্রদায়ের লোকেরা হরষ্পরেরে কয়। এরকম কেন কয় আঁই তোরে কইতে পারি। দোনো সম্ম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু লোক আছে, যারা উস্কানি দেয়, তাতায়, যার যিয়ানে জোর বেশি, হিয়ানে ওরা অন্যেরে দাবায় রাখতি চায়। আমরা হিন্দুরা এইদেশে কম, তাই আঙ্গরে তাড়াইতে হাইরলে সম্পত্তি দখল কইরতে, বাড়িঘর কব্জা কইরতে সুবিধা হইব। ‘মালাওন শব্দের অর্থ কী?’ ঈশ্বরের করুণার তুন বঞ্চিত। এইটা এমন খারাপ শব্দ নয় কিন্তু কে কখন কী উদ্দেশ্য নি কয়, কীভাবে কয়,কেন নয়, কারে কয়, ভালোবাসি কয়, না ঘেন্না করি কয়, না খোঁচা দিই কয়, হের উপর খারাপ ভালা বোঝা যায়। ‘মা, খালের ধারের গ্ৰামের লোকেরা মোসলমান কেন হইছে, আঙ্গ গ্ৰামের লোকেরা ক্যান হিন্দু, ওরা মসজিদে নামাজ হড়ে ক্যান, আর আমরা ক্যান মন্দিরে হুজা করি, মোসলমানরা আল্লাহ কেন কয় আর আমরা ঈশ্বর ঈশ্বর করি? কিন্তু আঙ্গ চেহারাগুন তো এক? কাজি কেন আঙ্গ বিয়াসাদি দেয় না, পুরোহিত কেন ওগো বিয়া দেয় না।’ আঙ্গ নিয়ম আচার আঁর ওনাগো নিয়ম আচার ভেন্ন তাই। ‘আঁর ইসকুলের বন্ধু বেল্লাল কেন আঙ্গ ঘরে আইয়ে না? আঁর নাম কেন ফারুক হয় না, ওগো নাম কেন সুবোধ হয় না? ইয়েল লাই কী ওরা আঙ্গরে তাড়াইতে চায়? ক্যান তাড়াইব? আঙ্গ বাপ ঠাকুরদাদা তো এইদেশের মানুষ, বছরের পর বছর ধরি এই গ্ৰামে বাস, আর কত বছর বাস কইরলে এমন করি যাইবার কথা উইটত ন। মা, আমনে কইলেন কালেমা হড়াই আঙ্গরে জোর করি মুসলমান করি হালায় ওরা। আচ্ছা, এইঢা কন চাই কি হইড়লে মানুষ হওন যায়, কই এই কতা খান তো ইসকুলে শিখায় না ?’ চুপ, চুপ থাক, এইসব কথা জোরে জোরে কইতে নাই। তোর এত এত হশ্নের উত্তর তো আঁই জানি না, ক্যমনে দিমু। আর আঁই তো কনও তোর মতো করি ভাবিন। ‘ তাইলে কারে জিগাইমু কও?’ তুই ওইদেশে যাই কবি নজরুল ইসলামের কাছে চলি যাইস, উনি এসব কথার উত্তর জানে। কইলকাতায় থায়, উনিই ঠিকঠাক কইত হাইরব।
আঁর হোলাঢা কেন যে মন মরা হই আছে কদ্দিন ধরি। দেশ ছাইড়বার কথা হোনার হর তুন কাঁদি কাঁদি বুক ভাসায়। ছোট্ট হোলার কচি মন, ক্যামনে ছাড়ি যাইব মা বাবা ভাই বোনদের। মনটা তো খারাপ হইবার কতা। কইলাম, যা তো যা, রওশন চাচির ঘর তুন ঘুরি আয়। চাচিদের কইস, ‘মা পাঠাইছে পাঁচটা হাসের ডিম আর পাঁচটা মুরগির ডিম দিবার লাই।’ দেখবি তোরে দেই চাচি খুশি হই যাইব। আঁর হোলারে হিড়িতে বইসত দিল, ভালামন্দের কথা জিগাইল। ঘুরি আই কইল, ” মা, চাচিদের ঘর দেইখলাম, খড়ের চালে হুঁই শাকের ডাল ভরতি হই আছে, সবুজ, লাল রঙের দানা, চালটা দেয়ন যায় না। গোবর দিই লেপা হর্মূলের বেড়া। চালের উপরে ঘরের কোনায় ঢেউয়া গাছ। চাঁচি আঁরে তিনটা ঢেউয়া দিছে। সজনা গাছের তুন হাড়ি সজনা দিই কইছে, ‘বাবুরে, তোর মারে দিস, মারে কইস নতুন ডালের সজনা, খাইতে স্বাদ লাইগব। তোর মা ভালা আছেনি, জ্বর হইছিল হুইনছিলাম। আঁর ছোট হোলা জামালের হাত দিই তিলের নাড়ু হাঠাইছিল, খাইতে কী ভালাটাই না লাইগছে। আঁই চলি আইত চাইলে কয়, আর একটু বয়।’ মোরগ আর মুরগী ঘরের চারদিকে ঘুরঘুর করের। আঁরে দেই যেন জোরে ডাকের কোঁকর কোঁ কোঁ। ঘরের মধ্যে একখানা মাচা দেইখলাম, সুয়ারি গাছ কাঢি কাঢি বানাইছে। আলমরা বই বই কী যেন হড়ের। চাচি ঢুল্লার শাকের গাছ রুইছে হেতাগো ঘরের হাশে। ছোট একটা হানাহুকুর, ডুবাই ডুবাই মাছ ধরের। ছাগলগুনরে বাঁধি রাখছে খুঁটিতে, ঘাস চিবার। দূরে দুইচারখান ঘর, আঁরে দেই মাইয়ারা দিদিরা ঘরের দরজায় খাড়াই রই বিড়বিড় করের। আঁর নজ্জা লাগি গেছে। ট্যাঁয়াগুন চাচির হাতে দিই আঁই দৌড়াই চলি আইছি।’ তুই তো এমনিতে নাজুক, আর অচেনা লোক দেইখলে তো আর মুয়ে দিই রা বার হয় না। মনে নাই বর্ষাকালে জিপসিরা বজরায় চড়ি আঙ্গ গ্ৰামে জড়িবুটি, চুড়ি হার বেইচত আইছিল, যেই না হুইনছস ওরা ধরি লই যায়, তুই তো চইয়ের নিচে হলাস, হাসির ঢল নামে তন, কত খেলনার লোভ দেখাইল, তাতেও কী তোর দেখা হায়। ক্যামনে যে তোরে দূরদেশে হাডাই, মনটা খচখচ করে।
আঁর হৌরি আগে তুন বাঁকি বইসছে কিছুতেই হাডাইত ন হেথেরে। বড় নাতি, হেথেনের নেওটা কিনা। দেশঘরের যা অবস্থা ভরসা হাই না, কন দাঙ্গাবাজরা গ্ৰামে ঢুকি আই মারি হালায়, একটা হোলারে তো আগে বাঁচাই। হেথেনেরে অনেক বুঝাইলাম কিছুতেই বুঝ মানতি চায় না। হেথেনের তো কোনও দোষ নাই, কোনোদিন তো ঘরের বার হয় ন, বড় জোর নৌকায় করি বোনের বাড়ি গেছে, মা বাপ তো হেই কোন কালে ধরাধাম ছাড়ি গেছে, তার কী কোনো হিসাব আছে। আর অন তো বয়স হইছে বলে হুইরেও চান কইরতে যায় না। বড় জোর কন ধান উইঠল, ধান মাড়ানি হইল সেদ্ধ হইল, উঠানে মেলি হুয়াইল, গোলায় উইঠল এই হর্যন্তই ওনার জগত। সকালে বিয়ালে হরিনামের মালা লই দিন কাটে। বৌগরে বকাঝকা কইরলেও ভালোবাসে না এডা ক্যামনে কই। শরীল খারাপ হইলে টোটকা জানে বিধায় জ্বরজারি সারারাত জানে। আঁইও ওনার কাছ তুন কিছু কিছু শিখছি। বাকিটা ম্যাটেরিয়া মেডিকার হাতা উলটাই উলটাই রপ্ত কইরছি। আঁর স্বামী শহর তুন এক বাক্স হ্যানিম্যানের ঔষধ আনি দিছে, কত মাইনষের কত কামে লাগে, ডাক্তার বদ্যি কবিরাজ কী চাইলেই মিলে, তন আঁই ডাক্তার, আঁই বদ্যি। আঁর জায়েদের কত কইছি, একটু আধটু শিখি টিখি নে, গায়ে লয় না কথাখান, যেদিন আঁই বিছানায় হইড়ব, হেদিন টের হাইব। আঁর হোলা আই আঁর গলা ধরি কই, ‘ মা আমনেগো ছাড়ি আঁই ক্যামনে থামু, আঁর যে হড়ান হোলে।’ আঁর কথা হোন, পুরুষ মাইনষের মন এত নরম হইলে চলে নি। জীবন বড় কঠিনরে বাপ, পদে পদে হোঁচট খাওনের সম্ভাবনা, তোর বাপেরে দেয়স না, কত কষ্ট করি রোজগারপাতি করি ভাইদের লগে লই এত বড় সংসার চালার, কত ছোট্ট বেলায় বাপ মারা গেছে, তন তুন সংসারের জোয়াল কাঁধে লইছে। সরকারের তুন কত সুযোগ হাইছিল বিনা খরচে আরও হড়নের লাই, যায় ন, নয়লে হক্বলে কন্নাই ভাসি যাইত। তোর ঠারদার কথা হুনবি, তবে হোন। ওই যে আঙ্গ বড় বাড়ি তোর দাদু সংসার বড় হই মাওয়ায় এই বাড়ি বানাইছে, তওনের দিনে পাঁচ হাজার ট্যাঁয়া খরচা হইছে, যন চালের মন ছিল তিন চার ট্যাঁয়া। তা হইলে ভাবি দেখ কোথা তুন কোথায় আইছে। বুঝতি হারলি তো, মনঢারে এমন করি শক্ত করতি হইব শত ঝড় তুফানেও আঙ্গ বাড়ির দরজায় তাল গাছের মতো উপড়াই হালাইত না হারে। শ বছরের তালগাছ, এখনও ফল দিই যার, কুটুস করি তাল হড়ে, কী মিঠা তাল, হক্বলে কুড়াই কুড়াই খায়। খেজুর গাছ দেয়ছ না, ফল দেয়, রস দেয়, কারও কাছে কিছু চায়নি, অভিযোগও করে নি, অথচ আঙ্গ মাইনষেরে দেখ কিছু না দিই, চাইতে থাকে, খালি চাই খালি চাই, শুধু খানা চাইলেও হেট ভরে না, মাইনষের রক্ত চাই। শুধু ধম্মের ছাতার নিচে থাকলে চইলত না, কে বড়, কে কতছোট এরও প্রমাণ চাই, প্রমাণের জন্য বড় জায়গা চাই, আলাদা দেশ চাই, তবে না শান্তি। কে দোষ করে, আর কে শাস্তি পায়, এর বিচার কইরব কে ? কাল যদি কোনোদিন এর বিচার করে, তবে হেদিন মাইনষের কাছে মাইনষে কৈফিয়ৎ দাবী কইরতে হাইরব।
দেশ ছাইরবার আগে একবার হোলাঢা পাগলের মতো এবাড়ি ওবাড়ি করে। দুঃখের কথা কারে কইব বুইঝত হারেন না। মনের কষ্ট মনে চাপি ক্ষেতের আল ধরি হাঁটে, খালের ধারে যাই দেয় পাল তোলা নৌকা তরতর করি চলি যার দূরগ্ৰামে। খেলার দোসরদের লাই এত যে টান কোনোদিন চিন্তাও তো করে ন। যাওনের কথা মনে হলেই ভাবে ওরা কত না আপন। কত ভাব, কত কল্পনা আই গুনগুন করে। বিয়াল হইলে হুইরে ছিপ হালায়। কি জানি বিদেশে হুইর আছে না নাই। বাইলা মাছ, মেনি মাছ, কৈ মাছ হুইরে খলবলাই উঠে, হিয়ানে দেইব নি। ইয়ানে কত আম জাম লিচু বাগান, হাইঙ্গল, গাছে গাছে মুচি, বেতইন, ডেউয়া, গুলাবজাম। কত সুঘ্রাণ। গাছে উঢি বই থায়, পা দোলায় আর টুক করি জলে ঝাঁপ মারে। কথা কইত চায় না বিশেষ। আঁই যদি জিগাই কীরে কথা কস না ক্যান, মুয়ে তালাচাবি মারি রাইখছস কীয়ের লাই? জবাব না দিই ঘাড় ঘুরাই চলি যাই। হোলার মনডারে তো আঁই বুঝি। কীইবা কইতাম, কওনের তো কিছু নাই। তবুও কইলাম, চিরকাল কী কেউ এক জায়গায় থায়, বড় হইলে মা বাপ ছাড়ি, গ্ৰাম ছাড়ি রাইতেই হয়। দেয়ছ না, আর কত হোলারা চলি যার। আঁই যে এই কতাখান কইছি, বুকে হাথর চাপা দিই কইছি, পোলারে হে কথা কেমনে বুঝাইয়ুম। ও ভাইবছে মা কত নিষ্ঠুর, মন বলি কিছু নাই, আসলে তো ওর ভাবগতিক আঁই সব বুঝি। আঁর হৌরি আই কয় তুই হোলাডারে যাইতে দিস নারে বউ। মইরলে হক্বলে একলগেই মরুম। যাইবার দিন মত আগাই আইয়ের আঁর নিজের মনগড়া আনচান করের। মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে হোলাডারে জড়াই ধরি কাঁদি। শীতের মধ্যে কাঁথাখান টানি দি মনে মনে কয়, হোলারে জীবনটা এমনি হয়, হক্বলরে ছাড়ি যাতি হয় ঘর ছাড়ি জগতের অন্য কোনোখানে আর না হয় এই জগৎ ছাড়ি অজানা অচেনা দেশে যিয়ানে মা বাপ নাই, আত্মীয় বান্ধব কেউ নাই, ঘোর আঁধারে হূন্যতাই হুধুই হূন্যতা। আঁর কপালটাই মন্দ, ইছামারি আঁর কপালে, যেই হোলারে হেঢে ধইরছি, হেই পোলারে ছাড়ি থাইকত হইব, কী আশ্চার্যের জীবন! হোলা আঁর বিড়বিড় করের, স্বপন দেইখছিনি কী জানি। আঁইও তো জীবনে কত স্বপন দেইখছি, হুরণ হইছে কিনা জানিনা, আঁর দেয়াটাও বাস্তবের লগে লড়াই কইরতে কইরতে ঝিমাই গেছে, নতুন নতুন স্বপন আই জায়গার দখল নিছে। যেইদিক তাকাই, দেই ভাঙিচুরি যাওয়া ঘরবাড়ি, হুইনতে পাই ভেন্ন ঢঙের গল্পগাছা। আঁর চোয়ে ঘুম নাই, হোলার দিকে চাই থাই, কেমন একটা ভয় আই জাপটাই ধরে। কী যেন কইতে চায়। এত বকস কিয়ের লাই। নাতির জন্য আঁর হৌরির দরদ উথলাই উইঠলে মাথায় আই হাত বুলায়। মোটে ত মাইঝখানে আর একটা দিন। হতে ঘাটে কী জানি কী হয়! পরদিন রাইতের আঁধারে ধান ক্ষেতের আল ধরি মাইলের পর মাইল ধরি কাকার লগে হাঁটা হুরু করে। যাইবার আগে হোলার চোখ দিই টপ টপ করি জল ঝরে। বাপেরে আরে আঁরে পেন্নাম করি কয়, ‘মা তোঙ্গরে আর কবে দেইয়ুম।’ হোলার কথা হুনি আঁই আর নিজেরে সামলাইতে পারলাম না। বাড়ির বাকি লোকজনও আঁর দেয়াদেয়ি কাঁদাকাটি হুরু করি দিল। কুত্তাগুলাও ঘেউ ঘেউ না করি চুপ মারি গেল। ওরাও যেন বুঝতে হাইরছে যাওনের সময় চেঁচাতে নাই। বিলাইগুলা উঠানের এক কোনায় ঘাপটি মারি রইল, মুয়ের তুন একটুও শব্দ বার হইল না, অন্য সময় হইলে মিউ মিউ করি, নিজেরা নিজেরা ঝগড়া করে মাইনষের মতো আওয়াজ করি বাড়ি হাডাইত। আদর লকলকাই উঠছে, কারও সোহাগ যেন বাই বাই হড়ের। শত হইলেও স্থানের টান। ওর ঠাকমার রোদন আর দেয় কে, মনে কইরল চির জনমের মতো বিদায় লর।
কত আজব আজব ঘটনার কথা হরে হরে কানে আইল। জলা জমিন বাগান আলপথ ধরি আট দশ মাইল পথ হার হই গেলে কত তো মোসলমানদের গ্ৰাম হইড়ল। ওরা ওদের কত আশ্বাস দিই কইছে, ‘ কিচ্ছু ভয় হাইয়েন না দাদা, আমরা আমনেদের আঙ্গ গ্ৰামের পথ পার করি দিমু। তার হরে কী হইব, আমরা কইতাম হাইরতাম ন । ভয়ে কাঁটা হই গেছিল আঁর দেওর আর হোলা, কোনরকমে হা টিপি টিপি গ্ৰামের পর গ্ৰাম পার হইল। কেউ গেলাসে করি জল দিল, খুদার জ্বালায় খানা চাইলে লোকজন চিড়ামুড়ি দিল। হিড়িতে বইসতে দিয়ে জিগাইল, ‘ কোন গ্ৰামে রাখবেন?’ সন্দেহ করের নাকি! ভাইবল, যদি ধরা খাই যায়। তাই মাথায় টুপি হরি নিল ওরা । নাম জিগাইলে কইল, নূর মহম্মদ। হোলা বলি হরিচয় দিই কইল, আনোয়ার। ‘ আহারে এত ছোট্ট হোলাটারে লই এত দূরের হথে যানের, শরীল টরিল যদি খারাপ হই যায়, তন কী কইরবেন।’ ‘ আল্লাহর ওয়াস্তে, আমনেগো আব্বা আম্মার দোয়ায় চলি যাইত হারুম।’ ‘তা হইলে এক কাম করুন চার মাথার হত ধরুন, তাড়াতাড়ি হৌঁছি যাইবেন।’ ওরা হাঁইটতে সুরু কইরলে হঠাৎ করি হুইনল হৈ হৈ রৈ রৈ চিৎকার। তা হইলে লোকেরা ইচ্ছা করি ভুল পথ দেয়াই দিছে। যদ্দুর জানা ভারত পাকিস্তানের সীমান্ত বেশি দূর না। শব্দটা ওদের আরও কাছাকাছি চলি আইয়ের। অনেক শব্দ ওদেরকে যেন ঘিরি ধরইল, গলার স্বর হুদুমুদু নয়, মাইনষের চোখ দেই মনে হইল, রক্তের নেশা ওদের হাবেভাবে যেন ফাটি বেইরচ্ছে। কী যেন খুঁজি বেড়ার। বিধর্মীদের দেইখলেই কল্লা নামাই দিব। থরথর করি কাঁপুনি সুরু হই গেছে। মানুষ হরি মাইনষেরে খুন কইরবে। দেওর হালায়, হোলা হালায়। একটা টিনের চালের বাড়ি সামনে দেই বুকে বল হাইল। ছুটি হলাইতে যাইব, কে যেন পানি ধরি হিছনে টান মারলাম। দেওর ভাইবল আর কারোগে দেখা হইল না বুঝি, দুইজনের জীবনই ইয়ানে শেষ। শ্বাস ঘন ঘন ওঠের আর নামের, ইচ্ছা কইরলেও ওদের কিছু করার নাই। কোনোটাই ওদের হাতের মুঠোয় নাই। চিৎকার চেঁচামেচি ‘আল্লাহু আকবার’ হক্বল কথাই কোন জাদুবলে কন দূরে চলি গেছে, ওরা বুঝতে হারেন ন। ওরা হায়াড়ের গায় অনামি গাছের নিচে হড়ি আছে। এই জায়গাটা কন্নাইয়ের, ওগো দেশ তো নয়। কারা ওগো ইয়ানে লই আইছে, বিন্দুবিসরগ জানে না। ওই সময় হুইনছিল কিছু কথা ‘আল্লার রহমতে ওগো জান বাঁচি গেছে।’ বুইঝত হাইরল, এই যাত্রায় হরানটা রক্ষা হাইছে। অনুমান কইরল জায়গাটা ইন্ডিয়া হইত হারে।
ছোট হোলা নদের নিমাই
ভাবের তার অন্ত নাই
লোকে কয় পাকিস্তান
আঁর ছোট বইন কদ্দিন ধরি কয়, ‘তোর কী মন চায় না আঙ্গ বাড়ি তুন ঘুরি আইতে?’ কার না মন চায় কদিনের লাই বেড়াই আই, ঘর সংসার হোলাপাইন হালাই যাই ক্যামনে ক । কতবার যে ওরে না কইরছি, শেষমেশ কইল, ‘তোর বাড়ি আর আঁই আইতাম ন।’ এই কতা তুই কইতি হারলি সুধা! এমনিই জীবনটা সংসারের জোয়াল টানি টানি হুকনা রসকস ছাড়া মরা গাছের মতো হই গেছে, এরপরে যদি তোরা এমন তিতা কথা কস, তা হইলে হরানটা ওষ্ঠাগত হই যাইব, এমনটা তোরা চাস। আঁর কতা হুনি বোনের মুয়ে আর কথা নাই। মন খারাপ করি হোলামাইয়ারে লই চলি গেল। এবার ঠিক কইরছি বোনেরে আর কষ্ট দিতাম না, যত সমস্যাই থাউক, সুধার বাড়ি যাইয়ুমই যাইয়ুম। আঁর স্বামীরে কইলাম, আমনে কদিন হোলামাইয়াগুনরে সাইমলান, বড় মাইয়ারে কইলাম ভাই বইনরে দেই রাইচ, আঁই এই অবসরে তোর মাসীর বাড়ির তুন ঘুরি আই। ঘুরি আই বইললে তো যাওন যায় না, কতকিছু গুছাই গাছাই যাইতে হয়। কন্নাই চাল, কন্নাই ডাইল, কন্নাই তেল, নুন, মাইয়ার কাম নি এগুন খুঁজি খুঁজি বার করার, রান্নাবান্নার কাম, রসুইঘর, উনুন লেপাপোঁছা, হাঁড়িকুড়ি ধোয়াহালা করা এও তো কম বড় কাম নয়। মাইনছি একঘর লোক রইছে, হক্বলে মিলিমিশি করে, তবুও চিন্তা তো কম হয় না। হক্বলে তো জানে জেঠি আছে, যাকে বুঝি বুঝি ভাগাভাগি করি কামকাজ দিব, কারও মাথায় কোনও চিন্তাও নাই, ঘাড় নাড়ি মানি লইব, আঁর জায়েরাও অমত করে না। না হইলে এত বড় বাড়ি, এত বড় উঠান, গোয়ালঘর, কাঁচারিবাড়ি এত আম জাম শব্জি বাগান, এতকিছু সামলানো কী মুয়ের কথা! সাপখোপ, হোকামাকড়ের জ্বালা যন্তনাও তো কম নয়। হক্বলগুন তো আবার হমান নয়, এর এটা চাই ওর ঐটা চাই, হাতের কাছে না হাইলে গোঁসা। মাইনছি দেশের অবস্থা অন আগের চাই শান্ত। দেশ তো ভাগ হই গেছে কিছুদিন হইল। মাইনষের মনের অবস্থা কার কী রকম কে কইব। আঙ্গ গ্ৰামের অবস্থা তেমন খারাপ ন, লোকের ওই নি তেমন মাথাব্যথাও নাই, দেইখলে মনে হয়, তেমন দেশখানা ছিল তেমন দেশখানাই আছে, চোরচোট্টা আগে যেমন ছিল, তেমনিই আছে, ভালা মানুষদের মনও তেমনি কোনো হাল্টায়নি আর চাষাভুষা গরীব গুরবো মানুষরা দুবেলা হেঢ ভরি দুমুঠো খাইতে পারলেই সন্তুষ্ট। দেশভাগ লাভের অংশিদারী কে হইব, এইডা ভাবি ওরা কী কইরব। এর কারবারী কোনো কালেই কি ওরা ছিল? যেমন মৌলবী পুরোহিতরা ধর্মের নাম করি কইছে তেমন চইলছে, অন দেশের হর্তাকর্তাদের কথাই তো শেষ কথা, আঙ্গ কথা আর কে শোনে ? শুধু তো পাকিস্তান ন, পূর্ব আর পশ্চিম, তাইতেই একদল লোক এখন আহ্লাদে আটখানা। হেথাগো লাভ লোকশান হেথারাই বোঝে।
বইনের বাড়ি তো যাইমু ঠিক কইরছি। ক্যামনে যামু? একলা একলা যাইতে ডর লাগে। ঘর তুন বার হইলেই মাইয়া মাইনষের কত জ্বালা। মাটির রাস্তার দুধারে কচি কচি ঘাস। বরো ধানের নাড়া বিছাই রইছে গোটা রাস্তায় যিয়ান তুন রিকশা ধরি যাইত হয় দুই আড়াই মাইল। নাড়া মাড়াই হাঁটতেই থাই, মচর মচর শব্দ হয়, ওই শব্দ কানে বাইজলে কী ভালা যে লাগে, কী আর কমু। ঘর তুন ত সচরাচর বার হই না। দুনিয়াটা খোলামেলা লাগে, কার লগে যে ভাগ করি লইয়ুম এই আনন্দ, উথলি উথলি উডের মনের ভিতরটা। মাঝে মাঝে মনে হয় জানেন নি মনের ভেতরেও আর একটা জীবন আছে, সেঢাও কথা কয় আঁর লগে চুপি চুপি, আঁই জানি না, ওই জীবনের মধ্যে কারা কারা আছে, সংসারের মানুষ আছে, আবার ভাবি ভাবি অস্থির হই সংসারের বাইরেও তো কত মানুষ আছে, ওদের চেহারাগুলা তো যায় আর আসে, আঁই ওগোরে ধইরত হারি না কেন। হারুম ক্যামনে! মাইয়া মাইনষের জীবনে স্বামীর লাই টান, হোলামাইয়ার লাই টান, কী যে এমন টান ওরাই জানে। এই যে ঘরে হালাই আইছি, কত না দেখার কষ্ট, তাই বলি কী বাপের বাড়ির আত্মীয়স্বজনকে ভুলি থাইকতি হারি, কইতন বুঝি, হৌরবাড়ির আমোদ আহ্লাদে মত্ত হই রক্তের সম্পর্ক মুছি ফালাইছি দিনে দিনে। কেউ কেউ কইতে ছাইড়ত ন মাইয়া মানুষ স্বার্থপরের জাত, কিন্তু এই কথাটাই তো বোঝেন ন, কত কষ্ট করি ওদের স্বার্থপর হইতে হয়। একটা কথা দূর তুন ভাসি আইয়ের, আঁর হোলার ডাক, কোন ফাঁকে হলাই আইছে, যদি হায়ে কাঁটা হুটি যায়, তন কী হইব। ‘মা আঁইও যাইয়ুম, আঁরে হালাই যাইয়েন না। রিকশার ঘন্টিটা তনও কিরিং কিরিং আবাজে বাইজতে থায়, আঁই হক্বল কতা হুইনতাম হারিয়েন না, খালি মা শব্দটা হুনিই হিছন হিরি তাকাই দেই হোলাটা আঁর রিকশার পেছন দিই নেংটা হই ঝুইলছে। কারে কী কইয়ুম, নিজের কপাল চাপড়ানো ছাড়া অন আই কী করুম। কনডাই হাইয়ুম জামা, কনডাই হাইয়ুম প্যান্ট, মাইনষে কী কইব, অমুক বাড়ির তমুকের হোলা নেংটা পোদে ঘর তুন বার হই চলি আইছে। উডি আয়, উডি আয়, মারে ছাড়া বুঝি এক দুদিনও থাওন যায় না। হোলার চোয়ের জল দেই কাপড়ের খুঁটি দিই নিজের চোয়ের জল মুইছলাম। রিকশাওয়ালা কয়, ‘কাঁন্দেন ক্যান, কাঁদিয়েন না, আঁর কাছে হুকনা একখান গামছা আছে, হোলারে হরাই দেন।’ শরমও লাইগল। হরের জিনিস ক্যামনে লই। তবুও হাত বাড়াই লইলাম, হোলাগা আঁর কী খুশি! রিকশার চাকা গড়ায় আঁর মনও গড়ায়। উঁচানিচা মাটির রাস্তায় চাকা লাফাই উইঠলে হোলা আঁর ভয়ে লাফাই ওঠে। রিকশাওয়ালা হিরি হিরি চায়। ‘হোলারে কোলে লই বইয়েন। চিন্তা করিয়েন না, শক্ত করি ধরি রান, আস্তে আস্তে চালাইয়ুম এবার। রাস্তা সারাইবার লাই কারও মাথাব্যথা আছে দেয়েননি। সরকার তো নিজের গদি আঁকড়াই আছে, গরীব মাইনষের কথা ভাবে কজন। আঙ্গ যে কারো হেডে ভাত নাই, রোগে ঔষধ নাই, মাথার উপরে চাল নাই, কার খেয়াল আছে কন।’ মিঞা আমনের সন্তানাদি কজন। ‘সেই দুঃখের কথা জিগান কিয়ের লাই ভাবিজান। কলেরা ভেদবমি হই হোলামাইয়া দুইটার ইন্তেকাল হইছে, আল্লাহ মুখ তুলি চাইছে, আলহামদুলিল্লাহ আঁর বিবির কোল জুড়ি আর যমজ হোলা আই সেই দুঃখ, সেই জ্বালা খানিকটা হইলেও মুছাই দিছে। মাইয়ার শোকটা ভুইলতাম হারিয়েন না কিছুতেই।’ চিন্তা করিয়েন না মিঞা দিন তো হুরাই যায় নি অনও, ফুটফুটে মাইয়া আবার জনম লইব আমনের ঘরে। ‘ফুল চন্দন হড়ুক আমনের মুয়ে। মাইয়াডা খোদার পেয়ারা হইবার হরে মনে আঁর সুখ নাই। মনে হইড়লে বুকের ভেতরে চিন চিন করে। আঁর বিবির মুয়ের দিকে তাকাতাম হারি না।’ চোয়ের জল হালাইয়ের না মিঞা, হোলাগুনের অমঙ্গল হইব। ‘কত কষ্ট করি যে সংসার চালাই, সে কতা আমনেরে ক্যমনে কমু, নুন আইনতে পান্তা হুরায়। যা রোজগারপাতি হয় দুবেলা ভাতের জোগাড় কইরতেই চলি যায়, কাপড়চোপড় কিনি দিমু কী, ছিঁড়া প্যান্ট হরি ঘুরি বেড়ায়। বিবি মুখ ফুটি তো কিছু কয় না, আঁই বুঝিও কিছু কইরতাম হারিয়ের না। মনের দুঃখে কত কতা কইলাম, কিছু মনে করিয়েন না যেন।’ আমনে পাগল হইছেন নি, মাইনষে মাইনষের লগে কথা কই মনের জ্বালা জুড়াইব না তো কার কাছে কইব। ঠাঁ ঠাঁ মাইরা গরমে জান যায়, গা হুড়ি যার একটু জিরাই লই ভাবী, দর দর করি ঘাম হড়ের। আঙ্গ দেশের লোকজন কত কষ্ট করি মাথার ঘাম হায়ে ঝরাই সংসার চালায়। ঘরের বার না হইলে কী জীবন চিনন যায়! কত মাইনষের কত রকমের লড়াই। রিকশাটা ফের চইলতে থায়। মাইলের হর মাইল যায়, আঙ্গ বাড়িঘর কত যে দূরে চলি যায়, তালগাছ হার হয়, খেজুর গাছের রস বাই বাই হড়ে। কন যে যাই পৌঁছাইয়ুম, সেই চিন্তায় মরি। হোলাঢার ক্ষুধা লাগি গেছে। রিকশা আই থাইমল। মানুষজন গিজগিজ করের। একজন আঙ্গুল তুলি দেখাই দিল লম্বা রেললাইনের দিকে, সোজা লম্বালম্বি চলি গেছে উত্তর দিকে।
হুশ করি একটা রেলগাড়ি চলি গেল, কয়লার ইঞ্জিনের ধোঁয়ার গন্ধটা আঁর নাকে আঁই লাইগল। মাইনষে হুইনছি নাক চাপি ধরে, সহ্য কইরত হারে না, আঁর মন্দ লাইগল না, নাক দিই টানি লইলাম, গাড়িটা তো ঝিকুর ঝিকুর আওয়াজও তুইলল। আঁই খানিকক্ষণ চাই রইলাম। মনে হইল এই গাড়ি কত মাইনষেরে কত জায়গা তুন উডাই লই আই আবার যিয়ানে যাইত চায়, হিয়ানে নামাই দেয়। লতাহাতা, ঝোপ জঙ্গল বোবার মতো ধুলা ধোঁয়া যে উড়ায়, সব গায়ে মায়, মাইনষের মতো ওরাও তো কত ঘটনার সাক্ষী হই রই বাঁচি আছে আঁর আদর কইরতে ইচ্ছা করে। হোলারে কোলে লই হাঁঢিয়ের তো হাঁঢিয়ের, রাস্তাখান আর ফুরাইতে চায় না। ইস্টেশনে হা দিই দেখি একটা ট্রেন আইতেছে। ইস্টেশন মাষ্টারেরে জিগাইলাম ট্রেনটা লাকশাম যাইব নি? কইল, ‘কুমিল্লা যাইবার ট্রেন, উইঠা হড়েন, স্টপেজ দিব হিয়ানে। হড়বড় করিয়েন না, বাচ্চা পোলা, কন কী বিপদ হয়!’ জানালার পাশে বই হোলাঢারে বুকে জড়াই ধইরলাম। কয়লার গুঁড়া আই চোয়েমুয়ে লাগের। ইঞ্জিনের হাশের বগিখানা খালি ছিল বিধায় তড়িঘড়ি করি হিয়ানেই উইঠলাম কিনা। নামি দেই এই কী অবস্থা! কিছুই চিনতাম হারিয়েন না। কী হইব অন! একটা দোকান তুন জামাপ্যান্ট কিনি হরাই দিলাম। শেষমেশ খালটার দেয়া হাইলাম, আগামাথা দেওন যায় না। মাঝে মাঝে দুই একখান বড় নৌকা এপার ওপার করে। বইনের বাড়ি গঞ্জের হাশে। কত আগে আইছিলাম। দেইখতে দেইখতে যে এমন করি হালটাই যাইব, স্বপ্নেও তো কল্পনা করি ন। বইনের জামাইয়ের ব্যবসার উন্নতি হইছে। গুদামঘরখাইন আড়েবহরে বড় হইছে, লাগোয়া গদিঘরখানা দেইখলে মন জুড়াই যায়, কনডাই ছিল, কনডাই আইছে, লক্ষ্মীর ঘড়া উঠছি হড়ে। বোনপো গদিতে বই দোয়াইত কলম লই কাঠের বাক্সের উপর হিসাবের খাতায় বিক্রিবাটার হিসাব লিখছিল। আঁরে দেই লাফাই উইঠল, ‘মাসী, তুই ক্যামনে আইলা? একটা খবর তো দিবা, আঁই যাই লই আইতাম।’ আইয়া পড়লাম মন চাইল, ভাইবলাম তোগরে চমকাই দিমু। ‘খুব, ভালা করছ। চল,চল বাড়ি চল।’ বেগ্গাইন ঠিক আছে তো? তোর বাপেরে দেইখছি না, কনডাই গেল! ‘বাবা, তাগাদায় গেছে। কে কনডাই আছিস, বাজার তুন ভালা চাই একটা নারায়ণগঞ্জের বড় দেই চার কেজি ওজনের একটা ইলিশ মাছ কিনি লই আগে বাড়ি পৌঁছাই দে, বড় দেই তেলা কইও সঙ্গে লইচ বুইঝলি, বাজারের ভালা মাছগুন কিনবি, কি দিলুম। আঁর মাসি কদ্দিন বাদে আইছে। মা দেইখলে কত খুশি হইব। আঁর ভাইটার লাই চকলেটও কিনিস, মনে থাইকব ত!
ধেই ধেই করে নাইচতে নাইচতে আঁইও মনের আনন্দে বইনের বাড়ি আইলাম। এলাহি কান্ডকারখানা দেই তো আঁর চক্ষু চড়কগাছ! আঁর আবার এত জাঁকজমক হচন্দ হয় না। দামি দামি সেগুন কাঠের দরজা জানালা। আঙ্গ জীবন চলে হ্যারিক্যানের আলোয়। এদের ইয়ানে ফটাস করি কাঠের বাক্সে কালা কালা সুইস টিপলেই আলো আইয়ে, সুইস নামায় দিলে আলো চলি যায়, শোয়ার ঘরে হাখা বনবন করি ঘোরে। আঙ্গ বাড়িতে ঘরে ঘরে তালপাতার হাখা। কী আদর আপ্যায়ন, দেখি দেখি মন ভরি যায়। নিজেরে বড় ছোট ছোট লাগে। আঁর বইন আঁরে জিগায়, আঁর ভালা লাগেন নি! কী কমু কন চাই। বইনের মনে কষ্ট দেন যায়। তার চাই ওরা সুখে আছে এটা দেই তো আঁর আনন্দ। উঠানের ডাইন হাশে এত্ত বড্ডা মন্দির। দেই চোখ জুড়ি যাই। মন্দিরে ঢঙ ঢঙ করি ঘন্টা বাজে। অন্য বাড়ির বুড়া বুড়িরা আই পাটি হাতি গোল হই বয়। হরি সংকীর্তন করে। আঁই যাই এক হাসে বই। আঁরে দেই একজন আঁর বইনেরে কয় ‘তোঁর বড়া দিদি বুঝি, কটা হোলাপাইন? কন আইছে, থাইকব বুঝি কদিন?’ বইন আঁর মাথা নাড়ে। ‘বইনের জামাই আইয়ে ন?’ ‘ওনার কত কাজ, সময় হায় নি। আরও তো হোলাপাইন আছে, হড়ালেখা আছে, কেমনে আইব কন?’ আঁর বইনের বড় মাইয়া আইছে বেড়াইতে। ওর গভ্ভে সন্তান আইছে। অন কিছুদিন ওর মার কাছে থাইকব। এই মাইয়ার আবার অনেক গুণ। গলায় সুরের নদী আছে যেন, মধু মাখি দিছে। কীত্তনও গায়, পল্লীগীতিও গায়। কোথায় রে কাঙালের হরি– একবার দেখা দাও আমারে। আমার সাধের ধন চিন্তামণি– না হেরিলে প্রাণ ফিরে।। যে সুখে রেখেছেন গৌরাঙ্গ, দিবানিশি তুষানলে জ্বলিছে অঙ্গ; তোমার প্রেমবারি বরষিয়ে– দয়াল, সুশীতল কর আমারে।। আহা! মনটা গলি যায়। হুনি আঁর গর্বে বুকটা হুলি ওঠে। হক্বলে মুগ্ধ হই হুইনল, ধন্য ধন্য কইরল। থুতনি ছুঁই একটু আদর করি দিছি। বোনের হৌরি আইজ দুই বছর হইল বিছানায়। হাগা মুতাও বিছানায় সারে। মাথার ব্যামোতে ভোগের বছর দুই তিন ধরি। শোধ বোধ নাই, কথা কইত হারে না, হুঁ হাঁ করে। আঁই কাছে যাই মাথায় হাত দিলে চোখ মেলি চায়। জিগাই মাসি আঁরে চিনতে হারেন নি? আর বইনে কয়, ‘বড়দি, তুই হাগল হইছত নি, ঢোক গিলতে কষ্ট হয় যার, তোরে চিনব কেমনে! ঈশ্বরের কী লীলাখেলা, যে মানুষটা এত বড় সংসার সামলাইত, আজ এমন দশা। যে যার কামকাজ লই এদিক ওদিক ছোটে, কেউ ডাক খোঁজও করে না। আপন হর হিসাবের খাতাটা বড় ছেঁড়াবেঁড়া। আঁর বোন আই কয়, চল খাইতি চল। আঁর হোলাগারে লই বইনের বাড়ির কী আনন্দ! বেগগুনে হেথেরে মজার মজার কথা হুনায়। আর ও খিলখিলাই হাসে। হক্বলের আদর হাই ও তো আঁর কাছেই ঘেঁষতে চায় না। আঁর বইনের জামাই কয় ‘হোলাডারে কয়দিনের জন্য আঙ্গ বাড়ি রাখি যান দিদি। হক্বলের কেমন মায়া হড়ি গেছে এই কয়দিনে।’ ওর কত রকমের বায়নাক্বা, চাইলেই হাতের কাছে চলি আয়ে। ইয়ান তো আঙ্গ মতো গ্ৰাম নয়, হোল হার হইলেই এত্ত বড় বাজার। গঞ্জের বাজারের কত জৌলুস, চোখ ধাঁধাই যায়, কোনোদিন এরম দেইখছেনি এর আগে। যা-ই দেয়, অবাক হই তাই থায়। আঁর বোনের জামাই ব্যস্ত মানুষ, চালের গাড়ি আই থাইমলে দম হালাইবার সময় হায় না। আঁর হোলার হাগলামিতে মাথা ঘামানোর সময় কন্নাই। আঁর হোলাও কম শয়তান ন। ছেলেধরার ভয়ডর নাই। বাঁশীর তালে তালে সাপুড়ে সাপখেলা দেখাইলে ও মজা হাই হাততালি দেয় আর আবোলতাবোল কইতেই থাকে। সাপুড়ে কয়, ‘পয়সা দাও, খেলা দেয়াইলাম।’ হেথে দৌড়ি চলি যায় গদির কাছে। সোলার কান্ডকারখানা দেই হক্বলে হো হো করি হাসে। হেথের মেসো দোয়ান তুন জামা প্যান্ট কিনি দিছে। আঁরে আই দেখায় আর আনন্দে লাফায়। কী কইয়ুম বোনঝি আনি আঁর হাতে দুইখান শাড়ি দিই কয় ‘ আমনের লাই আর বোনের লাই।’ রাগ কইরব বিধায় কিছু কইতামও হারিয়েন না। ওগো ট্যায়া পয়সার অভাব নাই ঠিক কতা, তবুও শরম লাগের। তিন দিনের লাই বেড়াইত আই সাত দিন কাটি গেল, ওরা ছাইড়ত চায় না, ফিরি যাই হেথেনেরে কী জবাব দিমু, বুইঝলাম কপালে শনি নাচের।
খবর আইয়ের কী লই জানি দেশে আবারও গণ্ডগোল লাগের। দেশটা ভাগ হইছে কটা দিন আর হইল। আবার এত গোলমাল! বোনপোরা গালে হাত দিই বসি পইড়ল। ঢাকা তুন হুরু হইছে। ময়মনসিংহ, সিলেট আর রাজশাহী কোনো জায়গােআর বাদ যান না। কত মাইনষের নাকি গলা কাটি হালার, বাড়িঘর হোড়াই দের, মাইয়া মানুষের ইজ্জত লই টানাটানি। আঁই তো হড়ছি বিপদে। রেল স্টেশনে যাইতেও তো ভয় লাগে। এই দেশে থাউন কেমনে! নিজের দেশ তুন আঙ্গরে মারিধরি তাগড়াই দিব? এই দেশে কী বিচার আচার ধম্ম বলি কিচ্ছু নাই? ‘কীয়ের ধর্ম?’ কেন! হিন্দু মুসলমানের ধম্ম বাদ দিইও যদি, দেশের ওতো একটা ধম্ম আছে। এমন কেউ কী নাই দেশের ধম্মটা মান্য করে। দেশটা পাকিস্তান হই গেছি বলে যা ওগো মন চায় তাই কইরব। এইঢা আবার কোন দেশী আইন! ‘ মাসী আমনের কথা ওগো কানে পৌঁইছত ন। পাকিস্তান করি করি ওরা হাগল হই গেছে। ভালা মাইনষেরে উসকাই রক্ত গরম করি দের। হুইনলাম আঙ্গ আড়তদার হিন্দু হর লাই চাঁটগায় ওগো গুদাম লুট করি সর্বশান্ত করি দিছে। মোসলমানদের হর্তাকর্তা গোছের দুই একজন এই অন্যায় মাইনত হারে ন বলি বাধা দিছে, হেথেনেরে বাঁশ দিই পিটাই মাথা ফাটাই দিছে।’ কী কছ রে ইগাইন! আঁই তো বিশ্বাস কইরতে হারিয়েন না। ‘ আরও যে কত কিছু ঘটের আমনে হুইনলে মুচ্ছা যাইবেন।’ মাইনষের মনের মধ্যে এত হিংসা রেষারেষি কেমনে যে বাসা বাঁধি রইছে, ঈশ্বর জানে। ধম্ম ধম্ম করি পুরা দেশটা একদিন রসাতলে যাইব, এই আঁই কই দিলাম। এই ধম্মের কারবারীরা মাইনষেরে মিলত দিত ন। এমন একদিন আইব দেশটা ভাঙি আরও দুই টুকরা হই যাইব। একটা কথা বুইঝতাম হারি না এই খুনোখুনি করি আখেরে কী লাভ হইব, কার লাভ হইব? এক ধম্মের মানুষ অন্য ধম্মের মানুষের চড়াও হই কী সুখে শান্তিতে থাকতে হাইরব? জোর খাটাই দল ভারি করি যদি লাভ হইত, না জানি না হুনি হুজুকে হরি ছুরি কাঁচি রামদা, ভোজালি দিই কোপাইলে নিজের ধম্মরে অচ্ছদ্দা করা হইব, এটা কেউ বুঝেন না। ‘মাসি, আমনে বুঝি বুঝি কথাখান কন, কিন্তু এর মর্ম বুঝে কজন। মা কয়, আমনের মাথাটা বরাবরের সাফ।’ ধুর পাগল, আঁর মনে যা আইয়ে আঁই তা কই, কেউ হোনে কেউ হোনে না। রাইত হই গেলে আর ঘুম আইয়ে না। কাইল ভাগ্যে কী আছে কী জানি। হরদিন দুইটা খবর হুনি মাথায় বাজ ভাঙি হইরছে। তেভাগা আন্দোলনে আঁর দূর সম্পর্কের এক ভাই ছিল, পাকিস্তানি পুলিশ হেথেরে গুলি করি মারি খালের জলে হালাই দিছে। অন্য খবরটা হুনছি আঁর রোমকূপ খাড়া হই গেছে, বুকের ধুকধুকানি শুরু হই গেছে। ফেণীতে আঁর মাসতুতো ভাইয়ের পোলারে রামদা দিই কোপাই ধড় তুন মুণ্ডু আলাদা করি দিছে। হেথাগো বাড়িতে আগুন লাগাই ছাই করি দিছে। পাকিস্তানি পুলিশ আর আনসার বাহিনী আগাই আইয়ের, স্থানীয় মুরুব্বিরা হেই লগে যোগ দিছে। আঁই তো খুবই চিন্তায় হড়ি গেলাম বাড়ি যামু ক্যামনে। একবার যদি কোনরকমে স্টেশনে নাইমতাম হারি তা হইলে আর চিন্তা নাই। চেনা মাঝি দেইখলে আঁরে ঠিক পৌঁছাই দিব। ভয়ে ভয়ে বোনপোরে হঙ্গে লই স্টেশনে তো হৌঁছালাম। ফট করি এক দল লোক আই আঁর হোলাটারে লই আঁর হাত তুন ছিনতাই লই গেল। আঁর বোনপোর হরিচিত লোকজন আঁর চিৎকার হুনি দৌড়ি আই ওদের হাত তুন রক্ষা কইরল, না হইলে আঁর হোলার যে কী দশা হইত কে জানে। গাড়ি আইল, স্টেশনে নামালাম। চারদিকে শুনশান। সাহসে ভর করি হাঁটা শুরু করি ঘাটে আইলাম। একটাও নৌকা নাই, কী যে করি। ভাগ্যদেবী সাথ দিছে। আঙ্গ বাড়ির দিকের তুন আলাউদ্দিন মাঝি আই নৌকা ভিড়াইল। আঁরে দেই ডাকি নিই নৌকায় তুইলল। কত কথাই তো কানে আইছে, মাঝিরা অন হিন্দুদের নৌকায় তোলে না। তাইলে কী আঙ্গ গ্ৰামের লোকেরা এসব কথার আমল দেয় ন। নিজের দেশটা কখন যেন হর হর হই যার। আঁই পাগল না ওরা হাগল কী জানি। মনের মধ্যে একটা খটকা লাগি গেল। আলাউদ্দিনের মাথায় পাকিস্তানের ভূত চাপেনি তো! যদি নৌকাটা ঘুরাই অন্য দিকে লই যায় কী হইব। হোলাটারে জাপটাই ধরি ছই-এর নিচে দম বন্ধ করি বই রইলাম। আলাউদ্দিন যন কইল আইয়া পড়ছেন জেঠি, ওই তো আঙ্গ গ্ৰামের সাঁকোটা দেয়াই যায়। মনটা শান্ত হইল। মঠের চূড়া দেই হরানটা জুড়াই গেল। আলাউদ্দিন বুইঝত হারছে আঁর মনের অবস্থা। ‘ ভয় করিয়েন না জেঠি। জেঠারে এত বছর ধরি নৌকা করি ভোর রাইতে লই গেছি, হাশাহাশি গ্ৰামের লোক, বেঈমানি কইরতাম ন। দেশ লই মাইনষে মাইনষে ভাগাভাগি আঙ্গ কাম ন। যাগো এসব করি লাভ লোকসান হইব, তারা দিনরাত এইসব লই হিসাব কষের।’
আঁর স্বামী আঁরে দেই ভূত দেয়ার মতো চমকাই উইঠল। চিন্তায় চিন্তায় হেথেনের চোয়ে দুই দিন ধরি ঘুম নাই। এত চিন্তা করেন কিয়ের লাই, এই নেন আমনের হোলারে। আঁর মাইয়াটার কান্না দেই নিজেরে আর ধরি রাইখতে হাইরলাম না। মা বেটি দুইজন দুইজনেরে জড়াই ধরি কিছুক্ষণ কাঁইনলাম। এই কদিনে বাড়ির মানুষগুলান কেমন হালটাই গেছে। মনে ভয়, খালি ভয়, এই বুঝি এক দল লোক আই কোতল করি দিব। মাইয়াগুলার চোয়ের দিকে তাকাইতাম হারিয়েন না। ওরাও তো ভৈরব ব্রীজ, সীতাকুণ্ডর অত্যাচারের গল্প হুইনছে। কেন্নে কেন্নে ওরা যে হুনি ফালাইছে ওরাই জানে। কাঁদি কাঁদি কয়, ‘জেঠিগো আঙ্গরে যদি ধরি ধরি মুসলমান করি হালায়। বিয়া করি নেয়। শরীল লই খাবলাখাবলি করে আঙ্গরে কে বাঁচাবে কও।’ আফজল আলি আঁরে কইছে ‘ ভাবি এই গ্ৰামে যদি একটা হিন্দুর মাইয়ার মান সম্মান লই টানাটানি হয়, তবে আল্লার কসম যেই হাত দিই ওরা এই কুকাম কইরব, সেই হাতখানা কাটি হালাইয়ুম, আমনেগো কোন চিন্তা কইরত হইত ন। ওরা আঙ্গরে চাচা কয়, আঙ্গ মাইয়ার মতো।’ তোরা নিশ্চিন্তে ঘুমা। আর স্বামী বাড়ির যুবক হোলাদের কয়, ‘ কওয়া তো যায় না, হঠাৎ করি যদি কেউ আক্রমণ করে, তোরা রামদা বটি কুড়াল শাবল খন্তা লই পাহারা দিবি, মইরলে মরবি, যুদ্ধ করি মরবি, গ্ৰামের হক্বল বাড়ির যুবক পোলাদের একই কথা কইছি। ভয় পাইলে চইলব না, দেশটা আঙ্গও, তাড়াই দিব, কইলেই হইল।’ পাকিস্তানি পুলিশও আইয়য়ে ন, আনসার বাহিনীও আয়ে ন। রাত তো হুরোয় না। একটা হাতা হড়াড় শব্দ হইলেই গা ছমছম করে। এই বুঝি সব সাবাড় করি দিল। ঘুম তো আর আইয়ে না। দিনের আলো হুটলেই দুই একখান নৌকা আই ঘাটে ভিড়ে। বাহিরের তুন লোকজন আই নামে। গাছের আড়াল তুন, খড়ের গাদার হিছনে থাই চোখ বড়বড় করি উঁকি মারি চায় কারা আইল, কারা গেল। হিন্দু মোসলমান নৌকার যাত্রীরা হক্বলে চেনাশোনা আঙ্গ গ্ৰামের লোক। যুগী বাড়ির তাঁতিরা আধমাইল হেছনের গ্ৰাম। হিয়ানে ঢুইকতে চাইলে মুশকিল আছে। চারদিক ঘিরি হালাইব। কই গেছে তেমন বুইঝলে আঙ্গরে খবর দিয়েন। মাইয়া আর ছোট হোলাগুনরে হার করি দিমু। ওরা দিনে তিন চারবার করি হালা করি খবর লই যায়। ডরে ডরে দিন কাটি যার। পূর্ব পাকিস্তানের কাটাকাটি লই দেশ বিদেশে কথা চালাচালি শুরু হইছে। এই নিই কত কানাকানি বলাবলি। হরিস্তিতি কতকটা ঠাণ্ডা হইলে আঁর স্বামী শহরমুখী হইবার লাই ছটফট করে, আঁর কথা কানেই তোলে না। কত কত কতা লই হেথেনে নাড়াচাড়া করে ‘ মাইনষের মধ্যে এমন অমানুষের ভাবগতিক দেখি আঁর বাঁইচতে ইচ্ছা করে না।, কনডাই যামু কও চাই। মানুষ খুন করা ছাড়া হেথাগো অন্য কোনো কাম নাই। সমাজ তো উচ্ছন্নে যাইব গই। মনের মধ্যে এত ঘেন্না হুষি রাই জীবনরে চিনত হারে কেউ, উপরওয়ালা তো দূরের কথা? আঁই তো বুঝতেই হারিনা কিয়ের লাই এত শত্রুতামি? জোর করি ঘর হালটাই দিলে মানুষটা কি হালটাই যাইব, জবাব তো চাইব একদিন। বোকার হদ্দ, আস্ত বলদ, না হইলে সংখ্যা দিই কনও সমাজের মাইপত চাই ! হায় হায় হায়রে দেশটার কী দশা হইল? বাঙালিরা বুইঝত হারেন না, পাকিস্তানিরা আজ না হয় কাইল ঝোপ বুঝি কোপ মাইরব হেদিন ওরা হিন্দু মুসলমান বুইঝত ন। ধম্মের দোহাই পাড়ি হাত মিলাই লাভ হইত ন এই দেশের লোক যত তাড়াতাড়ি বুইঝব তত ভালা, দল ভারি করার খেলা খেলি আখেরে পশ্চিমাদের হাতের পুতুল হইব। যেমন খুশি ওরা নাচাইতে চায়, তেমনে নাচাইব। নাইচত না চাইলে গুলি করি মাইরব, ধম্ম তন কোনো কামে আইত ন।’ আঁর স্বামী এই সকল কতা লই বিড়বিড় করে। খোলা মনের মানুষ তো, হক্কলরে নিজের মতো করে দেখে, তাইতে কষ্ট হর। মানুষ দিনে দিনে চোয়ের সামনে পশু হই যার, সহ্য কইরত হারেন না। শহরে যাইব কি মনস্ত কইরছে, হিয়েল্লাই আঁর এত ভয়।
কইলকাতা তুন চিঠি আইছে
হোলার দুঃখে মন কাঁদে
কইলকাতা তুন আঁর হোলার মনঃকষ্টের কথা হুনি কী করি স্থির থাইকতে হারি কন চাই। যন হেথে দেশ ছাড়ি চলি যার তন খালি চিন্তা হইত কেন্নে হেতেরে পাকিস্তানের সীমানা হার করি দিই জল্লাদদের হাত তুন রক্ষা করুম। আমরা মরি মরি, একটা হোলা তো এই পিথিবীর বুকে বাঁচি থাউক। বুকের মধ্যে পাথর চাপা দিই রাইখছিলাম। যতদিন হার হই যার, যন্তন্নাটা এখন থাকি থাকি চাগাড় দিই উঠের, নাড়ী কাটার ক্ষণের চাই কম কিছু নয়। হোলার মুখটা ঝাপসা হই যার দিন দিন। হোলারে যে এমন করি হারাইত হইব সে আর বুইঝছি নি। আইজ হোলার চিঠি হাইলাম। কত ঘুরি ঘুরি এই চিঠি আইছে। এই চিঠি নাকি চাইর নম্বর চিঠি। বাকি চিঠিগুন কনডাই যাই হড়ি রইছে, কে জানে, না জানি কেউ কুটি কুটি করি ছিঁড়ি হালাইছে। আঁই নিজেও জানি না কেন্নে এই চিঠি আই আঁর হাতে হইড়ল। বড় আশ্চর্যের কতা, একটা শব্দও কাটাকুটি নাই, ক্যামনে আঁর হোলা এত সোন্দর চিঠি লেখা শিখছে। এই দুই তিন বছরে নতুন দেশে ওর মনটাও অন্যরকম হই গেছে নিশ্চয়ই। হইবার তো কতা। কত লোকের লগে জানাশোনা, মিশিমিশি। চাপা রাগের হোলা, এমনে যন কতা কয়, কতার ফুলঝুরি ছোটে। অল্প রাগ দেখাই ওর বাবা কইত টন্নি, বাক্যবাগিশ আর অন হেইসব কতা মনে করি চোয়ের জল মোছে, কয় ‘কতদিন হই গেল হোলাটার মুখ দেই না, আঁর হোলাঢারে আঁর কাছে আনি দ।’ মা বাপের লাই ওর কষ্ট আঁই বুঝি। হেথের একখান ছবি লই বার বার করি চাই থায়। একখান প্রশ্ন কইরতে ইচ্ছা করে এই জন্য দায়ী যেনারা, তেনারা কি কষ্টের ভাগ লইবার লই রাজি হইব? আঁর হোলার দুঃখটা বড্ড জ্বালায় হোড়ায়, কতদিন হই গেল বাপ মায়ের মুখ দেখে না। যারাই দেশ তুন যায়, লিশ্চয়ই জনে জনে জিগায় ‘আঁর বাপ মা ভাই বইনরে দেইখছনি তোমরা? কেমন আছে ওরা?’ চোয়ের দেয়া দেইখবার আর তো কোনো উপায় নাই। চিঠিতে হোলার কত সুখ দুঃখের কথা। মনের কথা মনেই থাই যায়।
‘মাগো মা, আজ বাদে কাইল ইয়ানে আঙ্গরে লই এক সভা হইব। আঙ্গ ইয়ানে নতুন নামে ডাকে রিফিউজি ইংরেজি নাম, আর আমরা যিয়ানে থাই, হিয়ানের নাম রিফিউজি কলোনী। কেউ বাংলা নামেও ডাকে ‘শরণার্থী’। অন্য দেশের লোক বলি লোকে অন্য চোয়ে চায়। কদ্দিন ধরি আঁই আর কাকা স্টেশনে ছিলাম, গাড়ির তুন নামি যাত্রীরা ফিরেও তাকাইত না, মানুষ বলি গইনত না, মাড়াই চলি যাইত, গরু যেইমনে ধান মাড়ায়। কারা আই খিচুড়ি দিই যাইত। পায়খানা পেচ্ছাপের গন্ধে টিকতাম হাইরতাম না। শেষমেশ কাকা আরও কজনের লগে হরামর্শ করি আমরা ইয়ান তুন অন্য জায়গায় আই উইঠলাম। ইয়ানে হোগলার ঘর বানাই অন আমরা মাথা খুঁজি রইছি। হেট ভরি খাইতাম হাই না। কনডাই যে চান করুম। কত দূরে যাই দেই রাস্তার ধারে চৌবাচ্চার জলে অনেকে চান করের। হেথাগরে কইলাম একটা মগ দিবা নি, চান করুম। মুখ ঘুরাই দেখি কইল ‘ও রিফিউজি! শহরটার বারোটা বাজিয়ে দিল। আমাদেরই থাকার জায়গা নেই, উটকো ঝামেলা এসে জুটেছে। দেশের ভাগাভাগি হওয়াতে এই দশা।’ আচ্ছা দেশটা ভাগ হইছে আঙ্গ কী দোষ। কারা ভাগ কইরছে এই দেশ, কিয়ের লাই কইরছে! জিগাইলাম দুই তিন জনেরে। আঁর কথা হুনি হাঁটা দিল। হারাদিন ধরি এর উত্তরই খুঁইজলাম। আচ্ছা, আমরা কী ইচ্ছা করি আইছি, ওরা আঙ্গরে থাইকত দিত ন, আমরা কনডাই যামু কন। কইল, ‘জাহান্নামে যাও।’ আচ্ছা, এইটা একটা কথার মতো কথা হইল। ভিজা কাপড়ে এমাথা ওমাথা কইরলাম। একটা রাস্তার হোটেলের মালিককে কইলাম, ক্ষুধা লাগছে, দুইডা ভাত দিবা নি।’ ‘ শরণার্থী শিবিরে যাও না।’ কন্নাই কন না। ‘ জানি না।’ শেষে আবার চাইতে দুমুঠো দিল। হেথাগো দোষ নাই। আঙ্গ মতো অনেক রিফুয়িজিরা ঘুরি বেড়ার। ইয়ানের পেল্লাই বাড়িঘর দেই মাথা ঘুরি যাইবার জোগাড়। উঁচা উঁচা দালানবাড়ির দরজা জানালা, এলাহি ব্যাপার । দারোয়ানের পাকানো গোঁফ, হাতে বন্দুক। সাহস করি উঁকি দিছিলাম, এমন হাঁক মাইরল, দৌড়ি হালাইতে গেলে কুকুর কামড়াই হায়ের মাংস খাবলাই নিল। বুইঝলাম এই জায়গা আঙ্গ লাই নয়। কাকা হক্বাইল হইলে কামের খোঁজে বার হইছে। হারাদিন ঘুর ঘুর করে এমাথা তুন ওমাথা কোনো কাম জোটে না। কেন জানি বাঁচার লাই আর বাঁচাইবার লাই এই দেশে আইলাম, অন উপাষ করি না মইরতে হয়। আঙ্গ দেশখানই না ভালা ছিল। কেন নিজের গ্ৰামে আঙ্গ জায়গা হইত ন, ভিটামাটি উচ্ছেদ করনের লাই উঠিপড়ি লাইগছে, ওরা সব ছোলাই ভোলাই খাইত চায়। কইলকাতার লোকেরা রোজ হোনায় ওগো ভাগে ভাগ বসাইয়ের, রাস্তাঘাট নোংরা করিয়ের। কাউরে দোষ দিই না, হয়ত ঠিকই কয়, বেবাক আঙ্গ কোয়ালের দোষ। আইজ দুইখান রুটি জুটছে কোনোমতে। থানার তুন হুলিশ আইছে। কয় আমরা নাকি জবরদখলি জমিতে ঘর বানাইছি। হক্বলে লাঠিসোঁটা লই একত্র হইলে তাড়াইত হারে ন। জমির মালিকও গুন্ডা পাঠাইছিল,মারিধরি উঠাই দিবার লাই, সুবিধা কইরত হারে ন, আঙ্গ মারকাটারি অবস্থা দেই ফেরত চলি গেছে। সাপের কামড়ে ভেদবমিতে শয়ে শয়ে লোক মারা যার, আঙ্গ হাশের ঘরের হুরা পরিবার কাইল মরি গেছে, জানি না আমরাও কবে মরি যাইয়ুম।
আঙ্গ দেশে কনও এরুম দেই ন। কাতারে কাতারে লোক। হাঁঢি হাঁঢি লোক আইয়ের। লোকের হাতে হাতে লাল রঙের ফেলাগ, কতগাইন লেখা, কতকটা হইড়তাম হারিয়ের, বাকিটা হারিয়েন না – ‘আমাদের দাবি মানতে হবে, না হইলে গদি ছাড়তে হবে।’ ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’ ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও।’ অবাক হই খানেক চাই থাইকলাম। লোকের আওনের কোনও বিরাম নাই। হামনের লরিতে কত বড় বড় নেতা। রাস্তার দুই হাশ তুন কত লোক বড় বড় ক্যামরা লই ছবি তোলের। এরা এসবেরে কয় শ্লোগান। এক এক জনের কথায় কত রাগ। একজন দুইজনে কয়, বাকিরা তাল দেয়। রাস্তার উপরে রেললাইন হাতা, দুই বগির গাড়ি চলে, এরা কয় ট্রামগাড়ি, বিদ্যুৎ-এ চলে। টিকিটের হয়সা নাই বিধায় কনডাক্টর ধাক্কা দিই নামাই দিছে। রাস্তার ধারে একখান বই হইড়েছিল, কে হালাইদিছে। আমনে তো জানেন, আঁই বই হইড়তে কত হছন্দ করি। বইটার হাতা উলটাই চমকাই গেছি। নামখানা বাইরের দেশের মানুষের। হইলে কী হইব। বাংলাতে লেয়া। কথাগাইন এমন করি লিখছে, যেন আঙ্গ দেশের সমইষ্যার কতা লিখছে। অত দূরের মানুষ, আঙ্গ মনের কথা জাইনল ক্যামনে! জাদু জানে মনে হইতেছে। আহা! মানুষটার যদি একবার দেখা হাইতাম। কথাগুলা বুকের মধ্যে তীরের ফলার মতো যাই বিঁধে। হুইনবেন, তবে কই – এমন এক দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপন দেহেন তিনি, যিয়ানে সকল জাতি, হকল বর্ণের মানুষ হমান সুযোগ লই এক লগে থাইকত হাইরব। আমরা থাইকত হারি ন কিয়ের লাই কইত হারেন?
আর একখান কথা কই, কাইল এক জায়গায় গেছিলাম। কারে দেইখছি আমনে হুইনলে তাজ্জব বনি যাইবেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামেরে দেইখলাম সামনাসামনি। কেমনে যে ঢুকি হইড়লাইম, কইতাম হাইরতাম ন। এক ইসকুলের হোলামাইরা দলবাঁধি যায়ের। জিগাইতে কইল, ‘কবিরে দেখতে যাচ্ছি।’ ভিড়ি গেলাম ওগো দলে। ওরা যাই পেন্নাম কইরল, আঁইও কইরলাম। কবি কোনও কথা কইল না, উদাস হই চাই রইল হক্বলের দিকে। ওরা আবৃত্তি কইরল ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ – … অসহায় জাতি মরিছে ডূবিয়া, জানে না সন্তরন, কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন। হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার…। কবির সামনে তুন বাইরে আসি কাঁইদলাম। কেউ তো ইয়ানে নাই যে আঁরে সান্ত্বনা দিব। কইলকাতায় শয়ে শয়ে লোক, কারে মনের কথা বুঝাই কমু। হিন্দুরাও যার, মোসলমানরাও যার, সাহেব মেমরাও যার, আঙ্গ গায়ের রঙ আর হেথাগো গায়ের রঙ ধলা, আর বেবাক মাইনষের গায়ের রঙ এক রঙের। আকবরের মা চাচীর মতো কারে যেন দূর তুন দেইখলাম, হাঁঢি চলে যার গটগট করি হোলার হাত ধরি, কত ডাইকলাম, হুইনল না। দেশের কতা মনে হড়ের খুব আইজ। এই শহর জমজমাট কিন্তু আমি কাঁঠালের বাগান দেইখতাম হাই না, হাখির বাঁক হুনি না, খাল বিল কন্নাই আর দেইয়ুম। বড্ডা এক নদী আছে গঙ্গা, মেঘনা নদীর লাই হরান কাঁদে। গাছগাছড়া অলিগলিতে আছে ইয়ানে হিয়ানে ছড়াই ছিটায়, চোখ জুড়ায় না। নাই মাঠ ভর্তি সোনার ধান, মনটা হু হু করে গো মা। আমনেগো ভাইয়ের বইনের মুখ দিন দিন মুছি যার। কাকা কইছে একটা বন্দোবস্ত হইলে ইসকুলে ভর্তি করি দিম। রিফিউজিদের কষ্টের শেষ নাই। কে কারে দেয়ে। রাজশাহী খুলনা সিলেট তুন কত লোক হলাই আইছে। কত কাহিনী ওদের মুয়ে হুনি। এত অমানুষ মাইনষে ক্যামনে হয়। এক এক জনের এক এক রকম যন্তনা। আবার জায়গা লই মারামারিও হর।
মাইনষে ওই দেশ তুন এই দেশে আইছে। অনও আমরা বেড়াল কুত্তার মতো ঘুরিয়ের। ইয়ানের কারও চিন্তাধান্তা নাই। ঘর ছাড়ি হেথাগো অন্য জায়গায় থাকনের দরকার হড়ে ন। আঙ্গ লগে যারা এক লগে আইছে হেথাগো আত্মীয়দের বাড়িতে থাইকবার জায়গা জুইটছে। কাকা এক হোটেলে কাম করের। এক বাবুর হাতে পায়ে ধইরলে উনি ব্যবস্থা করি দিছে। আঁই যদি চেষ্টা চরিত্র করি কিছু জোটাইতাম হারি, কাকার চিন্তা কমে। কাকা কয় আঁরে ইসকুলে ভরতি করাইব। এত খাটাখাটনি করি কাকার শরীল ভাঙি গেছে। দিন রাইত হোগলার ঘরে মশামাছি ভ্যানভ্যান করে। আঙ্গ চেনা দুগা মাইয়া কন্নাই যে চলি গেছে, কেউ আর খুঁজি হায়েন না। কত জনে মন্দ কতা কয়। নেতারা আয় আর যায়, কত ভালা ভালা কতা হোনায়। কয় মিছিলে যাইত হইব, তার হইলে আঙ্গ ভাগ্য হালটাইব। কিছুই তো বুঝি না, একটা সমিতি হইছে, কাকারে সদস্য বানাইছে, অধিকার নাকি বুঝি নিত হইব। কই এদেশের মাইনষের তো মিছিলে যাইতে হয় না, যত দোষ আঙ্গ বেলায়! এক দেশেই তো জন্মাইছি, আঙ্গ কি দোষ? আমনে কইছেন আঁর বাবা কইলকাতায় হড়ালেখা কইরছে, অন হরদেশ হই গেল রাতারাতি। রোজ লোক মরি তার না খাই, না দাই। কী একটা চোরা জ্বর আইছে, এনারা কয় এই সকল অসুখ বিসুখ আঙ্গ লাই হর। আঙ্গ ভাষা লই এরা হাসাহাসি করে, শুদ্ধ ভাষায় কথা কয় কিনা। হুইনতেছি আঙ্গরে জমি তুন উৎখাত করনের লাগি ওরা লোক লাগাইছে। কতাটা যে হাঁচা টের হাইলাম যন লাঠিসোঁটা লই হত্যেক দিন আট দশ জন গুন্ডা আই শাঁসাইতে লাইগল, কয় উডি না যাইলে মাজা ভাঙি দিব, ঘরদোর তছনছ করি দিব। দেশ তুন ইয়ানে আইছি দাঁড়াইবার লাই, এনারা আঙ্গরে অন্য চোয়ে দেয়ের, উড়ি আই জুড়ি বইছি, আমরা এনাদের ভাগে ভাগ বসাইছি। অকথ্য গাইল দেয়। আঙ্গ মতো কত লোক, কোনো দিশা নাই, যে যিয়ানে রাস্তা হার, ঐদিকে ছোটে। খালি বাড়ি দেইখলে জোর জবরদস্তি ঢুকি যার, সরকারি জমি, মিলিটারি ব্যারাকে মাথা গোঁজের। আঙ্গরে এরা কয় বাস্তুহারা, উদ্বাস্তু, শরণার্থী, যার যেমন খুশি ডাকে, আঙ্গরে কেউ মানুষ বলি জ্ঞান করে না, বাঁকা চোয়ে চায়। সরকার আঙ্গরে ফেরত পাঠাইতে হারালে বাঁচে। একবারের লইও কারো মাথাব্যাথা নাই যে হিন্দুরা ওইদেশে থাইকত হাইরত ন, থাইকলেও হরান হাতে করি বাঁইচত হইব, আইজ না হয় কাইল দূর দূর করি তাড়াইব। মাথা নিচু করি, গলা নামাই থাইকত হইব। কানাকানি করের মাইনষে যতদিন হারের খাইবার লাই কিছু পয়সাকড়ি দিব, হরে হরে দণ্ডকারণ্যে হাডাই দিব, আবার কেউ কর বিহার, উড়িস্যা, আসামে ঠেলি দিব, এত লোক পশ্চিম বঙ্গে রাইখা হাইরত ন। স্থানীয় লোকেরা এমনিতেই মাড়াই চলি যার, ওর কর এই ভিখারির দলেরে, কদ্দিন ধরে খাওয়াইতে হইব। এই কদিন আগেও ছিলাম গঙ্গা পদ্মা মেঘনা যমুনার হক্বলে এক দেশের মানুষ, আর আইজ হই গেলাম হর, হৈর। আঙ্গ ব্যথাখান কেউ বুইঝল না মা, পূর্ব বঙ্গ না পশ্চিম বঙ্গ।
আঙ্গ কলোনীর মধ্যে একখানা ইসকুল হইছে। জায়গায় জায়গায় থাইকবার ঘর বানাই নিছে জোর করি। ইয়ানের লোকেরা নাম দিছে উদ্বাস্তু কলোনী, গালভরা নামও দিছে। মাইনষে গিজগিজ করের। খাইবার জলের দু’একখান টিউবওয়েল, খাটা পাইখানা, ছিঁড়া জামাকাপড় হরি ঘুরি বেড়ায়। বড়লোকদের বাড়িতে ফাইফরমাস খাটে, চুরিচামারি আর রোগশোকের ভয়ে কামে নিতে ভয় পায়। হেটব্যথা, জ্বরজারি, আমাশা, দাস্তবমি ঘরে ঘরে। ডাক্তার দেখাইব যে হয়সা কন্নাই। খাইবার হয়সা জোগাড় কইরত হারেন না, চিকিৎসা তো দূর অস্ত। কী কইব মা, হক্বলটাই একটা নরককুণ্ড। এখন তো হক্বলে কোমর বাঁধের সরকারের কাছে দাবিদাওয়া জানাইব। অনেক নেতা হইছে কলোনীর মাইনষে তুন বাছি বাছি নেতা বানাইছে। বাইরের নেতারা ওদের কানে মন্ত্র দেয়। ওরা ওই মন্ত্র জনে জনে হোনায়। তেনাদের হাতে পোষ্টার, ফেলাগ, ফেষ্টুন। বেড়ায় সাঁটাই দিই গেছে। এক নতুন উপদ্রব আই হাজির হইছে। সিলেট, যশোর, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, নোয়াখালী আরও জেলার লোকজনের মধ্যে কেমন একটা রেষারেষি, এ ওরে কয় ছোট, ও এরে কয় বড়, বীদেশ বিভুঁইয়ে ভাষা লই, খানা লই আগ বাড়াই ঝগড়াঝাঁটি, কিলাকিলি, বড় ঘর ছোট ঘর লই ঠেলাঠেলি হাতাহাতি। কনডাই গেলে যে শান্তি হামু, বুইঝতাম হারিয়েন না। কদিন আগে কলোনীতে মিটমাট করার লাই সভা হইছে, লম্বা চওড়া ভাষণ। হেডে ভাত না থাইকলে, পায়ের তলায় স্থায়ী জমি না থাইকলে, কে আর কার কথা হোনে, আর হুইনলেও কজন আর মনে রায়, পিছনে পিছনে নানা টিপ্পনী কাটে। নেতারা তো ভাবে কত লোক ওদের কতা হোনে। আসলে যে বেগ্গাইন হুদা হুদা, বোঝেন না। আঙ্গ ভাগ্যে কবে যে ফিরব, কে জানে। কাকা আই কয়, ‘একটা খবর আছে, তোর ইসকুলে হড়ার একটা বন্দোবস্ত করি আইলাম। মন দিই এবার হড়ালেখা কইরত হইব। আঁর মালিকরে হাতে পায়ে ধরি কইলাম আঁর ভাইপোগার ইসকুলে ভর্তি করি দেন না, মাথা ভালা, আমনের বদনাম হইত ন। মনে দয়া হইল, এক কতায় রাজি হই গেল। ওঁনার হোলার ইস্কুলের হেডমাষ্টারের লগে খাতির আছে, মনে হয় হই যাইব, আর চিন্তা নাই। কোনদিকে না তাকাই লাগি হড়। মালিকের হোলার হুরান বইগুলান তোরে দিব কইছে।’ মা, চিন্তা করিয়েন না, আঁই হাশ করি চাকরি লইয়ুম। এই জঞ্জাল তুন মুক্তি হইলে বাইরে কোনো হাড়ায় একখান ঘর ভাড়া লই ভাইরে লই আইয়ুম, বোনেরে আনি ভালা একখান হোলা দেই বিয়া দিমু। আমনেগো কোনো কষ্ট হইত ন আর।’
হোলার চিঠিখান হড়ি চোয়ের জল হড়ে টপ টপ করি। ক্যামনে যে ওরে সান্ত্বনা দিই দিন রাইত খালি ওই কতাই ভাবি। ওর এত বছরের স্মৃতি মনের মধ্যে ওঠে আর হড়ে। হোলা আঁর কী খাইতে ভালোবাইসত, কেমন করি চোখমুখ কুঁচকাই কথা কইত, মিষ্টি মিষ্টি সেসব কতা। আঁই যন সিদ্ধ ধান ছড়াই উঠানে এদিক তুন ওদিক যাইতাম আঁর হোলাঢা হিছন পিছন ঘুইরত, আঁর গা ঘেঁষি ঘেঁষি হাত বুলাই দিত। ওর ওই কচি হাতের ছাপ হড়ি থাইকত ধানের গায় গায়। হেথে যন একটু বড় হইল ওই ধানের বস্তা লই চলি যাইত আধ মাইল হাঁঢি ধান কলের মিলে। ওর মনের মধ্যে কী আনন্দ ধানের মিল তুন চাল গুন যন বার হই বস্তা ভর্তি হয়। মাথায় চাপায় ঘর দূয়ারে রাখি কইত, ‘মা এই চালগুন দিই আঙ্গ কদিন যাইব?’ মাথায় কত চিন্তা ওর বাবার রোজগার নাই, বাকিদেরও ব্যবসাপাতি ভালো চইলছে না, মা কত কষ্ট করি সংসার চালায়। এমন দিন কেন আইছে, সেই কথা সময় হইলে কমু। উনুনে আঁচ দিই আঁই বই থাই, মুড়ি খই ভাজা হয়, ফটাস ফটাস ফাটে। ওর কী মজা, ভাইগোর লগে বই থায় কন বাটি ভর্তি খইমুড়ি দিমু, কম হইলে কয় ‘মা আর চাট্টি দাও’। হোলার যে আঁর হেট ভরে ন, মুখ দেইখলে বুইঝতে হাইরতাম। খাই দাই দৌড়ি চলি যাইত। ও কনডাই রাইত হারে আঁই ভালা করে জানি। বনবাদাড় গাছগাছালি ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে ঘুরি বেড়াইতে কী রে ভালোবাসত। হিয়ালমুত্রা আদামনি গাছ তুলি আনি দিত। ও জাইনত ইদানিং হেট খারাপ হইলে খায়, এইসব জ্ঞানগম্মি বিদ্যাবুদ্ধি আঁর তুন শিখছে। পোলারে বেশিক্ষণ না দেইখলে চিন্তা হড়ি যাই কি জানি কোনো গাছের আগায় উডি দুই ডাইলের মাঝখানে মাথা দিই হুই আছে কিনা, ধড়াস করি হড়ি যাইব হুইড়ের জলে, সাপখোপে কামড়াইব, নাকেমুখে জল ঢুকি জ্বরজারি বাঁধাইব, বার্লি তো খাইতই চায় না, এই হোলারে লই আঁই কী হড়ুম। আইজ বড় দুঃখ লাগে মনে হইড়লে, এমন দিনও গেছে হোলা আঁর নাড়া কাইটত যাই মাঠ তুন ফিরি আয় ন, আঁই তো এদিকে ভাত লই বই রইচি। এই হোলারে লই আঁই কী হড়ুম। কনডিয়ার হুইড়ের হার বরাবর যে রাস্তাখান চলি গেছে, কত দিকে যে মোড় নিচ্ছে, এক মোড় যাই ধাক্কা খাইছে নমঃশূদ্র হাড়ায়, আর একটু হাঁটলেই কবিরাজ বাড়ি, আঁর ভিতর দিই একটা রাস্তা সোজা চলি গেছে অধিকারী বাড়ির দিকে। হোলাঢা যে কোনো দিকে চলি যাইত হারে, বিশ্বাস নাই। ওর ভাবুক মনে কত রে জীবন আগাপাশতলা ঘুরি ফিরি বেড়ায় আঁই কইতাম হারাতাম না। কত কিছুই না ভাবে কনডাই তুন কনডাই চলি যায় বুঝা যায় না। এইজন্যই তো ভাই বইনরা কয় ‘হাগলা ভাই’। এই হোলাডারে আঁই হাতে ধরি বনবাসে হাডাই দিলাম। মইরতাম মইরতাম, এইদেশে এক লগেই মইরতাম, মোসলমানদের হাতে, নিজের দেশের মাটিতে অস্তি মিশি গেলে যাইব। এতই যখন ঘেন্না, মারি হালাক, মনের জ্বালা জুড়াক, ওরাই ভোগ করুক হুরা দেশ। কারা চাইছে ভেন্ন দেশ, রাতারাতি যে ভাগ কইরছে, আঙ্গরে একবারের তরেও জিগাইছে আঙ্গ মত কী! কে ওদের অধীকার দিছে আঙ্গ ঘর ভাঙার, ভিটা ছাড়া করার, আঙ্গ বাপদাদার আঁর দশ পুরুষের হৌরবাড়ির ভিটা, এমন করি ভাঙ্গা যায় না ভাঙ্গা উচিত। হাতের মুঠায় হাইলে ওই নেতাগুলোর গলা টিপি দিতাম। হুনে রাখ, তোরা আঁর হোলার তুন আঁরে আলাদা কইরছস, দেশতুন কোনদিন হাইরতি ন, বাধি গাছের লাছার মতো আঁর মনের মধ্যে জোড়া লাগি আছে এই দেশ, এই গ্ৰাম, সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি, ঘোর কলি, কোনো কালেই হাইত্তি ন। ধম্ম লই কামড়াকামড়ি যত করবি কর, জল ধুই খা, মাইনষের মা আর দেশের মা একই, নাড়ীর টান, ছিঁড়তে হাইরতি ন, দেশের নেতারা হুনি রাখ, হিরি হিরি আইবই আইব একদিন, ভূমিকম্পে হোক, মাটি হাঁঢি হোক, কই দি গেলাম, ছোট মুয়ে বড় কতা।
দেশের যন ভাগ হই গেছে
মনের ভাগ আর কে দেইখছে
সংসারটা কন যে এত বড় হই গেছে উপর উপর না হোক মনে মনেও টের হাই ন। কনও বুঝি নি, বুইঝবার দরকারও হড়ে নি, মা বুঝাই দিছিল সংসারটা এরমই হয়, জড়াই জড়াই ছিলাম। দুই একবার হোঁচট যে খাই নি এমনঢা নয়, গায়ে মাখি নি। কনও মিষ্টি, কনও ঝাল, কনও টক হইব, এই লই ভাইববার তো কিছু নাই, আছেই বা কী! হোঁচট খাইছি, উডি দাঁড়াইছি, কেউ আবার টানি তুইলছে, পট্টি বাঁধি দিছে, ফের গটগট করি হাঁডি চলি গেছি, গড়গড়াই চইলছে সব। এইটা বুইঝলাম যে দড়ির গিঁট দিই সংসারটা বাঁধা ছিল, গিঁটগুলা খুলি যার দিন দিন, কারন আছে, আবার কারন নাইও। কারে আর কইয়ুম। স্বামীর মাথায় তের চিন্তা। দেশটা ভাঙি খান খান। বড় হোলার ভারতে চলি যাওয়াটা মন তুন মাইনত হারে ন। গোপনে গোপনে চোয়ের জলও হালায়। মানুষটা কেমন যেন একা হই গেছে। অন আঁর ভাবনা হেতেনের কানে তুইললে মনের শান্তির জলাঞ্জলি হইব, তার চাই দেই না কতটা ধরি রাইখতাম হারি। হক্কলে যার যার মতো চলে। কেমন যেন নতুন নতুন মানুষ হইতে চায়। এমন ভাবগতিক জম্মে দেই ন। ওরা কতা কয়, ভাঙা ভাঙা, হুনিওনি কোনোদিন। মেজ দেওরের রকম সকম উলটাপালটা লাগে। হোলামাইয়ার বাপ হইছে, ঘরের দিকে নজর নাই, খেয়ালখুশি মতো চলে। এমনিতে হোমিওপ্যাথির বাক্স আর লগে হোমিও মেটেরিয়া মেডিকা লই বাড়ি বাড়ি ঘোরে। কী যে আয় করে ঈশ্বর জানে। রোজগার করি দুপয়সা সংসারে যে দিব তা আর কয় কে। আর জা ভালা মানুষ। দুকতা কইত গেলে উলটা ওরে গালমন্দ করে। হোলাগুন হড়ালেখা করের, না হান্ডাগুলি মারের কে কইব। বাপ যেমন বন্ধুবান্ধব লই গপ্প মারে হোলারাও বাপের ধাঁচ হাইছে। হরের ধনে পোদ্দারি করি কদিন চলে। হুকুর তুন ডুব দিই আয় কয়, ‘ বৌদিরে কোও ভাত দিত, আঁর হেঢে ছুঁচো ডন মারে।’ এই তো মেজ দেওরের কীর্তিকলাপ, আঁর স্বামী হিগাইন কানে তোলে না। আঁর ছোট দেওর ফর্সা টুকটুকে ছোটমোডো, কতা কম কয়, সাত চড়েও রা কাড়ে না। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিদ্যায় হড়ালেখা শেষ করি ওর ইচ্ছা হইল গ্ৰামের পাঠ চুকাই শহরে যাই ডাক্তারি কইরব। ওই কথা জানাবার হর মনে ভারি দুঃখ হইল। কী আর করুম। ওর দাদাও সায় দিল। ছোট ভাইটারে হরান দিই ভালোবাইসত। ভেন্ন সংসার পাতার কতা হুনি যেন গাছ তুন হইড়ল। শেষমেশ ভাইয়ের ইচ্ছার কাছে হার মাইনল। বুইঝলাম জীবনটা কেমন যেন শোধবোধের খেলা খেইলতেছে। এইটারেই কি কয় সময়ের ভাঙন, না ভাঙনের সময়। আঁই আর স্বামীরে একদিন কইলাম আমনের মেঝ হোলারে আমনের লগে শহরে লই যান, হরানটা একটুখানি হইলেও জুইড়াব। উনি তাতে মোটেও অমত করেন ন। হোলাও আহ্লাদে আটখানা, নতুন জায়গায় যাইব, নতুন ইসকুলে হইড়ব, ওর বাবার মুয়ে কত গল্প হুইনছে, হুনি হুনি ওর মনে কত ভাব আসি জড় হর, জাইনত চায় ‘কবে যামু, কবে যামু।’ হোলার খুশি দেই আঁর হোলারে ছাড়ি থাওনের মনের কষ্টটা কিছুটা কইমল যেন। কইলাম তো বটে, কিন্তু আঁর মনটা তো মানেন না। বড় হোলা চলি গেছে, মেঝ হোলারেও ছাড়ি থাইকত হইব, ভাইবলেও কষ্টে মনটা ভার হই যার। ঠাকুরপো ঘর ছাড়ি নতুন বাসায় যাই উইঠছে। কারে কি কমু, সময়ের ধাক্কায় সব উলটি পালটি যার। কোনও কিছুই আঁর আর বশে নাই। অদৃশ্য শক্তি কী এমনটাই হয় !
হোলা হইলা হইলা কাঁদাকাটি কইরত। দু’তিনবার ঘর চলি আইছে। অন মন বই গেছে। ওর বাবা কয়, দুষ্টর একশেষ। হড়ালেখায় মাথা ভালা। ইসকুলে মাষ্টাররা আদরও করে। হিংসাহিংসি একটু আধটু আছে। এবার বৃত্তি হাইছে। খুশিতে ডগমগ। ওর বাবা চায়, হোলারে এমন করি মানুষ কইরব, যাতে করি কোথাও ঠেইকত না হয়। উনি বারে বারে কয়, ‘আঁই তো চিরকাল বাঁইচতাম ন, লোকে তন কইত হারে, মাইনষের মতন মানুষ হইছে অমুক বাবুর হোলারা।’ আঁর মাইয়াটার বোধবুদ্ধি ছুরিকাঁচির মত চকচকে, ধার আছে। আঁই তো চব্বিশ ঘন্টা ওর লগে থাই, বুইঝতাম হারি, একবার কানে ঢুকাই দিলে আর ভুইলত ন। মাইয়াটার যত্মআত্তি কইরতাম হারি না, কামকাজ ঠিকমতো না কইরত হাইরলে বকাঝকা করি। এমনিতে মাইয়ার চোপা আছে কিন্তু ঐটুকানি মাইয়ার কর্তব্যজ্ঞান আছে। বাপ-ভাইদের লাই মন হড়ি থায়। ওরা বাড়ি আইলে ভালামন্দ রাঁধেবাড়ে। কিছু কইবার আগেই মুয়ের সামনে হাজির করে। এই মাইয়াটা বড় অর। বেঢিরে লই আঁই কী করুম, চিন্তায় আঁর ঘুম আয়ে না। আঁর স্বামীর এসবের লাই কোনো চিন্তা নাই। মাইয়াটা হাওয়া খাই বড় হই যাইব, হরে একটা ভালো হোলা চাই বিয়া দিতে হাইরলে সাত কুল রক্ষা। উনি আইন ঘাটাঘাটি করি, মুসাবিদা করি, মার্কেল মুহুরি কোর্ট-কাচারি করি সময় হাইলেই কত রকমের বই লই
যে হড়ি থাই উনিই জানেন। ওনার এমনিতে পানসুপারি বাদে কোনও পান চুরুটের নেশা নাই। সখের মধ্যে কেবল ওই মাখনজিনের প্যান্ট হরি কোর্টে যাইবার সখ। গুনের কথা বলি শেষ কইরতাম হাইরতাম ন। ওনার মুখ দিই একটা কথাও আইনের বাইরে কেউ কথা বলাইতে হাইরতেন ন। সাদাসিধা লোক, খড়ের ছাউনির মুলি বাঁশের বেড়ার ঘরে থায়। সময়ের লড়চড় নাই ঘুম তুন রাতের হোয়নের ইস্তক। সময়ের লগে ছোটে ওনার শরীল আর মন। নিজের হাতে আলু বাইগুন ছিম মরিচ আরো কত জাতের গাছ যে লাগায় হারা বছর ধরি উনিই জানে। কাচাকাচি ধোয়াধুয়িতে আপনার হাত জগন্নাথ। যত কই হক্কল কাম নিজের হাতে কইরতে যান কেন, হোনে কে ? চৌদ্দ বার কইলে একবার উত্তর দিই কয়, ‘ তুঁই এই সবের মানে বুইঝতা ন।’ হাঁচা কথা, ওনার ভাবসাব আঁই বুইঝতাম হারি না, এতদিন ঘর কইরলাম এর হরেও। সার কথাখান হইল এই, মানুষটা অন গোত্রের। না হইলে বড় ঝড় তুফানের রাতে যন একটা মানুষও ঘর তুন বার হন না, ঘরের মধ্যে রই ভয়ে কাঁপে, উনি কেমনে খালি ট্রেনে চড়ি হাই কোর্টে যাই জজের সামনে সওয়াল করি হারা মামলা জেতাই আনে। ট্রেনখান উল্টই হালার, মরিই তো যাইতে হাইরত। কথার দাম রাইখব বলেই না জীবন বাজি রাখা। স্বামী হইল তো কী হইছে, এমন মাইনষের বিচার করা কি আর সাজে ? কখন যে কি সিন্ধান্ত লইব, কে জানে।
কত মানুষ তো ভয়ে আতঙ্কে গ্ৰাম ছাড়ি কইলকাতা চলি গেল, উনি কেন রই গেল। কি জানি হয়তো কারও কারও মতো ভাইবল, এ আবার কেমন কথা, দেশ আবার ভাগ হয় নাকি, নাকি ভিটামাটির জন্য মায়া ? হিন্দু মুসলমানের গন্ডগোল থামি গেলে দু’দিন বাদে যেমন দেশ তেমন হই যাইব। আমার স্বামী বইলছিল, কোন সাহেব নাকি ম্যাপ বানাই সীমানা ভাগাভাগি করি দিছে, আঁই বিশ্বাস করি ন। দূর অ, এই আবার ক্যামনে হয় ! দেশ আবার ভাগাভাগি হয়?
যত সব আজগুবি কথা। ভারত, আঙ্গ কত বড় দেশ, এও কি সম্ভব! কার ঘাড়ে কটা মাথা, মাইনষের মনে কী মায়াদয়া নাই, যা খুশি তাই কইরব। হরে হরে হুইনলাম দুই দেশে পাসপোর্ট ভিসা চালু হইছে। নিজের বিশ্বাসটা নড়িচড়ি উইঠল। ঘরের কোনে বই ফোঁপাই ফোঁপাই কাঁইদলাম। তাহলি কি ব্যথা যায়? কত বছর ধরি এই ভালোবাসা জমা হইছে, শুধু চোখের জলে কী কইরে ধোয়ামোছা যায়? তাহইলে দেশটা কি ছোট হই গেল ? আঁর স্বামীর মনের অবস্থাখান আগের মতো নাই, দিনে দিনে কিরকম যেন হই গেছে। কী কারণ বুইঝতাম হারি না। মন খুলি কথা বইলতে যেন ভয় হায়। যে ওজনের মানুষ, চোখ তুলি কথা বইলতে যারা একসময় কাঁচুমাচু খাইত, হেতাগো বোধবুদ্ধি সব লোপ পাইছে, মুয়ের উপর কথা কয়, কথার মইধ্যে কথার কোনো ভাইল নাই, কথা হুইনলে গা’র ভেতরে জ্বালা ধরে, আকথা কুকথায় ঠোঁটের ডগায় ঠেলি বার হয়। টিটকারি মাইরতে ছাড়ে না। কনডাই ছিল এগুন এদ্দিন? অন্য দেশ তুন আইছে ? হেই দেশের কি নাম ? আঁর হোলা শহর তুন বাড়ি আইলে কত কথা বলে। হোলাপাইন মানুষ, সাদা মনে কাদা নাই, হেগের ভিতর রাখইত হারে না, গড়গড় করি বলি দেয়। আঁই আঁচ কইরতাম হারি, কী কষ্টে ওরা আছে। কারও কারও মনে বাসা বাঁইধছে যেন কোন তুন যেন হিন্দুরা উড়ি আই জুড়ি বইছে। হিন্দু হাড়ার মুয়ে বই গা জোয়ারি করে। কতক্ষণ আর চুপ করি থাওন যায়। অপমানের জ্বালা সহ্য না কইরত হারি মুসলমান বন্ধুদের কি হালায় মনের কথা – কী হইতে আছে গোলাম ভাই, আমাগো লগে ক্যান এরকম ব্যবহার করের, কয়েন চাই। এত পুরুষ ধরি বাস করি এই দেশে, রাতারাতি আমরা হর হই গেলাম। আমনেগো কোনো ক্ষতি তো করি নি। আঁর কাছে আমনেগো ধর্মের কতো মক্কেল আইছে গেছে, কোনো তফাৎ তো করি নাই, মুসলমান না হিন্দু। তবে আইজ ক্যান মোসলমানের দেশ, মোসলমানের দেশ বলি হক্কলে চেঁচার। ‘আমনেরে আর কি কমু, আমনে তো মান্যিগন্যি মানুষ, এই শহরে ব্যাক লোক আমনেরে এক ডাকে চেনে, আমনের লগে এই ব্যবহার হইতে আছে, আঙ্গ কি ভাল্ লাগের কন চাই। দুনিয়াদারি হক্কলখান পালটি যার। কেউ যেন উপর তুন চাঁপাই দের।’ ‘গোলাম ভাই, আমনে একখান কথা কন চাই, হাঁচা করি কইবেন। পশ্চিম পাকিস্তান আঙ্গ দেশ শাসন কইরব, এই কেমন কথা। ওরা কী বাঙালিদের চেনে না জানে, আমরা কী খাই, কী হরি, কেমন করি কথা কই, কেমন ভাষায় কথা কই, আঙ্গ মধ্যে কেমন সম্পর্ক, মিলমিশ, ওরা এসবের কি বুইঝব, ধর্মের নামে আগুন জ্বালাই দিলেই হইল। আচ্ছা কন তো পশ্চিম পাকিস্তানের মোসলমান আর পূর্ব পাকিস্তানের মোসলমানরা কি এক হাতে কনও হারে! এইযে এই দেশের মুসলমান ভাইরা আঙ্গরে তাড়াইতে চায়, ওরা কি একটুও বোঝে না, আমনেরা আমরা প্রতিবেশী, হেথারা নয়। ঝগড়াঝাঁটি করি, মারামারি করি, আমরাই দোসর,হেথারা নয়। একটু বোঝান দয়া করি এই দেশের লোকদের সুখ দুঃখের অংশীদার ওরা হইত হারে না। হায়ে হা মিলানোর নামই জীবন, বাকিটা মরণ।’
কে কার কথা কানে তোলে। হক্কলের কথার মধ্যে ফিসফিসানি ভাব। আঁর স্বামীর হাশ কাটাই দু’তিন জন চলি যাইবার সময় খোঁচা দিই চলি যায়। উনি একটু রাগি মানুষ, বেয়াদবি মাইনত হারে না। অন্য সময় হইলে জবাব দিতে ছাইড়ত নি, অন আর কী কইরব, কথা হজম করি চলি আইয়ে। ওরা পিছন পিছন আই আবারও টিটকারি মারে। এতদিনের চিনা হরিচিত শহরটার হালটা যে এমন করি হালটাই যাইব, জম্মেও ভাবে নাই। উনি জোরে হা চালায় চলি আইয়ে। হেথারা ছড়া কাটি কাটি ভ্যাংচায়। বয়ষ্ক মানুষটারে ওরা টিকতে দেয় না। এক আধা পাগলেরে উসকায়। ঘরে চলি আইলেও রক্ষা নাই। ওনার নামের বিকৃতি করি দরজার সামনে ঘাসের উপর বই তালি মারে। উনি বুঝি হালায়, ওর একার সাহসে কুলাইত ন এমন করার, কেউ না কেউ পেছন তুন ঠেলা মারের। উনি তাড়াই দিলেও হাগলটা আবার আই আরও জোরে জোরে নাচি নাচি গানের সুরে মত হারে ওনার চেহারা লই কথা কর। জালালুদ্দিন, এলাকার মুরুব্বিরে নালিশ কইরলে কয়, ‘ দাদা, মানাই গুনাই নেন, ‘কী আর কমু। একটা কথা কইতাম হারি, ইচ্ছা করি কইরছে, এরকমটা নয়, এটা নিশ্চিত, কলকাঠি নাড়ের অন্যলোকে।’ ‘এটা কী বাছি বাছি হিন্দু বাড়ির সামনেই করের !’ ‘অনুমান আমনের বেঠিক নয়।’ কথাটা হুনি উনি মুচড়ি হড়ে। বুইঝত হারে, গোলমালটা বড় রকমের লাইগব। খনিক বই থায়। হুইরের দিকে তাকায়। জলের তুন মাছেরা উঠি ঘাই মারে, আবার জলের তলায় চলি যায়। বুঝি হালায়, আঙ্গ অন এমন করিই বাঁইচত হইব, না হয় এক কোপে হক্কলে শেষ, কেউ বাঁচাইত হাইরত ন। ঠিক করি হালায়, আরও তো শহরের আনাচ-কানাচে হিন্দু হাড়াহড়শি আছে, ঘুরি ঘুরি দেইখব, আসল ব্যাপারখানা কি ? বাজার সারি ঘরমুখো হর ব্রজেন ডাক্তার, কানে কানে কয়, ‘বুইঝলেন দাদা, হিন্দুদের ওরা কালে কালে কচুকাটা কইরব। গোপনে শলা পরামর্শ করের মিউনিসিপ্যাল বাজারে আর হিন্দুদের দোকানপাট রাইখত দিত ন। কী করন চাই, কন ত। চিঠিচাপাটি কইরলে কোন কামে আইব ?’ ‘চেয়ারম্যানেরে আমরা চিঠি লেই দেইখতাম হারি যদি কোনও কামে আইয়ে।’ ‘দাদা, উনি তো মুসলিম লীগের সদস্য, উনি কি আর হিন্দু দোকানদারদের লাই লইড়ব, কী কন আমনে ? পাকিস্তানি পুলিশ সুযোগ হাইলেই বাছি বাছি হিন্দুদের ঠ্যাঙানি দের। উপায় নাই দেখে, মুখ বুঝি সহ্য করের। মুদি দোকানি কাজল ব্যবসাপাতি গুটাই হালাই গেছে। ভিটামাটিরে আঁকড়াই আমরা আর কয়দিন থাইকত হারুম, কন চাই। আমনে বুদ্ধিমান মানুষ, একটা উপায় বাতলাই দেন না।’ ‘গান্ধিজীর কথায় এখানের হিন্দুরা তো বিশ্বাস রাইখছিল, কী হলো? আঁর বড় হোলার কইলকাতায় কী দুর্দশা, আঁই তো জানি। রিফিউজি কয় ওদের, এট্টু থাইকবার জাগার লাই কী মারামারিটাই না করের। ওদের ধরি ধরি ক্যাম্পে, দন্ডকআরণ্যে, আন্দামানে হাডাই দের। কন্নাই গেলে যে আঙ্গ একটু ঠাঁই হইব।’ ‘তাইলে হিন্দুরা কি এইদেশে থাইকত হাইরত ন আর?’ ‘এ কথার উত্তর হাওন খুব শক্ত। মুক্তিহাড়ার সুজিত মন্ডলের মাইয়ার ইজ্জত লই কি টানাটানি হইল, মাইয়ার মা কি কাঁদাকাটিটাই না কইরল। আঁর হাখান জড়াই ধরি কইছিল, ‘কন চাই এই মাইয়া লই আঁই কনঢাই যাই। লজ্জ্বায় মাথা কাটা যায়, কাউরে মুখ দেয়াইতে হারি না। ওগো ঘরে কি বউঝি নাই, কন চাই দাদা ? ধম্ম ধম্ম লই এই দেশটা উচ্ছনে যাইব, আঙ্গরে তাড়াই, আঙ্গ জমি বাড়িঘর কব্জা করি ওরা কি সুখে থাইকত হাইরব? আরে, মুসলমানের দেশ লই কি জল ধুই খাইব ? হেথাগো খোদার কাছে কি জবাব দিতে হইত ন।’ মাথা নিচু করি চলি আইলাম। জবাব দিবার মতো কি ছিল আঁর কাছে যা দিই ওই মাইয়ার মা’র চোখের জল মোছাই দিমু। বুইঝছেন, তবে কিনা একটা আশার কথা আছে মনে হর, সময়টা আস্তে আস্তে ঘোরের। আঁর মোসলমান বন্ধু কবীর,বড় দরাজ মনের মানুষ, কইল, ‘দাদা, আমনে আঁর বেশি চিন্তা করিয়েন না। আল্লার ওয়াস্তে এমন দিন আর রইত ন। আঙ্গ লোকেরা বুইঝত হারের পাকিস্তান পাকিস্তান কই চেঁচাইলে আর কিছু লাভ হইত ন। পশ্চিম পাকিস্তানিরা দেশভাগের নাম করি বকলমে আঙ্গ দেশের সম্পদ চুইসবার ফাঁদ পাঁতা শুরু করি দিছে। ঢাকা রাজশাহী চাঁটগার নেতারা সব বলাবলি করের। হোনা যার ওরা নাকি বাংলা ভাষা উঠাই দি উর্দু চাপাইব। অন বুইঝত হারেনের ওদের মতলব খানা। দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে সিংহাসনে বই জিন্নাহ সাহেব আঙ্গ দেশেরে আসলে উপনিবেশ বানাইব। আঙ্গ নেতাদের আসলে হাত্তাই দের না। আঙ্গ দেশের লোকজন মরুক বাঁচুক ওদের কি আওন যায়। তাই কইতে আছি, দেইখবেন ধর্মের জিগির কমি যাইব, আবার সব এক হইব।’ ‘তা হইলে তুমি কইতে আছ কবীর আমরা এই দেশে নিশ্চিন্তে থাকতে হারুম, আঙ্গ আর ভিটামাটি ছাড়ি যাইতে হইত না। যারা চলি গেছে ওগো ভিটার মুই চাইতাম হারি না, খাঁ খাঁ করের। মনটা আঁর হু হু করের। ‘আমনের মতো শক্ত মনের মানুষ উকিল বাবু, এমন কথা কইলে আমরা যাই কোথায়। সারদা উকিলের মুয়ের দিকে তাকাইতে হারি না। আল্লাহ আঁর জবান যেন কাড়ি নিছে। দুঃখ করি কর, হেথেনের কাঁচারিবাড়ি ভাঙচুর হইছে। ওনার মেধাবী হোলা দেশ ছাড়ি চলি গেছে। কত মেধাবী হিন্দু হোলারা চলি যার, এই দেশের কোয়ালে অনেক দুঃখ আছে।’
আঁর স্বামীর মনঃকষ্টটা আঁই বুঝি। হেথেনের মনের যন্তনাটা আঁই দূর কইরতে হাইরতাম ন। কিন্তু ভাগাভাগি করি লইতে দোষ তো নাই। তাইতে শহর তুন বাড়ি আইলে খোঁচাই খোঁচাই জিগাই – আমনে চুপচাপ হই গেছেন কিয়ের লাই? শহরে গোলমাল চইললে বাড়ি চলি আইয়েন, আঙ্গ গ্ৰামের দলিল মিঞা, মুস্তাক আলীরা আমনেরে কত সন্মান করে, জেঠা জেঠিমা ছাড়া কথা কয় না। হুইনতাম হাই হেথাগরে কারা আই ফুসলাইতে আছে। হেথারা সত্য মিথ্যা বুইঝত হারে না। মাথা চুলকাই আঁর কাছে আয় কয়, ‘আমনেই অন কি কইরতাম কন। কোনোদিন এমন কথা মনেও আইও ন, অন মুসলিম লীগের লোকজন আই আঙ্গ ঘর দূয়ারে শলা পরামর্শ করের কেমনে হিন্দুদের বাড়িঘর তুন উচ্ছেদ কইরত হইব। তওবা তওবা, এতদিন আমনেগো নুনভাত খাইছি, জমি-জিরাত চাষবাস কইরছি, এইসব কথা হোনাও পাপ। আমরা কই দিছি মৌলবী সাবদের, এইসব আকাম-কুকাম আঙ্গ দ্বারা হইত ন, এর হরেও যদি কুমতলব করেন, তবে আঙ্গ লাশের উপর দিই কইরত হইব। হেথাগো গায়ে হাত হইরলে জ্যান্ত হুঁতি হালাইয়ুম, ভাবি চান, কোনটা কইরবেন। ওরা কয়, ‘বলদ, তোমরা চাও না, পূর্ব পাকিস্তান শুধু, মোসলমানের জন্য হোক। বুইঝলা না, ওরা কাফের, বিধর্মী, বোঝ না, হুতলা হুজা করে। ওদের মাইয়াদের মোসলমান কইরত হাইরলে বেহেশতে যাইবা। কও, কোনটা চাও, বেহেশত না দোজখ। কইলাম, দোজখ। চোখ বড় বড় করি কইল, নেক কামটা কইরলা না, তোঙ্গ শাস্তি উপরওয়ালা দিব।’ এই কথা হুনি আঁর স্বামীর মনটা একটু হইলেও শান্ত হইল। তবু কথার কথা একটু কইতেই হয়। হোলাগা আঁর উঠানের মাঝখান দিই দৌড়াদৌড়ি করে। বড় হইছে তো। বাবা মা কি কথা কয়, হুইনবার লাই ছটফট করে। হেতেরও মনের মধ্যে থাকি থাকি নানা প্রশ্ন আই ঘোরে। শহরের ইস্কুলের ক্লাসে সহপাঠীদের মুয়ে অবাক হই কথা গাইন হুইনলে উত্তর খুঁজি মরে। বাবারে ডরে কিছু কয় না, যদি ধমকাই দুই একটা চড় থাপ্পর লাগাই দে। বাড়ি আইলে চোখ মুখ হুকনা দেই বুকে জড়াই ধরি জিগাই কীরে বাবা, তোর মন খারাপ কিয়ের লাই ? ঝরঝর করি কাঁদি হালায়। ওরা কয়, ‘ইয়ান তোগ দেশ ন, জানস নি।’ ‘কেন কয় এমন কথা মা ? তা হইলে আঙ্গ দেশ কোনটি ? আঁই তো ইয়ানেই জন্মাইছি। দেশ হইতে গেলে আরও কি লাগে ? ওর কথা হুনি আঁই তো খেই হারাই হালাইছি। বাবা হোলা কারে শান্ত্বনা দিমু বুঝি উইঠতেই সময় লাগি যাই। হোলারে বুঝাই দেশ ক্যামনে হয় আঁই তো জানি না বাপ, তবে এইটা জানি দেশ হইত গেলে একটা শিকড় চাই, আর সেই শিকড় উপড়ান এত সহজ কথা না, ধম্ম দিই তারে যেমন বিচার করা যায় না আর কোনো সাহেবের কলমের লাগে নাড়ি কাইটত হারা যায় না। হেইঢা তো আঙ্গ মনের মধ্যেই গাঁথি আছে। আঁর হোলার আঁর কথার মর্ম কি বুইঝল জানি না, আঁর চোয়ের দিকে চাই কইল, কী কইলা মা, ‘আমরা যিয়ানে যাই, দেশ আঙ্গ হঙ্গে হঙ্গে চলে ?’ ঠিক কথা কইছস । যিয়ানে আকাশ যায়, যিয়ানে নদী যায়, যিয়ানে বাতাস যায়, মাটিও যায় জলের লগে মিশি, এক সুঘ্রাণ শাস নিবার সময় নাকে আঁই মন লাগে, তন বুইঝবি এইটা আঙ্গ দেশ। কত দূরে তোর মামার বাড়ির দেশ কুমিল্লার সংরাইশ, বেড়াইত গেলে মনে হয়নি তোর দেশ ন, ত্রিপুরা ছিল এককালে, মনটা তো হড়ি আছে হিয়ানেই।
নৌকা চলি যায়। গাঙে নৌকা ভাসে। বুক হাঁঢি যায়। সকাল হইতে তনও অনেকেই বাকি। কারা যায় ? আমের পাতা জামের পাতা কুড়াইবার লাই নারিকেলের ঝাঁটা লই উঠান ঝাড় দিই। ধুল উড়ি যার আর ছুঁই হালার কত গাছের ডাল, কত হাতা, ধুলের লগে মিশি থায় হুকনা ধান, লাফাই লাফাই ঢুকি যার খড়ের গাদার নিচে। ভিজা খড়ের পচা গন্ধে কিলবিল করে কেঁচো ক্যারা দলে দলে। তুরুল পোকা জায়গায় জায়গায় গর্ত করে মাটি তুলি। কলকল কলকল শব্দ কানে আয়ে দূর তুন। আঁই ঝাঁটা হালাই ছুটি চলি যাই সদর দরজায় নাক বরাবর। পাখিরা বাকের মগডালে বই। কি জানি কে চলি যার ঘরবাড়ি ছাড়ি। এমন দশা দেই স্থির থাওন যায়! হেথেনগো ঘর তুন বার করি দিই বাড়ির সামনে লিখি রাইখছে কাইল তুন এই বাড়ির মালিক অমুক শেখ তমুক রহমান। কী আনন্দ, কী আনন্দ, আনন্দে হেট হুলায় নাচে। চোয়ের জলে বুক ভাসি যায়। কী মজা ঠ্যাঙানি দিই জবরদখল। কয়, বিবি বালবাচ্চা লই যদি স্থানে বাঁইচতে চাস, এক কাপড়ে পালা। কোনও শব্দ নাই। বাচ্চা কাঁদি উইঠলে মুখ চাপি ধরি থায়। কথা কই জিগাইবার আগেই পগারপাড়। যদি ধরা খাই যায় এই ভয়ে দিশাহারা। যাগো কোয়ালে এমন দুঃখ নামি আইছে, তাগো আর নিস্তার নাই। কোনো অজানা ঘাটে নামি যাই হাঁঢা শুরু কইরব। কার কাছেই বা দরবার কইরব। যদ্দুর চোখ যায় হাঁটাই সার। এসব কথা ভাইবতে ভাইবতে আকাশের এক কোনে সূর্য আই উঁকি মারে। আলো আই হইড়লে কাকভোরের ছায়া এট্টু এট্টু করি দূরে চলি যায়। আঁই খালের পাড় তুন ঘোমটা টানা ভিতর বাড়ির দিকে চলি আই। কি জানি দেখি হারাই যদি জিগায় ‘কনডাই গেছিলা ?’, তন কি জবাব দিমু। বাড়ির পুরুষ মাইনষে তন বদনা লই টাট্টির দিকে ছোটে। দেশের মধ্যে যে এত কআন্ড ঘটি যার, হিয়ানে লই হেথাগো কোনো হুঁশ নাই। হেথেনরা ভাবে, আঙ্গ গ্ৰামে কত দূরের ঘটনার কোনো আঁচ লাইগত ন। আঙ্গ গ্ৰামের মানুষগুন নিজের মতো চলে। হক্কলে সকলের সুখ দুঃখে ঝাপাই হড়ি ভাগাভাগি করি লয়। ওই তো আমিন চাচা কই গেল, ‘মগের মুল্লুক নি, যা খুশি তাই কইরব, আঙ্গ গ্ৰামে কি কোনো মুরুব্বি নেই? হেথাগো মতের বিরুদ্ধে যাই কোনো কথা হইত ন।’ উপস্থিত একজনে কয় ‘ হেথাগো মনের মধ্যে যদি ঘুণে ধরে।’ ‘হেরও দাওয়াই আছে।’ এসকল কথা হইতেছিল আঙ্গ কাচারিবাড়িতে বই। ‘উকিলবাবু, আমনে কোনো চিন্তা করিয়েন না। আমনেগো দেশ ছাড়ি কুথায়ও যাইতে হইত ন, আল্লার কসম।’
আঙ্গ হাশের বাড়ির রমেশ আই খবর দিল মুস্তাক মাষ্টারের ইন্তেকাল হইছে। বাংলার মাষ্টার খালি নয়, মিউনিসিপ্যাল বোর্ডের চেয়ারম্যান। দশ গ্ৰামের লোক এক ডাকে চেনে। এই মানুষটার জুড়ি নাই। আঁর স্বামীর লগে খাতির ছিল। এত দরদী মানুষ কী কমু। আঙ্গ বাড়ি আইলে গালগল্প কইরলে বুইঝত হাইরত না কেউ কোন ধম্মের মানুষ। কত আবদার করি কইত, ‘ ভাবী আঙ্গ বাড়িতে একবার আপনার পায়ের ধুলো হইরলে খুশি হইতাম।’ কইছিলাম, ‘যামু একদিন ভাইসাব।’ কেন যে কথা রাইখতাম হারি ন, ভাইবলে ভারি দুঃখ হয়। কেন মনে হয় এই মানুষটার এই দুঃসময়ে বাঁচি থাইকলে সকলের কামে আইত। আঙ্গ মনের মধ্যের এই কাঁটাই কি থাকি থাকি খোঁচা মারে, নাকি সাঁকোর খুঁটিগুন এত নড়বড়ে, খাল পার হইতে গেলে মড়মড় করি ভাঙি হড়ি যাইব এই ভয়। নাকি হেচন তুন কেউ টানি ধরি থাকে, হা বাড়ালেই হ্যাঁচকা টান মারে আর হোনায়, ‘হেথারা অন্য দুনিয়ার মানুষ।’ তাইলে মাষ্টার কী মনের এই কিন্তু কিন্তু ভাবখানা গুছাইতে চাইছিল ! আমরা বুইঝতাম হারি ন। অন মনে হইতেছে পাপ করি আইছি। বড় ভুল হই গেছে, ভালো মন্দ বুইঝতাম হারি ন। ভুলের মাশুল দিতে হইব অন। আমরা যন চিনতাম হারি না, হেথেনরা বা আঙ্গরে চিনব কেমনে ? মুস্তাক মাষ্টার চিনাতেই চাইতো, মিলাইবার লাই জানহরান দি হালাইত। মানুষজন বলাবলি কইরত, রসিকতা করি কইত, মাষ্টার হিন্দুর ঘরে না জন্মাই ভুল করি মুসলমানের ঘরে জন্মাই গেছে, হেথাগো হোলাগো লাই এত দরদ। কথাটা ভুল কয়নি, ক্লাসেও হিন্দু মুসলমানে কোনও তফাত করে না, শাস্তি দিবার বেলাও হমান দৃষ্টি। পরীক্ষার খাতায় নম্বর দিতেও চোট্টামি করে না। মৌলবীরা কয় তুমি কোন ধাতুতে তৈরি মাষ্টার। এমন একজন মাইনষের চলি যাওয়াতে শোক সামলাইতে কয়দিন কষ্টই হইল। তাহলে কী দ্যাশের ভিতর এবার আগুন জ্বইলব।
মাইনষে বাঁচে ক্যামনে? খাই দাই হুতি বই আর রোজের কেত্তন করি না এমন কিছু আছে যা আমরা দেখইতে হাই না, ফুঁড়ি ফুঁড়ি বাইর হয়। কত কিছুই তো ঘটে, আমরা ধার ধারি না। হক্কলে ভাবে এমন ত কত ঘটে, ফের ঠিক হই যায়, তা লই এত মাথা ঘামানোর কি আছে ? কাল যন চলি গেছে কালের নিয়মে হরের দিনের কথা ভাইবলেও তো চলে, কালকে দুষে আর লাভ কি। কত কিছুই তো পঞ্চাশ বছর ধরি ঘটি গেছে, তার কি আমরা ফেরত আইনত হাইরছি। ইংরাজরা আঙ্গ দেশ শাসন কইরছে একশো নব্বই বছর ধরি। আঙ্গ গ্ৰামের লোকের বোধ হয় নো, এই দ্যাশটা কে চালার, ক্যামনে চলের, দশ গ্ৰামের জোতদাররা খড়গহস্ত লই মাথার উপর ছড়ি ঘোরার, কেউ তো মুখ খোলে ন। তাইলে দোষটা কার ? কত কথা মাথায় ধরি রাইখছে। বোতলের ভুত বার হই আইলে ঘাড় মটকআই দিব, এমন ভয়ও হাইছে। দলিল মিঞা কি চুপ করি থাইকত হারে ! হায়ের নিচের মাটিটা সরাই আগাই যায়। মাঠে যাওনের তাগিদে জোরে জোরে হা ফেলে। কাঁচা মাটির দুই হাশে সবুজ ঘাস খাড়া হই, আবার হেলিদুলি লুটাই হড়ে। এত দিকে নজর দিবার সময় কোথায়। গট গট করি চলি যায়। আঁর মেলা কাম, নজর দিবার সময় হাই না। তবুও নজর চলি যায়। গরমের ছ্যাঁকা ধান গাছগুনের গায়ে জ্বালা হয়। হুধু দেওন যায় চাষীদের মাথা। বোরো ধানের চারাগুন চোয়ের নিমিষে বাড়ি যায়। ইদ্রিশ মিঞা বর্গায় চাষ করে। মাথার ঘাম হায়ে হেলি দিনের হর দিন খাটি মরে। ইদ্রিশ মিঞার মুয়ে রা-টি নাই। গরু দিই মাড়াইবার সময় হ্যাট হ্যাট করে। খুঁটির চারধারে ঘুরনের সময় যত সময় গড়ায় কথার বাঁধনটাও হাল্টায়, গরুও দৌড়য়, ইদ্রিশ মিঞা গরুর লগে লগে ঘোরে। ওই সময়ে ইদ্রিস মিঞারে আঁই চিনতাম হারি ন। মাঠের তুন লই আঁই আঁটি আনি স্তূপ করি রায়, পালা বাঁধে। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি আইয়ে। কে যে কোনদিকে দৌড়াই কাঁচারি বাড়িতে ঢুকি যাইব। হিয়ানে রইছে খড়ের গাদা। ইদ্রিশ মিঞা আরও দু-তুন জন হোলারে লই খড়ের গাদায় হেলান দেয়। ওরা মাঠ তুন দৌড়ি চলি আইছে। কড়কড় আওয়াজ করি বাজ হড়ের। আর কিছুক্ষণ হরেই যেন আকাশ ভাঙি হইড়ব। কতদিনের জমানো খড়ে বৃষ্টির জল লাগি বাসি গন্ধ। ওরা শোঁকে আর গপ্প জুড়ি দেয়। আঁর কানে আয়ে সেসব কথা। গরুটা খুঁটির গায়ে কল্লায় দড়ি পেঁচাই ঠাঁয় দাঁড়াই দাঁড়াই বিষয়টির জলে চুপচাপ হর, হেইদিগে কারও খেয়ালই নাই। গরুগোতানের কথা কে আর চিন্তা করে। হেথাগো কথার মাঝখানে মাঝখানে একটা হব্দে আয় বার বার করি আঁই আঁটকি যাই। আঁই রসিঘরের এক কোনায় বসি বসি চুলার আঁচটা উসকাই দি। কাইলেও তো আম বাগান তুন মড়াৎ মড়াৎ করি যে ডাইলটা ভাঙি হইড়ছে, টুকরা হুকনা ডালগুন কুড়াই লই আইছি, একটু হইলেও আঁর মাথার উপর হইড়ত। ঈশ্বরের কৃপায় বাঁচি গেছি। আগুনটা গনগন করি উপরের দিকে উডের। ধানগুন বড় ড্যাগে সিদ্ধ করি আর এক চুলায় কাপড় সিদ্ধ করি ধোঁয়া উঠের দেই উঠানের দিকে তাকাই। আঁরে হক্কলে কয়, আমনের থাকি থাকি উদাস হয়নটাই একদিন কাল হইব। আঁই কিঅরুম। আঁর মনটাই এমন ধাতুতে বানাইছে ভগবান। এর তুন বেইরুম কেমনে !
মাটি ভিজি গেলে, হাঙ্গইল, গয়াম,গাব, ঢেউয়া গোলাবজাম,বেতৈন কাডল ককিয়া গাছের পাতা তুন জল গড়াই হইড়লে, কবুতর, চড়ুই শালিখরা ডানার জল ছিটাইলে ইদ্রিস মিঞা, দলিল মিঞা বিড়ি ফোকে, ধানক্ষেতের দিকে চাই থায়। উত্তর বাড়ির মৌলীনাথ ছাত্র হড়ায়, সদর দরজা পার হই যার কবিরাজ বাড়ির দিকে। ঝড়ের তান্ডবে দৌড়াই আই মন্দিরের হাশ দিই কাঁচারি বাড়িতে ঢুকি হড়ে। হায়ের মধ্যে হাঁটু সমান কাদা লাগি কী যে দশা হইছে, দাঁড়াই থাওন যায় না বেশিক্ষণ। ফুডা চাল দিই হোডা হোডা জল গড়াই হড়ি মেঝে বেগ্গাইন ভিজি এমন হইছে দাঁড়াইবার জায়গা নাই। কী আর করে মৌলীনাথ। আকাশের দিকে চাই কত কথাই না ভাবে। ইদ্রিস মিঞা বিড়ি ফুকে, ধোঁয়ার গন্ধে ভুত হালায়। বিষ্টি কী আর থামে, সনের ছাউনির তুন জল হড়ে গড়াই গড়াই। এই সময়ে কত কথাই না মনে হড়ে। চিল্লাই চিল্লাই কয় ‘মাষ্টার আমনে তো কত বড্ডা বড্ডা বই হইড়ছেন, জানেন নি কেন্নে তৈরি হইছে দেশ গাঁ। হুইনছিলাম আঙ্গ বাপদাদারা কয়েক যুগ আগে হিন্দু ছিল, আওলীয়া আর পীরের অলৌকিক ক্ষমতার হরিচয় হাই মোসলমান হয়।’ ‘বেগ্গাইন সোনা কথা। প্রমান তো নাই। খাদেম মুরিদরা কইত পাঁচশ বছর আগে পীর আওলীয়ারা মাছের পিঠে চড়ি, কেউ ভূঁই ফুঁড়ি, কেউ আকাশ তুন নামি আইত। পীর আওলীয়া ফকিরের ভক্ত হই গরীব নিরক্ষর হিন্দুরা বএহএস্ত যাওনের লোভে মুসলিম ধর্ম লইছিল। আঁই তো এইঢা জানিনা তোঙ্গ পূর্ব পুরুষরা কেমনে কবে তুন মুসলমান হইছিল।’ ‘মাষ্টার কইতাম হারেন নি আমরা গরীব কেন হইলাম ?’ ‘ এর উত্তর দিতাম হাইরতাম ন। তবে এইটা কইতাম হারি নোয়াখালীর ধন সম্পত্তি ছিল বৈশ্য-বারুজীবী, সাহা ও নারীদের হাতে। চাষবাস ছিল মাহিষ্য ও মুসলমানদের হাতে, বামুনদের সম্বল ছিল তালপাতার পুঁথি আর কায়স্থদের হাতে কলম।’ ইদ্রিস মিঞা গালে হাত দিই সকল কথা শুইনল আর দুই হাত উপরে তুলি কইল, ‘আল্লার কেরামত’। হরে মেঘের গজরানি থাইমলে যে যার হত ধরি যাইত চাইলে দলিল মিঞা কয়, ‘ মাষ্টার আর একটু দাঁড়াই যান না। একখান কথা জিগাইবার ছিল। জানি আমনের মেলা কাম। মাঠে লাঙ্গল চালাইতে চালাইতে কথাখান চাগাড় দিল। হুইনছি আঙ্গ জেলার নাম ছিল ভুলুয়া, হাঁচা কথা না ?’ হেথাগো কথাগাইন হুইনতে আঁর খুব ভালা লাগে। কান হাতি হুনি। মাষ্টার কয়, ‘ ভুল হোননি দলিলদা। হক্কল দেশেরই একখানা ইতিহাস আছে। আঙ্গও আছে।’ বিষ্টিটা আবারও যেন আকাশ ভাঙ্গি হড়ে। রাইক্ষুসি ঝড়ও উড়ই আই জুড়ি বয়। আঙ্গ ঘড়ের সামনের হাইঙ্গল গাছের ডালটা মড়াৎ করি চালের উপরে উড়ি আই হড়ে। হেথাগো গালগপ্পো জমি উডে। মাষ্টারেরও হুনাইত হারি চোয়েমুয়ে আনন্দের ফোয়ারা ছোঢে। ইদ্রিস মিঞাদের স্কুল, মাদ্রাসা, মক্তবে যাওনের সুযোগ হয়নি। জীবনের আনন্দ উল্লাস হক্কলটাই দোয়া, দরুদ, ওয়াজ, মিলাদ মাহফিলকে ঘিরে। লুঙ্গি আর চাদর আড়াল দিই আমাগো যাত্রায় আর কবির আসরে বই শাস্ত্রের গান শোনে। মাইনষের জানার ইচ্ছা দমানো কেমনে রাখিব ? মাষ্টার শিকড়ের গল্প হুনিয়েই চলে। ‘ভুল হুয়া ভুল হুয়া। মাটির গব্বের তুন উডি আইল বুঝি আবাজ। শোরগোল শোরগোল। বারাহী দেবীর কন্ঠে ধ্বনি প্রতিধ্বনি। রাজা বিশ্বম্ভর শূর নাম দিল ভুলুয়া। আঙ্গ পূর্বপুরুষের জীবন আর আঙ্গ ভবিষ্যতের চিহ্ন আঁকা হই গেল কইতে কইতে। দেইখতে দেইখতে বারশো খ্রীষ্টাব্দ পার হই কত ভাঙচুর হইল, জলের তলায় চলি গেল কত দ্বীপ, আবার চর গজাইল, রাজা বাদশাহর আক্রমণে রক্তারক্তি হইল, জমি দখল হইল, খুনখারাবি হইল। বিদেশি জমিদারের প্রতাপে দেশি জমিদার তালুকদার হইল। অন্য জেলার কত হিন্দুরা বসতি গইড়ল। ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, যশোর, হুগলি, সিলেট,পাবনা, মুর্শিদাবাদ জেলার, রাঢ় দেশের কত হিন্দুই তো বসত গইড়ল। পরে পরে হিন্দুর হোলামাইয়া পীর আউলিয়াগো কেরামতি দেই মুসলমান হইল। ভালা মন্দ জানি না। ভুলুয়া রাজ্য ভাগাভাগি হই পরগনা হইল, নতুন নতুন খাল বিল জলা মিলে হইল নতুন এক বালুচর, হেঁকে মাখামাখি। বঙ্গোপসাগরের কোলের তুন উডি আইল নোয়াখালী। সেই সকল গল্প কইত যাই মৌলীনাথ উদাস হই গেল। ‘কী মাষ্টার কও না ভালা করি। তোঁর বিদ্যাবুদ্ধির তো মাপজোক নাই। কন তুন কনে আই হাজির হই যায়, কে কইব। মাষ্টার আমনে যাই কন, আমরা হক্কলে মিলাই তো অন নোয়াখাইল্লা, হিন্দু মুসলমান। কী ভুল কথা কইছিনি।’ ‘ ইতিহাসের তলায় তলায় কত ইতিহাস। যুদ্ধের পর যুদ্ধ। পাঠান, পর্তুগিজ, মগ আর মোগলরা এই মাটির অধিকার লই কম কাড়াকাড়ি তো করে নি। মেঘনার জল হইছে রক্তে রক্তে লাল। হক্কলে হইত চায় রাজা। কারোগো ক্ষমতা হয়নি এগুনেরে আটকাইবার। হিন্দু মুসলমান হক্কলেরে খাঁচায় হুরি ডেকের নিচে বাঁধি লই যাইত পর্তুগিজরা আর দাস দাসী বানাইত। এরমই শোচনীয় দশা ছিল আঙ্গ দেশের। আর কত কমু, কই শেষ কইরতাম হাইরতাম ন। অনও কি আমরা ভালা আছি, ধম্ম ধম্ম করি আগুনে হুড়িয়ের। বাকিটা ভবিষ্যত জানে।’ ‘মাষ্টার আমনের মতো করি কয়জন ভাবে, সকলের তো ভাগাভাগিতে আনন্দ।’
চাঁদ যেমন করি সূর্যের লগে ঘর করে
মাইয়া হেথির ভাইদের লগে সুর ধরে
আঁর মাইয়াটার কতটুক আলো নিজের আছে আর কতটা ধার করা, কে জানে। তো মাইয়ার বুইঝছেন নি বড় সখ হাত পা ছড়াই থাইকব, নিজের ঘরে খেয়াল খুশিমতো বাসা বাঁইধব। হিয়ের লাই আঁই নজরে নজরে রাই। আঁই খেয়াল কইরছি মাইয়া আঁর উইড়ত চায়। বাড়ির হোলারা যন বই খুলি চেঁচাই চেঁচাই হড়ে, শব্দগুলা রসুইঘরে ওর কানের মধ্যে যাই ধাক্কা মারে, ভাতের ডেগের ঢাকনা উলটাই ভাত উতরাই ভট ভট করে। মাইয়া তন লাকড়ি নিবাই আঁচ কমায়। কাউগে তো কইত হারেন না আঁইও হড়ুম। মাইয়াটার ইচ্ছাটা চাগাই উঠইলে আঁই একদিন ওর বাপেরে কইলাম মাইয়াঢা হইড়ত চায়, কোনো একটা বন্দোবস্ত করা যায় কিনা। ওর বাপ অমন কথা হুনি আকাশ তুন হইড়ল। তড়াক করি লাফাই উডি কইল, ‘তোঁর কি মাথা খারাপ হইছে ? আঁই মাইয়াদের হড়ালেখার বিরোধী নই। তুঁই চারহাশের অবস্থাখান দেইখতে হাও না। তবু কোন আক্কেলে কও। হুরুষ মাইনষে নাকাল হই যার, মাইয়াদের কথা দূর অস্ত। দেশের অবস্থা আগের মতো আছে নি, দিন দিন খারাপ হই তার, হিন্দু মাইয়াদের মুখ দেইখলে হক্কলে ছোলাই খাইব। আঁর অন চিন্তা হইল মাইয়াডারে কেমনে ওই রাক্ষসদের হাত তুন বাঁচাইয়ুম। হিন্দুর মাইয়ারে দেইখলে হেথাগো জিব লকলকাই উডের, তুঁই কইছ হড়ার কথা, একবার কইছ কইছ, দ্বিতীয়বার মুখ দিই উচ্চারণ করিও না।’ বুইঝতাম হাইরলাম দরজাটা সেই যে মাইয়ামানুষের লাই কোনকালে বন্ধ হইছে, কোনকালে যে খুইলব, কেউ জানে না। আঁই অনেক চেষ্টা চরিত্র কইরছি, হক্কল কিছু জলেই গেল বুইঝলাম। নিজের ঘরের লোক এত শিক্ষিত হই রাস্তা খুঁজি হান না, আঁই তো কোন ছার। আঁর মাইয়াঢার মাথা ভালা, কত স্বপ্ন দেইখছি ওর স্বপ্নটা হূরন করুম। বই দেইখলে হেতি ঝাপাই হড়ে, হাইরলে বইয়ের হাতাগুন চিবাই খায়, যেমন করি ঘুণ হোকা কুট কুট করি বইয়ের অক্ষরগুনেরে খায়, আমরা দেইখতও হাই না। আঁর মাইয়ারে আমনেরা কইতে হারেন চোর হুলিশ খেলে, বইয়েরে এমন জড়াই ধরে, হাত ছাড়া কইরত চায় না। বাপ তো কইয়ে খালাস, হেদিকে নজর আছে নি। হেথেনের সন্তুষ্টি অন্যখানে। খালি রামায়ন মহাভারত সুর করি হইড়ত হারলেই হয়, আর কাব্যের চরিত্রদের মুখস্ত কইতে হাইরলে মনের ভিতরটা আনন্দে নাচি উডে, তন বাকিদের ডাকি ডাকি কয়, ‘তোরা দেই যা আঁর মাইয়ার কেরামতি, এই মাইয়া যদি হোলা হইত, বাপের বেডা হইত, বংশের নাম উজ্জ্বল কইরত। হেই দিন তো আর নাই, গার্গী, মৈত্রেয়ী লোপামুদ্রা মরি স্বগ্গে গেছে। মাইয়ার নাম রাইখছি লোপা, তাই হইলে কি হইছে, ঋগ্বেদ শ্লোক রচনা কইরবার মতো পান্ডিত্য কেমনে হইব। সকল গ্ৰহ নক্ষত্র রাশির যোগ ঠিকঠাক না হইলে অমন মাইয়া কি জন্মাইব আঁর ঘরে।’ হেথেনের মনের মধ্যে একখানা সুপ্ত আশা ছিল কিন্তু এইটা বুইঝত হারেনের সময়টা সাথ দেওনের মতো না। মাইয়ার গুণের কদর করেন না হেই কথাখান কেমনে কই। বিশ্বাসও রাখেন এমন একদিন আইব, মাইয়াদের দমাই রাইখতে হাইরত ন। দুঃখ করি আঁর কাছে কয়, ‘বুইজঝনি আঁর মাইয়াটা যদি আরও কুড়ি বছর পরে জন্মাইত, এমন দুর্দশা হইত না, অন তো শিক্ষাদীক্ষা না হাই ঘরে বসেই পচি মইরব। বাপ হই চোয়ের সামনে দেইখতে হইব আর এই মনের কষ্ট লই মইরত হইব যে মাইয়ার স্বপ্নখান ভাঙ্গি টুকরাটাকরা করি দিছি।’ আঁর মাইয়াও বুইঝত হারে বাপের কষ্টখান, হিয়ের লাই বাপের কাছে হড়ার আর আবদার করে না, মুখ বুঝি থায়। ভাইয়ের বই খাতা লই লাড়াচাড়ি করে। কদ্দিন হইছে এক মাষ্টার আইছে বাড়ির হোলাদের হড়ায়। লম্বা বারান্দায় বেত লই হড়া ধরে, শাসনও কি কম করে, হড়া না হাইরলে দু’একখান চড় থাপ্পর ও হড়ে। আঁর খুড়তুতো দেওরের মাইয়ারা উঁকিঝুঁকি মারি ফ্লাইং রায় আর মাইয়া কিন্তু সটান দাঁড়ায় থায়। কিরে লোপা তুই হড়বই নি। মাইয়া এমন করি ঘাড় নাড়ায় কিছুই বোঝা যায় না। ওর ওই টানটান চোখ দুইটা কত কথা যে কইত চায়, কত কিছু যে জাইনত চায় ঈশ্বর জানে। কিছু নমুনা টের হাওন যায় ও যখন ইসকুলের পাঠ্য বইয়ের তুন তুলি তুলি এমন সকল প্রশ্ন করে, জবাব দেওনের মতো কেউ থায় না, হক্কলে হলাই বাঁচে। আঁই কইতাম হাইরতাম ন, এটা কেমনে সম্ভব হইল, ওর ভাবনা চিন্তাগুলা কেমনে জন্মাইল। বাড়ির অন্য মাইয়ারা যেমন খেলনা বাটি খেলি, মজার মজার গালগপ্প করি, বাড়ির কামকাজ করি সময় কাটায়, হেথি তো হেইর তুন বেশি কিছু নয়। আঁই ভাবি ওর এই এমন একটা মন কেন্নে তৈরি হলো, আঁর মাথায় কোনোমতেই ঢোকে না। তবে এককান কথা ঠিক হেথি বারে বারে জিগায় বেগম রোকেয়া, কামিনী রায়, আশাপূর্ণা দেবীর কথা। খাতা পেন্সিল লই খচ খচ করি আবোলতাবোল লেখে, যার মাথামুণ্ডু আঁইও কিছু বুঝি না। আঁর ভাবসাব আর মনের ছায়া হেথির মনের মধ্যে যে একটু আধটু জায়গা করি নিছে, আঁর বাপের বাড়ির সংষ্কার আর এই বাড়ির আদব কায়দা, চালচলন দুইঢা মিলি যে ওর গড়ন হইছে, এইঢা হলফ করি কওন যায়। আঁর স্বামীও কয়, ‘মাইয়াঢারে লই আঁর দুশ্চিন্তার শেষ নাই। কেন্নে যে লোপাটা দেইখতে দেইখতে ওর দাদা ভাইদের মতো হই উইঠল, অবাক হই যায়। হেথির গুণটা স্বীকারও কইরতাম হারিয়েন না, অস্বীকারও কইরতাম হারিয়েন না।’ বইটই লই ওর বাছবিচার নাই, যা পায় গোগ্ৰাসে গিলে খায়। বড়দের হক্কলের হাতে-পায়ে ধরি যোগাড়যন্ত্র করে। হক্কলে হেলাফেলা কইরলেও মাইয়াটার এলেম আছে, দমও আছে। আঁর নিজের মাইয়া বলে নিজের মুয়ে ঢাক পিটাইয়ের না, কেন জানি মনে হয় আইজ না হয় কাইল হেথি কিছু একটা করি দেয়াইব।
লোপা ঘরের এক কোণায় বই কি যেন বিড়বিড় করে। আঁর ছোট জা টকস টকস কথা কয়, ‘লোপা তোর লক্ষণখানা তো ভাল দেইয়ের না। এই বইয়ের ভুত তোর মাথা তুন তাড়াইত না হাইরলে সব্বনাশ হই যাইব। এর একটা হেস্তনেস্ত কইরতেই হইব। মোসলমানের কচি কচি মাইয়াদের লগে গপ্প মারা বার কইরছি। হেথিগো ঘরের খবর জানি তোর কি কামে আইব। কোন চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার হইব, ক চাই। গাঁ গেরামের মাইয়া বাড়ির ভিতরে ঘুরি ঘুরি থাইকবি তা না, তোর পাখনা গজাইছে, উড়ি উড়ি বেড়াইতে চাস, কই বাকি মাইয়ারা তো এমন স্বভাব চরিত্রের নয়, তোর কেন এমন লা ?’ এর উত্তর লোপা কেমনে দিব ? ঈশ্বর ওরে যেমন করি গইড়ছে, তেমনটাই তো হইব। উত্তরটা না দিই চুপ করি কেমনে থাকে। আঁই তো জানি ভেতরটা হেথির গুড়গুড় করের। ‘কাকি, সমাজের খবর না লইলে চলে। হাশাহাশি গ্ৰামের মাইয়া ওরা, কেমনে থায়, কেমনে চলে, না নিলে মনটা কেমন কেমন করে।’ ‘তোর মুখে বেশি চোপা হইছে। বাড়ির হোলাগো লগে হাল্লা দেওনের লাই তোর এমন দশা হইছে, ঝুনা নারকেলের মতো। এই মাইয়া বংশের বদনাম না করি ছাইড়ত ন। যেদিন হুশলাই লই যাই কলেমা হড়াই মোসলমান করি দিব, সেদিন বুইঝতে হারবি কত ধানে কত চাল।’ ‘কাকি আমনে তো বই হড়েন ন, হইড়লে বুইঝতে হাইরতেন এর কী স্বাদ।’ ‘ না হয় তুই রামায়ণ মহাভারতের গল্প মুখস্ত বলতি হারস, লাইন আওড়াতি হারস, হিয়ের লাই খোটা দিতি ছাড়বি না ?’ ‘ আরে, আঁই কি হেই কথা কইলাম, কাকি,আঁই দুই কলম হড়ার লাই ছটফট করি। বাড়ির হোলারা হক্কলএ কেমন সুন্দর হড়ের, আমরা মাইয়ারা কী দোষ কইরছি কয়েন চাই।’ আঁই খালি রঙ্গ দেখি। আঁর জায়ের মুখ দিই আর কোনো কথা সরে না, এককারে বোবা।
ভাই আই হেথের দিদিরে সান্ত্বনা দেয় ‘দিদি তুই হড়ালেখা লই এট্টুও দুশ্চিন্তা ক্যান করিস? ইসকুলে ভরতি না হইচছ তো কী হইছে, আঁই আছি না। ক্লাসে যা যা হড়াইব মাষ্টাররা, বেগ্গাইন তোরে আঁই বুঝাই দিমু। হুরান বই আঁই তোরে জোগাড় করি দিমু। তুই জিগাইন বুইঝতি হারবি না, আঁরে কইচ, তোরে জলের মতো বুঝাই দিমু।’ লোপা এই কথা হুনি কী যে খুশি হইছে, পিতলের কলসিটা লই লাফাইতে লাফাইতে কলের গোড়ার দিকে ছুট মারে। মাইয়ার আনন্দ দেই আঁই কী যে কমু, আঁর হোলাহাইন বেলার দিনগুনের কথা মনে হড়ি যায়। হেই মাইয়া কল চাইপতে চাইপতে ভুলিও যায় কন কলসিটা হুরি গেছে। আঁই ঘর তুন হক্কল কিছু চোয়ে চোয়ে রাখি। রাতারাতি মাইয়ার মধ্যে কেমন যেন হরিবর্তন আইছে। এমনে তো আঁই আগলাই আগলাই রাই, অবস্থাটা হইছে বাঁধন ছাড়া গরুর মতো। কিছু গাইল দিতাম গেলে চোখ দিই জল হড়ে, ভাবি মাইয়া মানুষ কদিন বাদে হরের বাড়ি চলি যাইব। কামকাজ শিখাইবার লাই দুই একটা চড় থাপ্পর দিলে বাড়ির হক্কলে মিলি আঁরে খামচাইতে আয়ে। হুইরে আঙ্গ নাইরকেল গাছের গুঁড়ির ঘাট। ঘর তুন হুইর দূর কম ন। দুই তিন বোন মিলি এতগুন মাইনষের কাঁসের আঁইডআ থালাবাসন মাজিঘসি গেছে হুইরে ধুইত। শেথলাতে হিজল খাই মাইয়ার গেছে কোমর ভাঙ্গি, থালাবাসন গড়াই হইড়ছে হুইরের জলে। মাইয়ার এই অবস্থা দেই মাথা ঠিক রাখতে হারি ন। কী করুম রে! কোনরকমে ঠাণ্ডা হই দুই এক পুরিয়া হোমিপ্যাথি ঔষধ আর্ণিকা খাওয়াই দিই, ধনেশ হাখির হাঁড় দিই ঝাড়িও দিই। ইগাইন আঁই কন যে দেই দেই শিখছি, অন সময়ে অসময়ে কামে লাগি যার। সংসারে এমন বিপদ আই চাপি বয়, হক্কল কিছু তালগোল হাকি যায়। মাইয়াটার তবু হেলদোল নাই, ঘোরে থাকে। স্বপন আই হেথাগরে ঘিরে ধরে। অদ্ভুত কইতেন হারেন। খালি রামায়ন মহাভারতে চরিত্রগুলা লই দিনরাত ভাবে আর ব্যাখ্যা করি করি আঁর নিজের হৌরী, খুড় হৌরীদের হোনায় আর ওরাও কান হাতি হোনে। ঈশ্বরের এত কাছাকাছি আওনের সুযোগ ওরাই বা হাতছাড়া কইরব ক্যান। নাতনিরে লই তেনাদের গর্বেরও শেষ নাই। কদ্দিন হইল হেথি কোমরে চোট হাই বিছানা নিছে। মনের মধ্যে ভারি চিন্তা ভাই কইছে ইস্কুলের প্রশ্নগাইন আনি ঘরের তুন পরীক্ষা নিব। চিন্তায় বেটির ঘুম নাই। কোমরের যন্তনায় কাতরায়, পরীক্ষা দিব ক্যামনে। ঠিক হইছে ওর বাপ হইব হেথির হরিক্ষক। হাশ কইরত হাইরলে দশ টিয়া পুরষ্কার আর সাট্টিফিকেট। মাইয়া তো খুশিতে ডগমগ। এদিকে চোয়ের জলও ধরি রাইখতে হারে না, গাছের পাতার তুন জল হড়ার মতো করি হোটাঁ হোঁটা হড়ে। যে কটা পাতা হোলা বুঝাই দিই যায়, মন দিই হড়ে, সামনের হপ্তায় হড়া ধইরব যে। ঘরদোরের কাম সামলাই তবে না বই লই হইড়ত বইব। অন সুযোগ পাইলেই হক্কলের লগে তর্ক জুড়ি দেয়। এই লই বাড়ির কাকিমা জেঠিমা দিদিরা তো কথা বইলতে ছাড়ে না – লোপা আইজকাল টক্কর টক্কর কথা কয়। কিছু কথা কইবার জো নাই জবাব তুবড়ির ফুলকির মতোই ছোটে। যে যত কিছু কক, মাইয়া কী সহজে হার মানার পাত্তর। লোপার চলাবলাও হালটি গেছে। সংসারে যে রীতিগুন আমরা মানি চলি, সহজে আর মিনতি চায় না, খালি জাইনত চায় এইসব কে শিখাইছে, কিয়ের লাই মানি! জন্ম- মৃত্যু, স্বর্গ-নরক, পূজা-আচ্চা লই হচনের পর হচন করে। হক্কলে হাসে যন জিগায় – আমনেরা হাসলেন ক্যান। তাকের তুন বই হাড়ি হাতা উলটাই দেয়ায় – এই চান কী লিখছে, আমনেরা তো কোনোকালে একটুও হড়িও দেইখলেন না। আঁই আবার কইতে ছাড়ি না অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী। হেথির ঠাকুরমা কয়, ‘হবে তো মূলার এক হাতা, আর তো দিন হড়ি আছে।’
মাইয়ার হড়ালেখা লই বাড়ির মাইনষের চোখাচোখি কানাকানি। জেঠা কাকাদের চোখ টেরা হই যার। কারে কী কমু আঁর এক দেওর আই খবর দেয় ‘হুইনছেননি বৌদি সকলে বলাবলি করের আমনেরা নাকি ঘরের মধ্যে ইস্কুলের বন্দোবস্ত করনের। লোপা নাকি শহরের ইসকুলের মাষ্টারের তৈরি প্রশ্ন লই ঘরে বই হরীক্ষা দিব। তাইলে আমরা কী মুখ দেখাইতে হারুম।’ আরে মাইয়ার আঁর বড় হই মাষ্টারনি হওয়ার সখ। কইলকাতা তুন আঁর বড় হোলা, ঠাকুরপো চিঠি লিখছে। চিঠিতে কত সুখ দুঃখের কতা। হিয়ানে মাইয়াদের আলাদা ইসকুল আছে, দিদিমণিরা হড়ায় প্রাইমারি ইসকুলে, হাই ইসকুলে। ওই চিঠি হড়ি হড়ি মনের ভেতরের গোপন ইচ্ছাটা জাগি উইঠছে। আঁরও তো অল্প বয়সে বিয়া হওয়াতে আর হড়তাইম হারি ন। আঁর স্বপ্ন আর মাইয়ার স্বপ্নখান মিলিমিশি এক হই যাওয়াতে আঁই সায় দিছি। বুইঝনি ঠাকুরপো নিজের মাইয়া বলি কইছি না মাইয়ার মাথা ভালা, একবারের বেশি দুইবার বইলত হয় না, সব ঝরঝর করি মুখস্ত বলি দিতে হারে। তোঁর বিশ্বাস না হয়, হরীক্ষা লই চাও না। তুঁই কী চাও না তোঙ্গ বংশের মাইয়া বিদ্বান হোক। হেথাগরে দেই তোঙ্গ লেদা মাইয়াগুন দেই শিখব। ‘কী যে কন, হেঢাই তো মুশকিল। হক্কলে ওই নিই তো পেচাল পাড়ের, আঙ্গ গ্ৰামে এমন বেআক্কেলে কআণ্ড জম্মে দেখেনি। হড়ালেখা কইরত যাই মাইয়ার বয়স হই গেলে বিয়েসাদি ক্যামনে দিমু।’ এই কথাটা ভাবি চাও তো, তোঁর মাইয়া মূর্খ থাইকলে হেথির হোলামাইয়ারে কী শিখাইব। পুরা জগতটা অন্ধকার লাইগব, এক বিন্দুও আলো হাইতন। দুনিয়াদারি হালটি যার ঠাকুরপো, এট্টুও কী টের হাইচ্ছ না। আঁর কথা ঠাকুরপোর হচন্দ হইল না, মাথা চুলকাই চৌকাঠ ডিঙ্গাই চলি যায়। কোনও জবাব যে নাই হেথের কাছে।
মাইয়া আঁর দরজা বন্ধ করি কী করের কেউ জানে না। হেথির খুড়তুতো জ্যাঠতুতো বইনেরা বাড়ির চৌহদ্দিতে ঘুরি ঘুরি বেড়ায়, ভাইরা হান্ডাগুলি মারে। লোপারে অন দলে না হাই চিন্তার একশেষ। শেফালীর ভাগে হইরছে মাসের পনের দিন হুজার ভাগ। হুজাআচ্চার নিয়ম কানুন ষোল আনা রপ্ত কইরছে। ধোয়া একখান শাড়ি হরি, হুইরে যাই বালতি করি জল আনে, হুজার বাসন ধোয়াপালা করি মন্দিরের দরজা ঠেলি দিই হুজায় বসে। হাঁচালিখান লোপাই সুর করি জোর গলায় হড়ি দেয়। অন আর কোথায় খুঁইজা হেথাগরে। উপায় নাই, তাই জিগাইন মুখস্ত আছে, হিগাইন বার বার হড়ে। দরজার বাইরে মন্দিরের উঠান। বাস্তুগাছ ডান কোনায়, বাঁ কোনায় গয়াম গাছ আর পশ্চিমে করবি ফুলের হাতায় ছড়াই থায়। লেদা মাইয়াগুন ঝাড় দিই হরিষ্কার করি রায়। নিচে নামলেই লাউ মাচা, কুমড়া মাচা। হলদি রঙের কুমড়া হুল আর সাদা রঙের লাউয়ের হুল, ডগার তুন হাতার গন্ধ বার হই বাতাসে ভাসে। লাউডগা সাপ লকলকাই উঠে। শেফালি ঘন্টা বাজায়। মন্দিরের ধার ঘেঁষি আঙ্গ বাড়ির কুত্তাগুন হুই থায়। শব্দের আওয়াজ হুনি হেগুনে গলা উঢাই ঘেউ ঘেউ করি ডাকে। বাড়ির বউ মাইয়া হোলারা বুইঝত হারে হূজার আরতি হুরু হই গেছে। অন বেলা বারোটা, বাজার তুন ব্যবসাপাতি বন্ধ করি ব্যবসাদাররা ঘরমুখো হইব। মাঝিরাও ঘাটে নৌকা ভিড়াইব। লোপারে মাইয়ারা হুজাআচ্চা তুন হক্কল কামে লগে হাইত, হেথি এখন বইয়ের হাতা খুঁজি মরে। যাগো মুয়ে অনও ঠিকমতো খই হোডে না, হেগুনেও সিলেট পেন্সিল বই লই নাড়াচাড়া করে। বইয়ের রোগ তো যেন তেন রোগ নয়, ছোঁয়াছো রোগ, একবার ধইরলে আর ছাড়ে না। লোপা হেগুনেরে গল্পের মতো করি বুঝাই দেয়, ওরা এমন ভাব করি হোনে যেন অন্য দেশে চলি গেছে। ওরা ভালা করি জানে ভাইদের মতো ওরা কোনোদিন ইসকুলে যাইত হাইরত ন। তবু কিয়ের লাই জানি মনের মধ্যে যেন আনন্দই আনন্দ, লাফায় ঝাঁপায়। লোপার হিছন হিছন ঘোরে। হেথিগো বাবারা কয়, ‘তোগো কোনো কাম নাই, মা’র হাতে হাত লাগাইতে হারচ না, কামকাজ না শিখলে চইলব কেমনে। হৌর বাড়িতে যাই তো মুখ ঝামটা খাইবি দিনরাত। আঙ্গ হোড়া কপাল মাইয়ার হড়ার ঠেলায় সব সম্বন্ধগুন ভাঙ্গি যার। মত নষ্টের গোড়া ওই বড় বৌদি মাইয়াগুনের মাথা খার। লক্ষ্মীর পাঁচালি শনির পাঁচালি হইড়তে হাইরলেই তো হইল, না মাইয়াগুন পণ্ডিত বানাইবার সখ। কিছু কইবার কী জো আছে, কইত গেলেই তো পাঁচ কথা হুনাই দিব, হেথেনেই জানে হড়ার মধ্যে কী মধু আছে!’ আঁই কথাগাইন হুনি মনে মনে হাসি। গান আছে না – দোষ কারো নয় গো মা, আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা…। বাপের ঘরে এক কাকা একতারা বাজাই গান কইরত, ভেতরটা তন কেমন করি উইঠত। অত কথার অর্থ কী তন বুইঝঝি ! অন বয়স বাড়ছে, বুইঝতাম হারি, খুব না দিত হাইরলে কিছু বোঝা যায় না, গাঙের জলের মতো ভাসি ভাসি চলি যায়, কুলকিনারা খুঁজি হাওন যআয় না যে হাড়ে উইঠব, অক্ষরের জাদুতে কত যে মায়া, ডুব না দিত হাইরলে বোঝা যে সহজ কথা নয়, খালি জল আর জল। মাইয়া আঁর শিখত চায় কিন্তু কে আর মুয়ের কাছে খাওন আনি দিব। চারিদিকে দুর্মূল্যের বাজার, কার অত আর পয়সাকড়ি আছে, দামদর করি খুঁজি আইনব। খুদকুঁড়া যিয়ানে যদ্দুর হায়, খুঁজিপাতি আনে। টঙে আঙ্গ থরে থরে হাজানো রইছে কত হুরান কাঁসা পিতলের থালাবাসন কলসি ডেগচি। দরকার না হইলে কে আর নাড়াচাড়া করে। এই মাইয়ার বড় সখ। দিনদুপুরে ঝনঝন আবাজ করি সব তছনছ করি হালায়। কার কথা কে হোনে – ও লোপা কী করচ, চাপা হড়ি তুই মরবি তো একদিন, তন তোর আক্কেল হইব, তুই তো মরণপণ কইরছস কারও কথা হুইনতি ন, তাইলে আর কি, হাত-পা ভাঙি হড়ি থাক। ওমা, মাইয়ারে দেই সিঁড়ি বাই বাই টঙ তুন নামের। লাল শালুতে পেঁচানো কী একটা বুকের মধ্যে চাপি ধরি আছে। সোনাদানা হাইলে চোয়েমুয়ে খুশির ঝিলিক মারে, হাবভাব দেখি ওইরকমই লাগে। কোনো কথা না বলি মাঝ ঘরের হেছনে ঘরটায় চলি যায়। ওই ঘরটাতে হেথির যতো নিজের লগে নিজের কথা কওয়া, শয়তানি, মদ্দানি। কাউরে ঢুইকত দিত ন। হুরা বাড়ির মধ্যে ওই একচিলতা ঘরই হেথির সম্পত্তি। মাঝে মাঝে রাগি গেলে কই – তোর হৌরবাড়ি যাইবার কালে এই ঘরটাও তুই লগে লই যাস। মাইয়া এই কথা হুনি মুখ ভার করি হালায়। কিন্তু মাইয়া টঙ তুন কী নামাই আইনল দেইখত তো হইব। খুলি দেই এক আশ্চর্য জিনিস। চৌকোনা ভারি ভারি। খুলি দেই আরে, এই তো বই। লেখক: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কলকাতার তুন কেউ আনাইছে। হুইনছিলাম আঁর এক দাদাহৌর গান গাইত, কবিতা লিখত, নোবেল হইড়ত, হাগলামি করি ঘুরি ঘুরি বেড়াইত। কোন কামকাজে মন দিত না। রাগিমাগি হেথেনের বাপ মন ঠিক করনের লাই পণ্ডিতের বাড়ি হাডাই দিছিল। সে এক আজব কাণ্ড। হেথেনের হিয়ানেও মন টেঁকে নি। কন্নাই যে হলাই গেছিল, ঈশ্বর জানে। এদ্দিন বাদে এই মাইয়া খুঁজি খুঁজি বার কইরছে। বিধির কী খেলা! কার ধন কার কাছে হয় অমূল্যরতন! মাইয়ারে আঁই কী কইয়ুম, নোবেল হইড়তে বারণ করুম, না হেথির যেমন ইচ্ছা মন চায় করুক বলি ছাড়ি দিমু, ঠিক কইরতাম হারিয়েন না। হেথির বাপ হুইনলে তো মাথা গরম করি হালাই লঙ্কাকাণ্ড বাঁধাইব, যা চেতা মানুষ। মাইয়া তো ঘরের মধ্যে মাথা গুঁজি খালি নোবেল হয়ে। স্নানের কথা ভুলি যায়, ফাঁক হাইলে আবার বইয়ের হাতা উলটায়, নেশার মতো হাই বইছে। মাইয়া তো আঁর কতা হুইনত ন, অন কারে কই। শেষমেশ শহর তুন হোলা বাড়ি আইলে হেরে কইলাম। হেথে কইল, ‘মা, আমনে কিচ্ছু চিন্তা করিয়েন না, দিদিরে আঁই বুঝাই কমু।’ মাইয়ারে আঁই জিগাইলাম, তুই কী হড়স? উত্তর দিল একখান কথায় – ‘রাধারাণী’।
কইলকাতা তুন এক নাতজামাই আইছে। বাড়ির হোলাপাইনরে লই জামাইয়ের আমোদ আহ্লাদের শেষ নাই। এত্ত বড় শহর, হক্কলের লাই হিয়ান তুন একটা না একটা কিছু লই আইছে। মজার এমন এক জিনিষ আইনছে, যা আগে কেউ দেয় নাই। নতুন এক জিনিস দেই হক্কলে হতবাক। আগে এর নাম হুইনছে, স্বচক্ষে দেয় নাই। উঠানে চাটাই হাতি গোল হই বই হোনে এক বাক্সের ভেতর তুন বার হই আয়ে মাইনষের কন্ঠ। যাত্রাপালা: নটি বিনোদিনী হোলামাইয়ার মনের মধ্যে আনন্দের ঢেউ উঠায়। এক দল আবার গোল হই নাচে। দলিল মিঞা দূরে চোখ পিট পিট করি চায়, তাইলে এর নামই রেডিও। লোপা কয় মা এই রেডিও কে বানাইছে জানেন নি ? উত্তরও দেয় নিজে, মার্কনি। এমন একটা আশ্চর্য জিনিস আঙ্গ বাড়ির উঠানে যে কোনদিন বাইজব, কল্পনাও তো কইরত হারে ন। নাতজামাই কইল, ‘কাল মহালয়া, কাল সকাল সকাল সকলে ঘুম থেকে উঠবে।’ ‘কিয়ের লাই, কন।’ সকাল হইল, বাড়িশুদ্ধ লোক উডি আই আমবাগানের নিচে আই জড় হইল। রেডিও চালু কইরতেই শুরু হই গেল মহালয়া ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের এমন গলা জম্মে হুনি নাই। এমন যে হইব, আগে কেউ জানে ন। আমবাগানের নিচে যেন মেলা বই গেছে। কোথা তুন যে এত লোক আইছে চোয়ের নিমেষে। চার বাড়ির বউঝি, হোলারা, কর্তারা হাজির হই গেছে। এমন কীর্তি এই জনমে দেই ন। হক্কলের আনন্দ আর ধরে না। সূর্যের আলো আমগাছের ফাঁকফোকর দিই ঠিকরাই হড়ের। মা যেন জাগি উডের। কারো মুয়ে কোনো কথা নাই। মহালয়া শেষ হই গেছে, কারও এট্টুও নড়ন চড়ন নাই। এই আশায় বসি আছে যদি ফের শুরু হয়। একজন গ্যাতি হৌরি জামাইর মাথায় হাত দিই আশীর্বাদ কইরল, ‘জামাই কী হুনাইল, কোনোদিন ভুইলতাম ন, বাঁচি থাক। কইলকাতার লোকেরা কী ভাগ্যবান, বছর বছর হুইনত হায়, আমরা পোড়াকপাইললা এত ভালা ভালা মায়ের গল্প গান হুইনতাম হারি না।’ আঁর মাইয়া মনের খেয়ালে কই হালায়, ‘মেসো, একখানা রেডিও কিনে দিয়েন চাই।’ সরল মনে কি মনে আইল, কই দিল। হেথি যা দেয়, মনের মধ্যে গাঁথি হালায়। আঙ্গ গ্ৰামের লোক আগে কনও রেডিও দেয়নি। হিয়ের লাই হামলাই হইড়ছে। বাক্সের মধ্যে নিশ্চয়ই করি মানুষ আছে, না হইলে এত কতা কয় কেমনে! এই সকল কথা হুনি জামাই হাসে। হেথি অবাক হই ভাবে কত কিছুই অনও শিখনের বাকি আছে। জামাইয়ের মুয়ে গপ্প হুনি হুনি চোখ বড় বড় করি চায়। ফোনে এক জায়গা তুন কথা কইলে অন্য জায়গা তুন হোনা যায়, অমন আজব যন্ত্রও হয়! শহরের মাইনষের মাথায় কত না বুদ্ধি, আঙ্গ মাথায় গোবর পোড়া।
খাওয়া নাই, নাওয়া নাই, মাইয়া খালি হড়ে। ভুতে হাইছেনি! ভাই বাড়ি আইছে। প্রশ্ন করি করি হাগল করি হালায়। এত প্রশ্ন কইরলে উত্তর দিবে ক্যামনে। যারা ইসকুলে যায় হেথাগো চাই দিদির বুদ্ধির বহর দেই আঁর হোলা আকাশ তুন হড়ে। কেন্নে দিদি হাতার পর হাতা মুখস্ত বলি দেয়, ইসকুলে হইড়লে ফাষ্ট সেকেন্ড তো হইতই। দুঃখ করি কয়, ‘এইদেশে যদি মাইয়াদের হড়ার বন্দোবস্ত থাইকত, কন্নাই চলি যাইত আঁর দিদি, হোলাদের সাধ্য কী ধরে।’ মাষ্টারের জিগায়, ‘স্যার, মাইয়ারা কেন ইসকুলে হইড়ত আইত হারে না। মাষ্টারের মুখ দিই নাকি কোন কথা সরে না। সহপাঠীরা এদিক ওদিক চায়। মাইয়ারা কিয়ের লাই ইসকুলে আইব? হেথিরা হড়ালেখা করি কীই বা কইরব? এমন বেঢপ প্রশ্ন কেউ কাউরে করে? মাইয়ালোকের বুদ্ধি কোন কামে আইব? ডেগ মাষ্টারি, ঘর গোছানো আর বাচ্চার জম্ম দিবার লাই নাকি মাইয়াদের ভবে হাডাইছে। এইসব কথা হুনি আঁর জেদ চাপি গেল। যেমনে হোক তেমনে হোক মাইয়ারে আঁই হড়াইয়ুম। ঘর সংসারের কামকাজ তো কইরতেই হয়। এত্ত বড্ডা পরিবারে হক্কলের বাঁধাধরা কাম তো আছেই। বাগানের তুন লাকরি কুড়ানো, উঠানের ঝাঁট দেয়া, বাসন মাজা, কাপড় কাচা পালা করি, পূজা আচ্চা, পাঁচালি হড়া কোনটা আর বাদ আছে। সময় বাঁইচলে বাড়ির অন্য মাইয়ারা যন গালগপ্পো করে, আঁর মাইয়া তন বই লয় বয়। একখান ঘর আছে, হিয়ানে কেউ ঢোকে না, চাটাই বিছাই হারিকেন জ্বালাই হইড়ত বয়। বেশিক্ষণ তো হড়ন যাইত ন, কেরোসিন তেল মাঙ্গা। হইড়তে হইড়তে ঝুরি হড়ি যায়। নরম স্বরে কই, যা মা চোয়ে মুয়ে জল দিই আয়, ঘুম চলি যাইব। কদিন বাদে ঘরে বই হরীক্ষা দিব ওর বাপ। ছ মাস হরে হরে হরীক্ষা দিতে হইব, যদি একবার ফেইল করি রায়, বাপ ওর বকুনির চোটে ভুত ভাঙ্গাইব। বাংলা, ইংরাজি, অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল আর বিজ্ঞান কোনটাই কি আর বাদ যায়। স্লেট পেন্সিলে এক অঙ্ক বার বার করি মোছে আর কষে। হরে হরে হপ্তায়ের দেওয়া অঙ্ক কুড়িটা করি কাঠ পেন্সিল দিই খাতায় করে। ভূগোলের ম্যাপ আঁখিতে হেথি ভয় হায়। বাপের ধমকের চোটে কাঁচুমাচু খাই যায়। তবে একখান জিনিস খুব লাভ হইছে। লেদা হোলাপাইনগুনে জাইনত চায় ‘দিদি, তুই কী হড়স রে?’ ‘রামায়ণ মহাভারতের গল্প হড়ি, তোরা হুইনবি?’
এই তো গেল নিজেদের বাড়ির কতা। হক্কল কতা বাতাসে ভাসে। এই বাড়ি ওবাড়ি করি কন যে কথা গাইন ভাসি চলি গেল। মাইনষে যে কেন সহজে অস্থির হই যায়, কে কইব। নতুন কিছু হুইনলেই চোখ টাটায়, রে রে করি তাড়াই আসে। কত কতার আগুন ছড়ায় – মাইয়া মাইনষের আবার হড়া কী ? কারা আই কতা হুনাই যার, আঙ্গ চার হুরুষ আগের গ্যাতি, কত বছর আগে ভাগ বাটোয়ারা হই নতুন বাড়ি হই গেছে, তবুও কতার পিঠে কতা রাইখতে ছাড়ে না। নতুন কিছু কইরত গেলেই খবরদারি করে। লতায় পাতায় জেঠা আই কয়, ‘এটা কিন্তু তোরা ঠিক করছেন না। আঙ্গ বাড়ির মাইয়াদের উসকানি দেয়ছের। হেথিরা কত বায়না ধরের, কওন হুরু কইরছে বই হইড়ব। এটা আবার একখান কথা হইল। উত্তুরের বায়ু দক্ষিণে আইলে যেমন আজব লাগে কতকটা তেমন। এত কিছু মাইয়াদের মাথায় ঢুইকলে যদি বেচাল হই যায় তন সামলাইতে হাইরবি নি, মাথায় চড়ি বইব।’ ওই জেঠার কতা হুনি আঁই তো আকাশ তুন হইরলাম। রাগ করিয়েন না জেঠা, একখান কথা কই। যদি মাইয়ামানুষের লই আমনেগো এত মাথা ব্যথা, তো খালের জলে ভাসাই দেন, আমনেরা একাই ঘরে থান। ‘এই তুমি কী কতা কইলা, ঘরে বউঝি না থাইকলে চলে, রাজ্যের কাম কইরব কে?’ ও এতক্ষনে আমনে হাঁচা কথাখান কইলেন। আঙ্গ ক্ষমতাখান দেইখলে আমনেরা এত ভয় পাই যান ক্যআন? মাইয়ারা বাঘ না ভালুক যে সুযোগ পাইলেই হুরুষ মাইনষের মাথা মুড়াই খাইব। মাইয়াদের এট্টু সুযোগ দিই দেয়েন না শেষকালে আমনেগো লাভ ছাড়া লোকসান হইত ন। বৈতরণীও হার করি যাইবেন এক লাফে। ‘তুঁই এইটা কী কও কমলের মা, তোঁর কি এট্টুও বোধজ্ঞান নাই, মাইয়ারে হড়াইতে চাইছ হড়াও, এর ফল কিন্তু ভোগ কইরত হইব। নিজের মাইয়ার সব্বনাশ কইরছ কর, হুরা গ্ৰামের হিন্দু মাইয়াদের হরকাল ঝরঝরে করি দিও না। এমনিতে হুইনতে আছি হিন্দু মাইয়াদের ধরি ধরি বিয়া করার হিড়িক হইড়ছে মোসলমানদের মধ্যে, সেই জ্বালায় জ্বলিহুড়ি মরিয়ের, তাড়াতাড়ি হরের বাড়ি হার কইরতাম হারইলে বাঁচি যাই। দেশকালের অবস্থার কথা তো একবার ভাইববা।’ কথাটা যে এক্কইবারে হালাই দিবার মতো নয়, কিন্তু মাইয়ার স্বপ্নটারে জলাঞ্জলি দিই কেমনে? ক্যামনে মাইয়াটারে কই, তোর হড়া বন্ধ করি দে। মাইয়া তো মুখটারে বেজার করি হালাইব তন। তবে মাইয়ার আঁর মনের গতি অনেক হালটি গেছে। মতো রাজ্যের খুঁতখুঁতানি ছুঁতমারগ আর আগের মতো মাইনত চায় না। হছন্দ না হইলে কতায় কতায় তর্ক লাগাই দেয়। কতায় কতায় কইছিলাম, স্নান করে লোহা হাতে বাড়ি আসতে নাই। মাইয়া মুয়ের উপর জবাব দিল, ‘এমন কতা কইও না মা, তা হইলে হড়ালেখা শিখানোর লাই এত উডিহড়ি লাইগছ ক্যান?’ মাইয়ার কতা হুন, এতকাল যা মানি আইছি, আঙ্গ বাপ ঠাদ্দারা, হৌড় হৌড়িরা যা মানি আইছে বেগ্গাইন ভুল ! এতদিনের শিক্ষাদীক্ষা সহজে ভুলন যায় রে মা, মন তুন তাড়াইতে সময় লাইগব। তোরা আজকাইলার যুগের মাইয়া, তোগো মতের লগে আঙ্গ মতের ফারাক তো থাইকবই। এই ধরছ না, কাল তো মনসা হুজা, উপাস করবি, মা মনসার গান করবি, আচার বিচারও মাইনবি, কাঁসর ঘন্টা বাজাই নমোও করবি, কলা, নাইরকল, তিলের সন্দেশ দিই ভোগ নৈবেদ্য দিবি তো, কলার খোলার ভেউঁরায় চিয়ঁই পিঠা রাই বাতি জ্বালাই হুইরে ভাসাইতি ন, কলাপিঠা বানাইবি। তোর বইয়ে কি ইগাইন লেখা আছে? নাই, মনের ভেতরে ঢুকি আছে, যুক্তি তক্ক করি এমন অনেক কিছুরই কুল কিনারা হাইতি ন। আমরা যে বত-এর ভাত খাই – আশ্বিনে রাঁধে কার্তিকে খায়। যেই বর মাগে হেই বর পায়।। সংক্রান্তির দিন আতপ চালের ভাত রাঁধি হরের দিন সেই ভাত গুড় নাইরকেল কোরা গন্ধ লেবু দিই চটকাই খাই, হরে ট্যাহা বৈচা, চাঁদা মাছ কড়া ভাজি দিই হান্তা ভাত খাই আনন্দ করি, এই নিয়ম কনডাই লেয়া আছে, মাইনষে নিজেই খুঁজি নিছে দরকারে। এইসবেরে অস্বীকার করুম ক্যামনে, তুই ক। সময়ের পায়ে মাথা নোয়াইতে হয়। মাইয়া আঁর কথা হুনি ধন্দে হড়ি যায়। হেইলে কী দুই রকমের শিক্ষা হয়! মাথা চুইলকাতে চুইলকাতে ভাড়ার ঘরের দিকে চলি যায়।
মাইয়া আঁর শ্রীপঞ্চমী দিন হুজা করে ঘটা করি। হিঢা হায়েস বানায় নিজের হাতে। বেড়ার ফাঁক দিই চিতল হিঢা নিজেও খায়, ভাই বোনেদের খাওয়ায়। হেই বেলা খুব বিশ্বাস করে হেইলে মনে রাখবার ক্ষমতা নাকি বাড়ি যাইব। হেই বেলা আর মুক্তির ধার ধারে না। হড়ালেখার ভুত যে হেথিরে চাপি ধইরছে চার ধার তুন।
হেথি ভূগোল ছাড়া হক্কল বিষয়ে হুরা মার্কস হাইছে। রসা মাষ্টার দিই হেথির বাপ খাতা দেখাইছে। নিজে দেইখলে ঠিক বিচার যদি না হয়। মাইয়াও তাতে খুশিতে ডগমগ। আরও বেশি খুশি হইছে এইবার বাপ যন কইছে নতুন বই খাতা কলম কিনি দিব। এতকাল তো গোপনে হুরান বই দিই হইড়ছে। নতুন বইয়ের গন্ধই আলাদা। চারহাশে ছড়াই যায়। বিকাল তুন এঘর ওঘর করে বাপ কন নতুন বই আনি দিব শহর তুন। সদর দরজার দিকে তাকাই থার কন নৌকা আই ঘাটে আই ভিড়ব। আঁরে হুদ্দা হাগল করি হালার বাপ কন আইব। ঘরের চৌকাঠ ডিঙ্গাইলেই ঝোলাটা বাপের কাঁধের তুন টান মারি হালাই দেয়। বইয়ের ছবি দেই চুপ মারি যায়, কি কইব আর কি কইতন বুঝি উইঠত হারে না। খালি নাকের কাছে নি গন্ধ শোঁকে। হক্কলরে তুলি তুলি দেখায়। নাইচব না গাইব বুঝি উডোনের আগেই ছড়ছড়্ করি বইগুন হাত তুন মাঢিতে হড়ি যায় । কত না অপরাধ কইরছে ভাবি ঝারিঝুরি বইগুন লই কপালে ছোঁয়ায়। হক্কলে জড় হই দেখে এমন অবাক কাণ্ডকারখানা! মাইয়ার হাগলামি দেই আঁইও ভালামন্দ দু’এক কতা হুনাই দিই। টেবিল চেয়ার তো নাই চইয়ের এক কোনায় সাজাই গোছাই রাখি দেয়। রসময় মাষ্টার দরজার সামনে দিই যাইবার সময় কী মনে ঘরে আই ঢোকে। ‘নতুন বই বুঝি, লোপা? উঁচা ক্লাসে উইঠছ, এইবার কিন্তু আরও ভালা করি হইড়ত হইব, কেমন।’ রসময় মাষ্টারের কথাগাইন একটু শুদ্ধ শুদ্ধ লাগে। মাইয়ারে সাহস জোগাইলাম এই জীবনটা হুরাটাই তোর, যেমন ঢঙে বাঁইচতি চাস বাঁচ, আঁই কিচ্ছু কইতাম ন। ঝওলআভর্তই বইখাতা লই দুইধারে দুই বেণী ঝুলাই দুইতে দুইতে চলে। আঁই চাই থাই। যেদিক যাইত চায় যাক। হাঁডি হাঁডি আজ না হয় কাইল হেথির লক্ষ্যে পৌঁছি যাইবই, এই বিশ্বাস আঁর আছে। ভয় তো লাগে, রাস্তাঘাটে কাঁচা মাঢির ভেতরে কত সরু সরু কাঁটা, কন যে হায়ে হুঁডি যাইব, কে জানে। এই বাড়ি তুন সেই বাড়ি যাইতে বাঁশের হামা, ধুপুস করি যদি খালে হড়ি তাই জলের তোড়ে ভাসি যাইব। হেথি ভরসা দেয় – মা, আমনে কোন চিন্তা করিয়েন না, হড়ালেখা শিখনের লাই কষ্ট কইরত হইত ন, কন। আমনেও তো কত কষ্ট কইরছেন, হক্কলের বিরুদ্ধে যাই মাইয়ারে হড়াইতে চান। রসময় মাষ্টারও চায় মাইয়ারা যাতে হড়ালেখা করে। মাইয়া আর জান হরান দিই জোরকদমে মনযোগ দিই হড়ে। কামের ফাঁকে হড়া মুখস্ত করে। মাষ্টার কয় হেথিরে এক ক্লাস উপরের বই আনি দিতে, ছয় মাসে সব বই হড়ি হালাইছে কিনা। মাষ্টারেরে এমন প্রশ্ন নাকি করে, কোন উত্তর দিতে হারে না, আজব মাইয়া বটে। মাষ্টার কয়, ‘এত ছাত্র হড়াইলাম, এমন ছাত্রী জম্মে দেখি নাই, হোনার টুকরা মাইয়া। ভাগ্য ভালা, এমন মাইয়া পেটে ধইরছেন।’
দেশের কথার হিসাব রাখে কোন জনা
মনের দুঃখে হরান যায়, শুনতে রে মানা
দেশ তো ভাগ হইল, কতশত লোকের কপাল হুইরলো। কে যে কোনদিকে ছিটকাই গেল, কেউ কি তার হিসাব রাইখছে। বুক হাঁঢি গেছে, গুমরাই গুমরাই কাঁদি মইরছে। কেউ তো কারো মুখ দেয়ের না কমদিন তো হইল না। মাইনষের কথা না হয় বাদই দিলাম, গরু-গোতান, কুত্তা বেড়ালের চোখ দিই বাই বাই জল হড়ের অনও। টুকরা-টাকরা হই যাবার হড়েও যে আগুন জ্বইলছে দাও দাও করি, হেইঢা যেন টিম টিম করি জ্বলের, চোয়ে দেয়ের না কেউ সত্য কিন্তু আগুনের আঁচ তুন কারও কি রেহাই হাইব কোনোদিন। কেউ কেউ আনন্দে মজি আছে, মনের মতো দেশ হাইছে, কেউ কেউ যেন মনের দুঃখে চেঁচাই উঢের, এইঢা আবার একখান দেশ হইল। কথাখান তো ফেলাইনার নয়, অন্য জায়গা থুন কি আমাগো দেশ শাসন করা যায়, পাকিস্তানীরা হুকুম কইরব আর পূর্ববঙ্গীয়রা মাথা নত করি অক্ষরে অক্ষরে হুকুম তামিল কইরব, এইঢা কেমন করি হয়। এইসব হক্কল কথা আঁর কানে আইয়ের। হাওয়ায় ভাইসতে ভাইসতে চলি আয় নি। রসময় মাষ্টার ঘুইরতে ঘুইরতে যন আঙ্গ বাড়ি আয়ে, দেশগাঁয়ের খবর আনি আঁরে হুনাই যায়। হইলা হইলা আঁই গ্ৰাহ্য কইরতাম না, হরে হরে ভিতরে ভিতরে যন্তনা শুরু হইল। সত্যই তো এইঢা কেমন কথা? একে তো অত্ত বড় দেশ ভারত ভাগ হই গেল, আমরা এক কোনায় গালমন্দ হুনি হড়ি রইলাম, অন আর একটা দেশ আঙ্গরে শাসন কইরব, আঙ্গ উপর খবরদারি কইরব, এইঢা তো মানা যায় না। কিন্তু আঁই ঘরের বউ হই কিইবা কইরতাম হারি। তবে আন্দাজ কইরতাম হারিয়ের দেশের লোক মোঢেও চুপ করি থাইকত ন। এই প্রশ্নখান জাগে তো মনে, এত ঘটা করি দ্যাশভাগ হইল, দেশের গরীব মানুষগুনের একটুও তো উন্নতি হইল না, যেই তিমিরেই ছিল, হেই তিমিরেই হড়ি রইল।
গাঁ-গঞ্জের মানুষ কোনো কথা যে কয় না, যেমনে মুরুব্বীরা চালায়, তেমনি ওরা চলে, কথা কইবার কোনো জো আছে নি। কোন হতে যে হেথারা গেলে শোক দুঃখের জ্বালা জুড়াইত হাইরব কিছুই বুইঝত হারেন না। মন তো চায় একটা না একটা উপায় খুঁজি বাইর কইরতে। মাসির ছেলে মনোরঞ্জন আইছে বেড়াইতে। ও খালি দুঃখের নদীতে ভাসে। চালের মহাজনের গদিতে হিসাবের খাতা লেখে। ছুটিছাটা হায় না কিন্তু মন তো চায় পূজা-পাব্বনের দিনে আত্মীয় স্বজনের মুখ দেইখতে। আইতে যাইতে বড় দূর্গতি, রাস্তাঘাটের অবস্থাটা ভালা ন। খানাখন্দে ভরতি, গোড়ালি হমান কাদা, মাটি কামড়াই হড়ি থায় ইটের টুকরো টাকরা, হাড়ের তালুতে থাকি থাকি খোঁচা খায়। কয় ‘মাসি গো আমনেগো গ্ৰামের রাস্তাঘাট আঙ্গ গ্ৰামের মতোই, ইউনিয়ন বোর্ডের বাবুরা খালি হড়ি হড়ি ঘুমায়, মানুষ মরুক বাঁচুক হেথাগো কোনো মাথাব্যথা নাই। হক্কলে খালি বড় সাহেব-সুবোদের তাবেদারি করের, হায়ের উপর হুমড়ি খায় হড়ি থায়, বাঁ হাতের কাম কাজবার ছাড়া এক টেবিল তুন অন্য টেবিলে একখান হাইলও নড়ে না, বেশি কতা কইলে মুখ ঝামটা, সহ্য হয় না ইগাইন। এখন নাকি হেথাগো সময়, দিনেরে রাইত বানাই দের। কী আর কইয়ুম। আঙ্গ জমির তুন ফসল কাটি লই গেছে, কিছু কইতে গেলে ধমকাই ধমকাই তাড়াই মারে। দা কাস্তে লাঠি লই মাইরত আসে। দেশের অবস্থা খুবই খারাপ হই গেছে গো মাসি। কী কইরলে যে ভালা হইব কেউ জানে না। অন নাকি হেথাগো রাজত্বই চইলব। কানাকানি হানাহানি বাতাসে ভাসে। এটা গোঙানির হইত হারে, গুনগুনানিও হইত হারে। মধুর চাকের মতো মাইনষের মনের মধ্যে জমা হর। সুরটা উল্টাহাল্টা লাগের। রাগ হাঢি হড়ি কথাগাইন খইয়ের মতো হোঢের। মাইনষের দম বন্ধ হই আইলেও আছড়াই হইড়ব তুফানের মতো এইঢা আন্দাজ কইরতে বেশি সময় লাগের না। হথেঘাটে হাটেবাজারে রাস্তার মোড়ে মোড়ের ফিসফিসানি ছড়াই হড়ের আস্তে আস্তে ঘরে ঘরে। হেস্তনেস্ত তো কইরতেই হইব। এখন গোপন কথা হইল কিয়ের লাই? কাদের বিরুদ্ধে গোপন কথা? এর উত্তর খুঁজি হাওন কি দূর অস্ত! তাইলে কী হইছে! মাইনষের কথা কি আর থামে, দিনে দিনে বাড়ে। লোকে কয় ইসকুল কলেজেও ঢুকি গেছে।’ বড় দুঃখের দিন আইল রে মনোরঞ্জন। দেইখবি না কিছুদিন যাইতে না চাইতেই সব খাঁ খাঁ করি উইঠব। দেশ ভাগ হইবার সময়ই আঁই টের হাইছিলাম। বুইঝতে হাইরলাম হক্কল কিছুরই একটা জের আছে। এন্নে এন্নে ঘটনার জের হুরাই যায় না রে। এর হরেও মাইনষের মনের বোমা ফাইটবই ফাইটব। যন আঁই কইছিলাম কেউ বিশ্বাস করে ন, এবার বুঝি দেখ, মাইয়া মাইনষের কথা কেউ বিশ্বাস করে ন। এতগাইন ভাঙনের হর হক্কল কিছু এমন সরল হইত হারে, তোরাই কস না।
ঠিক কথা কইছস রে, ওদের ঘরের কান্দন, বাইরের কান্দন কন যে এক হই গেছে, কে কইব। এত তো কানাঘুষা, জীবন তো এক্কারেও হাল্টায়নি, তবে হক্কলে যে স্বাধীন দেশ, দেশ আঙ্গ স্বাধীন হইছে কই ঢাকঢোল হিঢায়, হের অর্থঢা কী হইল! নিজেদের লগে মারামারি ঝারাঝারি করি মরের। খাওনের লাই ঘরে ভাত নাই, কামকাজও তো তেমন আর নাই। কোন মুই গেলে শান্তি হাইব, হের উত্তর খুঁইজব কেমনে। দিন দিন অশান্তির কালা মেঘ চারদিক যে ঘিরি হালার, কেউ কি টের হান না, নাকি জানি হুনি বেবাক চুপ মারি আছে। কত কথাই তো হোনা যার, পাকিস্তানীরা বাঙ্গালীদের কব্জা করার লাই ফন্দি আঁঢের গোপনে গোপনে। তুই কি বেগ্গাইন হাঁচা কথা কসের? আচ্ছা আঁই রসময় মাষ্টারেরে জিগাইয়ুম। মাষ্টার ঠিক কথা কইব। দিন দুনিয়ার খবর হেথেনের নখদর্পণে। প্রশ্ন একখান মনে আর জাগে থাকি থাকি মানুষ আর আগের মতো নাই কেন? কনানে তো একটা ধাক্কা খার। স্বভাব চরিত্র আর মাইনষে মাইনষে বিশ্বাস তেমন আর নাই। আঁর কর্তা কয়, ‘বুইঝঝনি কোনো কিছু জোর জবরদস্তি চাপাইতে গেলে তার ফল ভালা হয় না, ভেতরে ভেতরে ভাঙন ধরে, ঝাঁঝরা করি দেয় একটু একটু করি। মানুষ বেবাক চোখ বন্ধ করি আছে। কোনো শোধবোধ নাই, কারে কখন কি দিব, দিলে কি দিব, অপাত্রে দান ছাড়া কি কইয়ুম।’ হেথেনের কথা আঁই যে বুঝি নাই, এমনটা না, তবে কিনা হক্কলটা বুইঝঝি এটা কইতাম হারি না। এই কথাখান কেন কইলাম জানেন নি, মাইনষের মুখ দেই আঁই চিনি হালাইতাম হারি কোনখান তুন আইছে, আর কনডাই যাইব। কদ্দিন হইল, আঙ্গ দেশগাঁয়ে এক গায়ক আইছে। আগে কনও দেই নি। হারমোনিয়াম কাঁধে ঝুলাই কত যে গান ধরে, মনের খুশিমতো গান বানায়, চট করি সুরও দেয়।
সময় গেলে রে ও মন সাধন হবে না।
দিন ধরিয়ে তিনের সাধন কেনে করলে না।।
জানো না মন খালে বিলে
মীন থাকে না জল শুকালে
কি হয় তারে বাঙ্গাল দিলে
শুকনো মোহনা।।
ওর পেছন পেছন ঘোরে কচি কচি হোলামাইয়ার দল। ওর গলায় গলা মিলাই এমন করি যেন কতকালের চেনা। অবাক তো লাগে, মনের ভেতর যাই ধাক্কা না লাইগলে এমন গানের জন্ম হইব ক্যামনে। কতজনের জিগাইলাম লোকটারে আগে দেইখছে নি। ঘাড়টা ডাইনে বাঁয়ে এমন করি নাড়ায়, কিছুই বোঝার উপায় নাই হাঁ কইছে কি না কইছে। লোকটারে আপন না কই হারিয়েন না, সুরের জাদু এমনি হয়, না হইলে এত জমাইত হারে নি। কথার পিঠে কথা রাখি মনের কথাখান কইত হারলে মানুষটা যেন হরান লই বাঁচে। মাইনষেরে হুনাইবার লাই ও কেন জানি এমন ভাব করে যেন রাজা বাদশাহর দরবারে বই দরদ দিই হুঢাই তুইলত চায়। হইলা হইলা বুইঝতাম হাইরতাম না। জনে জনে জিগাইতাম লোকটা কয় কিরে! হোলাপাইনরা সুরের তালে তাল মিলাই নাচে বটে কিন্তু কথার সার উদ্ধার কইরত হারে কিনা সন্দেহ। তবে কিনা শব্দগুলানের মাহাত্ম্য অস্বীকার কইরব কার এত বুকের পাটা। কোমর দুলাইতে দুলাইতে ও যখন সদর দরজা ছাড়ি উঠান হমান চলি আয়ে, শব্দগাইন স্পষ্ট হয় ক্রমশ ক্রমশ। কান পাতি তন হুনি থাকি।
‘দেশে অন আগুন লাইগছে,মানুষ গেছি ক্ষেপি রে।
ও পোলার দল, মা বোন ঝি, হুইনতে আছস রে।
দুঃখের কথা হোনামো কি, ভাবের ঘরে নেত্য করে আমরা সকল কলের পুতুল এ অধম সংসারে।’ বুঝি না তো, অনেক চেষ্টা তো কইরলাম। ও বাবাজি, একবার বুঝাই কন না, আমনে বড় পেঁচাই পেঁচাই কথা কন, সরল সাদাসিধা করি কন না। ‘এ-ও বোঝ না, ছারখার হই যাইব সব, তোমার কথা আর তোমার রইত ন, হুরাটা অন্যের হই যাইব।’ এই আবার কেমন করি সম্ভব! মাইনষের কথার মাঝে অমন পাল্টাপাল্টি হয় নাকি ! ‘ হয় গো হয়, মানুষ চাইলে কি না হয়। হক্কলটাই উপরওয়ালার ইচ্ছা। তিনি যে সকল চাওয়া পাওয়ার উপরে গো। তেনাকে ধরা কি তেমন সোজা কাজ! হুইনছ নি কথাখান –
উত্তুরের হাওয়া দক্ষিণে যায়, দক্ষিণের হাওয়া উত্তুরে, গাঙের পানিতে ছলাৎ ছলাৎ ধরা অধরার পানি রে।
এই পানি যে গভীর পানি হরান কাঁদে তল অতলে
মধুকর বাসা বাঁধে কোন ঠিকানায় কে আর জানে।
আবারও বাবাজি আড়াল করি কথা কইলেন। কথার মধ্যিখানে এমন ঘোমটা হরাইলে আমরা মুখ্যুসুখ্যু মাইনষেরা যাই কন্নাই কন দেখি। ‘এত শহর গ্যারাম ঘুরি মইরলাম, সোন্দর সোন্দর কথা হুইনলাম, সেই কথাগাইন তোমাদের হোনাই হরান ভরি, ভাবের ঘরে কেমনে করি চুরি।’ আরে আঁর হইছে তের জ্বালা মানুষটার রকমসকম কিছুই ধইরতাম হারি না! যে করি হোক বুইঝত আঁরে হইবই। ‘অত বুঝে কাম নাই, ঘরে চল জেঠি, বেলা হই গেল যে।’ রত্না ডাকে বুঝি। কিন্তু মানুষটারে তো অমনি অমনি ছাড়ি দেওন যায় না। থালায় করি মুড়ি-খই-খেজুরে গুড় দি দেখি। কত দূর তুন আইছেন বাবাজি, আগে হেট ভরি খান, হরে কথা হইব। একখান হিড়িও দিছ, এক গ্লাস জলও দিছ, আরাম করি বই খাইব।
কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যা কে কইব। যিয়ান ঘটছে, ঘইটতে দাও, এইঢাই নাকি নিয়ম। আঁর কাছে কত আশা ভরসা লই মাইনষে আসে, হেথাগো মনে ভারি দুঃখ, হক্কল আশা ভরসার হইছে জলাঞ্জলি। একদিন কই হালাই তোঙ্গ মনে সুখ নাই বুঝি। ‘সুখ আর কনডাই দেইখলেন কাকিমা ? আঙ্গ কপাল হোড়া, গতর খাটাই খাই কিন্তু কেউ গতরের দাম দিল না। আশা ছিল মনে মনে দিন দুনিয়া হালটি যাইব একদিন, খড়ের চালে টিনের চাল হইব, হেঢে ভাত জুইটব, কনডাই কি, কেউ খবরও লয় না।’ হুইনলাম তোমাগো হোলাদের শহরে হাডাইবা। ‘ হুইনছেন তো ভালা, তেমন সুযোগ মিলে কই। যাক শেষমেশ ঠিক কইরলাম চাষীর বেটা চাষই করুক। লাঙ্গল উডাই দিলাম কাঁধে। হালের গরু লই মাঠে যায়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলি যতটা কামাইত হারে।’ জানি গো জানি, তোঙ্গ আর তেমন রোজগারপাতি নাই। খালবিলে আর তেমন জাল ফেলি মাছও উডে না। হইব কনতুন, এক জলে হক্কলে মিলে কাড়াকাড়ি কইরলে হইব কেমনে! মাছ তো আর ঝাঁকে ঝাঁকে আই জালে ধরা দের না। একটা জিনিষ খেয়াল কইরছনি আসমত মিঞা আঙ্গ গ্ৰামের লোকসংখ্যা কত বাড়ি গেছে দিনে দিনে। খেয়াল করি দেইখছনি হেইঢা। ‘ভাবি তো কুল হাই না, কেমনে কেমনে হই গেল, কন চাই।’ ওরা চোখের জল এক কইরত হারে না। কারে যে দোষারোপ করুম। রোগের চিকিৎসা নাই, হরনে কাপর নাই। পুরুষ মাইনষে না হয় ছেঁড়াছুঁড়া হইরলে চলি যায়, মাইয়া মাইনষের কি আর চলে? ইজ্জত বলি তো একটা কথা আছে। ছেঁড়া জামা গায়ে দেই ধোপাবাড়ির মেঝ বউরে ডাকি কইলাম, এরম উদোম গায়ে কেউ বাড়ি বাড়ি ঘুরি কাপড় নিত আসে? কি আর করি, একটা হুরান জামা হাতে দিলে খুশি হই নমষ্কার করে। ওঁর নমষ্কারের ধরন দেই কত ভাবনা আই জাপটাই ধরে।
আঙ্গ উঠানে চড়াই শালিক, কাক আসি ভিড় জমায়। লাফাই লাফাই খুঁঢি খুঁঢি ধান খায়। তাড়াই দিলে হুশ করি চলি তাই বেহায়ার মতো আবার উড়ি আঁই চড়িবড়ি খাইতে থাকে। মাইনষেও ক্ষুধার জ্বালায় কেমন যেন হই গেছে, হাত জোড় করি দাঁড়াই থায়। এইটা কী আঙ্গ দেশ! কে বানাইল এমন দেশ? কে কইছে এমন দেশ বানাইতে? হুদা হুদা এত লোক হরান দিল, ভাইবলে হরানঢা আঁর হাঁঢি যায়। খালি মনে হয় কারা যেন জোর করি আঙ্গ উপর কত কিছু জোর করি চাপাই দের। এমন কেউ কি নাই জিগাই তোমরা কারা গো? আঙ্গরে চেন না আঙ্গরে জান যে খবরদারি কর। দেশের ভেতরের পয়সাওয়ালারা গরীবগুরবোদের ঠিকঠাক চেনে না। বুঝেও না কেমনে ওদের দিন কাটে, কি ওরা ভাবে, কেমন করে কথা কয়, খালি উপর উপর ভাব ভালোবাসা, দরদ তো নয়, মরা কাঁদুনি। কিয়ের লাই যেন মনে হয় দেশটা আর একবার স্বাধীন হইতে পাইরলে ভালো হইত। আঁর স্বামীরে যন জিগাই, এত তো আমনেগো শহুরে বাবুরা গরীব মানুষদের দুঃখ শোকের কথা লই গলা ফাঢাই হালায় এমন করি যেন জীবন দিই দিব, হাঁচা কথা কন তো, মন তুন কি চায়, নাকি সব লোকেরে দেখায় কত চোখের জল ঝরার, আসলে মনে মনে চায় হেথারা আজীবন ওনাগো পায়ের নিচে হড়ি থাক। কথাটা হুনি আঁর স্বামী চুপ মারি থায়, মুখ দিই কোনো কথা সরে না। ক্ষাণিকক্ষণ বাদে টনক নইড়লে কয়, ‘এমন করি ভাবি তো দেই ন। হক্কল কিছু তাইলে উপর উপর দেখছে এতটাকাল। কথাটা তুঁই মন্দ কও নি। ঘরের ভেতরে ঢুকি দেইখতে হইব, খালি মাঠেঘাটে দেইখলে হইত ন। দেইখতে হইব ওরা কেন্নে হোয়, কেন্নে উঢি বয়, কেন্নে হাসে, কেন্নে কাঁদে, কেন্নে হোলামাইয়ারে ধমকায়, আদর করে, কেন্নে জ্যান্ত থাকে, কেন্নে মরে, কেন্নে খায় দায়, কেন্নে দিনমানে ঘুরি ঘুরি দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করি হেরে, কতটা চোয়ের জল হালায়, কতটা রক্ত ঝরায়, গায়ে কতডা মাডি মায়ের, কত পথ হাডি হাডি মরে, কতটা সুখ দুঃখরে লই ঘর করে।’ আঁর কি মনে হয় জানেন, আমরা ওগো অন্তরের ভেতরের কথাগাইন আগে জাইনত হইব, বুকে হাত রাই কইত হইব তোমরা আঙ্গ মানুষ তাইলে না অন্যরে চোখে আঙুল দেখাই কইতে হারুম, পশ্চিমারা আঙ্গ লোকদের কতটা দেইখছে, আর কতটা দেইখছে না, তার আগে যত কথা কইনা কেন, বেগ্গাইন হুদা। ওরা খালি ভেটকাই থাইকব।
আইজ হক্কাল তুন দেইখছি, কত পাখি বাতাসে ঘুরি ঘুরি মরে। এমন আজব কান্ডকারখানা কোনো দেই ন। পাখিরা এডাল তুন ওডালে যায়, কিচিরমিচির তো করে কিন্তু দুই একটা পাখি আমনে আমনে চক্কর খাই মাটিতে হড়ি যায়, আবার টুকুস করি মরিও যায়। এই দেই, এই নাই, আরে মরার আগেও তো জানান দন লাগে, এই কথাটা ভুলি গেলি চইলব কেমন করে! দুনিয়াশুদ্ধ হক্কল কিছু ঘটনা ঘইটবার আগে চারদিকটা কেমন হালটি খায় না, খায় তো ঠিকই, হেইঢা কেন হয় কারণটা খুঁজি বার কইরত হইব তো। আঙ্গ বাড়ির কুচোকাচারা মরার আগে হাখির ঠোঁটে আঁজলা ভরি জল দেয়, ওরা গিলতে গিলতেই ঢলি হড়ি যায়। কেমন আশ্চার্য লাগে। কার পাপে এমনটা ঘইটতে লেগেছে। কার আবার, মানুষ ছাড়া আবার কার। এই পাপের বোঝা কদ্দিন বয়ে বেড়াবে, আজ না হয় কাল, গায়ে তো লাগবেই। চুপিসারে লাগে না হয় ঝামটা মারি আয়ে। যার দেখা সেই দেখে, বাকিরা চোখ বন্ধ করি রায়। হৈ হট্টোগোলে হুরা গ্ৰাম যেন কলকলাই উঢে। কীসের টানে বুঝি উঠতি গেলে সময় লাগি যায়। রাজ্য কাবার হয়। কে কার কথা হোনে। হোনার ইচ্ছা থাইকলে তো হুইনব, বোঝার ইচ্ছা থাইকলে তো বুইঝব। হক্কলে ঘুরি ঘুরি মরে। কী হইছে, কী হইছে কই চিল্লায় মরে। এই হাঁকে ইসকুলের হোলারা যার যার মতো করি মনের কথা কয়। যিগাইন হুনি আইছে উগরাই দেয়। ওরা জানেও না কারে কী কইব, হুধু জানে কিছু একটা কইত হইব। ঘরবার ছানাছানি করে। বুজুর্গরা কথা চালাচালি করে। আকাশের মাঝামাঝি বৈশাখের দুপরে সূর্যের আলো মাঝ আকাশে লাফালাফি করি সটান আই হড়ে মাথার উপর। ঘামি নাই ওদের যে কী দশা ওরাই জানে। জোরে জোরে গা চুলকায়। মুয়ে ওদের একটাই বুলি ‘উর্দু’ । কচি ঠোঁটের নাড়ানাড়িতে কত কিসিমের যে শব্দ বার হই আইয়ে, অর্ধেক বোঝা যায়, আর বাকিটা বাতাসের ধাক্কায় নানারকমের উচ্চারণে কানের কাছে আই থামি থায়। হোনা যায় ‘উট’ ‘উবু’ ‘উদু’ ‘উদ’ ‘উদক’ আরও কত কী।
হুরা ব্যাপারটা যে এমন করি উথলাই উইঠব কে জাইনত। কারও বুঝি ওঠার আগেই শুরু হই গেল কানাকানি বলাবলি। কী কইত আছে বেগ্গুনে মিলি তাইলে এমন একখান দেশ হাই কি লোমের লাভ হইল, আঙ্গ মুয়ের ভাষা কাড়ি লইত চায়, এঢা কেমন মতলব, এইঢা তো ভালা কথা নয়। আঙ্গ হাশের বাড়ির রমেন, মোল্লা হাড়ার রহমত, বেল্লাল, যুগি হাড়ার রতন, সতীশরা, শীল হাড়ার অনন্তদের মুখ ভার। হেগুনে হক্কলে হাই ইসকুলে হড়ে। হোলাগুনের তেজ আছে – ‘ কচাইন এদ্দিন ধরি আমরা যে ভাষায় জন্মের তুন কথা কই আইছি, অন পশ্চিমারা আঙ্গ উপর চাপাইতে চায়, বেগ্গাইন হেথাগো সুবিধার লাই, ইয়ান কি আমরা বুঝি না। আমরা যাতে নিজের মারে ভুলি হেথাগো মারে মা ডাকি, আচ্ছা তোরা কস না, রমেন রাগে হোঁসে, এইটা কনও সম্ভব, একটা প্রতিবাদ কইরত হইব। আঙ্গ দেশের একদল লোক নাকি খুশি, হেথাগো মান ইজ্জত বলি কিছু আছে? ওগো কথাবার্তা হুনি আঁর চক্ষু তো চড়কগাছ। গ্ৰামের মধ্যে থাই এতগাইন শিখল ক্যামনে। ওরা তালগাছের নীচে বই গপ্প মারে, দেশের খবরও রায়, ভাবি তো অবাক হই যাই। আঁরে দেই ছুঁঢি আইয়ে কয় ‘হুইনছেন নি জেঠি দ্যাশের অবস্থা দিন কে দিন খারাপের দিকে যার।’ তোরা কিয়রছের ওই কাগজের টুকরাখান লই। পাকিস্তানী সরকারেরে হুঁশিয়ারি দিতে আছি জোর করে উর্দু চাপাইত চাইলে আমরা ছাড়ি কথা কইতানন। দ্যাশের নেতারাও ক্ষেপি গেছে এর একটি বিহিত করি ছাইড়ব। দেইখছনা আমরা হক্কলে কালা ব্যাজ হইরছি। ভাষা আন্দোলনের নেতারা কইছে হুরা দ্যাশে মিটিং মিছিল সভা হইব। কাল ইস্কুলে তুন শুরু হই এক মাইল ধরি প্রভাতফেরী হইব।’ তোগো কি মাথা খারাপ হই গেছে? হেগুনেরে চোয়েমুয়ে আঁই আগুন দেখছি। না জানি কী দশা হয়! টগবগ করি হুঢের কড়াইতে গরম জল তেমন হুঢে। ওরা চলি গেলে এক দল লোক আসি হুমকি দিই যায়। ‘গ্ৰামের হোলাদের সামলাই রাখবেন যেন বাংলা বাংলা করি না চিল্লাই।’ এমা এরা কী কর, হুমকি দিই গেল নি।’ আঁর দেয়রের হোলা কয়, ‘অত ঘাবরাইতে আছেন ক্যান জেঠি, এরা কিচ্ছু কইরতে হাইরত ন, হাওয়া অন উল্টি গেছে, বাজার গরম। জাহিদ আলীদের ধানের গদিতে খবরের কাগজে দেইখলাম লিখছে ‘ আরবি অক্ষরে বাংলা হড়াইতে চাইলে আগুন জ্বইলব হুরা দ্যাশে।’ এই দ্যাশে আর কোনদিন শান্তি আইত না রে। আমরা কনডাই যাই যে মাথা গুজুম কইতি হারস নি।
কারে যে কী কইয়ুম বুঝি উইঠতাম হারি না। আর একটা গণ্ডগোল লাইগল বলি। হুইনতে আছি ধরি ধরি তাজা তাজা হোলাদের জেলে ঢুকাইদের। এমন করি যদি উর্দু চাপায় শিক্ষিত হোলারা করি কম্মই খাইব। শেষে মূর্খ হই মাঠে নামি হালচাষ কইরব, ব্যবসাপাতি করি খাইবই বা ক্যামনে। হইড়বই বা ক্যামনে, ইস্কুলে মাষ্টারিই বা কইরব ক্যামনে। হেগুনে তো কোনদিন উর্দু হড়ে নি। পূর্ব বাংলায় বাংলা হইড়ত হাইরত ন, এই আবার ক্যামন কথা। পাকিস্তানী সরকারেরে কী এককারেই মাথা খারাপ হই গেছে। শেষমেশ দ্যাশটা ভাগ হই এই হাল হইছে। আঁর যদি ক্ষমতা থাইকত হেথাগোরে কানে ধরি কইতাম আমনেগো একটুও আক্কেল নাই আঙ্গ দ্যাশের এমন সব্বনাশ কইরতে আছেন। এত লোভ কীয়ের লাই, আমনেগো দ্যাশে কী চাইল ডাইলের টান হইড়ছে। আঙ্গ ভাষা ভিন্ন, রং-ঢং ভিন্ন, রহন-সহন ভিন্ন, মানুষগুন ভিন্ন, দুই হাজার মাইল দূরে থাই আমরা, আঙ্গরে আঙ্গ মতো থাইকতে দিন না। ‘হেথাগরে তো চিনেন না জেঠি, এক একটা রাইক্ষস, ধইরত হাইরলে খামচাই দিব।’ মাইনষে আবার ক্যামনে এমন হয়, হাঁচা কথা কচের তো? ‘ আঁই কই আমনের লগে রসিকতা কইরতে আছি। আঁই তো আমনেরে কম কইছি, ওরা হারে না এমন কিছু নাই, ঘরের বউঝিদের ইজ্জত লই টানাটানি করে সুযোগ হাইলে। হেথাগো চর ঘুরি বেড়ায় আঙ্গ দ্যাশে, হেইঢা জানেন। হেথারা বেক খবর লই ওই দ্যাশের সাহেবদের কানে তোলে। হেথাগো লাজশরম নেই গো জেঠি, না হলে আঙ্গ দ্যাশের এই হাল করে।’
চিন্তায় চিন্তায় মরি যাই। আঁধার নাইমছে চারধারে। এক একদিন একটা খবর আই পৌঁছাইতে আছে গ্ৰামে । হোলাগুনের মুয়ের দিকে চাওন যায় না। চোখমুখ হুকনা হই গেছে, খালি গজগজ করে। কে যে জবাব দিব? দ্যাশটা যে কোনদিকে যাইতে আছে বুইঝতাম হারি না। উঠানে হাইঙ্গল গাছের হাতা ছড়াই ছিঢাই আছে, হরিষ্কার না কইরলে নয়। একশরও বেশি গলার আবাজ কত দূর তুন মাঠ টপকাই গাছ-গাছালিতে ধাক্কা খাই ঘরে ঢুকার লাই হাঁকপাক করের। এমন গলার ঝাঁজ আঙ্গ গ্ৰামের হথে কোনো হুনি ন। ঝগড়াঝাঁটি কোন্দল নাই এই কথা ক্যামনে কই। অভাবের সংসার ঘরে ঘরে। দিনে আনে দিন খায়। জমি বিবাদ লই কোপাকুপি হয় দিন-দুপরে। কারোগে কিছু কওয়ার নাই। হিগাইন লই মামলা মোকদ্দমা চইলছে তো চইলছে। মুসাবিদা করার লাই
আঁর কর্তারে আই হাতেপায়ে ধরে। রক্তারক্তি মাথা ফাঢাফাঢি হইলে হোমিওপ্যাথি ঔষধের লাই আঁর ঘরের দুয়ারে আই মাথা খোঁড়ে। গালমন্দও করি – খুনোখুনি করার সময় মনে থায় না। এইসব তো নিত্যি কাণ্ড। যবে তুন বউ হই আইছি এমন কান্ডকারখানা সহ্য করি আইছি। এইসব দেই দেই দিন গুজরান হয়। ভালা কিছু নাই হেইঢা ক্যামনে কই। হরের বিপদে আবার হাত লাগাইবার লাই ছুঢিও আইয়ে। জান হরান দিই দেয়, চোয়ের জল হালাইতে হালাইতে ভিডা ছাড়ে। কিন্তু আইজ্জার কথাগাইন যেন অন্যরকম লাগে। মাথা চাটি হালার। কথার ভাইল নিজের জন্য নয়, দলাদলি হইলে যেমনটা লাগে তেমনটা নয়, এমন কথার ভাঁজ জম্মে হুনিনি। কিন্তু সেই কথাগাইন হুনিয়ের আরও বেশি করি হুইনবার লাই কান হাতার ইচ্ছা হয়।
‘আঙ্গ নেতারা দের ডাক। ঝাঁপাই হড়ুম হরান যাক। আঙ্গ ভাষা বাংলা ভাষা। হরানের ভাষা, মার ভাষা। হরের ভাষারে কবর দাও, নিজের ভাষা হিরি হাও।’ এই আকবর এই মন্টু ইস্কুলের হোলারা দলবাঁধি কন্নাই যাওনের লাই এত হায় হুতাশ করের। ‘দেইখছনি জেঠি এত খবর রায়, ইয়ান ক্যামনে ভুলি গেছে। ওরা দ্যাশ বাঁচাবার লাই, ভাষা রক্ষার লাই গ্ৰামে গ্ৰামে মিছিল করের, শহরে যাইব চার গ্ৰামের লোক জড় হই। প্রতিবাদ সভা হইব।’ বুইঝলাইম তোদের কথা। একখান কথা কই, ঢাল তলোয়ার ছাড়া হক্কলে মারা হইড়ব যে, এইঢা কী খেয়াল কইরছস। হমানে হমানে লড়ালড়ি হইলে না টক্কর দেওন যায়, না হইলে মাঝপথে উল্টাই হড়ি যাইব যে। ‘ওরা কত মাইরব মারুক, রুখি ওরা দাঁড়াবই। দেইখছেন না, রাগে ওরা ফুঁইসছে। বেশি কথা কইত আইলে নাকি হেথাগরে দেশ ছাড়া করি ছাইড়ব।’ এই কি দশা রে, এই যে দেইখছি কাতারে কাতারে লোক আইয়ের। হেগুনের কামকাজ নাই, খাওন যোগাইব কারা। চাষাভুষা হক্কলে তো যোগ দের। বুইঝাইতে চায় এই একখান ব্যাপারে ওরা এক, পাকিস্তান যত চেষ্টা করুক আঙ্গ দ্যাশের মাইনষেরে দাস বানাইত হাইরত ন। হুইনতে তো আছি ওরা আঙ্গরে হিরি হরাধীন করার চাল চালের।
দেইখতে দেইখতে মিছিলটা আঁর চোয়ের সামনে লম্বা হই গেছে। এত লম্বা হই গেছে আঁর নজর যায় হৌঁছেন। যত দূর চোখ যায় মানুষ আর মানুষ, হামনেও কিছু দেয়া যায় না, হেছনেও কিছু দেয়া যায় না যেন একখান নদী ঢেউয়ের তালে তালে নিজের মনে চলি যার, নিজেও জানে না কনডাই যাই ঠেইকব। ওরা এক শহর তুন আর এক শহরে যাইব, হেই শহরের মাইনষের লগে মিশি যাইব, তারপরে যা হইব, মাইনষের সমুদ্র, পাকিস্তানের রাজা উজিরদের বাপের সাধ্য আছে নি এমন মাইনষেদের মুয়ে তালা লাগাইত হারে। খালি খালি মনে হর কদ্দিন ধরি আঙ্গ দ্যাশে কী অলক্ষ্মী ঢুইকছে, না হইলে এমন আগুন জ্বইলব কিয়ের লাই। ওই ব্যাটাদের আর কি কোনো কাম নাই আঙ্গ দ্যাশের দিকে কুনজর দিত লাইগছে। জানি না আঙ্গ কোয়ালে আর কি কি লেয়া আছে। বেগ্গাইন তো ভাঙ্গিচুরি একসার হই যার। একে তো গরীব মাইনষের হেঢে ভাত নাই অন যদি মুয়ের ভাষাখানও কাড়ি লই যায়, তন কওন চাই কী দশা হইব। হুইনছি দুঃখের খালি জ্বালাই হয়, হেইঢার কোন চেহারা সুরত হয় না, খালি মুয়ের কথায় হাউমাউ করি ঘরবার করে। তারা সান্ত্বনা দিত বলি হাজির হয়, গায় মাথায় হাত বুলাই দেয়, কথার হিঢে কথা বয়ায়। অন্তরের ভাষায় হাসন কাঁদন যায় নি। রাগে হরীল হাডে। মাইয়ালোকের যদি রাস্তায় নাইমবার সুযোগ হইত, গ্ৰামের মাইয়াগুনরে লই আঁই রাস্তায় নামি দ্যাশের নেতাদেরে কইতাম আঙ্গরে আমনেগো হঙ্গে লন। আঁর মাইয়া তো কই ফালাইছে – মা তাইলে আঁইও আমনেদের লগে যামু। কী হইব মা উর্দু চাপাইলে আঁই হড়ালেখা করুম ক্যামনে। আঁর স্বামী কয়, ‘তুঁই তো খালি ভাষা দেইখছ, যত দিন যাইব, বেটারা আরও কত জিনিস যে কব্জা কইরব তার কোনও ঠিকানা আছে নি। কত কথাই তো কানে আইয়ের ওরা দিনে দিনে হেথাগো দ্যাশের আইন কানুন আঙ্গ দ্যাশে লাগু কইরব। হিয়ের লাই যেমন করি হোক, ভাষা লাগু করার আগে আটকাইতেই হইব, আদালতেও ভাষা লই তর্ক বিতর্ক চলের।’ মাইয়াঢার আঁর এত হড়ালেখার শখ, কেন্নে রে হেথিরে বুঝাইয়ুম। ‘আরে এত চিন্তা কর ক্যান, চাইলেই হই গেলনি, দ্যাশের এত মাইনষে বাংলা ভাষায় কথা কয়, পূর্ব বাংলার মানুষ আমরা, রাতারাতি বেবাক হাল্টি যাইব, ব্যাপারখানা এত সহজ হইত না, তুঁই দেই রাইও। আঁর কথাখান মিলাই লইও।’
হুইনছেননি, ওই যে চুনির বাপদের ঘরের হাশে নাইরকল গাছের কোটরে বই লক্ষ্মী প্যাঁচাটা ডাইকত না, এখন আর ডাইকতে হুনি না। পাখিটা বাড়ি ছাড়ি চলি গেল নাকি। ‘আরে কনডাই আর যাইব, অন্য কোনো বাড়ির গাছে চলি গেছে।’ আমনে আঁর কথাটার আমল দেনের না কিন্তু এত বছরের পাখি, লক্ষ্মী প্যাঁচা বলে কথা। আঁর হৌরি কয় এই পাখিটা বড় পয়া, লক্ষ্মীর বাহন, আঙ্গরে ছাড়ি চলি গেল। আই আগেও দেইখছি কোনো খারাপ সময় আইলে ও হলাই যায়। আঁর মনের ভিতরে দুশ্চিন্তা হর। কিছু একটা অমঙ্গল তো ঘইটব, আমনে চাই রাইয়েন। হক্কল কিছু কথায় কথায় কুসংস্কার বলি উড়াই দিলে চলে না। হেইবার মনে নাই আঙ্গ গরুর বাচ্চাটা মরি যাইবার আগে পাখিটা ডাকা বন্ধ করি দিল। আর একবার ফুলির বিয়াটা ভাঙ্গি গেল যন তার আগেই ও উড়ি চলি গেল আঁই নিজের চোয়ে দেইখছি। ইগাইন তুচ্ছ ঘটনা নয়। অস্বীকার কইরলে তো ঈশ্বরেও বিশ্বাস করি আর লাভ নাই, কাইল তুন হূজা আচ্চা বেবাক বন্ধ করি দিই কি কন। হেথেনে আঁর কথা হুনি চুপ করি থায়। মনের মধ্যে আঁর খচখচানি রই যায় – কিছু একখান বিপদ বুঝি আইয়ের। হৌরি বিছানার তুন ডাক দেয় ও খোকার মা, চা চাই কুকুরটা আবার অসময়ে কিয়ের লাই মরা কান্না কাঁদের। কুকুরের কাঁদনে আঁর ডর লাগে, ওরে চুপ কইরত ক।
ঘরের কথা ভালো মন্দ ঘরেই ছিল
মনের ঘরে ভাঙন ধরি বাইরে আইল
দুনিয়াদারি হাল্টি যে যার তিল তিল করি টের হাইয়ের। হিয়ার আঁচ বাড়িঘরে লাইগত ন, হেইঢা ক্যামনে হয়। তবুও তো আঙ্গ দিন চলি যায়, যেমনে যায় আর কি। কাউকে কিছু কইবার নাই, কত কথাই যে মনের মধ্যে পুষি রাইখতে হয়। মনের নাম বাবাজি যেমনে সাজাও তেমনে সাজি। সুখে দুঃখে ঘর গেরস্তি কইরলে কিছু কইবার তো থায় না। বিভ্রাট বাঁধে যন চাইবার জিনিসগুলা হাতের কাছে হাওন যায় না, মনের কথা কইবার মতো মানুষ থায় না তন যিয়ানে সুযোগ হায় মনের কথা উগরাই দেয়, বিপত্তিও শুরু হয় হিয়ান তুন। যিয়ানে হিয়ানে মাথা গলাই বানাই বানাই কথা কয়। কথার ঝোল টানি ফেলাইনা কথারে লই রামায়ণ মহাভারত বানায়। যারে কথা কয় হেও হোনে, যিগাইন লই কথা কয় আগা মাথা থায় না। কথায় কথায় ঠোকাঠুকিতে কত টক ঝাল, একসময়ের জায়ে জায়ে বইনে বইনে মন্ডা মিঠাইয়ের মতো সম্পর্কটায় তেঁতুলের গন্ধ নাকে লাগের। কী যে কারণটা বুইঝতাম হারিয়েন না। টের হাইলাম দুই একটা বাসন কোসন ঝন ঝন করি ঘরের মেঝেতে হড়ি ভাঙি টুকরো টাকার হই গেছে। কিয়ের লাগি হইছে ক্যামনে হইছে হেই কথা থাক। কত কথা হক্কলের মনে মধুর চাকের মতো জমা হইছিল, ভালা না লাগাইনা কথা, অপছন্দ আর মন খারাপের কথা কেউ আগের তুন বুইঝত হারেনি ক্যান, প্রশ্নটা আঁরে কুরি কুরি খার। আঁর ভাবনার কথাটা কইব কইব করি কইতে হারলাম না। এখন আঁর ভেতরটা কারণে অকারণে খাঁ খাঁ করে। কারও মুয়ের দিকে তাকাইলে মনে হয় ঘুণ ধরি ঝাঁঝরা করি হালাইছে কোনায় কোনায়। জড়াই জড়াই থাওনের সুখ চলি গেছে মন তুন, আর কি কোনদিন ফেরত আইনত হাইরব? আর ভাবনাটা অহেতুক ছিল ক্যামনে কই। আঁর এক জায়ে ভাশুরঝিরে কয় ‘তোর বড় হাখনা গজাইছে, লম্বা চওড়া কথা গজাইছে, বাপের তো দুপয়সা রোজগার নাই, এত বড় সংসার আছে বলি দুবেলা হাত পাড়ি খাইতে হারস, না হইলে এমন চোপা বার হই যাইত।’ মাইয়াঢা চোখের জল হালাইতে হালাইতে আঁর পা দুখান জড়াই কাঁইদল। ‘ কন চাই জেঠি, খুড়ি আঁরে ঠেস দিই কথা কর, খাওয়ার খোটা দের।’ মাইয়ার মাথাই হাত বুলাই দি সান্ত্বনা দিই কইলাম তোর এমন মুয়ে মুয়ে কথা কওয়া ঠিক হইছে ক। খুড়ি তো মায়ের সমান, না হয় দুকথা হুনাইছে, উঠানে গোবরের জল ছিঢাই দিই মুছি দিলে কী হইত। নিজের লগে নিজে কথা কইলাম – যতিনের মা’র বাপের রোজগার লই ঐটুকানি ছুটকিরে এত বড় কথাখান না কইলেই তো হাইরত। গোলমালটা আসলে যে অন্য জায়গায় হেইডা বুইঝতে সময় লাইগল না। কারোগে কইবার আগে আর একটু পরখ কইরতে চাইলাম। আঁর মা কইত, ‘বুইঝলি মা এমন কিছু কিছু জিনিস আছে, সময়ের হাতে ছাড়ি দেওন লাগে, হড়বড় করতই হয় না।’ ষোল আনা খাঁটি কথাই কইছিল মা।
সেজ দেওরের হৌর বাড়ির তুন পাঁচ ছয় জন আত্মীয় আইছে। হুইনতাম মাস খানেক থাইকব। ওমা মাস তো হুরাইল, যাওনের নাম নাই। এই কথা লই হেছনেও হেছনেও ফুসুর-ফাসুর শুরু হই গেছে, মুখ তুলি আর কথা কয় না। দেওরের কানে কথাগাইন গেলে কী দশা হইব। মাসান্তে বাড়ি আইছে। কোম্পানির ঘরে হিসাব লেখার কাজ করে। সেজ জা হোনে ন এমনটা নয়। কোনো কথা না কি চুপ মারি ছিল। এবার দেওর যদি হোনে, তাইলে তো লঙ্কা কাণ্ড বাঁধাইব, ভাইবলে আঁর গা দি জ্বর চলি আইয়ের। এই কথা সেই কথায় আঁর কাছে আই কয়, ‘ বৌদি আমনের লগে আঁর একখান কথা আছে। কিন্তু একটু নিরিবিলি জায়গা হাইলে ভালো হয়। ‘আইও না, রসুইঘরে চলো, রান্না কইরতে কইরতে তোঁর কথা হুনুম। ‘কিছু ভাইববেন না যেন। বাড়ি আসা ইস্তক দেইখছি আমনের জা গোমড়ামুখো হই আছে, কোনো কথা কয় না, হাসি ঠাট্টাও করে না আঁর লগে, এতবার করি জিগাইলাম কোনো উত্তর দেয় না। হেথি তো তেমন মানুষ নয়, কারণটা কিছু কইত হারেন।’ লাকড়িখান উনুনে গুঁজি দি আরও জুত হই বইলাম। কি উত্তর দিমু, কি উত্তর দিমু কই চাইর কদম হিছাইলাম। আঁর দেওরের মুখখানা বেজার হই গেল। ‘আরে মাইয়া মাইনষের কত কারণে মন খারাপ হয়। এই কাঁদে এই হাসে, অত চিন্তা করিও না। আঁই বুঝাই কই দিমু। দেইখবা দুই দিন বাদে বেগ্গাইন ঠিক হই যাইব। ‘চাপা গোছের মাইয়া তো, ডর লাগে কখন কী করে বসে। আমনে যন কইছেন আর একটু দেখি।’
মনের মধ্যে কত চিন্তা আই উঠবস করের। এমন করি ছাঁকি ধরে, হের তুন ছাড় হাওনের কোনো রাস্তা খুঁজি হাইয়ের না। বকুল ফুলের গাছটা দুলি দুলি উইঠলে বুকের মধ্যে হাপরের মতো শব্দ হয়। এক অজানা ভয় বুঝি আই বসে। বকুল গাছটা যত্ত নষ্টের গোড়া। নিজের ডালে কত রকমের পাখিরে জায়গা করি দেয়। ছাতার ময়না চড়ুই আই লাফায় ঝাঁপায়, মনের সুখে কিচিরমিচির করে। আবার ডানা মেলি উড়ি চলি যাই শূন্যে। ঘুড়ির মতো গোত্তা খাই মাটিতে নামি ছটফটায়। আহা মাটির জন্য ওদের কত মায়া। মানুষগুন যদি এমন হইত। গায়ে গায়ে লাগি লাগি থাইকত। আঙ্গ তো জলের তৃষ্ণা লাগে, পাখিরা জল খাইবার লাই মাটির কলসির ভাঙা টুকরার বৃষ্টির জলে ঠোঁট চুবাই তৃষ্ণা মিটায়। ভগবান পাখিও বানাইছে, আবার হিয়াল কুকুরও বানাইছে। ওরা বনে জঙ্গলে থায়, রাস্তাঘাটে ঘুরি বেড়ায়, সাপেরা গর্তে থাই ফোঁসফোঁস করে, মশামাছি ভন ভন করে, ঘরবার করে আর মানুষ খালি ঘর বানায়, জোট বাঁধে আবার সেই ঘর ভাঙ্গিও হালায়। মানুষ জাতটারে আঁই অনও ঠিকঠাক চিনতাম হাইরলাম না। কখন যে মাইনষের মতিগতি হাল্টি যায়, কে জানে। মাইনষের জীবনে ঝড় আয়ে না কে কইছে। আঙ্গ বাড়ির চারপাশে যন ঝড় বাতাস আই উথালপাথাল করে মটমট করি বড্ডা বড্ডা গাছও গোড়া উল্টাই হড়ি যায়। মানুষ এক জাতের, প্রকৃতি আর এক জাতের, হক্কলের স্বভাব চরিত্রির আলাদা, কেউ কাউরে লগে শত্রুতামি করে না, আঘাত করতি গেলে কেউ কাউরে ছাড়িও কথা কয় না, এ যেন বউ শাউরির কোন্দল। শান্ত হই গেলে ভালা, না হইলে কোয়ালে দুঃখ আছে। কালবৈশাখী ঝড়ের আঁচ এমন করি ঘরের দুয়ারে আই আঁছড়াই হইড়ব কেউ ঘুণাক্ষরেও জাইনত হারে ন।
আশঙ্কার মেঘ এত তাড়াতাড়ি যে কাছে চলি আইব কেইবা আন্দাজ কইরতে হাইরছে। হারার কথাও নয়। রসুইঘরের লগের ঘরের দশখানা পাতে তিন বারে ত্রিশ জনের ভাত বাড়ি দিছে বউরা। খাইত বই আঁর দেওরদের কত রঙ্গ রসিকতা। হক্কলে হাসিতে হাসিতে গড়াই হড়ি যায়। তারপরেও তো কথার শেষ আছে নি – হারাদিন কে কন্নাই গেছে, ব্যবসাপাতি মন্দা, লক্ষ্মী মুখ তুলে চাইছে না, গুদামে কত গাড়ি মাল ঢুইকছে, আউস ধানের চাষের অবস্থা যে ভালা নয়, সেই কথা লই দুঃখ করে নদেওর। খুড়তোতো জার মুয়ে খই ফোটে, বড় ছোট মানে না, যা মনে হায় কই হালায়। ধমক মারে – ‘তোঙ্গ খাইত বই যত কথা, গলায় কাঁটা আঁটকাই গেলে, বিষম খাইলে ঠেলা বুইঝবা।’ আর এক খুড়তোতো দেওরের বড় হোলার বিয়া হইছে, নতুন বউ হাইরতে কথা কয় না। ছোট ছোট হোলাপাইনরা ওর নেওটা। ওই বউয়ের হেছনে ওরা ঘুরঘুর করে ভালো মন্দ খাওয়ার লোভে। হেগুনেরে দেখভাল করার ভার ওর উপর হইড়ছে কিনা।রাতের খাওন সাইরলে ভাইবোন বেগ্গুনে তো হাথালি বিছানায় জড়াজড়ি করি হুইত যায়। মাইয়ারা তো পাটির উপর তোষক পাতি ভাগে ভাগে বিছানা করি দিছে। হেগুনেরে গল্প হোনায় আঁর খুড়হৌড়ি। জমজমাট সংসারে অভাব থাইকত হারে, সুখ দুঃখ হইলে হক্কলে ভাগাভাগি করি লয়। খুড়তোতো মেজজা মন্দিরা বিয়ের হর তুন দেইখছি একটু আত্মভোলা গোছের। সংসারের কামকাজে এককারেই মন নাই। তাই লই দুইচার কথা উইঠলেও বেশি কেউ চটকায় না। মন্দিরাও নিন্দামন্দের কথা কানে লয় না। ঘরের এধার ওধার হাঁটাহাঁটি করি ওর দিন কাটে। ওর যে তিন খানা হোলা দুইখানা মাইয়া আছে, ওরা ক্যামনে ক্যামনে বড় হই গেল ও নিজেও জানে না। ভাবখানা এমন, হইলে হইল না হইলে নয়। গায়ে হাওয়া লাগাই চলাটা ও বাপের বাড়ি তুন অভ্যাস করি আইছে। এত বড় সংসারে কথা কাটাকাটি হইত না সেইটাই বা ক্যামনে সম্ভব। কথা হইতেছে দিন কে দিন। দিনকাল তো সমান যায় না। মনের অবস্থা হক্কলের ক্যামন হাল্টি যার। আঁর কানের আর চোয়েরে বিশ্বাস কইরতাম হারিয়েন না।
সেঝ জায়ের আত্মীয়রা হেই যে আইছে আর যাইবার নাম করে না। কেউ কোনো কথা তো কয়ই না, দেয়া হইলে মুখ ঘুরাই চলি যায়। সংসারের হাঁড়িতে ভাগ বসাইলে গায়ে ছ্যাঁকা তো লাইগবই। কুন্তলারে ঠারেঠুরে বোঝাইবার কত চেষ্টাই তো কইরলাম – বোন এরকম করি কেন থাউস, ঘরে নতুন বউরা আইছে, ওরা ভালোমন্দ কইলে মুখ চাপা দি রাইখতি হারবি নি। আঁর কথার কোনো উত্তরই দেয় না। কলসি তুন এক গ্লাস জল লই ঢোক ঢোক করি গেলে। ওর ভাবগতিক আঁর সুবিধার লাগে না। ছুঢি চলি যায় হরমুলের বেড়ার কাছে। গোয়াল ঘর তুন গোবর লই হাতের পাঁচ আঙুল দিই গুটে দেয় আর হুকনা গুটেগাইন লই ঝোরায় ভরে। ওর ছোট হোলাটা ঘেঁটি ঝাঁকাই কয় মা ক্ষুদা লাইগছে। যা তোগো নতুন বৌদির কাছে চাগই, খাওন দিব। কুন্তলার হক্কল কিছুতেই গা আলগা ভাব। বাড়িঘরে কতকিছু যে ঘটি যার ওর কোনোটাতেই নজর নাই। ওর এমন উদাসীন ভাব আঁরে চিন্তায় হালাই দেয়। সময় তো কারও জন্য বই থায় না, নিজের মতো করি চইলতে চইলতে এক সময় ধাক্কা মারে, কত কিছু হাল্টাহাল্টি করি দেয়, আগে তুন অনুমান করা কঠিন হই যায়। কুন্তলা বাপের বাড়ির লোকজনেরে কিছু কইত হারে না, ওর আত্মীয়রা দেনা শোধ কইরত হারে নাই বিধায় বাড়ি তুন বার করি দিছে মহাজন। হিয়ের লাই ঘরের বউ মাইয়াদের কথা মুখ বুঝি সহ্য করে। এদিকে ঘরের মধ্যে দুই বুড়াবুড়িরে লই শুরু হইছে নানা ঝঞ্ঝাট। নব্বইয়ের কোঠায় বয়স কে আর যত্ন হাত্তি কইরব। হাগিমুতি লই বিছানায় হড়ি থাই। এক দূর সম্পর্কের বিধবা মাইয়ারে আইনছে, হেথি যতটা হারে সামাল দেয়। অন আর কেউ কারও কথা হুইনতে চায় না। খালি অভিযোগ আর অভিযোগ কার ভাগে কম হইরছে। রোজের কামকাজেও আগের মতো নিয়ম মানি কেউ চইলত চায় না। আদর ভালোবাসা লই কেমন দড়ি টানাটানি। আঁই আর কদ্দিকে তাকাইয়ুম। স্বামী বাড়ি আইলে বুঝাই যে কমু হেই সুযোগ নাই। গ্ৰামের পাড়া-প্রতিবেশীরা সকাল না হইতে ঘিরে ধরে। গ্ৰামের মধ্যে গুরুজন বলি ওনারে সকলে মান্যগন্য করে। আর উনিও এমন ধারার মানুষ কোনো কথাই হালাইতে হারে না। জান হরান দিই হালায় ওরাও খুশি খুশি হাসিমুয়ে নাইচতে নাইচতে ঘরে চলি যায়। হইব নাই বা কেন হাপিত্যেশ করি বই থায় যে গোটা হপ্তাহ।
সকাল না হইতে কাঁদাকাটি হড়ি যাই বাড়িতে। ওমা কী হইছে কী হইছে করি ছুটি গেলি তো ভিড়মি খাই যাই। এমনটা যে হইত পারে কল্পনায়ও আনিন কনও। কী করি কী করি ভাইবতে ভাইবতে হরান যায়। বাড়ির যে যেখানে আছে ওদের খবর দিতে হইব যে। কারে হাডাই, কারে হাডাই শেষমেশ বিসমিল্লাহর বাপেরে কইলাম, দোকানে, গদিতে, মাঠে হক্কলরে লোকজন দিই খবর পাঠান, এট্টুও দেরি না করি য্যান বাড়ি চলি আইয়ে, সব্বনাশ হই গেছে। কুন্তলা গলায় ফাঁস লাগাই আত্মঘাতী হইছে, নিজে তো গেছে গেছে, হক্কলেরে মারি গেছে। এবার থানার দারোগা আই বেগ্গুনেরে গারদে হুইরব। মেয়েটারে কত কইছি এমন উচাটন হইতে নাই, হুইনল না। বেবাকের কথাগাইন মনের ভিতরে গাঁথি লইছে, হুরা ভাবের মাইয়া। কারে আর কী কমু, নিজের মাথা নিজে হিঢাইতাম চাই। চাপা আর কন্নাই থায়। যে বাড়ির এত সুনাম ছিল এক নিমিষে ধুলায় মিশি গেল। লোকজন তো যা কইবার কইল, আঙ্গ বাড়ির মাইনষের ঘাড়ে দোষ হইড়ল, কুন্তলার চলি যাওন যেন বড় শিক্ষা দিই গেল, বুঝাই দিল অনেক কিছুই নতুন করি ভাইবতে হইব। কেউ কেউ যেন মনে মনে খুশিই হইল, ভাবসাব এমন, এমনটা হইবারই ছিল। অন্য বাড়ির গ্যাতিগুষ্টি মিলি আবার শাপ-শাপান্তও কইরল। কইরছে করুক, কইবার কিছু নাই, যত সব্বনাশ আঙ্গই তো হইল।
প্রস্তাবটা শেষমেশ আঁর হৌরিই দিল। বুড়া হইলে কী হইছে মাথায় বুদ্ধি গিজগিজ করে। ‘বুঝলি বড়বউ হালচাল যা বুঝিয়ের আর বোধহয় এই সংসারটা চইলত ন। ঘরদোর আর তেমন সুবিধার ঠেইকছে না। যেদিক তাকাই যেন হুড়মুড় করি ভাঙি যার। কেউ আর কারও কথা হুইনত হারেন না।’ আঁর হৌরির এই বুড়া বয়সেও যা নজর আঙ্গ ভাবনাচিন্তা হার করি চলি যায়। হেথেনের কথাগাইন ফেলনার নয়। এখন প্রশ্ন হইল, কথাটা হাড়ুম ক্যামনে, আর কারেই বা কইলে জুতের হয়। কইবার আগে চৌদ্দবার ভাবন লাগের, কে ক্যামনে নিব। যদি কই বসে আঁর কোনো স্বার্থ আছে। বড় ছোট জ্ঞানগম্মি তেমন কি আর আছে! আঙ্গ যাদের বয়স হইছে ওরা তবু কিছু কইবার আগে চৌদ্দ বার ঢোক গেলে, নতুন বউদের তেমন টান আর কই। কুন্তলার মরন আই হক্কলের চোখ খুলি দিই গেছে। কথা কইবার আগে অন হিসাব করি কইত হইব, কারও তো মুয়ের কোনো টেকসো নাই। আমরা যেন বাতিলের দলে নাম লেখাইছি। মনের মধ্যে কেন জানি না কেমন আনচান করে। বুকের মধ্যে একটা ব্যথা চাগাড় দিই উঢে। কত বড় লম্বালম্বি ঘর, ঘরের দিকে তাকাইলে এমাথা ওমাথা দেয়া যায় না। কত তো থালাবাসন জামাকাপড় বিছানাপত্র আনাচকানাচে। ছোটবড় মিলাই জনা সত্তর লোক গিজগিজ করে। হারাক্ষণ কলকল করে বাচ্চাগুনের চিৎকার চেঁচামেচিতে আর বউঝিদের গালগপ্পে। ঘরের মেঝে তো নয়, একখান ছোট উঠান কওন যায়। বাসন কোসন ঝনঝন করে একোনা থেকে ওকোনা যায়। ঘরের মধ্যে কত রাজ্যের কোনা, কে আর তার হিসাব রায়, হক্কলটাই চোয়ের দেয়া। সুযোগ হাইলেই দাপাই বেড়ায়, কার ধমকানি কার বারন কে শোনে। এতগুন মাইনষের চলন বলনে আনন্দের বহর ছিল মনের মতো। দূর সম্পর্কের আত্মীয় স্বজনের এমন সুখের ঘরকন্না দেই হিংসা কি কম করে, কারো রে চক্ষুশূল হয় না তাই বা কেমন করে কই। এমন একটা সংসারেও জোয়ার ভাটা খেলে।
এমন দিন যে দেইখতে হইব কোনোদিন ভাইবতাম হারি ন। অনেকগুন ঘটনাই চোখ খুলি দিছে, যদি অন ভাগ না হয়, হরে অনেক দেরি হই যাইব। হক্কলের মনের মধ্যে হায় হুতাশ ভাব। কি হইব আর কি না হইব, এই লই কেউ দুই চোয়ের পাতা এক কইরত হারেন না। বাড়ির যেই চেহারাখান লই বেগ্গুনে আনন্দে মাতি তাইখত, বেগ্গাইন যে এমন করি দুই টুকরা হই যাইব, স্বপ্নেও তো ভাবে নি! বড় ঘরের সামনের বারান্দায় লম্বা করি তিন চারখানা হাঢি বিছাইছে। এ ওর মুয়ের দিকে চায়, কিছু তো আর কওনের নাই। বড়দের মুয়ের উপর কথা কইব এমন সাহস তো নাই। যা অবস্থা দাঁড়াইছে, হক্কলের সম্মতিতে ঠিক হইল, বাড়িটা সাত ভাগ হইব। হক্কলের ভাগে দুইডা করি বড় ঘর মিলব, ঘরের তুন আলগা করি যার যার হিছনের ভিটায় রসুইঘর বানাই লইত হাইরব। ঘরের মাঝখানে মাঝখানে টিনের বেড়া দিই পার্টিশান করি নিত হইব, যাতে করি ভবিষ্যতে কোনোদিন ঝগড়াঝাঁটি না হয়। এই না হয় গেল ঘরের কথা। আর হরে হরে যার যার ঘর একটা তুন দুইটা কইরতে চাইলে ওরা নিজের খরচায় করি নিব, হেইঢা লই কারো কিছু বলার থাইকত ন। বিধির কী মহিমা হোলাপাইনগুনের সেইদিকে নজর নাই, মনের সুখে উঠানে গোল্লাছুট খেলে, একবার এই দল জেতে তো আর একবার অন্য দল। হেথাগো বাবা কাকাদের খেলা ওরা কিছুই বুইঝত হারেন না। ওরা জানেও না কাইল তুন বেগ্গুন ভিন্ন হই যাইব। কাঁসা পিতলের থালা বাসন ভাগে হইড়ছে কার ঘরে কতজন লোক সেই হিসাব করি। মাথা গুইনত যাই হৌরি কয়, ‘ল্যাদা হোলাদের গণায় ধইরচছ তো।’ হরের দিন ঘরের চেহারাখান হাল্টাই গেল। বাজারে গণেশের দোকান তুন মাপে মাপে টিন কিনি আইনল। হেই হর্যন্ত খরচাপাতি হুরান সংসারের তহবিল তুন দিবার কথা হইছে, তাই তো কারও গায়ে আঁচ লাগেন। বিপত্তিটা হইছে যবে তুন আলাদা রসুইঘর বানানো শুরু হইছে। মাটির উনুন তৈরি হইছে তড়িঘড়ি। লাকড়ি ঘরও ভাগাভাগি হই গেছে। রসুইঘরে ছ্যাঁতছুঁত আবাজ হইলে কারও কারও চোখ দিই জল গড়ায়। কাঁচারি ঘরের সামনের জায়গা তো ভাগাভাগি হবার জো নাই। কোনো মতে ঠাসাঠাসি করি যে যার জায়গায় খড়ের গাদা বানাইছে। আরো যে কত ভাগাভাগি কইরত হইব কে জানে। এতদিনের জড়াই জড়াই থাকি যা যা জোটাইছে তা কি এত সহজে ভাগ করা যায়! মনের ভাগ কার কতটা হইছে সেইবা কজনে জানে। গরুগোতানগুন মুখ তুলি চাই থায়। ওরা বুইঝত হারেন না হেগো মা-মাসিরা এদ্দিন একটা গোয়ালঘরে থাইকত, মজায় তো থাইকত গা ঘেঁষাঘেঁষি করি, আইজ কেন এক একজন ভিন্ন দিকে চলি যার, চোখের কোনা ভেজা, মুয়ের হাম্বা হাম্বা বাক নাই। এই প্রশ্নের জবাব কার কাছে চাইব। দলিল মিঞার কাছে কি আঙ্গ বাড়ির কর্তাদের কামকাজের হিসাব থাকে? ও তো সারাদিন ধরি হালচাষ কইরবার লাই মাঠে বলদ লই যায়, ঘাস খাওয়ায়, খড় খইল দেয়, ওরা জাবর কাটে। মাঝে মাঝে গায়ে গোবর লাগি থাইকলে মোছাই দেয়। এমন সম্পর্কের কি নাম হয়? মাইনষের সম্পর্কের আবার কত নাম, কত ভাগ, কত রূপ, এই পারদের মতো উঢে আর নামে, ধরি রাখন তো যায় না, এই আছে, এই নাই। কোনও কিছু বুঝি উইঠবার আগেই জায়গা হাল্টি হালায়।
জমিজমার ভাগাভাগি লই ভাইয়ে ভাইয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হইছে। কারোরে কি থামানো যায়। একজন ডাইনমুই যায় তো, আরেকজন বাঁমুই। দড়ি টানাটানির খেলা শুরু হই যায়। এমন গোলমালে অবস্থা দেইখলে নানা কথা আই মনের ভেতরে খচখচ করে। এতদিনের একজোট হই থাকা সব অংশীদারি লই, সীমানা লই বৃথা হই গেল! আঁই দূর থুন দাঁড়াই দাঁড়াই রঙ্গ দেই। কথার মাঝখানে কথা কওনের লাই মাইয়া মাইনষের জায়গা আছে নি। কে আঁর আঙ্গরে মূল্য দেয়। সংসারটারে আমরা কত কষ্ট করি বাঁধি রাই, এই কথা কেউ মনেও রায় না। এর মর্ম আর কয়জনে বোঝে। কোনও কিছু সিন্ধান্ত লইবার বেলায় পুরুষ মাইনষের কথাই শেষ কথা। হেথেনেরা সব বোঝাপড়া করেন কিনা। এমন নিয়মই তো চলি আইছে। যাই হোক না কেন জমিজমা ভাগাভাগি হইতেই হইব। ঘর ভাগাভাগির হর তুন কেউ কারও লগে তেমন কথা কয় না। হক্কলে কেমন চুপ মারি গেছে। ভিটা এক জিনিষ চাষের জমি আর এক জিনিষ। একটা হইল মাথার উপর ছাদ দেয়, থাওনের লাই জরুরি, আর জমি হইল লক্ষ্মী, এই হলো ফসলের ধন, হেটও ভরে, মনও ভরে। হক্কলে অন উডিহড়ি লাইগছে ক্যামনে কী করন যায়। দূরের জমির তুন কাছের জমি লই যত মাথাব্যথা। মাথার উপর বোঝা চাপাইলে তো আর রক্ষা নাই। জমির মাপজোক লই কাজিয়া তো কম শুরু হয়নি। আল বাঁধা লই গরম গরম কথা। মাঠেঘাটের ঝগড়া আই যন হড়ে ঘর-দূয়ারে তার জ্বালা তো কম নয়। ভাগাভাগির আগের দিন হইলে হক্কলে হক্কলের মুখ দেইখত, মিষ্টি মিষ্টি কথা কইত, বাইরের কথা ঘরে কইত, ঘরের কথা চটকাই মটকাই এমন দশা কইরত, ঘরের বাইরে যাইবার কোনো রাস্তাই খোলা থাইকত না। অন কি আর হেইদিন আছে, আগে ছিল একটা দরজা আর অন দরজা হইছে সাতখানা। খুড়তুতো জেঠতুতো মিলি সাত ভাই হেথাগো বউঝি হোলামাইয়ারা বেজার মুখ করি যে যার ঘরে ঢুকি যায়। জায়ে জায়ে বউয়ে বউয়ে গালগপ্পো হাসি ঠাট্টা কইরবার দিন ফুরাইছে। জানালার শিকের ফাঁক দিই দুইচার কথা কয়। কথার মধ্যে নাই কোনো রসকস, নাই কোনো ছিরি। আমাগোর জায়গায় তোঙ্গ হেথাগো আমনেগো আই হইড়ছে। যে যার ঘরে বই ইষ্ট নাম জপে। টঙের উপরেও পিচবোর্ডের হাটাতন দিই ভাগ ভাগ হই গেছে। ট্রাঙ্ক লেপ তোষক কাঁথা কম্বল হোটলা বাঁধি সরাই লই গেছে যার যার সীমানায়। হায় হায় রে, এমন দুঃখের হিসাব কষা কি সহজ কথা।
আঁর স্বামী মনমরা হই আছে। ঘরের চৌকাঠে পা রাখতেই টের হায় ঘরটা বড় ছোট হই গেছে। এমাথা ওমাথা কিছুই আর দেওন যায় না। কোনও ঘরে টিমটিমে আলো, কোনও ঘরে আঁধার। ভাইয়েরা কাম তুন ঘরে ফিরলনি বুইঝত হারেন না। নিজের মনেই কয়, ‘সংসারটা ভাগাভাগি না হইলে চলছিল না।’ হক্কলটা কি আঙ্গ ইচ্ছার উপর চলে। জোয়ার আই আমনাআমনি বানের জলে ভাসাই লই যায়। কনও আর ফেরত দেয় না। আঁর মুয়ে এমন কথা হুনি মাথায় হাত দিই বসি হড়ে। ভাইয়ে ভাইয়ে মুখ দেয়াদেয়ি নাই, দিনরাত হাওনাগণ্ডার হিসাব লই কূটকচালি। আঁর নিজের মাথা নিজে হাঢাইতে মন চায়। হোলামাইয়াগুনেরে হয্যন্ত আঁর কাছে হইড়ত হাঢায় না। আঁর হৌরি কয়, ‘ চোয়ের জল হালাইস না মা, বেগ্গাইন ভবিতব্য।’ মাইনতে হাইরলাম না কথাটা, মাইনষের অন্তরটাই হচি গেছে। হুইনলাম, আঁর মেজ দেওর চার কানি জমি কিনছে রমেশ অধিকারীর তুন। হেথেনরা ইন্ডিয়া চলি যাইব, হিয়ের লাই সস্তায় বিক্রি করি দিছে। মাইয়ার বিয়াও কেমনে কেমনে ঠিক কইরছে ইন্ডিয়ার হোলার লগে। বুকের ভিতরে মোচড় দিই উইঠল। আঁর স্বামী নিজে হেই হথ মাড়ায়নি যদি গ্ৰামের হিন্দুরা একা হই যায়, মাইন্যগন্য করে কিনা, আপদে বিপদে ভরসা কিনা। মুসলমানরাও কম ভালোবাসে না। ওরাও তো বিপদে হইড়লে শলা পরামর্শ করার লাই ছুটি চলি আইয়ে। মাটি আঁকড়াই হড়ি আছে দ্যাশটারে ভালোবাসে বলেই না। অমন মাইনষের নিজের ঘরেই ভাঙন ধইরছে এও কী সহ্য হয়। বাড়ির চারধারে তালগাছ, সুপারি নাইরকেলের বাগান, আমের বাগান। হেগুলিও তো ভাগ করন লাইগব। আঁর দেওররা হাত চাবি ধরি কয়, ‘ বড় বৌদি আমনে একটা উপায় বাতলাই দেন।’ আনন্দ পাইলাম এই ভাবি যে এত ঝঞ্ঝাটের হরেও হেগুনে আঁর উপর বিশ্বাস রাইখছে।
ঘরের পাশে ঘর হইল, ভাগ বাটোয়ারা হইবার হর যার যার মতো সংসার হইল। আগে যেমন মুখ দেখি কই হালাইতাম কে কেমন আছে, অন দেইও না হারাক্ষণ, ভালা আছে না মন্দ আইছে কে কইব, নিজেগো ঢাকিঢুকি রাইখতেই ওগো আনন্দ। ছোটোমোটো দোকানপাট করি যেতেগো দিন চলে হেথাগো অভাবের ঠিকানা নাই, চোয়ের জলে নাকের জলে হয়। এ যদি ওর গাছ তুন হল ছিড়ি খায়, লঙ্কাকান্ড বাঁধি যায়, কোমর বাঁধি ঝগড়া করে, আকথা কুকথার ঝড় বই যায়। মাঝখানে যাই কিছু তো কইতাম হারি না, হিতে বিপরীত হইলে আর রক্ষা নাই, চোয়ের জল হালাই ছোট বড় কথা হোনাইতে ছাড়ে না। এইভাবেই তো দিন চলি যায়। যাগো কাপড়ের ব্যবসা চালের গুদাম আছে হেথাগো মুয়ে চওড়া হাসি, অন্যদের দেয়াই দেয়াই মনের খুশিতে আরামসে চলে, কাউকে তোয়াক্কা করে না, ভুলি যায় একসময় ভাগাভাগি করি খাইছিল, সুখ দুঃখে একলগে মন জুড়াইত। সময় হালটি গেছে, জমিজমা দেয়াহোনার কাম ছাড়ি অন কেউ অন্য হথ ধইরছে, শহরে যাই মুহুরীগিরি করে। ছাড়াছাড়া ভাব, বাড়ি তুন সদর দরজা দিই বার হই যে যার রাস্তা ধরে। হড়ালেখায় মাথা ভালা হোলারা উঁচা ক্লাসে হড়ালেখার লাই দূরের শহরে চলি যায়। ঘরে বই থাই কিছু হোলারা বাপের দোকানে বই রোজগারপাতি করে। আঁর ন দেওরের হোলার বুকের দোষ হইছে। নরোত্তম কবিরাজ কম চেষ্টা তো করেনি, হোলার রোগের হল কোথায় হইল, কমা দূরে থাক, যত দিন যায়, আরও কাবু করি হালায়। শেষমেশ ঠিক কইরল, হক্কলের তুন চাইচিন্তি হোলারে বড় ডাক্তার দেয়াইব। দেয়ানো হইল কিন্তু ব্যারাম সারে কই। হোলা তো যায় যায়। আঁই কী চোখ হিরাই থাইকতাম হারি। হেথের শিয়রে বসি মাথায় হাত বুলাই দি। হাড়ার লোকে কইল, ‘ইন্ডিয়া লই যাইত হাইরলে এই হোলারে বাঁচানো যাইত হারে।’ ভালা ভালা কথা কইতে সোজা, কিন্তু নেয় কে? গাঁটের কড়িও নাই, কইলজের জোর যিগাইন ছিল, হুরাই গেছে। সংসার অসার, ভাঙি গেলে তো আর জোড়া লাগে না। একলগে থাইকলে না হয় একটা কথা ছিল, জমি এক চিলতে বিক্রি করি একবার চেষ্টা করি দেইখতে হাইরত। ভাগে যেইটুকুনি হইড়ছে, বিক্রি কইরলে খাইব কি, দেবতার কাছে হত্যে দিই হড়ি থাওন ছাড়া আর কি কোনো উপায় আছে।
সেজ দেওর কেমনে কেমনে অঢেল পয়সার মালিক হইছে। রাস্তার ধারে ধারে কানি কানি জমি কিনছে। বড় গোয়াল ঘর হইছে, হালের গরুর সংখ্যা দ্বিগুণ হইছে। কাঁচারি ঘরের লগে নতুন একটা ঘর বানাইছে। অতিথিরা বেড়াইত আইলে হেই ঘরে রাত কাটায়। ধনী লোক বলি হেথের নাম হিন্দু মুসলমান বেগ্গুনের মুয়ে মুয়ে হিরে। ছোট দেওরের ভাগ্য হেরেনি। হোলামাইয়া লই খুব কষ্টে আছে। ওর ভাগে শেষ মাথার ঘরটা হইড়ছে, রোদ হড়ে না। নাইরকেল সুপারি হপ্তার হাঁটে বিস্যুৎবার আর রইববারে যা বেইচত হারে, তা দিই কোনোমতে সংসার চালায়। আঁরে আঁর স্বামী যা হপ্তায়ের খরচা দিই যায়, হিয়ান তুন বাঁচাই ছোট জার হাতে দু-এক টিয়া দিই। হোলাঢারে আঁর কাছে হইড়ত হাঢায়। দুপুরের খানা আঁর কাছে খায়। আঁর আঁচলের খুট ধরি হারা ঘর ঘোরে। রসুইঘরেও একটা হিড়ি লই চুলার কাছে বই থায়। ওর মার কাছে যাইবার নাম করে না। আঁর বইন আইছে বেড়াইতে হোলা মাইয়া লই। বাড়ির চেহারা দেই হেতির তো চোখ ছানাবড়া। ‘এমন দশা ক্যামনে হইল কবে তুন হইল দিদি!’ হেতি ঘরে ঘরে যাই হক্কলের হাড়ির খবর লয়। এই ঘরের কথা অন্য ঘরে কয়। আগে যন আইছিল, কত সুখের সংসার ছিল, এক উনুনে হাড়ি চড়ত, গলায় গলায় ছিল কত ভাব ভালোবাসা, উবে গেছে বেগ্গাইন চোয়ের নিমিষে। ভাঙা ঘরে তেমন আনন্দ আর কই, হিয়ের লাই হেথির দুঃখের শেষ নাই। দুঃখ করি কয়, ‘দিদির বাড়ি আর আইতানন।’ এত কষ্ট আর হাইস না বইন, বেগ্গাইন বিধির নিয়ম, আঙ্গ আর কী করার আছে। হেথি আঁর কথা হুনি খুব একটা খুশি হইল না। বাইচ্চাকাইল তুন আইয়ের তো, একটা মায়া জন্মি গেছে, দিদির বাড়ি নিজেগো বাড়ির মতো হই গেছে। বেবাক ঘরের হোলামাইয়াদের নিজের ভাগনা ভাগ্নির মতোই দেয়ে। হেথির কষ্টটা আঁই বুঝি। মনে মনে চায় যদি আগের মতো এক হই যাইত। আইবার সময় বেগ্গুনের লাই টিন ভরতি করি লাড়ু লই আইছে। দিদির বাড়ি বইলতে এতকাল হেইরকমই ভাবি আইছে, অন আর মাইনত হারেন না। কার কাছে কয় দুঃখের কথা। আঁর জাদের গলা জড়ি ধরি কয়, ‘মেজদি, সেজদি তোমরা এমনটা কেন কইরলা, তোঙ্গ সুখের ভাগে টান হইড়ছলি নি।’ হেথিরা কি আর জবাব দিব, যে ব্যারাম তিল তিল করি শরীরে বাসা বাঁইধছে, তারে সারিতে গেলে তো ঔষধ খাওয়ানো লাইগব। এই ভাঙনই যে ঔষুধ তাইলে যদি মনের অসুখ সারে। বইন আঁর অখুশি হই বাড়ি যাইত চাইলে হক্কলে মিলি টানি ধরি রাই। রোজ এক ঘর করি নেমন্তন্ন খায়, আদর যত্ন হাই মনটা শান্তি হয়। মাইনষের মন বড় বিচিত্র কন যে কোন দিকে ঘুরি যায় কেউ কইত হারে না। সুখের খোঁজ কইরত যাই নিজেরাই গাড্ডায় হড়ে।
গাছগাছালি গরুগোতান ধানের গোলা খড়ের গাদা হক্কল কিছুই ভাগ হইছে, কেবল ভাগ হয় ন দুইটা বড় বড় হুইর। দুইটা হুইরই মেঘনা নদীর খালের লগে নালা দিই জোড়া। কত রকমের মাছই তো কিলবিল করে, লাফায় ঝাঁপায়, হিগুনেরে ভাগ করন তো যায় না। হিংসাহিংসি নাই, ঝগড়াঝাঁটি নাই, গলাগলি করি হুইরের মধ্যে ঘুরি বেড়ায়। হুইরে মাঝে মাঝেই বেড় দেয়। যেই মাছ এক ভাগ হইত, অন সাত গিরি মিলি ভাগ করি খায়। বাড়ির মধ্যে দড়ি টাঙাই সামনে হিছনে তেলচাপাটি, হুঁঢি, টেমবইচা, মেনা, ভেদা মাছ হুয়াই শুটকি করে। শ্রাদ্ধশান্তি বিয়া হইলে রুই কাতলা বোয়াল, কোরাল, আইড় মাছ ধরি চার বাড়ি নেমন্তন্ন করি খাওয়ায়। এদের ভাগাভাগি যে কবে হইল, কেমনে হইল কে জানে। বিয়ার পর আই যতটা হুইনছি তিন পুরুষ চার পুরুষ আগের তুন ভাগ ভাগ হই একখান করি বাড়ি হইছে। হেই বাড়ির ভিতরে ভাগ হই কত ঘর হইছে। লম্বা হাত পারি খাইত বইলে মুখগুনরে চেনা যায়, দেখা-সাক্ষাৎ হয়, না হইলে আর কে কার দিকে চায়, কালেভদ্রে না দেখা । খাইত বই কত হাসাহাসি, ঠাট্টা-মস্কারা – নিজে খাইবার লোভে কয় হেতের হাতে মাছের মাথা দাও দেখি ঠাউর। আরও চারটা রসগোল্লাও দাও। আহারে বেচারার মুখটা শুকনা হই আছে। অমিলের মধ্যে মিল দেইখলে মনটা আঁর জুড়াই যায়। এই হুইর আঁর মনের মধ্যে ঘুরি ফিরি বেড়ায়। মাইয়া হোলা বউঝি, হুরুষ মানুষ হক্কলে হেই হুইরে যায় ঝাঁপায়। বৃষ্টির জল হইড়লে হুকুরটা কেমন সুন্দর নাচে। মানুষ যায়, মানুষ আসে, সময় মরি গেলেও শরীরের ছোঁয়া মিশি থায়। মাটির উপরে থাইলে মনে হয় কত দূরে দাঁড়াই আছি, হুইরের জলে কত কাছের লাগে। ঘাটে যাই বাসন ধুইতে গেলে দেই হুকুরটা আঁর দিকে চাই আছে, আঁরে ইশারা করি ডাকে, কত শত কথা কয়। জীবনটা আঁর কাছে হুইরের মতো লাগে। আঁর হৌরি দেরি হই গেলে চিন্তায় হড়ি যায়। হুইরের পারে সন্ধ্যা হইলে নাকি আত্মারা স্নান কইরত আয়ে, হেথেনেরা মনের সুখে ঘোরে। বাড়ির লোকজনদের হাইলে আর ছাড়ে না। আঁই ভাবি মরা মাইনষের আঙ্গ লাই এত টান, জ্যান্ত মানুষরা কেন আলগা আলগা থাইকত চায়।
আম বাগানের পাশে এক চিলতে জমি। কারও নজরেও হরেন এদ্দিন। ইঁদুর মাটি তুলি খুঁড়ি খুঁড়ি রাইখছে। হেই জমিতে যে শাকসবজির চাষ হইত হারে কেউ ভাবেনি। জমির চারধারে খাদ, খাদে আমপাতা জামপাতা হরি হচা গন্ধ বার হর। গর্ত আবার সেজ দেওরের সীমানার লাগোয়া। বাড়ির তুন বার হইত গেলে গন্ধ শুঁইকতে হর বলে অনেকের গা জ্বালা। কারা আবার সাপের হামির গন্ধ হাইছে, কারা আবার গোখরো সাপের নাচনও দেইখছে। এইটা লই সেজ জায়ের লগে একদিন সারা দুপুর ধরি তুমুল ঝগড়া, এমন যে ঝগড়া, সেই আর থামতেই চায় না। হুইর বাগান টপকাই হাশের বাড়ির গ্যাতিগুষ্টির টনক নাড়াই দিছে। শেষমেশ তিন বাড়ির লোক জড় হই বুঝাই সুঝাই ঠাণ্ডা করে। হেই চিলতে জমিটা কার ভাগে হইড়ব এই লই আঁর স্বামী আর দেওরেরা মিলে বৈঠক কইরছে। ঠিক হইছে খুড়তুতো ছোট দেওর আর আঁর না দেওরের মধ্যে হক্কলে দাঁড়াই থাই আধাআধি ভাগ করি দিব। হরের দিন বাঁশের কঞ্চির বেড়ায় দুই ভাগ হইল। জমি নিড়ানি দিই দুই জনেই বীজ ছড়াইল। ঢুল্লার শাক, কাঁচা লঙ্কার চারা গজাইছে ন দেওরের জমিতে আর খুড়তুতো ছোট দেওরের জমিতে মাইরা গাছ আর টকবাইগুন। যে জমিখানের দিকে কেউ ফিরেও চাইত না, অন আইতে যাইতে চোখ টাটাই চায়। ন দেওর শখ করি ছাগল হুইশছে। সেই ছাগল গয়াম গাছের গোড়ায় বাঁধি রায়। ওমা কী কাণ্ড কী কাণ্ড ছাগল দড়ি ছিঁড়ি কেমনে কেমনে জমিতে ঢুকি মাইরা গাছের হাতা চাবাই চাবাই খাই হালায়। সব্বনাশের মাথায় আগুন। রাগিমাগি ফোঁস করি উঠে খুড়তোতো দেওর। ভরা উঠানে লাঠি লই তাড়াই আয়ে। অবস্থা বেগতিক দেই আঁই দুইজনের মাঝখানে আই গোলমাল থামাই। অগত্যা ঠিক হয় ছাগল আর কোনমতে বাড়িতে রাখন যাইত ন। আজ এই জমিতে আইছে কাইল অন্য জমিতে যাইব। ভাগাভাগির জেরে ভাইয়ে ভাইয়ে শত্রুতামির বীজও যে পোঁতা হই যাইব, কে আর জানত। মোদ্দা কথা হইল দেইখতে দেইখতে আঁর এত বছরের দেয়া হৌরবাড়িটা খান খান হই গেল। আঁর স্বামী কইল, আর যাই হই যাক, নিজের মনের ভেতরে কনও বেড়া দিও না।
পথের দিশা পথই চিনে
কখন জড়ায় আপন জনে
সিন্ধুবালা হত্যেক দিন কাঁধে এক গাঁট্টি কাপর লই হক্কলের ঘরে ঘরে ঢুঁ মারে আর জিগায় ‘দিদিগো ধোপার বাড়ি দিবার লাই কিছু আছে নি।’ কেউ হেথির কথা হোনে আবার কেউ হোনেও না। বাড়ির বউরা কামকাজ করি ফুরসত হায় না, হেথি আঁর ঘরের দুয়ারে আই চুপচাপ বই থায় দুই একটা সুখ দুঃখের কথা কইব বলে। কথায় কথায় আঁরে জিগায় ‘আচ্ছা দিদি কন চাই, মাইনষের কোয়ালে এত দুঃখ লেয়া থাকে ক্যান!’ সিন্ধুবালা মনের আবেগে এইসব কথা কয়, মনের ভেতরে কোনো প্যাঁচঘোচ নাই, নিন্দামন্দ করা, কারও কান ভাঙানো হেথির স্বভাবে নাই। এঘরের কথা আর এক ঘরে চালাচালি করার সুযোগ ছিল, একটুও হিগাইন কয় না। কত কথা হেঢের মধ্যে জমা করি রায়, আঁই খোঁচা মাইরলে কেবল ইনাই বিনাই গপ্প করে। বাটি করি খই মুড়ি দিলে গালে তোলে, ঢক ঢক করি এক গেলাস জল খায়, তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। হেথির চুলগাইন ঢেউ খেলানো, উদোম গা, হরনের কাপরগাইন ছেঁড়া। কিয়ের লাই কি জানি আঁর লাই হেথির মনের মধ্যে ভিন্ন একখান জায়গা করি রাইখছে যতন করি। সিন্ধুবালারে আঁই অনও বুঝি উঠতাইম হারি না। হেথি কি বুঝি হালাইছে এই জীবনে আর কিছু কইরত হাইরত ন, হিয়ের লাই ক্যামন আড়াল তুন নিজেরে জানান দেয়। আঁই কতবার চেষ্টাচরিত্র কইরছি ধইরবার লাই কিছুতেই হারি ন, হিছল খাই চলি যায়। ধরা আর দিব কি, হেথির নিজের ধারণা, হারা জীবন সংসারের ঘানি টানি ও তিল তিল করি শেষ হই গেছে। নাতিপুতি লই হেথির সংসারটা কম বড় ন। মনে কম কষ্ট ন । আঁই একদিন কইলাম, তোর বাড়িতে একদিন যাইয়ুম। কথাটা হুনি খুশিতে ডগমগ। ‘দিদি আমনেদের ঘরের মানুষ আঙ্গ বাড়িতে হা রাইখলে আমরা ধন্য হই যাইয়ুম।’ আমার হায়ের উপর কোয়াল ঠুইকল। আঁই তো আকাশ তুন হইরলাম – কী করস কী করস হায়ের মধ্যে কত কী লাগি আছে। ঈশ্বর উল্টা আঁরেই পাপ দিব।
‘দিদি গো সব্বনাশ হই গেছে। একবারে মরণ দশা। আমনেগো উত্তর বাড়ির চরণ জেঢা এই যায় তো হেই যায়।’ হেথির দুঃখে হরান যায়। কত বছর ধরেই না কত কাপড়জামা ধোয়াহালি কইরছে, ডাকখোঁজ কইরছে, এমন অসময়ে যে এমন দশা হইব, বিলাপ কইরতে শুরু করে সেইসকল কথা লই। সিন্ধুবালারে বোঝা এত সোজা নয়। ওর মনের ভেতরটা এত থলথলে, বাইরে তুন টের হাওন যায় না। ও নিজেও কী জানে হাড়াহড়শির জন্য কেন ওর এত দরদ, কেন হরানঢা এত ছটফট করে। ঝরঝর করি কাঁদি ওঢে। আঁই সান্ত্বনা দিই কই এত নরম মন লই তুই সংসার করচ ক্যামনে। ‘মাইনষের যে এত কষ্ট চোয়ে দেওন যায় না।’ সিন্ধুবালার মন বুঝার লাই আঁই ঠিক করি এবার ঘরে ঘরে যাই পরখ করি দেখুম মানুষগুন ক্যামনে বাঁচি আছে। বাড়ির মধ্যেই এতদিন চরকির মতো ঘুরি বেড়াইতাম, ভাইবতাম এইডাই বুঝি জীবন। সিন্ধুবালা আঁর ভাবনারে জাগাই দিল – না গো দিদি ঘরে বই থাইও না, দুনিয়াদারি দেইখবে চল। হেথি আঁরে লই চলি যায় অনেক দূর, যিয়ানে মাইনষে আর গরু ছাগল এক ঘরে থায়। খড়ের চাল আর গোবর লেপটানো হর্মূলের বেড়ার ঘরে দিন কাটায়। ওরা আধা লেংটা আর হেঢে ক্ষিদে লই আঁর হা দুইখান জড়াই ধরি কয়, ‘মা ঠাকরুন, এই তো নিজের চোখে দেইখছেন আঙ্গ অবস্থা।’ হেথাগো উনুনের উপর হাঁড়ি তুন ধোঁয়া গলগল করি উঢের। চাল হুঁঢের কি হুঁঢের না ঈশ্বর জানে। আঁই হা ছড়াই হিড়ির উপর বসি বসি দেই দুই তিন বছরের হোলাপাইন নেংটা পোদে ঘুরি বেড়ার, হেগুনের কোমরে তাগা হারানো, দুই একখান তাবিজ ঝোলে ঝনঝন আওয়াজ করে। মুখের দিকে ক্যামনে তাকাইয়ুম, হুকনা মুয়ে কথা বার হয় না। জীবনের রঙটা কনও তিতা লাগে। কত কষ্টের জীবনে লাগি রইছে রক্তের দাগ। নিজেরাও জানে না কনমুই গেলে এট্টু ঘুরি দাঁড়াইত হাইরব। হোলামাইয়াগুনের মুয়ে হাসি ফুইটব। সূর্যের আলো হেথাগো ঘরের বারান্দায় আই হইড়লে গোবর লেপানো মাটিটা চকচক করি ওঠে। ঘরের চালটা ফুটা। জল চৌকিতে বই তাকাই দেই নিম গাছের ডালটা উবুড় হই ফুরফুরে বাতাসে দুইলছে আর খড়ের চাল খড়গাইন উড়ি উড়ি হড়ের। কবুতররা নাচি নাচি বেড়ায়, শালিক চড়ুইরা হিচন হিচন ঘোরে। সিন্ধুবালা ওর দুই ছেলের বউ আর নাতি নাতনীর লগে আঁর হরিচয় করায়। মুখে ওর আনন্দে খই ফোটে, কয় পেন্নাম কর, পেন্নাম কর। আঁরও কি কম আনন্দ হর, হেগুনেরে জড়াই ধরি। দূর তুন হেথাগো রান্নাঘরের ছ্যাঁৎছুৎ আওয়াজ হুনি। দুইটা কাক আঁর হার কাছে আই ঘুরঘুর করে। কিরম একটা গন্ধ নাকের আছে আই সুড়সুড় করে। গন্ধটা চিনি চিনি যেন। গন্ধের কত রকম সকম। ভাতের মাড় নীল সাবান সোডা জলের গন্ধ নাকের চারপাশে আই বাতাসের তালে তালে মোচড় খায়। আঁর কাছে অন্যরকম লাইগলে কী অইছে, সিন্ধুবালাদের রোজের কাজের ঘোরে নাক সয়া হই গেছে, ফুলের গন্ধ, ফলের গন্ধ শুঁকতে যাইলেই শরীরের ভেতরটা কেমন করি ওডে। কেন হয়, হেই আন্দাজ ওরা কইরত হারে না। সকাল হইতে রাইত তক ওই গন্ধতেই ভাইসতে ভাইসতে ওগো সময় কাবার হয়। ডোবার নীল জলে শরীর ডোবে। সিন্ধুবালা আঁর চোয়ে চোয়ে কথা কয় আর হাসে।
সিন্ধুবালার এত যে চেনাজানা হথ আঁই আর কেমনে চিনুম। হেথি সামনে হাঁইটলে আঁই হিছনে হাঁটি। মাটির যে এত রঙ হেইঢা কী আগে জাইনতাম। মাটি চিনতে চিনতেই হথ চলি। সবুজ ঘাসের রঙ হলুদ মরা ঘাসের রঙে গা ঘেঁষাঘেষি করি মুখ তুলি চাই থায়। আঁই হাঢি চলি পা ফেলি ফেলি। আঁশশেওড়া গাছেরা হালকা বাতাসের ছোঁয়ায় রাস্তার উপর ঢুলি হড়ে। ফাঁকফোকরে থায় গিরগিটির দল। চোয়েরে ঘুরাই ঘুরাই চায় কে আসে কে যায়। বেতইন গাছের ফল ডালের ফাঁকে ফাঁকে মুখ বাড়ায়। আঁর শ্বাসের টানে লাগে গাছগাছালির ঘ্রাণ। খোলা আকাশ আর মাটির আলো যে এত মিঠা হয় কনও তো ভাবিনি। সিন্ধুবালা আঁরে কয় দিদি হা চালান। দুই একটা ছাগল ছানা ধুলা উড়াই চলি গেলে শূন্যে উঢি ঘুইরত থায়ে গোল গোল হই। এই হথে না আইলে ক্যামনে বুইঝতাম এমনও একটা গাছ-মাটি-জঙ্গলের চেহারা হয়। মাইনষে এই পথ মাড়ায় কালেভদ্রে। কোথা তুন আইয়ে, কোথা তুন যায়, কেউ কইত হারে না, সিন্ধুবালা আঁচ কইরত হারে চেহারাখান দেই। মাইয়াগুলানের মুখে ফাটা ফাটা দাগ, মাথার চুলে কদ্দিন তেল লাগায়নি, ছিঁড়া ছিঁড়া, রঙ চটা ব্লাউজের উপর গায়ের কাপড়খানা গলার কাছে ঢুলি হড়ি যায়। যুগি বাড়িখান দেইখবার সখ ছিল কদ্দিন ধরি। দূর তুন ঠক ঠক শব্দ হুনি চমকাই উঠলাম। কেমন যেন ওগো বাড়ির দরজা। নাইরকল সুয়ারি বাগান হার হই ডান দিকে মোড় ঘুরলেই সারি সারি দোচালা টিনের বাড়ি। ঘরে ঘরে তাঁতকল। হুতার ভিতর দিই মাকু যায় আর আয়ে। তাঁতির হাত দুইটা তালে তালে নাচে। ঘরের বউঝিরা হাত বাটায়। গাছের হাতা কুড়াই আনি জমা করে। ওরা হক্কলে জোর গলায় চেঁচাই চেঁচাই কথা কয়। দুই তিনটা কুত্তা আঁরে দেই ঘেউ ঘেউ করে। আঁই কতা কইতাম গেলেও কেউ সাড়াশব্দ করে না। কী জানি কোন অভিমান পুষি রাইখছে কিনা ভিতরে ভিতরে, হেইডাইবা কোনকালের ক্যামনে কমু। ওরা আঁরে দেই হলাই যায়, এমন করি হলাই যায় ইঁদুর যেমন করি গর্তে ঢোকে। বাড়ি ভরতি কত রঙ বেরঙের হুতা, মোটা মোটা লাস্যি ছড়াই ছিটায় আছে। সিন্ধুবালা হেথাগো মাইয়াগুলানের লগে গালগপ্পো জুড়ি দেয়। ওরা সিন্ধুবালারে হাই আহ্লাদে আটখানা। বুইঝতাম হাইরলাম মানুষ যারে আপন করি লয়, তারে আর সহজে ছাইড়ত চায় না। ওরা আসলে আঙ্গরে অনেক দূরের মানুষ ঠাওরায়। তবুও বাড়ির বুড়া কর্তা ছুঢি আয় কয়, ‘ খাড়াই আছেন ক্যান, আমনেদের খাতির যত্ন যে কইরব, তেমন সাধ্যি কি আমাগো আছে। এই জলচৌকিটায় বহেন।’ কোথা তুন আই ছাগলের ছানাটা আঁর আঁচল ধরি টান মারে। আঁর মাথার উপর বন বন করি এক দল চিল গোল হই ঘুইরত থায়। একটা লম্বা ধোড়া সাপ লম্বা হই রোদ ফোয়ায়। ‘ ভয় হাইয়েন না মা ঠাউরাইন, ও কামরায় না, আঙ্গরে মাঝে মাঝে চাইত আয়ে, ঘুরি ঘুরি উধাও হই যায়, ও আঙ্গরে চিনে, আমরাও ওরে চিনি।’ জীবনটা আঁর কাছে বিচিত্র লাগে। কত অভাব টানাটানি ঘরে ঘরে, ঠোঁটের কোনায় হাসি লাগিই থায়। মাইনষে মাইনষে মেশামেশিতে যে এত আনন্দ, আগে তো কনও বুঝি নি।
অভিমুন্য পাল কিয়ের লাই ইয়ানে আইছে। হেথে দুই একবার আঁর কর্তার কাছে আইছে কি কামে। তোঁগো বাড়ি কনডাই, আঁরে লই যাইবা নি। ‘সিন্ধুবালাদি তুঁই মা ঠাউরাইনরে আঙ্গ বাড়ির হথ চিনাও নি!’ হথের আর দোষ কি। কত মুই যে ছোটে। মেঘনার খাল পার হই তবে না ওই পারে পালেদের ঘরের দুয়ারে পা ফেলা। ঢেউয়ের হরে ঢেউ আই ছলাৎ ছলাৎ করে। মাঝি নৌকা বাইতে বাইতে চলি যায়। নদীর এঁটেল মাটি লই কুমোরদের কাজ কারবার। হাতে মাটি, পায়ে মাটি, গায়ে মাটি, মাটির সোঁদা গন্ধ হুরা বাড়ি। চাকা ঘোরে মেঝেতে, হাতও ঘোরে। অর্ধেক পাতিল তৈরি হয়। বাকি অর্ধেকের কাজ কুমোরদের বউরা করে। ঢিবির উপর কাদা বসাই পিটুনি দিয়ে পেটায়, গোল প্লেট হইলে পাতিল ও কলসির নিচে বসায় কায়দা করে। রোদে হুয়ায়, চুলায় হোড়ায়। মাটির হাঁড়ি সরা পাতিল মালা চরচর করি তৈরি হয় যায়। এই দৃশ্য ক্যামনে ভোলা যায়। বাঁশের ধারালো চোঁছ ছুরির মতো করি ধরি কাদা কাটি মসৃণ করে। হারা বাড়িতে হাঁড়ি কলসি হাতিল ঢুকসা সার বাঁধি হড়ি রয়। লোকে আই চাইল ডাইল সবজি দিই কিনি লই যায়। অভিমুন্য খাটে, ওর হোলা খাটে, বউ জান প্রান দিই হালায়। জাত ব্যবসা, ছাইরত হারে না। অন্য কাম করি যে খাইব হেই বিদ্যাও তো জানা নাই। হরের পিড়ির হোলারা আজকাইল কুমোরগিরি কইরত চায় না। চাষবাস দোকানদারি করে। ষ্টিলের হাড়ি গ্লাস বাজার দখল করি নিচে। মাটির খেলনা কে আর হছন্দ করে। বড় দুঃখ করি কয় অভিমুন্য আর চোয়ের জল হালায়। বাড়ি ভর্তি কাদামাটি এঁটেলমাটি চিনেমাটি জায়গায় জায়গায় হড়ি আছে। মাইয়াগুলা বাদ যায় না, মুয়ে চোয়ে হাতে পায়ে ওই হুকনা মাটির দাগ লই ঘর বাইরের কাম সারে। মাটির লগে ওরা ঘর করে, শোয়া বসা ওই মাটির গন্ধ শুঁকে শুঁকে। এই জীবনে আনন্দ আছে কিনা জানি না, তবে কিনা ষোলো আনা দুঃখ আছে। হেঢের ভাতও জোটে না। সিন্ধুবালা কি যেন খোঁজে। ঘুরে ঘুরে মরে মাইয়াটা। মাইনষের হকল দুঃখগাইন নিজের মধ্যে হজম করে। কতকাল আমরা অচ্ছুত করি রাইখছি। থুথু ছিটাইছি। হেগুনেরে আপন করি নিবার কথা একবারও তো ভাবিনি। আইজ এত কাছ তুন হেথাগো খাটাখাটনি দেই মনের ভেতরটা কেন জ্বলি পুড়ি যার। হরের কথা নিজের হই গেলে বুইঝতাম হারিয়ের কেমন দুঃখ লাগে। ওরা হাঁড়িতে ভাত চড়ায়। ভাত ভট ভট করি উথলাই হড়ে। বিক্রিবাট্টা হইলে তবে না চোয়ের কোনায় ঝিলিক মারে, খাওনের স্বপন দেইখত চায়। জুইটলে ভালা, না হইলে কোয়ালের দোষ ভাবি মাথা চাপড়ায়। ভাগ্যিস সিন্ধুবালা আঁরে মাইনষের দুঃখের লগে হরিচয় করাইবার লাই লগে লগে লই আইছে, না হয় কি এমন সুযোগ হইত। এমন করি ঘরের বার হইবার লাই কত কথা যে হুইনত হইব, বাড়ির মানুষ ক্ষেপি আগুন হই যাইব, হেই কথা আর বইলতে। হেগো আনন্দের বহরই দুঃখের বোঝারে নরম করি দেয়।
ছুতোর বাড়ি কোনদিন যে আইয়ুম ভাবি ন। জীবন কোন মুই ধায় কেউ জাইনত হারে না। মাইনষের মনের ভাবগতিক বোঝা দায়। রামচন্দ সূত্রধর আঙ্গ বাড়ি আইত, কোনদিন দেই ন। আঁর স্বামীর লগে কথা কই চলি যাইত। কী কথা হইত আঁই ক্যামনে জানুম। আম গাছের চেরাই কইরবার লাই লোক লস্কর লাগাই মাঝে মাঝে মুখ দেখাইত। হেথাগরে লই কোনো ভাবনাপাতি মনে জায়গা হায় ন। লোকে আঁরে যা কয় কক। কী আর কইব, বাড়ির বউ হাড়া চড়ি বেড়ার। হেথেরা কী করি বুইঝব এর মর্ম, হেথাগো কী দোষ আঁই নিজেও তো বুঝি নি। কত লোক আইছে গেছে, কত ঘটনা ঘইটছে, কতদিন চলি গেছে কোনদিন মনেও তো হড়েনি সেই দিনগুনের কথা। কালের মতো কাল চলি গেছে, অন মনে হয় হেই সময়টারে টানি তুলি। কত কথা মনে জাগে, মাইনষে মাইনষে কোনো মিলমিশ নাই কেন? এই প্রশ্নখান অবান্তর মনে হইলেও হইত হারে। মাইনষের ধর্ম মাইনষের কাছে, আঁই ভাবি করুম কী! তবুও আশা কইরতে দোষ তো নাই। রামচন্দ কেন্নে কেন্নে বংশ বিস্তার কইরছে, স্বপ্নেও তো ভাবি ন। খালি মনে মনে ভাইবছি দুইঢা হইসার লাই কত খাটনিই না খাটে। হারাদিন হাতুড়ি বাটালি করাত ছেনি রেঁদা ড্রিল লই হেথাগো কাজকারবার, হাত গুটাই বসি থাওনের জো আছে নি। কাঠের গুঁড়া ছড়াই রইছে কোনায় কোনায়, শিরীষ কাগজের ঘষাঘষি আর যেন থামতেই চায় না, তারপিন তেলের গন্ধে ভূত পালায়। গালা লাগায় কাঠের আলমারির গায়ে। সিন্ধুবালা হেথাগো ঘর দুয়ারে ঢুকি যায়। আঁই ভাবি ওগো মধ্যে কোনো ভাবের অভাব নাই। কে যেন আঁর হা টানি ধরি রায়। আঁই চাইলেও ওগো মনের কথা বুইঝতাম হারি না। ওরা যে ক্যামনে ডুবে আছে ঈশ্বর জানে। দুই চাইর জন লোক আইয়ে দূর গাঁ তুন। ওরা মাইয়ার বিয়ার খাট আলমারির বায়না করে। হুরা সেগুন কাঠ দিই করা চাই। ওদের বাবুর কড়া হুকুম। ওরা মাথা নীচু করি হুকুম তামিল করে। এতক্ষণ জড় হই কথা হুইনছি, হরে হরে যে যার কামে লাগি যায়। বায়নার জিনিস যেমন করি হোক, তৈরি করি দিতে হইব, এর অন্যথা হইলে বাবু মশাইয়ের গোঁসা তুন কেউই রেহাই হাইত ন। ওরা মাথা উঁচু করি না দাঁড়াইবার লাই আঁর মনটা খচখচ করি ওঠে। অপরাধের বহরটা বাড়ি যায়। হ্যাঁ আমাগো ব্যবহারই দায়ি, দূরে সরাই রাইখছি গরু ছাগলের মতো। হেই কারণেই তো আঙ্গরে আপন কইরত হারে না। সিন্ধুবালা কত সহজ করি কথা কয়, আঁই কইতাম হারি না। ভাইবলে নিজেরে দোষারোপ কইরতে ইচ্ছা করে – হেথেরা আঙ্গ কত বংশ ধরি দরজা জানালা আসবাবপত্র বানাই আইছে। হেথাগো বাড়ির সামনে বই নিজেরে একবার ঝাঁকাই লই মানুষ হইয়া জন্মাই কী লাভ হইল! এগো বাড়িতে কোনো ধানের পুঁজি নাই, খড়ের গাদা নাই, গরু নাই, ছাগল নাই। ডোবা নালা আছে, হানা হুইর আছে। হাঁসের দল প্যাঁক প্যাঁক করে। মাইনষের মুয়ে কোনো শব্দ নাই, মুখ গুজি ছেনি বাটালি চালায়। ধপাস ধপাস করি গরুর গাড়ি আই গাছের গুঁড়ি আনি গোলা ঘরের সামনে আনি হালায়। এমন দৃশ্য আগে কনও দেই ন।
ওদের ঘর দেই হরান যায়। আয়নাল হাড়ার ঘরবাড়ির রকমসকম চোয়ে লাগে না। এদিকে পানে চাই তো ওদিকের বারান্দা ঢাকা হড়ি যায়। খড়ের ছাউনি তো, গায়ে গায়ে লাগানো তাল পাতার ছাউনি, ফাটা ফাটা, বাতাসের ধাক্কায় মচমচানি শুরু হয়। পাখিদের কলকলানিতে চুপচাপ থাকা বাড়িটা চনমনে হয়ে উঢে। কোনও পুরুষ মানুষ ঘরে নাই, ক্ষেতে হালচাষ কইরত গেছে। মাইয়ারা চুলায় আঁচ দেয়। ধুলা উড়াই উঠানে ঝাঁট মারে। মোরগ মুরগী ঘুরি বেড়ায় কেমন সুন্দর। আঁরে দিবার লাই কোন কোনার তুন দুই তিনটা ডিম টুকরিতে করি লই আইয়ে। ওদের হরনে সবুজ রঙের ফুল ফুল ছাপা কাপড়। আঁচলের কাছে ছেঁড়া জায়গায় রিপু করা। হিন্দুর বাড়ির বউ হেথাগো বাড়িতে দেই চমকাই উঢে। কালেভদ্রে হা হড়ে না। কেমন করি আদর যত্ন কইরব তা লই ব্যতিব্যস্ত হই যায়। কি খাইতে দেয় এই লই নিজেদের মধ্যে শলা পরামর্শ করে। হিন্দুর বাড়ির বউ আইছে হেথাগো বাড়িতে চিন্তার অন্ত নাই। কত গাছগাছালি বাদি গাছ,আম গাছ, জাম গাছ, সুয়ারি গাছ বসত বাড়ি ঘিরে। রোদ আই ছায়াদের টপকাই কত না ছবি আঁকি রাইখছে মাটির দেয়ালে দেয়ালে। আঁর খালি ইচ্ছা হয় একটু আধটু ফাঁকফোকর খুঁজি। কেন খুঁইজতাম চাই হেই তো আমিও জানি না। মনের মধ্যে ঘুটঘুট করে। কী একটা আই যেন মিলাই গেল, আবারও আই চোয়ের পাতায় পকপক করে। একটা কিছু যা আমি দেইখতাম চাই আধাআধি দেখি, হুরোহুরি দেইখতে চাইলেও সর্বনাশ। ইয়ান তুন হিন্দুর বাড়ি দেয়ন এতই কী সোজা, যেন শত যোজন দূরে। কেন এমনটা হইল এই প্রশ্নের উত্তর হাওন এত সোজা কথা নয়। চোয়ের দৃষ্টি ঘুরাই ঘুরাই আঁই দেইখতাম চাই, হক্কলকিছু অন্ধকার লাগে। আঁর বাড়ি কনডাই বুইঝতাম হারি না। ঘর ছাইড়লেই বোঝন যায় হরের ঘরগাইন নিজের ঘরের চাইতে কত বড়, কত চওড়া। এই দুইয়ের মাঝখানে কত লতাপাতা কত খাল কত বিল, কত ঘেউ, কত মাঠঘাট, কত জঙ্গল, কত মানুষ, কত বনমানুষ, হেথাগো রোজ আওন যাওন। শঊন্যতআ আই গিলি খায় দিনরাত। মুনিয়া বানু, রশিদা বিবি, আমিনা খাতুন আঁর চারহাশে কথার হরে কথা সাজায়। আঙ্গ বাড়ির কত রাজ্যের গুনগান করে। হেগুনে আঁরে প্রশ্ন করে, ‘আমনেরা আঙ্গরে এত ঘেন্না করেন ক্যান? আমরা কি মানুষ নই?’ হেগুনের কথার কী উত্তর দিমু! উত্তর খুঁইজত যাই আঁই নিজেও কোনো কূলকিনারা হাই না। এই পৃথিবীতে অনেক প্রশ্নের উত্তর এরকম করি মাটিতে চাপা হড়ি যায়। আঁই ওগো মুয়ের তুন চোখ হিরাইতে হারিয়েন না। ওরা আমারে অনেক প্রশ্ন কইরব বলে নিজেদের গুছাইতে থায়। ওরা কত করি চায়, আঁরে হেথাগো রসুইঘরে লই যায় আঁরে ভালোমন্দ খাওয়াইব। আঁর মনের মধ্যে কত রকমের ভাবনা আই গুড়গুড় করে। যদি হাঁচাই ওরা টানি লই যায় সামলাইয়ুম কী করি! তবু এক প্রকার স্থিরই করি হালাইলাম যেমন করি হোক মনের বাধা বিপত্তি ঠেলায় হালায় ভেতরে যামুই যামু। আঁই যন হা বাড়াইলাম হেগুনে খুশিতে ডগমগ। সিন্ধুবালা আঁরে সাবধান করি দেয় – দিদি আমনের কিন্তুক জাত যাইব, একবার চিন্তা করি দেইখবেন হিন্দুর উঁচু জাতের মাইয়া হই এটা মানানসই হইব তো। হেথির কথা আঁই গেরাহ্যির মধ্যে ধরি ন। এত ভাবনাচিন্তা কইরলে চইলত ন গটগট করি ঢুকি যাইত হইব। শুধু কে যেন কইল ‘পঞ্চমী, হেথেরা গরুর মাংস খায়, মুরগি পোষে, প্রায়শ্চিত্ত কইরত হইব কিন্তু।’ দম বন্ধ করি ঢুকি গেলাম রসুইঘরে। আঙ্গ মতনই মাটির চুলা, হোড়া হোড়া হরমুল, হুকনা গাছের ডাল, হাঁড়ি পাতিলের গায়ে কালি লেপটানো, টেপ খাওয়া। দুই চারখান আরশোলা ফুরুৎ করি ছুটি চলি গেল। আঁরে একখান ছেঁড়া কাপড়ের সেলাই করা হিড়িতে বইসতে দিল। মাথার মধ্যে কি একখান পাক খাই গেল আবারও – তুই না হিন্দুর মাইয়া। বেড়ার ফাঁক দিই দেইখলাম খালের উপর দিই একখান পাল তোলা নৌকা চলি যার তর তর করি। নৌকাটা সরি গেলেই বালির স্তূপ। মাথা উঁচু কইরলে দূরে দেইখলাম আঙ্গ হাড়াখান লজ্জ্বায় ঢলি হড়ি আছে। মোসলমানদের হাড়াখান যেন উদোম গায়ে দাঁড়াই আছে। এক ঘর তুন দুই ঘর, দুই ঘর তুন তিন ঘর, এইরকম করি বারো চৌদ্দ ঘর জড়াই জড়াই আছে। আগে কোনোদিন আই না বিধায় এট্টুখানি দুঃখ হর। কতগুন হাখি উড়ি আই হেথাগো চালে বইছে, এগুনে উড়ি উড়ি আঙ্গ উঠানে চরিবরি খায়। এইভাবেই না এক দেশের মানুষ অন্য দেশে চলি যায়। ওই তো মোসলমানদের কবরখানা। হজরতের বাপরে ইয়ানেই তো কবর দিছে। আহা! কতদিন আঙ্গ জমিজমা চাষ কইরছে। মরার আগে বুয়ের হাড়গুন বার হই গেছিল, কইত, ‘ভাবি, আঁর বেশিদিন বাঁইচতাম ন। আঁর হোলামাইয়ারে হাইরলে এট্টু সাহায্যআন্তি করিয়েন।’ কইতে কইতে চোয়ের জল হড়ি যাইত। মাইয়াগুন আঙ্গরে আগাই দেয়। এই হথে কোনোদিন হায়ের ধুলা হড়ে ন, এই গাছের ছায়া কোনোদিন মাড়াই ন, এই জলের গন্ধ কোনোদিন গায়ে মাখি ন, গালে হাত দিই কোনোদিন চুমু খাই ন, এই এতগুন কেনোর উত্তর আঁরে কে দিব, আর কেন্নেই বা দিব, কেউ যে কারোগে চিনে না, জানে না, বোঝে না। আজ কিয়ের লাই আত্মীয় আত্মীয় লাগে, ছাড়ি আইতে ইচ্ছা করে না। ডানা ঝাপটাই আইত চায়, হায়ে যে বেড়ি হরাই রাইখছে কারা যেন, কবে তুন।
সিন্ধুবালারে আঁর ভাগ্যবান মনে হয়। বয়সে আঁর ছোট হইলেও জীবনটাকে কতদিন ধরি দেইখছে, কতরকম করি দেইখছে, হেথিরে দেই হিংসা হইত ন, তো কারে দেই চোখ টাটাইয়ুম। হেথি আঁরে কত কিছু চিনায়, আঙ্গুল উঁচাই চিনায়, বেগ্গাইন যে গুলি খাইছে। হেথিরে মানুষ মনে হয় না, এক লম্বা গাছ, জল দিই সার দিই কারা যে লম্বা বানাই দিছে, নিজেও জানে না ও আড়ে বহরে কতটা বাড়ি গেছে। হেথির চিনতাম চাই আঁই আছাড় খাই হড়ি যাইয়ের। আঁর কাণ্ড দেই পেট হাডাই হাসে। কোনও দুঃখ যেন ছুইত হারে না, দুঃখের ভার জমাট বাঁইধলে তাড়াই ছাড়ে। কত কথা নিজের মনে কয়। মানুষের গল্পগআইন ও রসিয়ে রসিয়ে আঁরে হুনায়। আঙ্গুল উঁচাই দেয়ায় – ওই মাঠ দেইখছেন দিদি কত কম বয়সী হোলারা মাথা ঝোঁকাই নাড়া তোলে মুঠা মুঠা করি চড়া রোদ মাথায় করি। সাতসকালে আইয়ে বিয়াল হইলে যার যার ঘরে চলি যায়। কী সোন্দর যে লাগে হেগুনের হা নাচাই নাচাই ঘর যাওন দেই। ওই নাড়া দিই চুলায় আঁচ লাগায়, রস জ্বাল দেয়, ভাত তরকারি রাঁধে, লাকড়ির খরচ বাঁচি যায়। হেইঢাতেই সুখ দুঃখের গোনা গুনতি করে। কী আনন্দ মনে, হেন্নেই কত খুশি হই লাফ ঝাপ করে। হেগুনের মা বাপের কাছে কোনো দাবি দাওয়া নাই। তুই এতগাইন খেয়াল ক্যামনে করছ? ‘এই যে মাঠের আল ধরি হাঁঢি, গাছের ছায়ার নিচে বই হরানডা জুড়াই আর হেগুনের দিকে চাই থাই।’ সিন্ধুবালা যন এই কথাগাইন কয় ওর মুয়ের হাবভাব হাল্টাই যায়, হেথি নিজের মধ্যে নিজে থায় না, অন্য মানুষ হই যায়। আঁই এককারেই চিনতাম হারি না। মাইনষের চেহারা যে এইভাবে হাল্টি যায়, ওরে না দেইখলে বুইঝতাম হাইরতাম না। মাইনষের আঁইডা খাই যারা দিনদুপুরে টই টই করে ঘোরে, তাঁগো ক্যামনে দরদ হয় অন্যের লাই বুইঝতাম হারি না। কবুতররা বাক বাকুম বাকুম করে, সিন্ধুবালা নিজেরে স্থির রাইখত হারে না, কি জানি ছানারা হড়ি ছটফট না করে। হেথি মানুষ আর হাখিরে এক করি হালাই। হিয়ের লাই কোনো ভিন্ন হথ দিই হাঁইটত হয় না। যে হথ দিই মানুষ হাঁটে, সেই পথের ধুলাই মাথায় তুলি লয়। তাই তো ওর চোয়ের আলো কত সহজেই না আঁর চোয়ে চলি আয়ে। আঁর এতকালের দেয়াটা কেমন করি নিমেষে হালটি যায়। কত প্রশ্নই তো হাঁকপাঁক করে। এই আঁই কি দেইয়ের! এই ঘর তো সেই ঘর নয়, এই বাড়ি সেই বাড়ি নয়, এই রাস্তা সেই রাস্তা নয়। হেথেনরা নিজের মতো সাজাই গওছআই রাইখছে, নিজেরা যেমন করি বাঁইচত চায়, হুইত চায়, বইসত চায়, ভালোবাইসত চায়। হেই কারনেই আঁর মনে হইতে থাকে, এত কালের ভাবনাগুলি দোমড়াই মোচরাই শেষ করি হালাই। হেথাগো আমাগো মিলাই মিশাই এক নতুন জগত তৈরি করি। সিন্ধুবালা তেমন করি চাই, আঁই কেন তেমন করি চাইতাম হারি না।
আঁই আর বাড়ি চলি আই, ঘরে ঢুকি তাই। ঘরে ঢুকি নিজের ঘরটাতে চিনতাম হারিয়েন না। বিষম খাই। আঁরে কী নতুন কোনো রোগে হাইছে? হাইলে কেন হাইছে এর উত্তর আঁরে খুঁজি বার কইরত হইব। ঘরের লগের ঘরের মধ্যে যে মনের ভাগাভাগি শুরু হইছে, ছাল ছাড়াইবার খেলা শুরু হই গেছে মনের মধ্যে এর একটা কারণ তো আছে। যদি কথার পিঠে কথা বসাই একে অন্যরে নরম সুরে ডাইকত, আঙ্গ বাড়ির চেহারাখান হাল্টি যাইত রাতারাতি। অন এমন এক অবস্থা হইছে হক্কলে যে যার ঘরমুখো হয়, কারও দিকে হিরেও তাকায় না, এক হাত জমি লই মারামারি চিল্লাচিল্লি, হাইরলে এ ওর চুল ছিঁড়ি হালায়। মনের দুঃখের কথা কারে আর কমু, এমন দিন যে আইব কোনোদিন ত ভাবিনি। চারদিকের বাঁচি থাওনের লড়াই দেই কত যে নতুন নতুন স্বপ্ন আই ঘিরি ধরে, আঁই শত চেষ্টা করিও জট ছাড়াইতাম হারি না। তবু ভাইবতাম শেষ চেষ্টা করি দেই। এর মধ্যে কত কথা উঠইছে, আঁই ছোট লোকদের দলে নাম লেখাইছি, হেথাগো রসুইঘরে বই পাত পাড়ি খাইছি, গা গলাগলি করি গালগপ্পো কইরছি, উঁচু জাতের ঘরের বউ হই সিন্ধুবালারে লই টইটই করে ঘোরা, মোটেও ঠিক কাম করি ন। যারা এত কথা কর আঁই জানিনা সিন্ধুবালারে ওরা কতজনে চিনছে। মাইনষের বাইরের চেহারা দেই ভেতরটা কি চেনা যায়! সিন্ধুবালা তো হাঁক দিই যায় ‘ধোয়াহালা কাঁচাকাঁচি করার কাপড়জামা আছেনি দিদিরা?’ হক্কলে ডাক হুনি ওর গাঁট্টির মধ্যে ছুড়ি ছুড়ি হালায়, হারিও তাকায় না, সিন্ধুবালার মুখটা কেমন, চোয়ের কোনায় কালি হইড়ছে কি হড়েনি। মনের মতো কথা বইলতে চায় কি চায় নি। আসলে হেথিরে সিঁড়িতে বইসতে দিলেও ঘরের ভেতরে আমরা ঢুকতে দিই নি। আজ আঁই ভালোমন্দ খানা বানাইছি, সিন্ধুবালারে কইলাম আইজ আঙ্গ ঘরে চাট্টি ভাত খাই যা। হেথি আর দিকে অবাক হই চাই থায় এমন করি যেন আকাশ থুন হইড়ল। আঁই বুইঝতাম হাইরলাম না কোন দিকে ঘাড় নাইড়ল। আঁই কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করি হেথিরে ঘরের ভিতরে টানি আনি বসাইলাম। কইলাম লজ্জা হাস না, হেট ভরি খান। বুইঝতে আঁর দেরি হইল না, সিন্ধুবালারে লই কানাঘুষা শুরু হই গেছে। খেজুরের রস দিই মিষ্টান্ন বানাইছি, হেথি খাই কী খুশি। আঁর দেওরদের হোলাপাইনদের লাই হেথাগো ঘরেও বাটি করি হাঢাইছি। ওমা কিছুক্ষণ হরে দেখি হেগুনে বাটিগুন ফেরত হাঢাই দিছে। সিন্ধুবালা বুইঝত হাইরছে কেন মিষ্টান্ন ফেরত আইছে। ‘দিদি, আমনেরে কইছিলাম এমন অনাসৃষ্টি কাণ্ড করিয়েন না, আমনে তো হুইনলেন না। আঙ্গ মতো নীচু জাতের ঘরের লোকেরে কে আর আমনের মতো ভালোবাইসতে চায়, শেষমেশ দেইখবেন আমনেরে না এক ঘরে দেয়। আর যদি জাইনত হারে আমনে মোসলমানদের রসুইঘরে হা রাইখছেন, বাঁধাই দিব লঙ্কাকান্ড।’ সিন্ধুবালার বোধজ্ঞান দেই আঁই তো আকাশ তুন হইড়লাম। কেন্নে হেথি আঙ্গ মনের ভাব বুঝি গেছে। আঁই মনে মনে ভাইবলাম, ধর্মের লাই মোসলমানদের আঙ্গ ঘরের চৌকাঠে জায়গা মেলে না, হিন্দুদের মধ্যেও কত ভেদভাব, কবে এগুনে মাইনষের মতো মানুষ হইব। অন যদি হেথিরা অন্য দিকে ঝুঁকি যায়, তাইলে কী মোসলমানদের দোষ দেয়া উচিত হইব !
সিন্ধুবালা কাঁদিকাঢি চোখ ভাসাইল। আঁই হেথিরে আগাই দিতে গেলাম। ‘আমনে হিরি চলি যান, বিপদ আর বাড়াইয়েন না দিদি।’ কি জানি হেথি কী ভাইবল। মনের মধ্যে নতুন কোনো ভাবনা জাইগবার সময় সুযোগ হায় না। এমন করি তুচ্ছতাচ্ছিল্য এইটাই যে রীতিনীতি, এইটাই চলনসই হাবভাব হক্কলের মনের মধ্যে গাঁথি আছে, এর তুন বার হইবার রাস্তা কারও যে জানা নাই। আঁই তাকাই তাকাই দেই হেথি চলি যার হিঢের হিছনে কাপড়ের গাঁট্টি হালাই। কোনোদিকে তেমন ভুরুক্ষেপ নাই। শ্মশান হার হই যাইবার সময় হিরি হিরি চায়। আঙ্গ বাড়ির মরা ইয়ানে হোড়ায়, হেথির দশ বছরের নাতিরে এই শশ্মানেই হোড়াইছে। আঙ্গ বাড়ির মরা মাইনষের স্মৃতির লাই মঠ বানাই রাইখছে। পঞ্চাশ একশ দেড়শ বছরের হুরান। আমরা দূর তুন মাথা ঠুকি যার যেমন মন চায়। সিন্ধুবালাদের মরার স্মৃতি রক্ষা কইরবার তেমন সুযোগ নাই। তবু কি মনে করি শ্মশানের বুকের মাঝখানে ছুটি চলি আইয়ে। আপন মনে ঠাঁ ঠাঁ রোদের মধ্যেও বিড়বিড় করে, গুনগুন করে, বুক চাপড়ায় । কী কয় ঈশ্বর জানে। জেলেরা জাল ফেইলতে ফেইলতে যায়। হাওয়ার মধ্যেও তন কত কথা ভাসি ভাসি যায়। সিন্ধুবালার সঙ্গে কথা কয় কিনা বোঝার উপায় নাই। তবু কিনা মাইনষের গলা হোনা যায়। সিন্ধুবালারেই তো ডাকে। কত তো ফিসফিসানি। জেলেরা ইশারা করি ডাইকলে নৌকায় চড়ি বয়। ঘুরি ঘুরি চলি যাইব অনেক দূর। পথের মধ্যিখানে হাঁকের মধ্যে নামাই দিলে হাঁঢি হাঁঢি যাইব এই আশায়। আউলা চুলে নৌকার গলুইতে হাখান মেলি জল ছিটায়। আঁর মনে মনে আশা জাগে যদি সিন্ধুবালার মতো হই যাইতে হাইরতাম যন যেমন খুশি যার তার লগে কথা কইতে হাইরতাম। কারা যেন আঁর হায়ে বেড়ি হরাই রাইখছে। আঁর স্বামীরে হিয়ের লাই দোষ দিই না। তবে কারে দোষ দিমু হের উত্তর আঁর জানা নাই। সিন্ধুবালা বেশ বুইঝত হারে হেথি কেন যন তন যিয়ানে খুশি যাইত হারে। কাউকে কৈফিয়ৎ দিবার কিছু নাই। আঙ্গ বাড়ির অনেকেই আঁরে বাঁকা চোয়ে দেহে। যত দোষ নন্দ ঘোষ সিন্ধুবালার বাঁকা চোখ। তবে কী হেথির আনা যানার উপর শমন জারি হইছে। তাই যদি হবে এত বড্ডা রাবণের গুষ্টির কাপড়জামার কী গতি হইব! চিন্তার বিষয়খানা বটে। শেষমেশ ঠিক হইল কাউরে দিই কাপড়জামাগাইন ধোপার বাড়ি পৌঁছাই দিবে। এতে সিন্ধুবালার এমন কী ক্ষতি হইল! হেথিরে না দেই আঁর হরানডা যে যায়। হেথির চোখ দিই যে অচ্ছুতদের ঘরবাড়ি দেই। হেগুনে বাঁচি আছে কি নেই কে আর খবর রায়, নিজেরা বহাল তবিয়তে থাকলেই হইল। দলভারি কইরবার বেলায়ই না সিন্ধুবালাদের ডাক হড়ে।
হায়ের তলায় মাঢি সরে
দ্যাশের মাইনষে কাঁদি মরে
ঢেউয়ের হরে ঢেউ আইয়ের, বেগ্গাইন ধুই মুছি লই যাইব মনে হর। এইবারের ঢেউয়ের রঙটা লালচে রংয়ের। এমনটা কেন হর বুঝি উইঠতাম হারিয়েন না। শহর তুন মোতালেব মিঞা অনেকদিন বাদে গ্ৰামে ফিরছে। চোয়ে মুয়ে এক অজানা আতঙ্ক। আঙ্গ বাড়ির দরজার সামনে আই খোঁজ খবর লর কে কেমন আছে। বড্ড দিলদরিয়া মনের মানুষ। ভালোবাইসতে যেমন জানে, গাল দিতেও ছাড়ে না। আহারে কতদিন বাদে আইছে। মোতালেব মিঞা কাঁচারি বাড়িতে আই বয়েন না। এক গ্লাস জল আর গুড় দিই চাট্টি মুড়ি খান। আগে তো কতবার আঙ্গ বাড়িতে আইতেন, এখন এতো লজ্জা হানের কিয়ের লাই। ‘না গো বইন, লজ্জা হাইয়ুম কিয়ের লাই ! আমনেদের লগে কত কালের সম্পর্ক, শহরে চাকরি করি বলি হিগাইন ভুলি যাইয়ুম এইঢা ক্যামন কথা কন দেহি।’ চারধারে শোরগোল হোনা যার। আমনের কাছে কোনো খবর আছে নি! বড় ভয় ভয় লাগে। কোন মুই তুন আগুন ছড়ায় কে কইত হারে। ‘এইডা আমনে দিদি ভুল কন ন। দ্যাশের অবস্থা অন হালটি যার। বুকের মধ্যে ধুকপুক করের হারাক্ষণ। ছাত্ররা টগবগ করি হুঢের।’ হেইডা তো আমনেরে দেই বুইঝতাম হাইরছি। মুখটা কেমন হুয়াই গেছে। আগে যন গ্ৰামে হিরতেন, মনে হইত হাঁঢেনেন না, দৌড়ানের। কত কত সুখের কথা মন খুলি কইতেন। আঁর অন কেমন বেজার মুখ। হুইনছি শেখ মুজিবুর যে আগের বছর ছয় দফা দাবি পেশ কইরছে, বেগ্গাইন ফের উথলাই উইঠছে বুঝি। ছাত্রগো এগারো দফা যোগ হইছে হের লগে। কী রে হর, এই আন্দোলন কোন দিকে যে যাইব কে জানে। মোতালেব মিঞা আমনে জানেন নি? চুপ করি থাইকলে তো হইত না। ভেতরের কথাগাইন জাইনত হইব, না হইলে দুনিয়াদারি চইলব ক্যামনে! দ্যাশটা স্বাধীন হইল কত আশা লই, মাইনষে আর না খাই মইরত ন, মন খুলি কথা কইরত হাইরব, যিয়ানে খুশি যেমনে খুশি যাইত হাইরব, গোরা সৈন্য আর গুঁতাইত ন। ওমা হুরাঢাই উল্টি ছারখার হই যার। এই আমরা কোন দ্যাশে আছি, নিজের দ্যাশ, না হরের দ্যাশ! মানুষগুনরে কথা কইত গেলে ধরি ধরি হাতকড়া হড়ার। ছালিমাটির সরকার, কোন তুন আইল, এই যে দ্যাইখছি পরাধীন দ্যাশের তুন খারাপ। মোতালেব মিঞা আঁর কথা হুনি ভুরু কুঁচকায়, কয়, ‘ দিদি এই কথাখান আমনে ষোল আনা হাঁচা কথা কইছেন।’ দ্যাশের মাইনষে আর সুখে নাই, ছিল সিংহের রাজত্বে অন আই হইড়ছে বাঘের খাঁচায়।
মোতালেব মিঞার মাথায় যে এত কথা জমা ছিল এত কথা কী আঁই জাইনতাম। দুঃখে দুঃখে হরান যায়। আরও গ্ৰামের মানুষ যারা রুটি রোজগারের আশায় আশায় শহরে ছুটি গেছিল, একে একে ঘরে হিরের। কারণটা প্রথমটায় বুইঝতাম হারি ন, হরে হরে বুইঝলাইম হুরা শহর জুড়ি কারফিউ জারি হইছে, কোনও আন্দোলন টান্দোলন চইলত ন, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের হুকুম তামিল করাই নাকি এই প্রাদেশিক সরকারের কাম। ‘পাঞ্জাবীদের ষড়যন্ত্র হুরাটা ধরা হরি গেছে, আর বোকা বানাইত হাইরত ন,বুইঝলাইম দিদি, এইবারে যা হইব সব সামনাসামনি হইব, দরকার হইড়লে রাস্তায় নামি সংগ্ৰাম কইরত হইব।’ মিঞা তুমি দেইখছি কত কিছু জানি বুঝি হালাইছ, ক্যমনে শিখলাম তুমি এইসব! ‘কী যে কন দিদি, এইসকল কথা কই আর লজ্জা দিয়েন না। যদি কিছু শিখি থাকি, তবে মাইনষের তুন শিখছি, মাইনষের চলা বলাই আঁরে সব শিখাই দিছে।’ আঁর বুইঝতে বাকি রইল না, এই দ্যাশের লোকের জীবন বড় সঙ্গীন হই আইছে, একটা বাজ ভাঙি তো হইরবই। জ্বালা ধরছে গ্ৰামের মাইনষের মনেও। আজকাইল আবার গণতান্ত্রিক সংগ্ৰামি পরিষদের লোকেরা মাইকে করি রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাইনষেরে মিটিং মিছিলে যাইবার লাই ঘোষণা করি যার। একবার না হুইনলাম দুইবার, দুইবার না হুইনলে তিনবার। শহরের নেতারা যেমন করি কয়, হেরাও তেমন করি কয়, ময়না হাখির বুলির মতো – এই সরকারের আদেশ আমরা মাইনতাম ন, মাইনতাম ন। দেশরক্ষা আর বিদেশ নীতি ছাড়া বাকি ক্ষমতা অঙ্গ-রাষ্ট্ররে দিত হইব। ছয় দফার স্বীকৃতি দিত হইব, না হইলে আন্দোলন চইলব। হেথাগো হক্কল কথার অর্থ আঁই বুঝি না। তবে আগুন যে জ্বইলব, এইটা হরিষ্কার। গ্ৰামের মাইনষে বুইঝত হারের বালিতে মুখ গুঁজি হড়ি থাইকলে আর চইলত ন। হেথেনরা আরও বুইঝত হাইরল যেমন পরাধীন হেরা ছিল আগে তেমনই আছে, শুধু জায়গাটা হাল্টি গেছে, ব্রিটিশরা আর লণ্ডন শহর যাই পাঞ্জাবীরা আর রাওয়ালপিন্ডি শহরে আইছে। কত কথা আই মাথা চাড়া দেয়, ভারত ভাগ না হইলে কি এমন সর্বনাশ হইত। এখন দ্যাশটা কোন মুই যাইব আর কারাই হাল ধরইব কিছুই তো বুঝন যায় না। হায় হায় রে বাঙালি জাতের কী দুরবস্থা! এর তুন মুক্তি ক্যামনে মিলব। এই কথাখান লই আঙ্গ ঘরে আঁর স্বামী আর মাইয়ার সঙ্গে কথা কাটাকাটি। হেথেনের কয়, ‘কিছুদিনের গন্ডোগোল, দেইখবানি সব ঠিক হই যাইব, এই দ্যাশের দাবিগাইন পশ্চিম পাকিস্তানের সরকাররে আইজ না হয় কাইল মানি লইত হইব।’ হেথেনের কথাগাইন মানতাম হাইরলাম না। আন্দোলন সংগ্ৰাম যে হতে আগার, শেখ মুজিব যেইভাবে ক্ষেপি গেছে একখান ফয়সালা করি ছাইরব। মুজিব তো কই দিছে আঙ্গরে এই পূর্ব পাকিস্তান চালাইবার অধিকার দিত হইব, আঙ্গ প্রদেশ তুন হক্কল কিছু লুটি লই যাইবা এঢা আমরা হইতাম দিতাম ন। হুঁশিয়ার খাই হেথাগো কী দশা হয় একবার দেখেনই না। আঁই মাইয়া মানুষ হইতাম হারি, কথাগাইন ভাবি দেইখবেন।
ইসকুল তুন দল বাঁধি ছাত্ররা ঘরে আইবার সময় হেগুনে নিজেদের লগে কত কথাই না বলাবলি করে। হিগাইন আঙ্গ বাড়ির হোলারা আঁরে আই কয়। হেগুনে নিজেরাও ফুসুর ফাসুর করে। কথার মধ্যে কতগাইন নতুন শব্দ উড়ি আই জুড়ি বয়। কারে যে কী কমু, এক নতুন উত্তেজনা আই আঁর মধ্যে চাপি বয়। হেগুনরে জিগাই তোরা ইগাইন কোত তুন শিখছস ? ‘ উঁচা ক্লাসের দাদারাই তো আঙ্গরে হোনাই হোনাই হক্কল কথা কয়।’ কী কয় ওরা ? ‘কয় ১৪৪ ধারা হাল্টাইত হইব, ভাষা আন্দোলনে যাগোরে জেলে ঢুকাইছে হেগোরে মুক্তি দিতে হইব, বাংলারে সরকারি ভাষা কইরত হইব, পুলিশের অত্যাচারের তদন্ত কইরত হইব আরও কত দাবির কথা কয়, জোরে জোরে কয়, গলা হাঢাই কয়।’ তোগো হড়ালেয়া বন্ধ করি বুঝি তোরা হিগাইন হোনস। ওগো কথা হুনি বুইঝলাইম দ্যাশ জুড়ি যে আগুন জ্বইলছে হের আঁচ আই হইড়ছে ইস্কুলের ছাত্রগুনের ভিতরে। কখন না এগোরে ডাকি না চলি যাই, এদের আগলাইয়ুম কী করি। বড় একখান চিন্তা আই চাপি বইছে। হেগুনরে সাবধান কইরলেও কি আঁর কথা হোনে। উল্টা কথা হওনআয় আঁরে। সব্বনাশের কথা, ‘ দ্যাশের কামের লাই ডাক দিলে যাইতানন বুঝি।’ মনে মনে ঠিক করি হালাইলাম হেগুনের বাপ মায়ের লগে ভালা করি কথা কইত হইব। ওগোরে যদি মিছিলে ডাক দিই লই চলি যায়, তন কী হইব! পাঞ্জাবীদের বিশ্বাস নাই কখন মিছিলে গুলিগালা চালাই দিব, বেঘোরে হরান যাইব। হেগুনে আঁরে সান্ত্বনা দেয় ‘এত চিন্তা করিয়েন না তো জেঠি’। এগুনেরে আঁই একসময়ে হড়াইছি, অন কত বোঝনদার হইছে। শুধু কী ওরা, অন্য গ্ৰামের হোলারাও একই সুরে কথা কয়। আঙ্গ বাড়িতে যেগুনে কামকাজের সুবাদে আইয়ে, হেগুনের কথাতেও পাঞ্জাবীদের আঙ্গ দেশ কব্জা করি রাইখবার কথা চালাচালি হয়।
আঁর স্বামী দুঃখ করি কয়, ‘ওরিও হুইনছনি দেশের অবস্থা দেই একটা কথা মনে হড়ের বারে বারে। ১৯৪৮ সালে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র কথাখান, ২১শে মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কইছিলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। সেইদিন প্রতিবাদে হাঢি হইরছিল আঙ্গ দেশের লোক। আঁর অনুমান কইরতে অসুবিধা হয়নি এর ফল ভালা হইব না, হেথাগোরে এই সিদ্ধান্তর ফল ভোগ কইরত আজ না হয় কাইল, দ্যাশের লোক এই কথাখান কিছুতেই মানি লইত ন। আইজ দেইখছনি দ্যাশের লোক কিরকম ক্ষ্যাপি গেছে। বেবাক শহরে মাইনষে রাস্তায় নামি মিছিল কইরছে, শ্লোগান দের, পাঞ্জাবীদের হুকুম মাইনতে অস্বীকার করের, বাঙালিদের লগে বৈষম্যর বিরুদ্ধে নেতারা জোটবদ্ধ হর। আঙ্গ অফিস আদালতেও আন্দোলনের আঁচ লাইগছে। মাইনষে দিশাহারা কে কোনদিকে যাইব বুঝি উঠতি হারেন না।’ স্বামীর কথাগাইন হুনি আঁর ভেতরটা গুলাই উইঠল, বমি বমি ভাব হইল, গা গুলাই উইঠল। পাঞ্জাবীদের এমন ব্যবহারে মনটা বিষাই উইঠল। ভাইবলাম এইঢা তো সহজে শেষ হইবার বিষয় নয়। এর পরিণামের কোপ আই হইড়ব আঙ্গ মতন ছাপোষা গ্ৰাম গঞ্জের মাইনষের উপর। পাঞ্জাবীরা যা বজ্জাত, ওরা তো ছাড়ি কথা কইত ন। রোজই তো হুনিয়ের ওরা একটা কড়া জবাব দিব। আঙ্গ এদিকে খবরের কাগজ আইয়ে না। কেউ কেউ মাঝে মাঝে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকা দূর তুন লই আইয়ে। আঁর স্বামীও শহর তুন আসার সময় আনে। বাড়ি ঘরের কামে হড়ার সময় করি উঠতি হারি না। একটা সুবিধা হইছে অন আঁর দ্যাশের খবর জানার আগ্ৰহ দেই একখান রেডিও কিনি আইনছে। কী আনন্দ যে হইছে, বইলতাম হাইরতাম ন। উল্টা কামও হইছে। আঙ্গ বাড়ির বউঝি হোলামাইয়ারা জড় হই উঠানে বয় আর কান খাড়া করি খবর হোনে। কত কথার অর্থ জাইনত বুইঝত চায়। দ্যাশের হালচাল হেগুনে বুঝি উইঠত হারে না। কোন দিকে যে জল গড়াচ্ছে কইত হারে না। গন্ডোগোলের ভয়ে ঠক ঠক করি কাঁপে। হেগুনে কোনোদিন ঘরের বার হয় না। বইয়ের হাতা উল্টাই দেয় নি। বিচারবুদ্ধির কোনো বালাই নেই। ঘরের কোনায় ঢুকি থায়। কেন্নে দ্যাশের হালচাল বুইঝব। আঁরে খোঁচাই খোঁচাই জাইনত চায় ‘তা হইলে কি দ্যাশটা উচ্ছন্নে যাইব? দ্যাশের জনগণের কি দশা হইব? ইসকুল কলেজ হক্কল কিছু বন্ধ হই যাইব। দিদি গো আমরা কি মাঠে মারা যাইয়ুম?’ হেগো আগ্ৰহটা বাড়ি যাইতে আঁর বেশি মুশকিল হইল। কিছুতেই কিছু বুঝাইতাম হারি না কী উত্তর হাইলে ওরা সন্তুষ্ট হইব। এইটা বুইঝতাম হারিয়ের জল যখন গড়াইছে এর একখান বিহিত হইবই। কত শত হথ আছে, কোন হথটা আসল আর কোন হথটা নকল, আঁর বাপের সাধ্য নাই বুঝার, কি বোঝানোর। একদিন হইল কি, হুরা গ্ৰামের লোক আঙ্গ উঠানে আই হাজির দল বাঁধি। ভিড়ের ধাক্কার চোটে ভাঁড়ার ঘরটাই হুড়মুড় করি ভাঙ্গি হড়ি গেল। আঁর জেঠাহৌড় তো রাগিমাগি অস্থির – হ্যাঁরে এইঢা তোরা কী করলি? উন্মাদের মতো কোনো কামই ভালা নয়। দ্যশের মাইনষে অস্থির হইছে বলি তোরাও অস্থির হবি। চাষাভুষা মানুষ তোরা, নেতারা তোদের লোম দিও হুইচত ন, হেঁটে ভাত নাই, দ্যাশ দ্যাশ করি মরের। এই দলের মধ্যে হিন্দু মোসলমান কামার কুমোর ধোপা নাপিত তাঁতি বেক জাতের মানুষই ছিল। হেগুনে রেডিও হুইনত আইছে না মুজিবের কথা হুইনত আইছে কে জানে। এই মানুষটার মনের ভিতর আছেঢা কী! হুরা দ্যাশ হ্যাথেনরে লই নাচের। তাইলে কি কালে কালে আর একটা দ্যাশ হইব।
রেডিও হুইনতে হুইনতে একটা শব্দ হক্কলের কানের কাছে আই বার বার করি ধাক্কা মারের। আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে কত মানুষ মরি গেছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ টঙ্গীতে। হক্কলে এই কথা হুনি মাথায় মাথা লাগাই ফিসফিস করে – বুইঝঝনি পুলিশ আর ইপিআর এর গুলি খাই মইরচ্ছে। দেইখছনি অবস্থাখান। হালারা মোটেই ভালা মানুষ না। দ্যাশের শত্তুর। ইগাইন আমরা জাইনতাম হাইরতাম না, রেডিওটা ছিল বলিই না এত কথা আঙ্গ গ্ৰামের ঘরে ঘরে হৌঁছি যার। আমরা ভাবিয়ের ইস্কুলের হোলামাইয়ারা হড়ালেখা হালাই কিয়ের লাই রাস্তার মোড়ে মোড়ে জড় হই হট্টগোল করের। অন তো বুঝিয়ের ওরা কয়, ‘সিলেটের মনু মিয়ারে মারছে আমরা ছাড়ি কথা কইতাম ন। দরকার হইড়লে দল দলে ঢাকার মিছিলে যামু, দেই না হালার পাঞ্জাবীরা আঙ্গ কয়জনেরে মাইরত হারে। আঙ্গ দ্যাশের মাইনষেগো অত্যাচার করা বার কইরছি, সুযোগ হাইলে বেটাগো মাজা ভাঙুম, খাবাই দিমু আঙ্গ জিনিস হাতাই লই যাওয়া।’ গ্ৰামের মাইনষে এমন করি যে ক্ষেপি যাইব, স্বপ্নেও কল্পনা করি ন। হঠাৎ করিই হাওয়ার দাপট শুরু হইল। তাইলেও ওরা এক পা-ও লড়ে না জায়গা তুন, কান পাতি হুনিই গেল। বুইঝলাইম মাইনষের মধ্যে একটা হরিবর্তন আইছে, কেউ দমাইত হাইরত ন। জীবন যে মাঝে মাঝে এইরকম করি কথা বলি উঢে তা ক্যামনে কইয়ুম। তন আর জাত ধর্ম লই এত কচকচানি মনে হইতে লাগে ফ্যাকাসে হই গেছে। এইঢা বুইঝতাম হারিয়ের দ্যাশটাই সব, দ্যাশেরে ভালোবাসইলে আর জাত ধর্ম কিছু থাকে না। কারও লাঢি উঁচাই কইবার দরকারও হয় না – এই হথ দিই হাঁঢিস না, হোঁচট খাই হড়ি যাবি, সময় থাইকতে সাবধান হ। কথাগাইন হুনি ওরা বুইঝত হারে আর বেশি দেরি নাই, সংগ্ৰামের আঁচ দুদিন বাদে আই হেথাগো ঘরের দুয়ারে আই লাইগব, দরজা জানলা বন্ধ রাইখলে আর চইলত ন। মানুষগুন এক এক করি উঢি যার, হেছনে ফিরি শব্দের আগুনে হইড়ত চায়। শুদ্ধ হইবার এমন ইচ্ছা কে আর কবে দেইখছে। হেথারা অন্য মানুষগুনরে দেই বলাবলি করি শান্তি হাইত চায়। ঘরে বউ বিবি হোলা মাইয়া আছে, এমন কথা ওগো লগে ভাগাভাগি না কইরলে কি চলে। দিন যায় আর দিন আয়ে, সময়টা ক্যামনে ক্যামনে হালটি যার, গাছগাছালি হলুদ হাখি এই বেগ্গাইনের লগে সাথ দের লুকাই লুকাই। আঁর কেমন আশ্চর্য লাগের হক্কল কিছু। নদীনালা খালবিল গরুগোতান কী মাইনষের তুন দূরে থাইকত হারে! খালি খালি মনে হয় ওরা আঁর লগেও তো কথা কয়। কয় কয়, না হইলে আঁঙ্গ ঘরের চালের উপরে দোল খায় ক্যামনে, কন না? হুরাটা মিলাই তো একটা দ্যাশ, একটা আন্দোলন।
একটা শব্দ কদ্দিন ধরি আই আঁর কানের মধ্যে বাজের। এই শব্দরা জন্মায়, দূরে যাইত চায় না, কাছ দিই ঘুরি ঘুরি মরে। শব্দের মধ্যে কী ভেলকি আছে, না বেবাক মায়া? কথাখান আমনাআমনি চলি আইয়ে। এই যে বড় আজব কাণ্ড। একদল হোলাপাইন সদর দরজার সামনে দিই মিছিল করি চলি যার, মুয়ে ওদের একটাই বুলি – বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা মাইনতাম ন, মাইনতাম ন। আইয়ুব খানের শয়তানি চইলত ন, চইলত ন। এত জোরের লগে আওয়াজ আগে কনও হুনি ন। একটা কথা বুইঝতাম হারিয়েন না কারে হেথারা বঙ্গবন্ধু কয়। এমন ভাব কইরছে যেন হরানঢাও হাইসতে হাইসতে দিই হালাইতে হারে। হক্কল কিছুর একটা মাপজোক আছে, এইঢা যেন বেবাক ছাড়ান দিই হালাইছে। রেডিওটা মাঝখানে এক কোনায় হড়ি ছিল, কেউ অত গা করে ন। আবদুল মাঝি চেঁচাইতে চেঁচাইতে আই নৌকা ভিড়াইছে হেছনের খালে। কইলাম, ‘কিয়া হইছে মাঝি?’ হানা ভর্তি খালের তুন উঠি আই আর কথা কইত হারেন না। খানিক চুপ করি থাই দম টানি কয়, ‘তেমাথার মোড়ে লোকে লোকারণ্য, ডরে আই অদ্ধেক হই গেছি, থানার দিক তুন মিছিলের উপরে হামলা কইরছে পুলিশ, লাঠিসোঁটা দিই পিঢাপিঢি শুরু করি দিছে। কোনরকমে সামলাই উঢি দেই, মাইনষে যে যেমুই হারে দৌড়ার, কারও কোনও হুঁশ নাই।’ তুমি শান্ত হই বও আবদুল, হরে বাকিটা হুনুম। বুইঝলাম যে আগুনটা টিম টিম করি জ্বইলছিল, হেইডা এখন দাউ দাউ করি জ্বলি উইঠছে, সরকার আর সামলাইতে হাইরত ন, বড় কিছু একটা তো হইবোই। হুইনলাম শেখ মুজিব নাকি পশ্চিমা শাসকদের ষড়যন্ত্র ধরি ফালাই আন্দোলনে নাইমছে বিধায় তেনারে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসাই দিছে। আবদুল কয়, ‘ ভাবি, দ্যাশের মানুষ কইতে আছে মুজিব এখন হক্কলের নেতা, বঙ্গবন্ধু উপাধি দিছে। উনি যে হথ দেয়াইব, হেই হথেই হক্কলে যাইব, হেছনে হিরে আর তাকাইত ন যতই গ্ৰেফতারি পরোয়ানা জারি করুক।’ হেথেনরা স্বায়ত্বশাসন দাবি করায় জনগন ঝাঁপাই হড়ি সাড়া দিছে। বুকের পাটা আছে, এমন করি দ্যাশের মাইনষেরে লই লড়াই করা কি মুয়ের কথা! কদ্দিন বাদে দেই আঙ্গ গ্ৰামেও পুলিশ আইছে। কোনায় কোনায় তল্লাশি চালার। এতদিন হুইনছি শহরে ধরি ধরি জেলে পোরের, এয়নতো দেই আঙ্গ ইয়ানেও ধরা শুরু করছে। এগুনের মতলব খানা তো বুঝি উইঠতাম হারিয়েন না। আঙ্গ গ্ৰামের মাইনষে তো কম যায় না, চড়কি নাচন নাচার। পুলিশও নাকানিচুবানি খার, আরে বাপ, গ্ৰামের মাইনষেরে কম বুদ্ধির মানুষ ভাবি হেথেনরা এখন ভ্যাবাচ্যাকা খাই যার। এই মামলা যে এমন করি কোনায় কোনায় ঢুকি যাইব, কেউ ত ভাইবত হারে ন। এমন হইছে বাইরে কামকাজ হালাই যুবক হোলারা গোলাঘরে, টঙের ভেতরে লুকাই রইছে, পুলিশ টোকাইও হাইত ন। হেথেনরা ভাইবছে শুধু শিক্ষিত হোলারা এই আন্দোলনে যোগ দিছে, হেইডা তো নয়, চাষবাস করি খায়, রোজের কাম করে, খেজুর গাছ কাটে, মাছ ধরি খায় হেথেরাও হেছনে আছে, এটা বুইঝত হারে ন। গরীব মাইনষের ক্ষমতা হেথেনরা টের হায় না, একবার যদি জাগি যায়,চেয়ার তুন টানি নামাই দিব। হাঁচা কথাখান এই যে দ্যাশের মাইনষে জাগি গেছে, ভালা মন্দ বুইঝত শিখি গেছে, কেউ আর বাঁধি রাইখতে হাইরত ন। পশ্চিমাদের জারিজুরি আর টিকত ন। উর্দু চাপানোর ফল হাড়ে হাড়ে টের হাইছে, তবু শিক্ষা হয় ন। এমন অস্থিরতা বাপের জম্মে দেই ন। এইটা বুঝিয়ের, হেরা চুপ করি থাকার লোক না, ঝোপ বুঝি কোপ মাইরব। আঙ্গ নেতাদের এই আন্দোলন দ্যাশের ভিতরেও কেউ কেউ ভালো চোয়ে দেয়ের না, শত্রুতামি করের। তবে এটা ঠিক হেথেরা সুবিধা কইরত হাইরত ন। হরের ধনে হোদ্দারি করন যায় না যে। হক্কল কিছুর একটা ধর্ম আছে, নিশানা ঠিক থাইকলে কারও বাপের সাধ্যি আছে নি কাবু কইরব। মুজিব কইছে পূর্ব পাকিস্তানের উপরে পশ্চিমারা মাথা মাইরত হাইরত ন। চোয়ের নিমিষে এট্টু এট্টু করি হিন্দু মুসলমান ব্যাকের চলন বলন যেন হাল্টি যার। কেউ কোনও প্রশ্ন কইরলে ফিরতি জবাব দের, আগে দেইখছি ক্যামন চুপ মারি থাইকত। মাইনষে জাগি গেলে ক্যামন হয়, আঁই টের হাইয়ের। আঁর মাইয়াও আঁর তালে তাল মিলায়। বাপ ভাইদের লগে চোপা করে। হেথির ভাবনা চিন্তার সমর্থন না করি হারি না। ক্যামন সোন্দর করি দ্যাশের হালচাল ব্যাখ্যা করে – এই মাইয়া তুই এত কথা জানলি কত্তুন। ‘ওমা নিজের দ্যাশটা কোন দিকে আগার, না ভাইবলে চইলবে ক্যান। ভাই আঁরে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ কাগজ চুপি চুপি আনি দিছে। তাইতে জাইনতে হাইরলাম শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আর ছাত্রদের এগারো দফারে লই ‘গণতান্ত্রিক সংগ্ৰাম পরিষদ’ হইছে। সব জেলায় জেলায় আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু হইছে। এই কাগজ যে আঁর কাছে আছে কারোগে কইয়েন না। এই কাগজ হড়া সরকারের নিষেধ আছে।’ সব্বনাশ, এই মাইয়া দেই ডুবাই ছাইড়ব। ও মাইয়া তোরে মনে ভয় ডর নাই, একে তো মাইয়া মানুষ, তার উপরে হিন্দুর মাইয়া, সরকারি পুলিশ কি ছাড়ি কথা কইব। আঁর কথা হুনি উল্টা হেথি চোখ টিপি টিপি হাসে।
আগুন কি এট্টু হইলেও নিভল, কি জানি। দিন যত যায়, কোন দিকে যে বেক কিছুর মোড় ঘুরি যার। কারে আর কি কইয়ুম, নিজের কাছেই উত্তর খুঁজি। ঈশ্বরের কাছে কই কনডাই গেলে এট্টু শান্তি হাইয়ুম, এক ঝড় থাইমলে আর এক ঝড় শুরু হই যায়। দ্যাশ বাঁচাইব শত্তুরের হাত তুন, না হেট বাঁচাইব, বেগ্গুনে এই চিন্তায় মরে। এই সময় গরুরা ডাকে ক্যান, হেঢে দানাপানি হড়ে ন, এই কথা জানাইত চায় বুঝি। আঙ্গ বাড়ির কয় ঘরে যাগো রোজগারপাতি নাই, এক বেলা খায় তো, আর এক বেলা হেঢে হাত দিই হড়ি থায়। হেই ঘরের হোলামাইয়ারা আঁঙ্গ ঘরে আইলে মুখ হিরাই তো থাইকতাম হারি না, এক বাডি মুড়ি দিই বইয়ায় খাইতে দিই। হেগুনের মুয়ের আনন্দ দেই আঁর মনের আনন্দ চার গুণ বাড়ি যায় – খা, হেঢ ভরি খা। হেগুনের মা মাথায় করি মাঠেঘাটে গোবর কুড়াই ঝুড়ি করি লই ধপাস করি উঠানের এক কোনায় হালায়। গরুর ঘরের বেড়ায় গুটে দেয়। ওই গুটে কিনি লই যায় আসমতির মা। হেথি আবার ঘরে ঘরে বেঁচেই দু’পয়সা রোজগার করে। মতির বাপ হুক্কা খায় জোরে জোরে আওয়াজ করি। বুয়ের মধ্যে সুরুত করি টিক্কার গন্ধটা টানি লয়। ঘন ঘন টানে। হেথেনের টানার ভঙ্গি দেই আঁর চোখ জুড়াই যায়। কেন জুড়াই যায় আঁই নিজেও জানি না। মাঠে মাঠে গরু চড়াই, নাড়া কাটি হরান হই গেলে ভর দুপুরে কাঁচারি বাড়িতে আই এট্টু ঝিমায়, ফের গরু চড়াইবার আগে সুখটান দিই লয়। হেইডা দেইতো ভাবি কত খাটনি খাডিও তো মতির বাপ কেমন করি সুখ খুঁজি লয়। আঙ্গ দ্যাশের মাইনষের তবুও দ্যাশ দ্যাশ লই এত চিন্তা। রটন্তি খুড়োর যত চিন্তা গ্ৰামের মানুষগুনরে লই। হোমিওপ্যাথির বাক্স লই বাড়ি বাড়ি ঘুরে মরে। মাইনষের চিন্তা ছাড়া তেমন হেথেনের আর কোনো চিন্তাই নেই। খালি খবর নিয়ে মরে আর গটগট করে হাঁটে এমন করি যেন দু’মিনিট দেরি হই গেলে আকাশ ভাঙি হইড়ব। মানুষটা বোধ হয় জীবনের ধম্মটা পাশ করা ডাক্তারের তুন কয়েক গুণ বেশি জানে। হাশ দিই যে কত পাল তোলা নৌকা চলে যায়, কত জেলে জাল ফালায় খালে, কত চাষি লাঙ্গল কাঁধে লই মাঠে যায়, খেয়ালই নেই। ‘এত হন্তদন্ত হয়ে কনডাই যান, কারও অবস্থা সংগিন বুঝি।’ ‘কথা কইবার সময় হাতে নাই, উত্তরটা সময় হলে দিমু, এখন আমনের পথে যান।’ হাঁঢে তো হাঁঢে, কোনো দিকে চায় না, সামনের দিকে চায়। কান পাতি হোনে, কার ঘরের তুন কান্দনের আওয়াজ আইয়ে। রটন্তি খুড়ো কথার পিঠে কথা কই হিঢে হাত বুলাই দিই সান্ত্বনা দের – সারি যাইব মা হেঢের ব্যথা। মাইনষের রোগ সারাইবার ঔষুধ আঁর কাছে আছে। দিন রাইত আঁই হড়ি থাইয়ুম তোঙ্গ ঘরে, ঘাবড়াইও না, মন শক্ত কর। মনের রোগ সারি গেলে শরীলের রোগ অর্ধেক সারি যাইব। আঁর কথার উপরে এট্টু ভরসা রাখ। রটন্তি খুড়োর কথাগাইন আঁর মনে ধরে। এই সময়টা বড্ড বেআক্কেলে সময়, এইদিক ধরি রাইখলে কী হইব, সুরুৎ করি অন্য দিকে পলায়। মাইনষের মন খাঁ খাঁ করে। গ্ৰামের হথঘাটে খালি বাতাসের গোঙানি, কেউ নাই যে হথ দেখাইব, কে দিব সুরাহা। মাইনষে ঘাটে মাঠে হোলের ধারে জড় হই পরামর্শ করে। বঙ্গবন্ধুর দফাগাইনরে লই কত ব্যাখ্যা করে। পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের হাতের পুতুল হই থাইকলে গ্ৰামগঞ্জের কী দশা হইব! চিন্তায় চিন্তায় ঘুম নাই। তবে দ্যাশটা যে ভাগ হইছে ঠিক কাজ হয়নি বুঝি, এই প্রশ্নখান মনে জাগে। মুয়ের ভাষাখান যদি চুরি করি লই যাই শুধু ধর্মের রেষারেষি করি কি দ্যাশ বাঁচইব। মুজিব তো হেই কথাখানই তো কয়, প্রদেশের অধিকার প্রদেশের মাইনষের হাতে তুলি দিত হইব, না হইলে জান কবুল, দেই না হালার পাঞ্জাবীরা কী কইরত হারে, ব্যাটাদের চোখ রাঙানি বন্ধ কইরতেই হইব, তবেই না এই দ্যাশের মাইনষেরে মাথা তুলি বাঁইচত হাইরব, না হইলে কুত্তার বাচ্চাগুন আঙ্গরে হায়ের নিচে মাড়াই চলি যাইব। এই দুঃসময়ে যে কোনো ভালা চিন্তা কইরব তার সুযোগ নাই। বাচ্চাগুলারে যে কীভাবে মানুষ করি তুইলব, ঘরদোর সাজাইগোছাই তুইলব সেই ভাবনা মরি গেছে, রাস্তাঘাটের ছিরি দেইখচস, ছাল চামড়া উঢি গেছে, হাঁইটতে গেলে হোঁচট খাই হড়ি যায়। ইস্কুলঘর পোষ্ট আফিসের কী মরণ দশা, চোখ তুলি তাকান যায় না। কারে আর কইয়ুম আঙ্গ কোয়াল মন্দ, না হয় সোনার বাংলা পূর্ব পাকিস্তান হয়, কচ না!
আর কত কইয়ুম। গালে হাত দিই বই থাই। যত দিন যায়, মন খারাপের দুনিয়ায় সাঁতার কাঢি কাঢি এপার ওপার করি। আইজ একখান খবর হাইয়ের, তো কাইল একখান। বেগ্গাইন দ্যাশের হাল হকিকত লই লড়াচড়া করে। একখান ভালা দিকও আছে, মাইনষেগো গলার স্বর তুন বার হই আইয়ের একই কথা, একই দাবি। এক বছর আগের মতো আর নাই, আরও জোরে, আরও ক্ষোভে। ভিন্ন ভিন্ন ছিল তো এদ্দিন, অন এক লগে, হিন্দু আর হিন্দু নাই, মুসলমান আর মুসলমান নাই, হক্কলে বাঙালি, বাংলায় কথা কয়, বাংলায় কাঁদে, বাংলায় হাসে, জাতে জাতে মিশি যাওনের এক শক্তপোক্ত ইচ্ছা জাপটাই ধরে। যেনারা ভিতরে ভিতরে অন্য রকম হইবার লাই ছটফট কইরছিল, তেনাগোও হালানোর হথ নাই। আঁর মাইয়ার মনে কী যে খুশি, লাফাই ঝাপাই বাড়ি মাথায় করি তোলের। ‘ মা গো মা, দৈনিক ইত্তেফাক’ কাগজ অন আর লুকাই লুকাই হড়ন লাইগত ন। সরকারের বাপের ক্ষমতা হইত না আঙ্গ দ্যাশের মাইনষেরে ধমকায় চমকায়, বুইঝঝনি।’ কেন কি হইছে, তোর এত উল্লাশ কেন রে? কাগজ একখান না হয় সপ্তাহান্তে হইড়তে হারবি, তার জন্য এত! ‘ মা, তুমি যদি বুইঝতা, এই কাগজ আঙ্গরে কন্নাই লই যার, দ্যাশের মাইনষেরে জাগাই তোলের, আরে হিয়ের লাই তো পশ্চিমা সরকার এদ্দিন ব্যান করা রাইখছে।’ তুই এত কিছু বোঝছ, আইজ যদি আঙ্গ গ্ৰামে মাইয়াদের দল তাইখত তুই মাইয়া নেতা হই যাইতি। ‘আমনে হইতেন দিতাম আঁরে!’ কেন দিতাম না, তুই মাইয়া বলে? তোরে কি এমনি হড়তাম দিছি, তোর ভাইদের লগে কাঁধে কাঁধ মিলাই লড়তি হারবি বলিই না। অন সমাজ অনুমতি দিচ্ছে না তো কী হইছে, একদিন দিব, দেই রাইচ। ‘কাগজে কী লিখছে দেয়েন, যে আইয়ুব খান বাঙালিদের উপরে রোলার চালাইছে, তার কী দশা হইছে। ভয়ে কাবু হই গেছে, কারফিউ উঠাই নিছে। হের আগের মতো আর এত ক্ষমতা নাই।’ তাহলে আঙ্গ দ্যাশের ভালা হইব ক। ‘হেইঢা তো জানি না মা, কবে ভালা হইব, মোটেই ভালা হইব কিনা, ঈশ্বর জানে।’ কথাটা যে আঁর মাইয়া ভুল কইছে, ক্যামনে কই। দ্যাশ কোন মুই যাইব, আঙ্গ দ্যাশের নেতারা কেবল কইত হারে। আরও মানুষ মাইরব কিনা, আরও মানুষ গ্ৰেফতার হইব কিনা, কদ্দুর অত্যাচার চালাইব, হেঢা তো পশ্চিমা সরকার আর হেথাগো পুলিশই কেবল কইত হারে। তবে কিনা, শেখ মুজিব যেরকম তেজ দেখাইতে আছে, সামনে তুন লড়াই চালার, ইট মাইরলে হাটকেল ছোড়ের, আর বেশিদিন ওরা সুবিধা কইরত হাইরত ন, আঁই একক্কারে কই রাইখলাম। আঁর মাইয়াও আঁর লগে ঘাড় নাড়ি সায় দেয়। আইজকাল আঁর ধ্যান ধারনার লগে মাইয়াটার চিন্তাটা ক্যামন মিলি যায়। আঁই আগাই আছি, না হেথি এক জায়গায় দাঁড়াই আছে, কে জানে।
বেদেরা সাপ ধইরবার লাই বনে বাদাড়ে ঘোরে। ঘুইরতে ঘুইরতে আঙ্গ বাড়িতে ঢুকি হড়ে। আঁই তো জম্মেও ভাবিনি এমন দিন আইব যে আঙ্গ ঘরের হাশে এমন বিষধর সাপ ঘাপটি মারি থাইকব। বাপরে বাপ জাত গোখরো। ঢোঁড়া সাপ, মাইঢ্যা সাপ ঘরের চৌহদ্দিতে ঘুরি বেড়ায়। বিষ নাই বিধায় তেমন ডরায় না কেউ। শয়তান হোলারা লেজ ধরি ঘোরায়। চড়কির মতো ঘুরি ঘুরি পাক খাই বেচারা হুমড়ি খাই হড়ে হুইরের জলে। কিন্তু এর বেলা! থর থর করি কাঁপে, দশ হাত দূর দিই হলায়। বেদে বেঢার তাই দেখি কী নাচন ঠাট্টা তামাশা। ‘অন বুইঝঝনি ক্যামন সাপের লগে ঘর কইরছিলা, ছোবল মাইরলে আর রক্ষা ছিল না, বড় বাঁচেন বাঁইচা গেলেন। আঁই আইলাম বলিই না।’ কথাটা মিথ্যা না। গর্তের মধ্যেই আঁধারে ঘাপটি মারি থায় শত্রুর বাচ্চারা। কে মিত্র আর কে শত্রু কেন্নে বুঝুম, হেরা তো সুযোগ বুঝি এক পা দু’পা করি আগাই আইছে গুটি গুটি, বোঝার কী কোনও উপায় রাখছে, আঁই ঘরে বই বই ভাবি কাইলা আঁর দিনটা কেমন করি যাইব, ওমা হুইনতে পাই হেরা নাকি একশ বছর আগে তুন ভাবি রাইখছি আঁর কাইলার দিনটায় কী করি থাবা বসাইব। দিনটায় ভাবি তো হুরা আলো, আসলে যে কত টুকরা টুকরা আঁধার আই আলোর মধ্যে ঢুকি হড়ি কেরামতি দেয়ার আঁই তো বুঝিই না, আঁর দ্যাশের মাইনষেও বোঝে না, যেমনে নাচার তেমনে নাচে, যেমনে ক’র, তেমনে হোনে। আচ্ছা কন চাই শত্রুর লগে ঘর কইরলে ক্যামন লাগে। শেখ মুজিব কী মসীহা, নাকি পূর্ব পাকিস্তানের মাইনষে মিলে হেথেনরে মসীহা বানাই দিছে। মানুষটার কথার মধ্যে কী মধু আছে, হক্কলে ঝাঁপাই হড়ি হরান দের, জেলের ঘানি টানের, ১৪৪ ধারা উডাইতে বাধ্য হর পশ্চিমা সরকার, আইয়ুব খানের গদি টলমল হই যার। মাইনষে ভাইবছিল পাকিস্তান তো হই গেছে পূর্ব আর পশ্চিম এইটাই খালি ফারাক, দোসর ভাই। এক ধর্মের দ্যাশ, ধর্মের জয় হইছে, দুধে ভাতে থাইকব। যন টের হাইল, দেরি হই গেছে, বাড়া ভাতে ছাই দিছে। হাত মিলান তো দূরের কথা, হাত দিই চুলের মুঠি ঘুরাইলে ভালা হয়। বেদে গর্ত তুন বার করি গোখরোরে যন নাচার, আঁর কথাটা আর চাপি থাইকতাম হাইরলাম না – কোথা তুন শিখলেন এই খেলা? ‘এইডা তো আঙ্গ জাত ব্যবসা, বাপের লগে থাই থাই শিখি হালাইছি। আমনে শিখতে চাইলে আমনেরে শিখাই দিমু।’ ডর লাগে না? ‘ডর লাইগব ক্যান! হইলা হইলা বরং লাইগত। যন বুইঝলাইম হেডের ভাত জুটাইতে গেলে সাপের বিষ দাঁত ভাঙি দিত হইব, বিদ্যাটা রপ্ত কইরত হইব, যেমন করি হোক, হেই তুন সাপ আঁর কথা হোনে। কেমন করি বশে আইনলাম, চোয়ের সামনেই তো দেইখলেন।’ তাইলে বঙ্গবন্ধু যা কইতে আছে সব ঠিক, আমরাও হারুম পাঞ্জাবিগুনরে তাড়াইতে, কও। ‘মা, কথা বাড়াইওনা, হেরে বিদায় কর।’ কী করস রে, কত বড় বিপদ তুন আঙ্গরে বাঁচাইছে হেথে, না হইলে কবে ঘরে ঢুকি আঙ্গরে ছোবল মারি চলি যাইত। তন তোরা আঁরে দেইখতি হাতি, না আঁই তোদের দেইখতে হাইতাম। হেথেরে এক কোটা চাইল আর চাইর আনা হয়সা দিই দে। শুধু কী সাপ ধইরল, কত দামী কথাগাইন শিখাই দিই গেল।
মনের জ্বালা কারে কইরে সই
বাস করি নিজের ভিটেয়
দ্যাশ আঁর কই
ঘুমের মধ্যেই আঁর হৌড়ি মণিবালা কাঁদি কাটি একসার। কোন দুনিয়ার কথা মনে হইড়ছে কে জানে। হেথেনের হৌড় হরকালে গেছে দিন তো কম হয় নি। পাঁচ হোলামাইয়ার মা হই গেছেন। সংসারের ভার সামলাইতে দিন যাইত। কে কার দিকে নজর দিব। দুই জা আর ওগো সন্তানাদি লই বিরাট সংসার। হুরান বাড়ির জ্ঞাতিগুষ্টি ছাড়ি আই নতুন বাড়িতে উইঠছে। চোয়ের সামনে বিশ কানি জমির উপরে বড় পুকুর কাটা হইল। হুইরের মাটি দিই বাড়ির ভিটা হইল। চাই চাই দেইখল দূর তুন। মনের মধ্যে কত চিন্তা আই বাসা বাঁধে। এই বাড়ি বই দেয়া যায় ওই মাঠটা ক্যামনে ক্যামনে বাড়ি হই যার, দুনিয়াটা এইভাবেই যেন বাড়ে কমে। হোটলা হোটলি লই এক বাড়ি তুন অন্য বাড়ি যাইবার লাই তোড়জোড়। ভেতরটা তো ভাঙি যার, কেউ কী দেয়ের নাকি। হায় হায় রে এমন ভাগাভাগি কী হরানে সয়! এই ওরে গলায় জড়াই ধরে, কত দিনের সুখ দুঃখের কথা কয়। শুইছে, বইছে, এক চুলায় রান্না কইরছে, নিজের বাড়িঘর বলি বড় গলায় হরিচয় দিছে। হক্কলে সমীহ করি বড় বাড়ির বউ বলি সম্মান দিছে। কীইবা করার আছে, সংসার বড় হইলে গায়ে গা লাগাই ক্যামনেই বা থাইকব। তবুও ভেতরটা আনচান কইরলে হুরা বাড়িটা দু’এক পাক ঘুরি আই মন জুড়ায়। এই ঘর ওই ঘরের লগে গা ঘেঁষাঘেষি করে। কত দিনের কত গন্ধ নাকে ভাসে। ইচ্ছা করে সেগুন কাঠের দরজাগাইন খুলে আর বন্ধ করে। খাটের মধ্যে দুই চাইরবার গড়াই লয়। যদি সম্ভব হইত হুরা ঘরখান উডাই নতুন বাড়িতে লই যাইত। হেথেনেরা তো আর ভোজবাজি জানে না। পাঁচ ছয় হুরুষের বাড়ি। কেন্নে কেন্নে এই বাড়ি হইছে হেইডাও তো জানে না। হেইদিন হেথাগো এইরকমই কষ্ট হইছিল। কনডাই যে হক্কলে চলি গেল। কত হুরুষ যে নিশ্চিহ্ন হই গেল, কেউ জানে না। কোনও একখান ছবিও নাই যে দেই দেই প্রণাম কইরব, খালি বাঁশের চোঙায় অস্তি হড়ি আছে সারি সারি। নতুন বাড়িতে তো হেথারা লই যাইতও দিত ন। কয়েক যুগ আগে আরও কয়েক জ্ঞাতিরা আর এক বাড়ি বানাই উঢি চলি গেছে। লতায় পাতায় হ্যাঁচাই যে আছে কারও এত তাগিদ নাই যে আঁশ ছাড়াই সম্পর্কখান খুঁজি বার কইরব। হাশ দিই চলি যায়, মুয়ের দিকে তাকায় না। অত হুরুষ বাদে অসঝ হালন করার নিয়মও নাই, এককালে যে শোক দুঃখে হেথাগো পূর্ব হুরুষরা যে চোয়ের জল হালাইত হেইঢাও অন টের হাওন যায় না। এতদিন হরে ফের আর এক পিড়ি গাঁট ছাড়ি চলি যার, তাতে কারও কোনও ভ্রূক্ষেপ আছে! সংসার বুইঝঝেননি বড় নিষ্ঠুর, হয়োজন হুরাইল তো হিছন হিরে তাকায় না। ভালোবাসি কয়জনা আর টানি ধরে, চোয়ের জল ঝরায়। এই মাটি, এই বেড়া, এই শাল গাছের খুঁটি, দেইখতে দেইখতে টিনের চাল, লোহার শিক দিই জানালা, ঘর হই যায়, কাঠের চই কোনায় কোনায়। বড় বাড়ি তুন দেয়া যায় যেন দক্ষযজ্ঞ চইলছে। মন কি চায় যাইবার লাই, কিন্তু যাইত তো হইব।
স্বপনটা ভাঙি যায় আঁর হৌড়ি হাত পা ছোড়ে। বুইঝত হারেন না কনডাই আছে, বড় বাড়িতে না নতুন বাড়িতে। এত সময় গেছে, এই ঘরটারে মনের লগে জুইড়ত হারে ন । বিছানায় হুই মনে করে বড় বাড়িতে হুই আছে। আসল কথা হইল এই ঘরের মধ্যেই যে নিজেরে বন্দী করি রাইখতে রাইখতে চৌকাঠ হর্যন্ত সীমানারে ভাবে নিজের জীবন, ভরাট জীবন। তাহাই দেখে নাতিপুতির চোখ দিই দেখে। সত্য মিথ্যা যা বোঝায়, তারে লই ভাবনা চিন্তারে চটকায়, আর খালি হুরান জীবনেরে আঁকড়াই ধরে। বড় বাড়ির বউঝিরে নাম ধরি ডাকি সুখ দুঃখের কথা কয়। এই লই নাতিরা হাসাহাসি কইরলে বাড়ির হক্কলে কয়, ‘ওনারে কইতে দে, বুইঝত হারস না মনের জ্বালাখান তো জুড়ায়, বাঁচি থাওনের রসদ তো হায়।’ কেন্নে কেন্নে হেথেনে গান্ধী বাবার কথা মনে তো রাইখছে। ওনারে যে নাথুরাম গুলি করি মাইরছে সে কথাখান বেমালুম ভুলি গেছে, ভাবে উনি অনও হাঁঢি চলি গোটা ভারত ঘুরি বেড়ায়। দ্যাশটা যে ভাগ হইছে, সেই শোধও নাই। কারোরে যে ডাকি জিগাইব, মনের সেই ইচ্ছাখানও হারাই ফেইলছে। এইরকম জীবন নিজের ইচ্ছায় কিনা জানে না কেউ, জিগাই কোনও সদুত্তর মিলে না, বেশি কথা কইলে ঝাঁঝাই ওঠে। এখনও কয় ভারত কত বড় দ্যাশ, এমন দ্যাশ বিশ্ব ভ্রমান্ডে আছে নি। নাতি নাতনিদের কাছে টানি আদর করি চুমা দেয়। কেনডে হেথেনে ভুলি যাইত হারে কার্জন সাহেব বাংলা ভাগ কইরত চাইলে মাইনষের ভিতরে নাকি আগুনের ফুলকি উঢি ছড়াই হইড়েছিল জনে জনে। হেথেনে অনও ভুইলত হারে না। গুন গুন করি গায় কবিগুরুর লেয়া গান – বাংলার মাটি, বাংলার জল/বাংলার বায়ু, বাংলার ফল/ পুণ্য হউক পুণ্য হউক/পুণ্য হউক হে ভগবান। আঁর হৌড়ি গান গাইতে গাইতে চৌয়ের পানি ঝরায়। কার্জন সাহেব নাকি লম্বা চওড়া বক্তিমা মেরে পূব বাংলার মুসলমানদের মনে বিষ ঢুকাই দিছিল – কইলকাতায় যত উন্নতি হইছে ভাগাভাগি হইলে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হইব এই বাংলায়, সুখের সাগরে ভাইসব, যা হেথেনরা এতকাল হায় ন। হের তুন হইতেই তো মুসলমানদের মনের মধ্যে বঞ্চণার বীজ পুঁতি দিই চলি গেল যা অন শক্তপোক্ত গাছ হই ডালপালা মেইলছে, দ্যাশটা ভাগও হইল আর ইংরেজদের ইচ্ছাপূরণও হইল। আসলে বাঙালি জাত এক থাইকলে ইংরেজদের অত্যাচার কইরতে অসুবিধা হইব, হেথেরা ভালা করি জানে। আঁর হড়ালেখা না জানা হৌড়ি বুইঝত হাইরল, দ্যাশের মাইনষে বুইঝল না। অন দেইখলে কেই বা বুইঝব হেই মানুষটা অন্ধকারে এক কোনায় হড়ি থাইকতে ভালোবাসে, হক্কল কিছু তুন নিজেরে আলাদা করি রাইখছে, ইচ্ছা করি, না এই হরিবর্তনটা মাইনত হারেন না, কে কইব। মাঝেমধ্যে আঁই তো খোঁচাই। রাগিমাগি যায়। এত রাগ মাইনষের লগে মাইনষের হয়। কেন্নে কেন্নে হুইনছে কত কথা। রবি ঠাকুরের ছবিখান ঝোলানো আছে আঙ্গ বড় ঘরে। সকাল হইলে এক চিলতে রোদ আই হড়ে লেপাপোছা মাঢির মেঝেতে। হেথেনরে টানি আনি চেয়ারের উপরে বসাইলে হেই রোদ ছিটকাই আই হড়ে আঁর হৌড়ির দুই পায়ের হাতায়। চোখ চলি যায় হেই হটোর দিকে, গুনগুনাই উডে, এই বুড়া বয়সেও গলার সুর আছে বেঢির – ‘ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে, মোদের ততই বাঁধা টুটবে।’ কনডাই হুইনছেন মা এই গান। ‘ মনে কি আর আছে রে মা। কত কথাই তো হুইনছি। থাই থাই মনে হড়ে।’ আসলে কি হইছে, সুযোগ হাইলেই হেথেনে সময়েরে আঁকড়াই ধরি বাঁইচত চায়। অনের জগতটারে মনের তুন অস্বীকার করে। তবু আই কি মুখ হিরায় চান না একবার, দেইখবেন ভাল লাইগব।
‘বৌ হুইনছতি বঙ্গভঙ্গ হইলে পূর্ব বঙ্গের মুসলমান চাষাভুষা মানুষ খুশিতে ডগমগ হইছিল। কেন হেথাগো মনে এত আনন্দ এর সারমর্ম বুইঝতে আঁর সময় লাইগছে। নিজের মনেরে জিগাইলাম ভাগাভাগি হইলে এত নাচানাচিই বা করে ক্যান! একই জাতের লগে মন কষাকষি করি মাইনষে কি টিকি থাইকতে হাইরবনি।’ মা আমনের বুদ্ধিখানের তারিফ না করি তো হারিয়েন না। হরাধিন দ্যাশের জ্বালাপোড়া হেই কবে তুন দ্যাশের মাইনষের শরীলে ঘা হই পুঁজ গলি গলি হড়ের। ‘সে আর বইলতে। ভাঙন যে ধরি গেছে হেই ভাব কেন্নে টের হাইলাম জানস, হুরাডা আঁরে বুঝাইছিল হজরত মিঞা। যুক্তিডা অস্বীকার করিইবা ক্যামনে, আঙ্গ গায়ে তো থুতু হড়ের। হেগুনে ভেতরে ভেতরে হুঁশের। কয় কি জানস, কইলকাতা শহরে কত কিছু হইছে, আঙ্গ হিয়ানে কি হইছে! আঙ্গ হোলামাইয়াগুনের কী দশা হইব কন চাই। মুসলমানদের উন্নতির লাই আমনেরা ক ভাবি দেইখছেন? হেই তো কত পিড়ি ধরি আমনেগো জমিতে চাষবাস করি খাই। এইভাবে আর কদ্দিন চইলব, নিজের হায়ে কোনোদিন দাঁড়াইতাম হাইরতাম ন। জিগাইলাম তুমি এত জ্ঞানের কথা কনতুন শিখছ। বইলল, জমায়েত তুন হুইনছি। হোনেনন বুঝি আঙ্গ মোসলমানদের নতুন দল হইছে মুসলিম লীগ। নেতারা আরও কত কথা কইছে। কার্জন সাহেব কইছে বাংলা ভাগ হইলে মুসলমানেরা সুখের মুখ দেইখব। বুইঝলাম মনের মধ্যে সাহেবরা ইচ্ছা করি বিষ ঢুকাই দিছে। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে শত্রুতামি লাগাই দিছে। এইবার আগুন লাইগব। কানে আইছে স্বদেশীরা বিলিতি কাপরজামা হোড়াইতে শুরু করি দিছে। হেথাগো কিছুই আর ব্যবহার না কইরবার লাই হচার করের। কইলকাতা গেছিল আঁর ভাশুর।’ আমনে তো কম যান না মা। ‘এমন কতা কইস না, যেইটুক শিখছি, বেগ্গাইন তো হুনি হুনি, না হয় কে আর আঙ্গরে শিখাইব। ভাশুর আঁর কত গপ্পই না করে, কতক বুঝি কতক বুঝি না। জগৎ সংসারে আঁই এমনিই আবোধা এই সকল কথার উত্তর কেমনে দিমু জানি না। কবিগুরু কইলকাতায় হিন্দু-মুসলমান হকলরে লই রাখিবন্ধন উচ্ছব পালন কইরছে, হক্কলে রাতে মিলমিশ করি থাইকত হারে। কত মিছিল নাকি হইছে, সভা সমাবেশ হইছে, পথ চইলতে চইলতে গানও গাইছে আঁর ভাশুরও ওই দলে যোগ দিছে, হিন্দু মুসলমান মিলি রাখি হইরছে। এমন মিলনের কথা তো কস্মিনকালেও হুনিন। কইলকাতায় কত আজব কাণ্ডই না ঘটে। কবিগুরু উপদেশ দিছে – জমিদার প্রজাদের, গ্ৰামের প্রধান গ্ৰামের লোকদের, ইস্কুলের হোলারা হেথাগো বাড়ির পাশের লোকদের এই উচ্ছবের কথা বুঝাই কইব। এইসব দেইহুনি হেথেনের তো রোমকূপ খাড়া হই গেছে, দ্যাশে হিরি জনে জনে দুগাল ভরি মনের মাধুরী মিশাই এমন করি কয়, হক্কলে হুনি তো আকাশ তুন হড়ে। হরাধিন মানুষরে আরও হরাধিন কইরবার লাই ইংরেজ সরকার কত ফন্দিই না আঁটে।’
সকালে ঘুম তুন উডি আঁর হৌড়ি কি যেন বিড়বিড় করের। ঠাউর নমষ্কার কইরত ভুলি গেছে। এইরকম বেবোলা হইতে কোনোদিন দেই ন । স্বরাজ স্বরাজ কই এক ঘোরের মধ্যে চলি গেল। শব্দটাতে যেন কত মায়া, কত না স্বপ্ন চোয়েমুয়ে খেলি বেড়ার। নিজেরে ধরি রাইখত চায় ওই সময়টাকে ঘিরে। কিন্তু হাইব কই। কারও লাই বই তো থায় না সময়, ঘটনার ধাক্কায় ধাক্কায় ঠেলি ঠেলি আঙ্গরে কন্নাই লই চলি যায়, কে কইব। আঁর হৌড়ির কি মাথা খারাপ হই গেছে, দিন দিন কেমন হাগলের মতো বকের। ‘আঁরে হাগল কচের, তোরা নিজেরাও কি কম হাগল। ঘরবাড়ি টুকরো টাকরা হইলে ভিতরটা ফালা ফালা হই যার, আর দ্যাশের মাইনষের মন ভাঙি গেলে হেইডা তো আগুনে ঘি ঢালনের মতোই দাউ দাউ করি জ্বলের।’ কথাখান আঁর হৌড়ি খারাপ কয় ন। খাঁ খাঁ করি উইঠলে এমন কথা বার হই আইয়ে। তারা ভুক্তভোগী তারাই টের হায়। ‘টের তো আঁই হাইছি রে, হকল কথার অর্থ ধইরতাম হারি ন। কেউ কইছিল ‘স্বদেশ বান্ধব’, কেউ আবার কইছিল ‘ব্রতী’, ঢাকার ‘অনুশীলন সমিতি’, কইলকাতার ‘যুগান্তর’-এর কথা তো গ্ৰামের মানুষ মুখস্ত করি হালাইছিল। আঁর ভাশুর অরবিন্দের গপ্প হুনাইল। তিনি কইতে লাইগলেন রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথা। হেই কথার মাথামুণ্ড আঁর মগজে কিছুই ঢুইকল না।’ আঁর হৌড়ি একবার কথা শুরু কইরলে আর থাইমতে চায় না। দ্যাশ দ্যাশ করিই গেল, খানাদানা সব ভুলি যায়। ওমা দেই কারও ধরন ছাড়াই চকির তুন নামি ধপাস করি মাডিতে বই হড়ে। কথার জোর যে শরীলরে চাগাই তোলে, কথার হিঠে কথার জন্ম হয়, ভুলি যাওনের ভয়ে শব্দগুনরে ছুড়ি ছুড়ি মারে। যেদিকে যেমন খুশি যাইব, তাইতে তেনার কী আসে যায়, কথাতেই তো সুখ, সময় আর ভাবের অনুভব তো আর কোনদিন হিরি আইত ন। হরের কথাটা কয় ‘ মানিকতলার বোমা, বারীন ঘোষ,কানাইলাল’। স্মৃতিতে ডুব মারে, আর কি কিছু মনে থায়। ‘গলাখান হুয়াই গেছে, এক গেলাস জল দে’। ঢক ঢক করি গিলি খায়। দেই তো আঁই অবাক। এত তৃষ্ণা লাইগছে ব্যাডির।
‘বুইঝসনি বউ, তোরা যতই কস আঁই তো ভারতেই আছি। কোনও উত্তর তো খুঁজি হাই না দ্যাশটা এক থাওনের লাই এত কেন লড়াই হইল, মারামারি, হাতাহাতি, ভাঙ্গভাঙ্গি কোনটা বাদ রইল! কেউ জুইড়বার লাই লড়াই করে, আর কেউ কয় আমরা এক থাইকতাম চাই না।’ মাইনষের মনের হদিশ ক্যামনে খুঁজি হাইয়ুম। কেউ এমুই যায় তো আর এক দল অন্য মুই ছোটে। ‘ নারে বউ কী বেজার মুখ করি আলমপুরের মাইনষে পিছপা হইছিল কী কমু! হাতির পাঁচ পা দেইখছিল ভাগাভাগির সময়, ফের জোড়া লাইগলে মন তুন মাইনত হারে ন। মুসলমানদের মনে ফুলার সাহেব বিষ ঢুকাই দিছিল। হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই এই কথা তন আর কেউ বিশ্বাস করে ন। এমন অবস্থা হইছিল এ ওর ছায়া মাড়াইত চাইত না, অন্য দিকে ঘুরি চলি যাইত। ইন্তেকাব মিঞা কইত আমাগোরে দোষ দিয়া আর কী লাভ, মুসলিম লীগ কইতে আছে, মুসলমানের লাই একটা প্রদেশ চাই, বাংলা আসাম প্রদেশ হয়োনে হক্কলের মনে খুশির জোয়ার আইছিল, এক্ষণ দেয়েন না কেমন ভ্যাদা মারি গেছে, বাজ ভাঙ্গি হইড়ছে বেগ্গুনের মাথার উপরে, ফের এক হই যাওনে মুসলমানরা বুক চাপড়ার। আঁই জিগাইলাম তোমরা কী হিন্দুদের লগে এক থাইকতে চাও না। হে কয় একবার মন চিড় ধইরছে, আঁই জানি না, কন্নাই যাই থাইমব। দিদি আমনেগো লগে তো আঙ্গ কোনো শত্রুতামি নাই, কিন্তু হিন্দু জমিদাররা আঙ্গরে মানুষ বলি জ্ঞান করেন এতকাল। দ্যাশের নেতারা যে দিকে চইলতে কইব, সেদিকেও আমরা চইলব, মৌলবী ইমামরাই তো কয় এই দ্যাশরে একদিন না একদিন মুসলিমদের দ্যাশ বানাইব। কংগ্ৰেস আঙ্গ লগে নাকি সুবিচার করে ন। ইংরেজরাও আঙ্গরে কাঁচকলা দেখাইছে, আঙ্গ মুসলমানদের লাই আলাদা প্রদেশ বানাই ফির জুড়ি দিছে, এইডা তো সরকার ঠিক করে ন। আঁই কইলাম, তাইলে আমাগো দ্যাশ কোনডা হইব? হে কয়, এই কথাখানের উত্তর আঁর কাছে নাই। ইন্তেকাব কলেরা হই মরি গেছে, গ্ৰাম কে গ্ৰাম মরি ছারখার হই গেছে, আঁইও তো যমের দুয়ারে চলি গেছিলাম, কোনপ্রকারে ঈশ্বরের কৃপায় বাঁচি গেছি। বউ তোরা বুইঝত ন কী দশায় ছিলাম আমরা, ডাক্তার বদ্যি নাই, ঔষুধ পথ্যি নাই, ঘরে ঘরে কান্দন, আঁর দেওর ননদ লই আঙ্গ বাড়ির ছজন, বড় বাড়ির পাঁচজন কাতরাই কাতরাই হরান দিল। মাইনষে বুইঝল না, খালি ধর্মের নাম করি আলাদা হইত চায়।’ ওমা তাইলে হেই সময়েই দ্যাশ ভাগের বীজ হোঁতা হই গেছিল! হরের ভাগাভাগি হুরান ভাগেরই জের। ‘কী কছ ইগাইন তুই বউ, হরে আবার কবে দ্যাশ ভাগ হইল?’ হেইডা আমনে বুইঝবেন না মা। ‘ কী বুইঝতাম ন, তুই ভালা করি ক না। আঁর তো ভালা করি মনে আছে আঁর ভাশুর দেই আইছে কইলকাতার মাইনষের রাস্তাঘাটে নাকি হক্কলের মুয়ে মুয়ে ফেরে ‘বন্দেমাতরম’, কার জানি লেয়া?’ ‘বঙ্কিমচন্দ্র লিখছে’ ‘ বরিশালে ওই গান গাইছে বলে ইংরেজের হুলিশ কী মারটাই না মাইরছে’ আমনের এতগাইন কেন্নে মনে আছে? ‘ জীবনের কত উডাহড়া, কত আর মনে আছে, ভুলি গেছি রে মা। অন যাইবার সময় হইছে, কোয়াল ভালা দ্যাশটা ভাগ হওয়ার তুন বাঁচি গেছে।’ আঁর মাইয়া মুখ খোলে, ‘কী কও ঠাম্মা?’ আরে মাইয়া চুপ কর, হেথেনরা আর স্মরণ করাইছ না, সময়টা চাপা হড়ি আছে, হড়ি থাইকতে দে। ‘ আরে তোরা মা মাইয়া কী বলাবলি করছ, আরে হুনাই ক।’
আঁর হৌড়ি তো চুপ করি থাওনের মানুষ না। কথার পর কথা উথলাই উঠে জল গরম হইলে যেমনটা হয় তেমন। জালিয়ানওয়ালাবাগের কথা উইঠলে দুঃখে শরীল হাঁডি যায়। চোখ দিই জল হড়ে আর বিলাপ করে। ‘হায় হায় রে মানুষগুনেরে গরু ছাগলের মতো মাইরছে। হেথাগো হরানে কোনো মায়াদয়া নাই। ব্রিটিশের বেডারা মাইনষের বাচ্চা না অন্য কেউ, কে জানে, পাগলা কুত্তার মতো ঘেউ ঘেউ করি কামড়ায়। প্রতিবাদ হইছিল, হিন্দু মুসলমান হক্কলেরে লই অসহযোগ আন্দোলন হুরা ভারত ছড়াই গেছিল। শেষমেশ গান্ধীর কথা মাইনষে হোনে ন, হিংসা হইছে। কেনই বা হইত ন, শয়ে শয়ে মানুষ মইরছে, সাধু সাজা কী উচিত হইব।’ সময় তো আর থামি রয় ন, নিজের মতো আগাই আইছে। কত ঘটনা দ্যাশের বুকে ঘটি গেছে, কেউ আর কইত হাইরব নি, মনের ভেতরে আটকাই রইছে, নতুন আই হুরানেরে ধাক্কাই হালাই দিছে। ‘কথাখান তুই ভুল বলস ন। দেশবন্ধু হুইনছিলাম চেষ্টা কইরছে শের-ই-বাংলারে একলগে লই। মাষ্টারদা সূর্যসেনের কথা ভুলি যাওন যায় নি। গ্ৰাম গঞ্জের মাইনষে এককারে অস্থির হই গেছে। কী অত্যাচারটাই না কইরছে। অমানুষরা ফাঁসি তো দিল, মরা মানুষটাকে বঙ্গোপসাগরের জলে ভাসাই দিছে। হেই লই কম দুঃখ তো হায় নি দ্যাশের লোক, ডুকরাই ডুকরাই কাঁইদছে। হরাধিন দ্যাশের এর তুন ভালা ক্যামনে হইব। এর হরের কথা আঁর আর স্মরণে নাই। কেউ আর কয়ও ন। কে আর কইব। কইলকাতা আর চাঁটগায় হুলিশের গুলি খাই মরি গেল আঙ্গ বাড়ির স্বদেশীরা। অন তো আঁই বুড়া হই গেছি। উপরের তুন খবর হইলে ড্যাং ড্যাং করি চলি যাইয়ুম।’ হকলটা আর কথার কথা নি। কথার মধ্যেও তো কত কথা ঘুমাই থায়। আঁর মাইয়া ফোঁপাই ফোঁপাই কাঁদে। বলি কাঁদছ ক্যান। তোর ঠাম্মা কি অনই চলি যার। বুড়া হইলে মাইনষের মনের মধ্যে মরার চিন্তা আয়ে। একপা থায় মর্তে আর এক পা থায় যমরাজের ঘরে। তন মনে হয় বেবাক গল্পের জীবনটাকে জাপটাই ধরি। আর হক্কলটা আই যদি জীবনের লগে মিশি যায় তাইলে তো কথাই নাই। দুঃখে দুঃখে হরান যায়। মায়ার বাঁধন আলগা হইবার ভয় আই সামনে যন খাড়ায়, এতকাইলের হিসাব নিকাশ বেগ্গাইন উল্টাপাল্টা হই যায়। তোর ঠাম্মা আঁরে হোনাই কিয়ের লাই জানস নি, স্মৃতিভ্রম হইবার আগে ভাবনার মালা গাঁথি রাইখত চায়। আঙ্গরে জোড়া লাগাইত চায়। বাইরের উডানে কলাবাগানে কলার ভারে কলাগাছগুন নোয়াই হইড়ছে, হেইদিগেই কোনো কথা না কই চাই থায়। মিনমিন করি কয়, ‘বউ, এই রোদের তাপ আর ভালা লাগের না, আঁরে ঘরে দিই আয়। কত ফল তো ফলাইছি, অন তো নইড়ত চইড়ত হারি না, মাজাখান বাঁকি গেছে, বেশি কথা কইতাম গেলে দম আটকাই আয়ে। বুড়া মাইনষের বেশিদিন বাঁচা উচিত ন। একখান কথা কই, আঁই মইরলে আঁর হোলারে কইচ যেন তোর হৌড়ের মঠের হাশে আঁরে হোড়ায়, আঙ্গ বাড়ির হরমুল দিই যেন মুখাগ্নি করে, গাছের কাঠ দিই জ্বালায়। আঁর চিতার আগুন আর ধোঁয়া আঙ্গ বাড়ির চাইরদিক ঘুরি ঘুরি উপরের দিকে উডি যাইব, উইড়তে উইড়তে ভগবানের হায়ের কাছে আছাড় খাই হইড়ব।’ হ্যাঁগো মা, আমনের যা মনে হায় কইতে আছেন, আমনের নাতি হুতি কথাগাইন তো হোনের, কী ভাইবব কন না। আঁর কথা হুনি হেথেনের চোখ ছলছল করি উডে। শোক সামলাইবার লাই এক গ্লাস জল চায়। কয় কত কথা, ‘আঙ্গ দ্যাশ কত বড় দ্যাশ, চৈতন্যের দ্যাশেই আঁই মরুম।’ গান ধরে –
এ পৃথিবী যেমন আছে তেমনই ঠিক রবে
সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে;
সেই নগদ তলব তাগিদপত্র নেমে আসবে যবে।।
আমার যখন মহাঘুমে বুজিবে দুই চোখ
পাড়াপড়শি প্রতিবেশী পাবে কিছু শোক;
শেষে আমি যে এই পৃথিবীর লোক
ভুলে যাবে সবে।।
এই আগুন নিভত ন, ক্যামনে নিভব। লকলক করি যে আগুন ওঠে সহজে কী বুজানো যায়। নিজের রাজত্ব কায়েম কইরব বলেই না মাইনষের পাগলামি যন ছড়াই ছিটায় যায়, কে কইত হারে, কনমুই ছুইটব। এই এক আজব দুনিয়া, চাওন পাওনের হিশাব কইষতেই দিন কাবার করে, কী হাইব, কতটা হাইব, কে জানে। খালি কয় আঁর আত্মার আত্মীয়, হেগুনেরে লই দল ভারি কইরতাম হাইরলেই দুনিয়া জয় করি হালাইয়ুম। ‘মার মার কাট কাট করি দা’র এক কোপে ধড় তুন মুণ্ড আলাদা করি দিমু। বেজাতের মাইয়া গুলারে শাদি করুম, ইজ্জত লই খেলা করুম। কী আনন্দ ! দ্যাশ তুন তাড়াই ছাড়ুম।’ কারা এই দলে নাম লেখাইছে? হেছন তুন উস্কানি দের এইসব কুকামে, আঙ্গ গ্ৰামের লোক জাইনত হারে না, বুইঝত হারে না।
আঁর হৌড়ি ইগাইন বিশ্বাসও করে না। মনের ঘরে হোকা বাসা না বাঁধাই মঙ্গল। ভাবের ঘরে চুরি না করলেই নিজের জগতে ডুব দিই থাকন যায়। কত নতুন নতুন ঘটনা আঙ্গ দ্যাশে ঘটি যার, জমিজোত ভাঙ্গি একসার হর, রাস্তাঘাট, বাড়িঘরদোর দোকানপাটের চেহারা সুরত হাল্টি যার, মাইনষের মনের ভাব হাল্টাইত ন, হেইডা আবার হয় নি! আঁর হৌড়ির চারধারে কত লম্বা লম্বা গাছ, ছায়ারা দিনে রাইতে ভাঙ্গিচুরি যায়, হোলামাইয়াগুন গোল্লাছুট, ডাংগুলি, হাডুডু খেলি বেড়ায়, ঘরে মন্দিরে শাঁখ বাজে, জেলেরা জাল হালাই হুইরে মাছ ধরে, চুলার কাছে রাঁধাবাড়ার ছ্যাঁৎ ছুঁত শব্দ, ছুটকিয়াগুন ভেটকায়, কাঁদি ভাসায়, কত আবদার করে, বৌঝিরা গালগপ্পো হাড়ে, কুত্তাগুন ঘেউ ঘেউ করি ডাকে, ধানের পালার গন্ধ, খড়ের গাদার ছড়াছড়ি, এই যেন এক মায়া, সংসারের এমন মায়ায় জড়াই শুই বসি থায় আঁর হৌড়ি। ইয়ার তুন বেশি কিছু হেথেনে জানে না, হুইনতেও চায় না। জাতপাত লই এত কানাকানি দলাদলি হানাহানি হেথেনের মাথায় যে ঢুকাইব হেই অবসর কন্নাই। দ্যাশের মাইনষে বোঝে দ্যাশ আগাইব, আঁর হৌড়িরা হিছাইব, হিগাইন ভালা না মন্দ আঁই জানি না, হেইডা বুঝি সময়ের চক্করে দরজা জানালাগাইন বন্ধ রাইখলে খারাপ না, বিষাক্ত ধোঁয়া ঘরে ঢুইকত হারে না, তন মন দুইডাই ভালা থায়, যেমন আঁর হৌড়ির ভালা আছে। আঁর হৌড়িদের জগৎ অন্ধকার, আঙ্গ জগতে আলো, হত্যেক দিন ভালামন্দ খবর যায় আর আইয়ের, কারা বানার খবর, কারা আঙ্গরে হোনাই আহ্লাদে আটখানা হয়, বুঝি না। তবে এইডা বুঝি ওরা খবর বেচে, কারও হয় লাভ, কারও হয় লোকসান, আঙ্গ দ্যাশখান দখল করার লাই হেথাগো কারসাজির অন্ত নাই। আইজকাল আবার এক নতুন চিন্তা আই কুঁরি কুঁরি খার, দ্যাশের মাইনষে আঙ্গরে নিজের মানুষ ভাবে তো? বড় শক্ত প্রশ্ন, কিন্তু হাঁচা উত্তর দিবার মতো কোনো লোক নাই। আঁই হিন্দুর ঘরের বউ, বাজার যাওন মানা। কিন্তু লবন তেল মশলা ছাড়া আর কদ্দিন চইলব, ঘরে তো কোনো হুরুষ মানুষ নাই। হৌড়ি সাবধান করে ‘পঞ্চমী তুই বাজারের দিকে হা বাড়াস না, দুই দিন বাদে আঁর হোলা শহর তুন আইলে কেনাকাটি করি দিব, না হয় তদ্দিন আতেলাই রাঁধ।’ এইটা কি একখান কথার কথা হইল, মা। মাইয়াডার মুয়ে ক্যামনে আলুনী খানা তুলি দিমু কন চাই। গ্ৰামের হাটে বাজারে হিন্দুর ঘরের বউরে ঘোমটা মাথায় দেই মুরুব্বীগোছের কেউ ট্যারা চোয়ে চায়। দুই-চারখান হিন্দুর দোকান ছিল, হেথেনরাও টোনটিটকারী মাইরতে ছাড়ে না। কেউ কেউ কয়, ‘এই আবার ক্যামন বেশরমের বেআক্কেলে কাণ্ড। মাইয়া মাইনষে হাট বাজার কইরত আইব।’ রাজিয়ার বাপ দেই আঁরে চিনি হালাইছে – ‘দিদি, আমনে তো আঁরেও কইতে হাইরতেন, আঁই তো কামে কাজে আমনেগো বাড়ি যাই।’ নিজের হআতরত থাইখতে তোমারে বিরক্ত কইরতাম কিয়ের লাই। ‘এইডা একখান কথার কথা হইল দিদি।’ রাজিয়ার বাপই শেষে কিনিকাডি দিল। মনে মনে ভাইবলাম দ্যাশ নয় একদিন পশ্চিমাদের কাছে তুন স্বাধীন হইব, কিন্তু মাইয়ামানুষ কবে হুরুষ মানুষ তুন স্বাধীন হইব।
আঁর হৌড়ির মনডা কদ্দিন ধরি খারাপ। খালি দোম মারি আছে। কথা কইলে উত্তর দেয় না, ঝাঁঝাঁই উডে। জিগাইলে কয় ‘তোরা আঁর দুঃখের কী বুঝবি?’ কত কারনেই হেথেনের দুঃখ হয়। দুঃখের বোঝা ভার হই গেলে আর নিজে নিজে সইতে হারে না। তন নিজের শরীরটাকে ঝাঁকাই উডি বসি হড়ে চকি তুন লম্বা টুলের উপরে। হালকা হইত চায়। শরীল হালকা হইতে চাইলেও মন কি হালকা হইত হারে। তন তো হাঁউমাউ করি কাঁদে। এই কাঁদা কোন ঘটনার লাই কে জানে। হেথেনে নিজেও কি জানে? কি জানি কোনোও সুখের ঘটনার জের আর শোকের মুহূর্তের লগে একসাথ হই এমন একটা ভাব আই হাজির হইছে কিনা, নিজে ছুঁইতেও হারেন না, ধইরতেও হারেন না, হিয়ের লাই তো এত যন্তন্না, কইতেও হারেন না, বুঝাইতেও হারেন না। হাগলের মতো লেংচাই লেংচাই হাঁডে এমাথার তুন ওমাথা। স্মৃতির ভাঁজ খুলি খুলি চায়। বইলত চায়, বইলত হারেন না। জিভ জড়াই যায়। সনটা ছিল নাকি আঁর প্রথম হোলা জন্মানোর বছর। হেই বছর কালা জ্বর যে ঘরে ঘরে আই বংশ উজাড় করি দিব, কনও কেউ ভাইবত হারে ন। হক্কলে কইতে শুরু কইরল, ভগবানের মার, মাইনষের ক্ষমতা কন্নাই যে রুইখব। চিতা জ্বলের। একখান লাশ হোড়ার তো আর একখান কাঁধে করি নামার হরিবোল হরিবোল করি। ঘর তুন এক হোলার মরা লই চলি যার তো নতুন অতিথির আঁতুড়ঘর তুন ওঁয়া ওঁয়া কাঁদনের শব্দ হোনা যার। এমন এক অচেনা অজানা সময় আই ঘিরি ধরে। হৌড়ি ঘর বার করে। এই ভাবের কি নাম দন যায় নিজেও বুঝি উইঠত হারে না। এইরকম ঘটনার ধাক্কা সামলাইতে সামলাইতে দিন কাবার রাত কাবার মাস কাবার বছর কাবার হয়। বুড়া হই গেছে না, কত কথা গুছাই গাছায় কইত চায়, চোয়ের জল হড়ে, মুখ খোলে না, এমনি বিধির বিচার। ছিল তো হক্কল কথা পাট পাট করি সাজানো কিন্তু গেল কন্নাই! কালের হেডে ঢুকি গেছে। ইগাইন কত ওজনের ছিল অন বেবাক ঘটনাই হাতলা হই গেছে। হেথেনের মাথায় হালকা চুলের মাঝখানে দু’একখান কাঁচা চুল উঁকিঝুঁকি মারে। অভ্যাসের বশে ডান হাত বাঁ হাত মোচড়াই খোঁপা বাঁধে। ওই সময় আঁর মাইয়া আই ইনাই বিনাই ভুলাই দিত চায় – ‘ যা গেছে, গেছে, হুরান কথা লই চটকাচটকি করি লাভ আছে নি আর, হামনের দিকে তাকান।’ ‘তাকাইতাম তো হারি না, হুরা অন্ধকার লাগে, কারা যেন গর্ত খুঁড়ি রাইখছে, আঁই চইলতে গেলে যে উষ্ট্রা খাই হড়ি যাই।’ হেথেনে আবারও গুনগুন করে, টানি টানি সুর বার করি আনে। আহা কী মধুর লাগে, কারা যেন শাঁখ বাজায়, কারা যেন আজান দেয়, এট্টু এট্টু করি জীবনের মানেখান গোল গোল হই ঘুইরতে লাগে, কী হুইনছি আর কী না হুইনছি, মাঝখানে মাঝখানে এমন ভাবের উদয় হয়, বুঝি উইঠতাম হারি না আকাশে বাতাসে কী সুর ভাসি বেড়ায়, সুযোগ হাইলেই আঁরে আই জাপটাই ধইরত চায়। কনডাই যে চলি যাই, জগৎ মিথ্যা না জগৎ সত্য এই কথার উত্তর দিবার লাই মানুষ খুঁজি হাই না। আঁর হৌড়ি নিজের ঘরে হিরি হিরি চলি যাইত চায়। যাইত কী হারে, যাইবার ভান করে। ভানের মধ্যিখানে মাটিরে ছুঁই দেইখবার কান্দনঃ
মাটির মানুষ মাটি হবে মাটি আসল ঠিকানা
এই পৃথিবী মায়ার বন্ধন ক্ষণিক সুখের নিশানা ।।
আপনজনা আছে মত তারাই তাদের মনের মতো
সুখের সাথি দুঃখে সাড়া দিতে কেহ চাহে না
নিজে নিজে বুঝতে পারবে বুঝাইতে পারবে না ।।
কথার আগুন মন হোড়াইল
তবু হতের দেখা মিলল নারে
কথাডা গলার মধ্যে কাঁডার মতো আটকি আছে। কোনোদিন তাইলে হিন্দু মুসলমান মিলত হাইরত ন! দেয়ালটা এমন শক্তপোক্ত, কার এমন সাহস যে ভাইঙব। বুয়ের পাডা শক্ত করি মিলাইতে যে আইব, হেথের কল্লা তো কাডা যাইবই যাইব, এক ঘরে হইত ন, এই কথাখান লই কোনো সন্দেহ আছে নি। আশায় মরে চাষা, আঁরও তেমন একখান ইচ্ছা আই মনের মধ্যে বাসা বাঁইধছে। কবে তুন চোয়ে পট্টি হরি রইছে, মুয়ে কুলুপ আঁডি রাইখছে, এর একখান উত্তর খুঁজি বার করতই হইব। দায়খানা কার – হিন্দুদের না মুসলমানদের, নাকি বেগ্গুনের? সময়ই একদিন না একদিন এর জবাব দিব। সময়ের হাত ধরি এই মাডিতেই এমন কামড়াকামড়ির জন্ম হইছে। মাডি খুঁইড়ত হইব, হাড্ডি মিলব। কোন সালের হাড্ডি, জইমতে জইমতে মাডির রঙই হাল্টি গেছে। চেনা দায়। ছেচল্লিশ হইত হারে, সাতচল্লিশ হইত হারে, পঞ্চাশ হইত হারে, কোনানের জল কন্নাই যাই গড়াই হইড়ছে কে কইব। কার রক্ত কার গায়ে মিশছে, হেইডাই বা কে জানে। কারও দাড়ি আছে, কারও দাড়ি নাই, কারও টুপি আছে, কারও টুপি নাই, কারও কাছে মূর্তি আছে, কারও কাছে মূর্তি নাই, কোন মুই গেলে ভালা থাইকব, অন বলার সময় আইছে নি। হরিক্ষা তো আমরা হক্কলে মিলি দিছি, কজন হাশ কইরছে, গুনি দেইখত হইব, কজন ফেইল কইরছে, গুনি শেষ কইরত হাইরত ন। কিন্তু ভাবি তো একবার দেইখত হইব, ফলটা কী ফইলছে, কয় কদম আগাইছি, কয় কদম পিছাইছি। খালি হিন্দু হিন্দু করি হিট চাপড়াইলে হইব, মুসলমান মুসলমান করি জোট বাঁইধলে হইব। জোট যদি বাঁইধতেই হয় নারী হুরুষের গিঁট বাঁইধত হইব, জনও বাঁইচব, মানও বাঁইচব। এই কথাগাইনের জন্ম ক্যামনে হইল, হেইডাও তো দেইখতে হইব। তবে কিনা আঁর নজরে অন্য এক শক্তি আই হাজির হইছে। শক্তি ছাড়া কীই বা কইতাম, বিরাট শক্তি, ক্যামনে ক্যামনে যে আই গেল! আমরা ভাবি এক, হয় আর এক। আমরা ভাবি কেউ দেইখছে না, কিন্তু দেইখছে, আড়াল তুন দেইখছেে – শত্রুও হইত হারে, মিত্রও হইত হারে।
রসময়রে কইলাম, মাষ্টার,উত্তরটা দাও দেখিনি। শুনে তো থ। কইল, এমন একটা প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেন কী এত সোজা জেঠিমা। দুনিয়া শুদ্ধ মানুষ ভাবি ভাবি কোনো কূলকিনারা হার না, আঁই কোন ছাড়। তবে এইডা ঠিক, শত্রুরাও ভুল করি এমন একখান অস্ত্র তুলি দেয়, বুইঝতে হারে না অস্ত্রখান কত ধারালো অস্ত্র। তবে তুমি কইতে আছ আঁর মনের গতি ঠিক হথেই আগাই যার। রসময় ঘাড় নাড়ায়। শত্রুর চেহারা কেমন করি হালটি গেছে। সাহেবদের লগে লইড়বার লাই তারা এক দ্যাশ এক দ্যাশ করি হরান দিছে, হেথেরা আজ হরান লইবার লাই উঠি হড়ি লাইগছে, ধরি ধরি জলজ্যান্ত হোলাগুনেরে গরাদের ভেতরে লুকাই দের। এর কোনও জবাব আছে নি কারও কাছে! কন যে কী হল কে কইব। চোয়ের নিমেষে বেগ্গাইন দেইখতে দেইখতে কেমন হাল্টি যায়, ছাপোষা মাইনষের কী এমন ক্ষমতা বুইঝত হারে। হা করি খালি চাই থাই, বুঝি না-বুঝি ফাঁসি কাঠে গলা দেয়। ভাবে এই পথে দ্যাশের মুক্তি, দশের মুক্তি। দ্যাশ কারে কয়, দশ কারে কয় হেইডা ক্যামনে জানব। হরের চোখ দিই চাইলে কী হক্কলটা বোঝন যায়। নিজের চোখ আর মন দিই বুইঝলেই হুরাডা না হইলেও কোন হথে হাঁইটত হইব টের হাওন যায়। আঙ্গ গ্ৰামের মাইনষে চালাক চতুর না হইলেও সাদাসিধে, যেমন বোঝায়, তেমন বোঝে। আইজকাল মাঝে মাঝে হুইনতাম হাই ভিন গ্ৰামের মানুষ আই আঙ্গ গ্ৰামের হথেঘাটে ঘোরে আর মাইনষের কানে কুমন্তর দেয়। লাভ লোকসান বুঝি না তবে আগাম আঁচ কইরতাম হারিয়ের বিপদ একখান ঘাড়ের উপরে আই আছড়াই হড়ার উপক্রম হর। কী যে কমু, কারে কমু, নিজের মনরে সুধাই আঁই জিগাইন অনুমান কইরতে আছি, হেডাই যদি ঠিক হয়, তবে তো আর রক্ষা নাই। হজরতের বাপ সকাল না হইতেই আম বাগানের এক কোনায় নাড়া জ্বালাই আগুন হোয়ায়। শীতও হড়ছে, কনকনে ঠান্ডায় ঠকঠক করি কাঁপে। আগুনের তাপ শরীলেরে গরম কইরলেও কী কারণে জানে মনটা উসখুস করে। মাঠ ভরা ধান হইছে, গোছা গোছা করি ধান কাডি মাঠের এমাথা তুন ওমাথা বিছাই রাইখছে। সবে এক গাঁইট মাথায় করি আনি ধানের মড়াইয়ের হাশে ধপাস করি হালাইছে। হারাদিনে মাঠ খালি কইরত হইব, মাঝখানে শরীল গরম করি দম নেওয়া। ধান ঝাড়াইবাছাই করি হাসিনা এক প্রস্ত উঠান ঝাঁট দেয়। মাড়াই দিত হইব তো। গোয়ালঘরে শ্যামা খামারে দাবনা দিছে, না হইলে বিয়াল তুন খাইটব ক্যামনে। হাসিনা জানে জিয়াদ আলি, হজরতের বাপ, মনসুররা হুক্কাতে এই সময় সুখটান দেয়। হাসিনা টিক্কাতে আগুন জ্বালাই হুক্কাটা হাতে দিলে হেগুনে গড়গড় শব্দ করি একজন টান মারি আর একজনেরে দেয়। ওরা হুক্কা টান দেওয়া হইলে মাঠের দিকে ছোটে। হজরতের বাপ বয়সের ভারে এট্টু ধীরেসুস্থে যায়। কইলাম, কি হজরতের বাপ শরীল নড়তে চায় না বুঝি। শরীরের আর কী দোষ, বয়সটা তো দিনে দিনে বাড়তেছে বই কমতেছে না। ‘তা দিদি আমনে ঠিক কথাই কইছেন। গোয়ালের গরুগুনের মতোই আমরা রাতদিন হরের কথায় উঠবস করি। কারা আঙ্গ গলায় ঘন্টা বাঁধি রাইখছে। আঙ্গ হোলামাইয়াগুনরে হেট ভরি খাইত দিতাম হারি না। কে আর আঙ্গ কথা ভাবে। বদইলা খাডি যা মজুরি হাই দুইজনের মাইনষেরই চলে না, পাঁচ জনের মুয়ে ভাত তুলি দিমু ক্যামনে।’ বড় খারাপ সময় এখন। চারধারে কান হাতলেই শুধু হাহাকার আর হাহাকার। এ ওর কান ভাঙার। ইগাইন হাঁচা কতা নি কন চাই। তোঙ্গ গ্ৰামের মাইনষেরে কারা আই আঙ্গ হিছনে লাগাই দের। ওরা নাকি আঙ্গ বাড়িঘর দখল করি আঙ্গরে উৎখাত করি ছাইড়ব। ঠিক হুনিয়ের নি? হেথে কয়, ‘দিদি ভুল হোনেন ন। চক্রান্ত একখান চইলছে। মুসলিম লীগের মেম্বাররা গোলমাল পাকার। নানা কতা বোঝার। কইতে আছে হিন্দুরা এতদিন আঙ্গরে শোষণ কইরছে, আঙ্গরে উঠতে দে ন। বদলা নিবার সময় আইছে। হেথাগরে বোঝাইতে হইব, আমরাও কোনও অংশে কম ন। এইটা প্রমাণ কইরত হইলে হিন্দুদের দ্যাশ তুন তাড়াইত হইব, একটা মুসলমানের দেশ বানাইতে হইব।’ ওমা হেই কথাগাইন তো বঙ্গবন্ধুর কথার লগে মিল খার না। হেথেনে কইতে আছে পশ্চিম পাকিস্তানিরা আঙ্গ শত্রু, এরা কয় হিন্দুরা আঙ্গ শত্রু, তাইলে কার কথা ঠিক ধরুম। তাইলে কি আঙ্গরে লোটা কম্বল লই দ্যাশ ছাইড়ত হইব। তোমরা বুয়ে হাত দিই কও না, এই দ্যাশ আঙ্গ দ্যাশ নয়? তবে আমরা কোয়ান তুন আইলাম? ‘হেইডা কইতে হাইরতাম ন। তবে যা বুইঝছি, আমনেদের আর বেশিদিন থাইকত দিত ন। মন খারাপ করিয়েন না। আমরা আছি ত। এতকাল আমনেগো নুন খাইছি, সুখে দুঃখে আঙ্গ হাশে ছিলেন কত হুরুষ ধরি, আমনেগো মাইরতে আইলে আমরা হেগুনরে ছাড়ি দিমু নি, আমনেগো গায়ে হাত লাগানোর আগে আঙ্গ বুয়ের উপর দিই মাড়াই যাইত হইব।’
মাইয়ার আঁর কদ্দিন ধরি হেডের গোলমাল হইছে। আদামনি বাডি খাওয়াইলাম। কিঞ্চিৎ উপশম হইলেও সোয়াস্তি হয়নি। সেই মনোরঞ্জন কবিরাজেরে ডাক কইরতে হইল। মাইয়ার হেডের গুড়গুড়ানি থাইমলই না। অবস্থা বেগতিক দেই কবিরাজ মশাই শহরে বড় ডাক্তার দেয়ানের হরামর্শ দিল। কতাটা কওন যত সোজা, করন তত সোজা ন। চারহাশে মিছিল হরতালের বান ডাকি উইঠছে। মানুষ রাগে হোঁসের। এমতাবস্থায় মাইয়ারে নৌকায় চাপাই হেথির বাপ সহ শহরের হতে রওনা দেওন ছাড়া অন্য উপায় কি। চিন্তায় তো আঁই দুই চোয়ের হাতা এক কইরতাম হারিয়েন না। কচি মাইয়ারে লই শহরে হোঁচাইতে হাইরলে হয়। মাঝি তো নৌকা বায়, আর একজন গুণ টানে। খালে ভরপুর জল, নদীতে জোয়ার আইছে বিধায় ঢেউয়ের দপদপানি। ছইয়ের নিচে ঠাণ্ডা কি আর মালকাড়ায়। মাইয়ারে কোনোরকমে জাপটাই ধইরলাইম। মাইয়া তো হেডের যন্তনায় থাকি থাকি লাফাই ওডে। কিছুদূর যাওয়ার হরে আঙ্গ বাড়ির সদর দরজার কাছে শ্মশানের মঠ চোয়ের আড়াল হই গেছে। নৌকাটা তো ভাইসতে ভাইসতে দেড় মাইল খানেক হার হনের হর সুলতানপুরের কবরখানা। রসুল মিঞার ইন্তেকাল হইলে গত হরশুই কবর দিছে। আঁর স্বামীর লগে ভালা সম্পর্ক ছিল। জমিজমা লই গোলমাল লাইগলে হরামর্শের লাই হেথেনের কাছে শনিবার শনিবার করি আইত। মানুষটার হরের জন্য ছিল মেলা দরদ। হেথেনরে দাদা দাদা কইত, মানুষটার হঠাৎ করি চলি যাওনে হেথেনে বড় কষ্ট হাইছে। আঁর এট্টু ভয়ও হইতেছে। মনে মনে ইষ্টনাম জপ কইরতে শুরু কইরলাম। এমনিতে মাইয়া মাইনষের শত রকমের ভয়, আর যদি কবরখানার হাশ দিই ঘেঁষি নৌকা চলি যায়, এবার আঁরই থরথর করি কাঁপুনি শুরু হই গেল। আঁর স্বামী মাথায় হাত রাই সান্ত্বনা দিই কয়, ‘মাইয়ার কথা ভাব, মাইয়ার মাথায় হাত বুলাও, দেইখবা ভয়ডর কন্নাই চলি যাইব।’ ওমা দেই ছলাৎ ছলাৎ করি গলুইয়ে জল ওডে। দু-একখান হুডি মাছ আর কাঁচকি মাছ তিড়িং বিড়িং করি লাফাই ছইয়ের উপরে হড়ে। চাইর মুই হাড়ের দৃশ্য কি দেইয়ুম, মাইয়ার দিকে মন হড়ি রইছে। থাই থাই মাইয়া আঁর কইতে লাগে, ‘হেডের মধ্যে যন্তন্না হর’ গরম তেল লই আইছি বাড়ি তুন বার হইবার সময় শিশি ভর্তি করি। চাইর পাঁচ হোডা নাভির মধ্যে মালিশ করনে মাইয়া এট্টু শান্ত হইল। একজন দাঁড় বায়, আর একজন গুন টানে। মেঘ গজরার আকাশ যেন হাঁডি হড়ের। বাতাস যেন পাগল হই উইঠছে। আঁর স্বামী কয় মাঝি অন কি উপায় হইব। তুঁই এক কাম কর হাড়ে নৌকা ভিড়াও, নৌকা তো দোলের। আঁর মাইয়ার কী দশা হইব। কেন্নে শহরে হোঁচাইয়ুম কন চাই।’ ‘বাবু, আমনে চিন্তা করিয়েন না, আঁর উপরে ভরসা রাখেন। আল্লার ওয়াস্তে ঠিক হৌঁচাই দিমু আমনেগরে। খোদাত আল্লাহ ঠিক রহম কইরব।’ আঁই আঁর মাইয়ারে চাইদর দিই মোড়াই জড়াই ধরি রাইখলাম। খালের জল যত বাড়ে, চিন্তা আঁর তত বাড়ে। খালের দুই হাড়ের জমির ধানের ছড়া জলের দামালপনায় অস্থির হইলে সোজা হই থাওনের চেষ্টা করিও নেতাই হড়ে। মড়মড় করি গাছ ভাঙি হড়ের, ডরে গায়ের লোম খাড়া হই যার, বুকের ধুকপুকানি গরু ছোটার মতো ছোটে। এর হড়ে আঙ্গ কী গতি হইব দম বন্ধ করি হড়ি রইলাম। ভগবান মুখ তুলি চাইল। ঘাটে আই নৌকা ভিড়াইলে দেইখলাম শহরের ঘরবাড়িখাইন মাথা তুলি খাড়াই আছে।
আঁর স্বামী কয় ‘সাবধানে হত চল।’ দলে দলে নানা মুই তুন লোকজন আই ভিড় কইরছে। হিন্দুর বাড়ির বউ মাইয়া দেই দোকানঘর তুন দুই চাইরজন বাঁকা চোয়ে চায়। কী জানি নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করি কথা কয়। মনের মধ্যে সন্দেহ একখান দানা বাঁধে। রাস্তাঘাটে দিন দুপুরে কত কিছুই না ঘটে। কার মনে কী আছে ক্যামনে কওন যায়। এ ওর কানে ফুসমন্তর দেয়। কদ্দুর যাই থাইমলাম। শেষমেশ বুকের বল আনি কয় পা আগাই গেলাম। যা হইবার তা হইব, ভয়ে হিছপা হইলে চইলব নি। মাইয়ারে ডাক্তারের কাছে লই যাইতেই হইব, না হইলে হেথিরে যে বাঁচান যাইত ন। ওমা এ কী! উল্টা দিক তুন দুই তিন জন যুবক হোলা দৌড়ি যাইতে যাইতে সাবধান করি গেল। হেগুনের হিছনে হিছনে আরও ক’জন মোড়ের দিকে তুন ডান দিকে চলি গেল। বুইঝতাম হাইরলাম, বড় একখান কিছু ঘটি গেছে। পিডাপিডি শুরু হই গেছে দূরে কন্নাই। কে কারে পিডার, খবর কেউ আর দেন না। মাইনষে খালি ছুইটতেই আছে। চোয়ে-মুয়ে আতঙ্ক, মুখ দিই কথা হরে না। চিন্তায় হড়ি গেলাম কী করুম,কী করুম। দ্যাশের অবস্হাটা যে এতটা খারাপ হই গেছে, আঁর স্বামী আঁরে কনও কয়নো। ছুতা একখান হাইলেই ধরি ধরি গারদে ঢুকায়। রিকশার হেছনে, হোলের গায়ে, দেয়ালের গায়ে গায়ে পোষ্টার হইড়ছে, কত কত দাবির কথা লেখা। দ্যাশের মাইনষে ক্ষ্যাপি আগুন। আঁর স্বামী জিগাইল, ‘কীয়ের এত গণ্ডগোল?’ ‘ওমা, আমনেরা হেও জানেন না। আওয়ামী লীগ আর অন্য কটা দল মিলে আন্দোলনে নাইমছে, পাকিস্তানিরা যে আঙ্গ দ্যাশের ধন সম্পত্তি লুডি লই যার, সেনাদের মধ্যে আঙ্গ বাঙালিদের জায়গা দিচ্ছে না, সরকারি দপ্তরে হেথাগো হচন্দের মানুষদের চাকরিতে ঢুকার, আইন সভায় আঙ্গ স্থান নাই, শোষন চালাইতে আছে, সেইসব লই ঢাকা সহ হক্কল শহরে হত্যেক দিন মিটিং মিছিল হর। আমনেরা দেইখছি কিছুই খবর রায়েন না।’ ‘আমনে এত খবর জাইনলেন ক্যামনে? দাদা আমনে কী কাম করেন?’ ‘আদালতে মুহুরীগিরি করি।’ আঁই এসব কথা হুনি বোবা হই গেলাম। মাইয়ার ইগাইন দেই মুখ দিই আর কথা হরে না। মুদি দোকানদার, ঔষধের দোকানদার, খাবার হোটেলের মালিকরা হক্কলে ঝাঁপ বন্ধ করি দিই হলাই চলি যার। গ্ৰামের তুন যারা কারবার কইরবার লাই শহরে আইছে হেথারা দিশাহারা। এমন অবস্থায় আমরা দিশাহারা, কোন মুই যাইলে একখান আশ্রয় মিলব। সামনে বড় রাস্তার তুন নামি হা চালাই চইললাম। আঙ্গ হাঁটু কাঁপা শুরু হই গেছে। মসজিদ দেই ধড়ে হরান আইল, ইমামরে জিগাইল, ‘রহমান ডাক্তারের কাছে যাইবার লাই ঘুরহতে কোনো রাস্তা আছে নি? আঁর মাইয়ার শরীল খারাপ, যেমন করি হোক যাইতেই হইব।’ ‘চারদিকের অবস্থাটা ভালা না, তবুও আঁই আমনেদের যেমন করি হারি হৌঁচাই দিমু, চিন্তা করিয়েন না।’
চিন্তায় আঁর দিন কাঢে। কন কী দশা হয় কি কমু। রেডিওতে খবর হুনি বেগ্গুনে অস্থির হই যার। কোন দিকে যে দ্যাশ যাইব, কিছুই বুঝা যান না। হুলিশের হিডাইনি আর গুলি খাই জেলায় জেলায় তরতাজা হরান চলি যার। আঁর এক হোলা আর স্বামী টাউনে থায়। থাই থাই কারফিউ জারি করে সরকার, কন রে কোন সংবাদ আইয়ে হরানডা ঢিপ ঢিপ করে। আর এক হোলারে তো ভারতে হাঢাই দিছি, জানি না কি সুখে আছে। কত দিন, মাস চলি গেল কোনো সংবাদ হাই না। ভারত তো পাকিস্তানের শত্রু দেশ, দিনরাত শাপ-শাপান্ত করে, একখান পোস্টকার্ড আই হৌঁইছতে মাসের হর মাস চলি যায়। চোয়ের জলের বাঁধ মানে না। আঁর মাইয়াঢাও দাদার জন্য চিন্তায় বাঁচে না। পাকিস্তান সরকার যদি এই দ্যাশেরে কব্জা কইরবার লাই উডি হড়ি লাগে, মাইনষে ছাড়ি কথা কইব নি, আইজ না হয় কাইল হেথাগো মাজা ভাঙি দিব, এই আঁই কইতাম হারি। কদ্দিন হইল এক দল হুলিশ সকালে বিয়ালে আঙ্গ বাড়ির সামনে দিই ঘুরি ঘুরি চলি যায়। কিল্লাই যায়,কন্নাই যায়, নতুন কোন ফন্দি আঁঢের কিনা, কে কইব। আমরা তো ভয়ে ভয়ে থাই। হেথাগো তো আবার হিন্দু বউঝিদের উপরে নজর। বউ মাইয়াদের কই, তোরা কিন্তু কেউ হাইত্তে সদর দরজার কাছে কিনারে যাইস না। কে কইত হারে নি যদি হেগুনের কুনজর হড়ে। বাড়ির কুকুরগুন দিনরাত ঘেউ ঘেউ করে। নতুন মানুষদের দেই ওরাও ভয় হাইছে। হেথাগো মুখের উপর দিই কিছু বলার লাই কোমর বাঁধি। একদিন ওরা আঙ্গ বাড়ির ভিতরে ঢুকি জল খাওনের ভড়ং করে। যাওনের বেলা সাবধান করি দেয় – তোমরা কান খুলি হুনি রাখ যদি কোন হোলা ওই সরকারের বিরুদ্ধে কোন চক্রান্ত করে তবে কিন্তু হাতকড়া হরাই টাইনতে টাইনতে লই যাইয়ুম, এমন ঠ্যাঙানি দিমু না, বাপের নাম ভুলাই দিমু, খোদা আইলেও বাঁচাইতে হাইরত ন। শেষমেশ বাড়ির মধ্যে যে হেথাগো কোপ হইড়ব, বুইঝতাম হারি ন। বাড়ির হোলামাইয়ার হড়ালেখা টঙে উইঠছে। ইসকুলে হাডাইবার কথা উইঠলে হক্কলে দশ পা পিছায়। বুড়াবুড়িরা তো দ্যাশের অবস্থা আর কিছু বোঝেন না। খালি কয়, ‘তোরা এত ডরে ডরে থাকস কিয়ের লাই, এই দ্যাশ তো আঙ্গ দ্যাশ, হেথাগো বাপের সাধ্যি আছে নি আঙ্গ দ্যাশখান তুলি লই যাইব।’ কিন্তু আগুন যে জ্বলের দেয়া না গেলেও টের হাইতে বেশি সময় লাগে না। বঙ্গবন্ধুর চোখ দিয়েও আগুন জ্বলে, মরণপন কইরছে একখান হেস্তনেস্ত করি ছাইড়ব। সপ্তাহান্তে যে একখান দৈনিক ইত্তেফাক আঁর স্বামী বাড়ি লই আইয়ে, দেইখবার লাই আঁই ছটফট করি। হেইঢা হেথেনে বোঝেনও ভালা করি। বাড়িতে ঢুকি হইলা কাগজখানা আঁরে দিই কয় ‘এই নাও তোঁর মনের খোরাক, না হইলে তো ঘুম আইত ন। আইজ কাগজে একখান নতুন খবর আছে।’ আগে দেইখতাম আইয়ুব খানের ছবি, অন দেই নতুন একজনের ছবি, ইয়াহিয়া খান, ইনি নাকি এখন দ্যাশের হর্তাকর্তা। কারে কি কমু একবার জাইনতামও হাইরলাম না, কখন সব হাইলটায় যায়। কী কাণ্ড কী কাণ্ড, আঙ্গ দ্যাশেরে হেথারা গনায় ধরে না, সাধে আঙ্গ নেতারা ক্ষেপি যায়।
বুইঝতে আঁর দেরি হইল না কেন্নে কেন্নে এই হাল্টাহাল্টি হইল। আঙ্গ গ্ৰামের অনেকের কাছেই এই খবর অজানা। কেউ কেউ আনন্দে নাইচল, কেউ আবার কইল, এই একখান খবর হইল, এইডা লই এত মাথা ঘামানোর কী আছে। কেউ আবার পণ্ডিতের মতো মাথা দোলাই দোলাই কইল, আছে, আছে। নানা মাইনষের নানা মত। এইঢা লই আঁর একটা অন্য মত আছে। আরে, সরকার হালটাইল কি হালটাইল না, এই খবরে আঙ্গ কি অমন হইব, দ্যাশের মাইনষের ভাগ্য কি হালটাই যাইব? বাঙালিদের নিজের একখান দ্যাশ লাইগব। আমরা কি খাই, কি হরি, কন্নাই আমরা থাই, কেন্নে আমরা থাই, কোন বাজারে বাজার করি, হোলামাইয়ারে কেমনে আদর করি হেথারা কেমন করি জাইনব, হেথারা কেমন করি আঙ্গ সুখ দুঃখের ভাগ লইব ? এই সকল প্রশ্নগাইন আঁর মাথায় গিজগিজ করে। তোরা হক্কলে ভাব, তোদের হোলারে তোগো মতো অন্য কেউ মানুষ কইরত হাইরব, ওগো হেঢের ক্ষুধা লাইগলে তোরাই তো বুঝবি, না অন্যরা আই খাওয়াই দিব, দ্যাশের মা’র-ও একই দশা, বুঝিস ন। না বুইঝলে আঁই ভালা করি বুঝাই দিমু। আঁর কথাগাইন হুনি বেগগুনে হাসে, আঁর স্বামী কিন্তু একটুও হাসে না, গালে হাত দিই ভাবে কিছুক্ষণ, তারপরে কয়, ‘তুমি এই কথাগাইন কোন তুন শিখলা, আঁই তো তোঁরে শিখাইনি।’ নিজে নিজে শিখছি, মাইনষে বুঝি নিজের তুন কিছু শিখতে হারে না, এ কেমন কথা! তোমরা হুরুষ মাইনষে ভাব, মাইয়ালোকেরা খালি চুলা ধরাইত জানে, ভাতের হাঁড়ি ধরি নাড়েচাড়ে, লাকড়ি, হরমুল জোগাড় করে, হোলামাইয়ার জন্ম দিত হারে, আর কিছু হারে না। এইবার আঁর কথায় চুপ করি থায়। কি জানি হুরুষ মাইনষেরে ঠেস দিই কথা কইছি বলে গায়ে ফোসকা হইড়ল কিনা। যদিও আঁই জানি আঁর স্বামী একটু অন্য ধাতের লোক, মাঝে মাঝে মাইয়াদের অধিকার লই দু’চার কথা বলে, তবে এইটা জানি না, কোন কথাটা উনি মাইনত হাইরব, আর কোন কথাটা মাইনত হাইরত ন। আঁর জায়েরা আঁর কথা হুনি ঠকঠক করে কাঁপে। হেগুনের স্বামীদের লগে ওরা কোন কথা কয়, আর কোন কথা কয় না, হেগুনেই জানে। মাইয়াগো যে আর একটা জীবন আছে, এইটা কোনদিন টের হায় ন, খোঁজেও ন। আবার ভাবি ওদেরও একটা ধর্ম আছে, যা আঁই জানি না, জাইনবার চেষ্টাও তো করি নি কোনদিন, কিন্তু এক লগে সংসার সামলাইছিলাম কত বছর। ওরাও আঁরে বড় জা বলি মান্যিগন্যি কইরছে। ওদের মনের কথাগাইন আঁরে খুঁজি দেইখতে হইব। হেগুনের মনে এত ভয় কেন, এই কথাখান আঁরে জাইনতেই হইব ।
ভয়টা যে কন্নাই লুকাই আছে, আঁই নিজেও জানি না। কেউ কম কথা কয়, কেউ বেশি কথা কয়, তাইতে দোষের কি আছে। হ্যাঁ আইজকাল হক্কলে যেন কেমন চুপ মারি থায়। চিন্তায় চিন্তায় হক্কলে আধমরা হই আছে। প্রশ্ন একখান মনের মধ্যে আই খোঁচা মারে এমন একখান দুঃসহ অবস্থা হাঁচাই আঙ্গ চাইরধারে গিলি খার! এরকমটা হইবার দরকার কি ছিল? কারা এর লাগি দায়ী, হিয়ানেই হক্কল কথার উত্তর আছে। আঁর দেওরের নাতনিটা আইজকাল খুব করি কারন নাই, অকারণ নাই ছটফট করের। হেথিরে আঁই বুঝাই হারি না, লাফাই লাফাই চলি যায়, এই আছে, এই নাই। আঙ্গ দ্যাশে যা হর, হেইডা কী হর, কারও জানা বোঝা নাই, শুধু দেখি যাই, বেগ্গাইন মনমানি যেন। বড় বড় শহরের মুই চাই থায়, হেথেনরা যে হতে চলে, বুঝি না বুঝি হেই হত ধরে। কামকাজ হালাই বদইলারাও দশখান কথার মধ্যেই পাঁচখান কথা ইয়াহিয়া খানরে লই কয়। এই বেডার কথা আঁর কানে আইছে। ইসলামাবাদে বই প্যাঁচ কষে কেন্নে আওয়ামী লীগের মাথা মুড়াইব। বড় আজব দ্যাশখানা, মাইনষে কয় হেথাগো সৈন্যরা নাকি জল্লাদের মতো, এক গুলিতে সাবাড় করি হালায়। লঙ্কার দ্যাশের রাইক্ষসদের যেমন ছিটাফোঁটা দয়ামায়া ছিল না, খালি হরের মাইয়াদের দেইখলে ছলচাতুরি করি চুরি করে, হেগুনেও নাকি রক্তমাংস চিবাই খায়। হায় হায় রে, এরা আঙ্গ দ্যাশে আইলে কী হাল হইব। দ্যাশের মাইনষেরে ভূত বানাই ছাইড়ব। একখান জিনিস হোনা যার, মুসলিম লীগের যে নেতাগুন লাফাইতে ঝাপাইত তারা কোন কারনে নাকি চুপ মারি গেছে। কী জানি হেথাগো হত হালটাই হালাইছে কিনা। এইটা বুইঝতাম হারিয়ের কোনানে না কোনানে কেউ আঙ্গরে হতে বসাইবার ফাঁদ বানার। আঁর তো চিন্তা বাড়ি যার দিন দিন কেন্নে হোলাপাইনরা হড়াশোনা চালাইব। আইয়ুব খান গদি ছাড়ি চলি যাইবার হর মাইনষে ভাইবতে শুরু কইরছে এখন আবার কোনরমের আদেশ জারি হইব। কি চাপ আই হইড়ব? বাজার যদি আরও আগুন হই যায়, আরও মাইনষের রোজগার কমি যাইব, ইগাইনের সুরাহা হইব ক্যামনে? হোনা যার অন নাকি হাঁড় ভাঙ্গা খাটনির টাকাগুন ওরা লই চলি যার ঘুরহতে। বাড়ির লোকজনেরে কই, তোরা যিহানে হিয়ানে মুখ লাগাইচ না, কে যে কার চর, শেষমেশ বড় বিপদ হই যাইব। রেডিওতে হক্কল কথা ঠিক কয় না, রাখিঢাকি কয় যাতে করি দ্যাশের মাইনষে জাইনতে না হারে। সিলেট তুন খুড়তোতো দেওরের বড় হোলা আইছে কত রাস্তা ভাঙ্গি, বাসে রেলগাড়িতে চড়ি, পায়ে হাঁঢি। সওদাগরি আফিসে খাতাহত্র লেয়ে। এমন হইছে ওর চোয়ের দিকে তাকাইতাম হারিয়েন না। তোর কি হইছে রে রেবতী, অত ঘাবরাই আছস ক্যান? চাকরি বাকরি ঠিক আছে তো রে? ‘না গো জেঠি, আর চাকরি কইরতাম হাইরতাম ন। বিছানাপত্র গুটাই বাড়ি চলি আইত হইব, ওপরের তুন নাকি চাপ আইছে, হিন্দু কর্মচারী রাওন যাইত ন। মালিক খারাপ ন, কনডাই তুন চাপ আইছে, কে কইব। আঁর অনুমান যত নষ্টের গোড়া ওই পাকিস্তান সরকার, হেথাগো লগে কারবার কিনা।’ কিন্তু এত সহজে যে ভাঙ্গি হইড়লে চইলত ন।
অন এমন অবস্থা হইছে, বাড়ির হোলাপাইনরা যারা ছড়াইছিটাই ছিল কাজেকর্মে কেউ চাঁটগায়, কেউ ঢাকায়, কেউ ময়মনসিংহে কেউ কুমিল্লায়, হক্কলে গুটাই গাটাই ঘরে চলি আইয়ের। মনের মধ্যে ভয় ঢুকি গেছে। একদিকে তো মিটিং মিছিল প্রতিবাদ ভাঙচুর, কোম্পানির লোকেরা কারবার গুটাই হালার। লস খাই আর কদ্দিন চালাইব। এগুনেই-বা গ্ৰামে আই কি কইরব, গ্ৰামে আর কামকাজ কিছু আছে নি। ব্যবসা-বানিজ্য যে কইরব দোকানপাট হাইব কন্নাই। এমনিই হিন্দুর দোয়ানের ব্যবসা চলে না। কেউ আর সওদা কেনে না, না খাই মইরবার জোগাড়। এই তো মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। আঙ্গ দুঃখের কথাগাইন কে আর হুইনব, চেঁচাইলেও, কাঁদাকাঁঢি কইরলেও কি সরকারি বাবুরা হুইনব, হেথেনরা তো অমনিতেই চোখ কান বন্ধ করি আছে। আঁর জাইনতে ইচ্ছা করে গোটা দুনিয়াটা চইলছে এমন করি, না আঙ্গ দ্যাশেই এত কষ্ট, এত ভাগাভাগি, এরুম হইলে আমরা বাঁচুম ক্যামনে? কারও কি আক্কেল, হচন্দ নাই যা খুশি তাই কইরব। জোয়ান হোলাগুন কী ঘরে বই থাইকত হারে! কে আগাই আইব এই বিপদের দিনে। মাথার উপর শনি নাচের। একটা দুঃসংবাদ কানে আইছে, হুলিশেরা মিছিলের উপর গুলি চালাইছে, মরি গেছে দুইজন, কত মানুষ যে জখম হইছে, তার কি ইয়ত্তা আছে। মুজিবুর রহমান সরকারেরে হুঁশিয়ারি দিছে এর ফল হেথাগরে ভুইগত হইব। খবরের কাগজে বড় বড় করে ছাইপছে বঙ্গবন্ধুর গর্জনের কথা। রেডিওতে টু শব্দটা করে নাই। এত যে কাজ চলি যাওনের লাই মাইনষে না খাই থার, হার তলার জমি চলি যার কারও কি মাথাব্যথা আছে। হুইনলাম একটা দল ভিতরে ভিতরে গরীব মাইনষের লাই দরবার করে, কম্যুনিষ্ট কয়। হেথাগো দলের কয়জন আঙ্গ গ্ৰামেও আইছে। ইয়ানের এক হোলা হেই দলে নাম লেখাইছে। হেথেই নাকি ডাকি আইনছে। আঙ্গ বাড়ির যে হোলাগুন কাম হারাইছে ওদের হুসলাইতে আছে হেথাগো দলে যেন নাম লেখায়। আঁই আর কি কমু, খড়কুটা হাইলেই আঁকড়াই ধরে। ওরাই ফের অন্যদের মাথা খায়। আওয়ামী লীগের লগে এতাগো কী সম্পর্ক কে জানে। তবে এগুনের কথাগাইন হুইনতে মন্দ লাগে না। ধম্মকম্ম লই কোন উচ্চবাচ্য এগুনে করে না। ইয়াহিয়া খান কি এদের খবর জানে? এগুনে ঠিক না বেঠিক হেইঢাই বা কে জানে। আঁই একখান কথা ওদের জিগাইলাম, এত ভারি ভারি কথা বুঝি না, হেঢের ভাতের জোগাড় করি দিতা হাইরবা, তাইলে তোঙ্গ কথা হুনুম।
হায় হায় রে কী গজব লাইগল
রাহু আই চন্দ্র সূর্যের টুটি চিপল
ইউসুফ আলী মণ্ডল প্রাইমারী ইস্কুলে হড়ায়। চাইর গ্ৰামের মানুষ সম্মান করে। সত্যনারায়নের হুজায় না ডাইকতেই চলি আয়ে। এই লই দুই-চার কথা হুইনতেও হয়। হেতেনে এসকল কতা এককান দিই হোনে, এককান দিই বার করি দেয়। এই লই টিটকারী মারি ছাড়া কতা কয় না – ধম্ম ধম্ম করি তোমরা মর, আঁর যিয়ানে ইচ্ছা হয়, আঁই যাইয়ুম। আঁর হরান যা চায়, তাই তো করুম। কিল্লাই যে এত টান ইউসুফ মাষ্টার নিজেও তো জানে না। আব্বার কাছে হুইনছিল কত হুরুষ আগে ওরা নাকি হিন্দু ছিল। হরে হরে পির দরবেশের কতায় সন্তুষ্ট হই মুসলমান হয়। আব্বাও আঁর বাঁচি নাই, কতাগাইনও আর স্মরনে নাই। অনেক কিছুই মিলাইত হারে না। মনের গতি এমন গতি কে আর টের হায়। আঁরে কয়, ভাবী এইডা কইত হারেন নি, আমনেগো লগে আমরা মিলতে হারি না ক্যান, আমনেগো চিন্তা, হাবভাব, ডাকখোঁজ বেগ্গাইনের লগে ষোল আনা না হোক বারো আনা মিল তো আছে আঁঙ্গ। বেবাকের সমাজই হড়ি আছে, কারা আগাই আছে, আর কারা হিচাই আছে। হেইডা লই, দেয়েন তো রোজের কাজে, চইলতে ফিরতে, এত অশান্তি কিল্লাই? এক হত দিই তো হাডি, আমনেরাও তো আঙ্গ মাজারে যাই দোয়া মাঙ্গেন, তাহইলে এত কতা উডে ক্যান।
মাষ্টারের মনের ভাবখানা হালাই দিবার মতো না, মনের মধ্যে থাই থাই খোঁচা মারে। কারা ঢাইলছে এত বিষ মাইনষের মনে, এই হশ্নখানের উত্তর দিবার লাই কেউ কি আছে, কেউ নাই। ইউসুফ মাষ্টাররা যা চায়, আঁঙ্গ সমাজের অন্য লোকরা কি তা চায়? মাষ্টার দূরের তুন এক কোনায় গাছের গোড়ায় বই থায় হূজা দেয়। কোনো কতা কয় না, মুখের ভাবখানা হাল্টি যায়। কয়, সত্যনারায়নের হস্যাদ হামু নি ভাবী। আঁর চোয়ের জল আই যায়। হেতেনেরে কী আর কমু, আঁর মুয়ের তুন একটা বাইক্য সরে না। দুঃখ তো লাগে যন হুনি আঁঙ্গ বাড়ির তুন দূরে কোন গ্ৰামে মারামারি কাটাকাটি হর, মুসলমান ভাইরা হিন্দু মাষ্টারের গলা কাডি হানা হুইরে ডুবাই দিছে, মরা মাইনষের গন্ধ বার হর হয়, চোখ ঠিকরাই বার হই আইছে, কেউ একটুও হিরেও চায় না, ভাবেও না, এই মানুষটা হেতাগো গ্ৰামের ইসকুলে হড়াইত, সন্তানের মতো দেইখত হেথাগো ঘরের হোলামাইয়াদের। একটুও চোয়ের চামড়া নাই। মানুষ কেমনে এত বেইমান হয় ধম্মের দোহাই দিই, না অন্য কোনও কারণ আছে, ভাবায় তো আঁরে। মাষ্টার কতা হুনি মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে ঠাঁডা মাইরা রোদের মধ্যে দিই হাডি চলি যায়।
ইগাইন হেতারা ইচ্ছা করি করে, না অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে? হক্কল কামের পিছনে একটা শয়তানি বুদ্ধি আছে। আজ যেটা দেয়ের তার ফলটা ভোগ কইরব অনেক হরে। বুঝি না মাইনষে কেন ছুটছে, না-বুঝি ছুইটছে কিনা, হরে বুঝা যাইব। এইডা বুইঝতাম হারিয়ের কেউ না কেউ মানুষগুনের মাথা খার, চিবাই খার। না হয় গরীব চাষা মোতালেব মিঞার মাথাটা ঘুরি গেল কেমন করি। আঁই অনেক চিন্তা কইরলাম, কোনো কুল কিনারা খুঁজি হাইলাম না। তবে একদিন না একদিন এই হালটানো হাওয়ার গন্ধটা আই শ্বাসের লগে ঢুইকবই ঢুইকব। মোতালেবের মাথাটা কারা খাইছে, কিল্লাই এত বদ মতলব হের ঠিকানা খুঁইজত গেলে কাইল্যা কী ঘটনা ঘইটছে এইটা ভাইবলে চইলত ন, মাইনষের মনের ভেতরে গোপনে যে কব্জা কইরবার ফন্দি চিড়বিড় করের হারাক্ষণ হেইডা লই টান দিত হইব। পাঁচ গণ্ডা জমির মালিক আর ভাগে জমি চাষ করি চাইর চারইটা হোলামাইয়া লই দিন কাডায়। মাইয়ারে বিয়া দিছিল সোনামুখীতে। জামাই কাজকারবার কিচ্ছু করে না, হান্ডাগুলি মারে, মারধর করি তালাক দিই দিছে। মাইয়া কাঁইদতে কাঁইদতে আই জম্মভিটাতে উইঠছে। হুনি আঁর মনটা খারাপ হই গেছে। এই মাইয়ারে আঁই কত ছোড দেইখছি। বাপের লগে আই আঁঙ্গ আমবাগানে আম কুড়াইত, আঁই কত তিলের লাড়ু খাইতে দিতাম। কোনদিন ভাইবতামও হারি ন, মোতালেব মিঞার মনে আঙ্গ লাই এত বিতৃষ্ণা জম্মাইব। এইডাই বোধহয় বিধির বিধান। হেতে কি একা, সঙ্গে জুটাইছে কত শাগরেদ। আইজ আঙ্গ গাছের নাইরকল হাড়ি লই যার তো কাইল জমি তুন ফসল কাডি লই যার। কারে কইয়ুম, কার কাছেই বা নালিশ জানাইয়ুম, কে কার কথা হুইনব। বইলতে গেলে রে রে করি তাড়াই আইব। এইদিকে আঁঙ্গ বাড়িঘরদোর ভাগ হই যাওনে আর এক বিপত্তি। ভাইয়ে ভাইয়ে মিলমিশ না থাইকলে যা হয় আর কি। ঘরের শত্রুর বিভীষণ, ওরা আই উসকায়, জমি সম্পত্তি হাতাই লইবার কারসাজি করে। আঁর এক দেয়রের কান ভাঙায়। হেথে তো কোনো রোজগারপাতি করে না, চাইর গ্ৰাম ঘোরে। হেতের কথার মধ্যে আর এক শাগরেদ মজিদ আলির কথার মিল খুঁজি হাই আঁই তো চমকাই উডি। ব্যাপারখানা কি, হেরা কি বাবদাদার কালের সম্পর্কটার কতাটাই ভুলি গেছে। আজব দ্যাশের গজব কথা, যা বাপের জম্মে হুনি নি, আইজ হেগুনে আই আঁঙ্গরে হোনার। কত কতাই না চাপা হড়ি থায়, সময়ের ধাক্কায় হুঁড়ি বার হয়। হেগুনে আঁর দেয়রেরে হুসলার সম্পত্তি কেন্নে হাতান যায়। এই বুদ্ধি আঁঙ্গ গ্ৰামের মোতালেব মিঞাদের মাথা তুন বার হয় ন। অনেক দূর দ্যাশের মাথা কলকাঠি নাড়ের, তারা হেতাগো মাথাগাইন খার। মোতালেব মিঞা সেদিন কইল, আমনেরা এত জমির মালিক হইলেন কেন্নে, টিনের চালের বড় বড় ঘরে থান, আর আমরা চাষাভুষা মাইনষেরা সনের চালের ঘরে গরমকালে বর্ষাকালে আধপেটা খাই দিন কাডাই। কতাগাইন যে একদম উড়াই দেওন যায় না। কিন্তু হেতেনের কতার মধ্যে কেমন যেন শত্রুতামির গন্ধ হাইলাম। আমরাই নাকি ওদের দুঃখ কষ্টগাইন কোনদিন বুঝি ন, নিন্দামন্দ কইরছি, অচ্ছুত করি রাইখছি, অন ওরা প্রতিশোধ নিত চায়।
ব্যাপারটা লই ভাইবতে হয়, এমন করি কোনদিন তো ভাবি ন। পাপ যদি পূর্বহুরুষেরা করি থায়, হের প্রায়শ্চিত্ত করুম কেন্নে। খালি ইয়েল্লাই এত ঘৃণা, এইডা ভাইবতে গেলে আঁর কষ্ট হয়। কই আমরা তো হেথাগরে কম ভালোবাসি ন। তাইলে কী অন্য জায়গার হিংসাহিংসি আঁঙ্গ গ্ৰামে আই বাসা বাঁধের। আঁই ঠিক দেইখছিতো, আঁই ঠিক বুইঝঝিতো, বোঝনের দরকারই-বা কি আছে। কত মানুষ কত কিছু জানে, আঁই তো কিছুই জানিনা। যদি জাইনতাম ঠিক, কাউকে চিনতাম হারি ন ক্যান। কত মাইনষেরে তো আমরা চিনতাম হারি না, তাতে দোষের কী আছে! দোষ গুন কজনেই-বা বিচার করে, হক্কলে তো নিজের মতোই চলে, সেইমতো জীবন দেয়ে, ভিতরে ভিতরে ডুব দেয়, ফের সামনে চলি আয় কয়, আমারে দেয়ো, আঁরে এতকাল যেইভাবে দেইখছ সেইভাবে নয়, নতুন করে দেয়ো। সত্যিই এই পৃথিবীর কত রূপ, কত গয়নাগাটি হরি আছে, আরও গয়নাগাটি হইরব বলে হক্কলেরে নিজের মতো বানাইতে চায়, অন্যরা যে ভিন্ন মানুষ এই কথা স্বীকারই কইরত চায় না। হোড়াইতে হইলে হোড়াইব, গলা কাইটত চাইলে গলা কাইটব, হোলামাইয়ার সামনে উলঙ্গ করি মাইয়া মানুষের শরীল দেইখতে চাইলে তাও দেইখব। কী জ্বালা! কী জ্বালা! এমন জ্বালায় কেইবা জ্বলি হুড়ি মইরছে। হরেক জাতের মানুষ আর নানা ঢঙের সংসার। চিনন কী যায়! কন যে কন মুই যাইত চায় কে জানে। এই তো হেইদিন মাচার তুন একটা কুমড়া লতার তুন ছিঁড়ি আনার সময় ধপাস করি হাত তুন মাটিতে হড়ি গেলে সে কী দশা! পিলপিল করি কত রাজ্যের হোকা আঁর চাইরপাশে ঘিরি ধইরল, ভাইবতামও কী হাইরছিলাম নি, এমনটা হইব, গা-টা ঘিনঘিনই তো কইরছে। আঁর গা-টা এরমই ঘিনঘিন করে। কন করে, যন দেই হোলা কাঁদে, মাইয়া কাঁদে, মাটিতে আঁছড়াই হড়ি কাঁদে।
তো ভাইবলাম এমন করি কেন্নে চইলত হারে, এর একটা বিহিত কইরতেই হইব, যেমন করি হোক। দুনিয়া চলে দুনিয়ার মতো করি, আমরা কেন্নে চলুম। রাতারাতি তো ভোল হালটানো যায় না। এইডা তো ঠিক এমন মেঘ তো দেই না, টুকরো টাকরা ছড়াই ছিটাই আছে, তেমন হইলে একখান কতা ছিল, ওমা এই দেখি, যতদূর চোখ যায় কালা জমাট বাঁধি আছে, রাতের বেলায় আঁধার নাইমলে যেমনটা হয়, এই আছে, এই নাই। খবর আইছে চুপি চুপি, হরে প্রমাণটা বোঝা গেল যন বোঝকা-বুঝকি লই আঁর বড় ননদের মেঝ হোলা আই হাজির হইল, বেজার মুখে দুঃখ করি কইল, আঙ্গ হিয়ানে যা শুরু কইরছে এক দল লোক হেথারা নাকি পশ্চিমাদের চর, গোপনে গোপনে শলা-পরামর্শ করের কেন্নে আঙ্গ বাড়িঘর দখল কইরব। মামী কি কইরতাম কন, কনডাই যামু। অত চিন্তা করচের কিয়ের লাই, আমরা আছি তো, আঙ্গ গ্ৰামের হাওয়া অনও অত গরম হয় ন। হেগুনের জুলুম বেশিদূর আগাইত ন, রেডিওতে যা হুইনতেছি, বঙ্গবন্ধু হুঁশিয়ারি দিছে ইয়াহিয়া খানকে, এইদ্যাশে গন্ডগোল পাকানোর চেষ্টা কইরলে মাইনষে চুপ করি থাইকত ন, তবে কিনা বেগ্গাইন হাঁচা কথা কর না মিছা কথা, কে কইব। তবে অনও এত ভয় হাওনের কিছু হয় ন। চন্ড-সূয্য মাথার উপর আছে, এত বেইমানি সহ্য হইত ন। ভগবানরে মন-হরান দিই ডাক, একখান ব্যবস্থা ঠিকই হইব। আমরা বাপদাদার কাল তুন এই দ্যাশে আছি, আঙ্গরে বাড়িছাড়া কইরব, এত সোজা কথা নি। তুই চুপ করি বয় তো, হাত মুখ ধুই ল, কিছু একখান মুয়ে দে। হেতে কি আর আঁর কথা হোনে, বাড়িতে মা-বোইনরে হালাই আইছে, চোয়ের কোনায় জল গড়ায়।
যত দিন যার ধুয়া ধুয়া লাগে, মাইনষের মনের মধ্যে কী একটা রোগ আই বাসা বাঁধের, আঁই কইতাম হারিয়েন না। আঙ্গ শরীলে ক্রিমি কামরাইলে যেমন মোচড় দেয়, থাই থাই মাথার মধ্যে কিলবিল করে কত রকমের দুশ্চিন্তা – কিছু একটা তো ঘইটব, কন হইব, কেন্নে হইব কেউ জানে না। এইডা বুঝিয়ের যন হইব, ঝড়ের বেগে আই উলটি হালাই দিব, হলাইবার হত খুঁজি হাইত ন কেউ। মোতালেব মিঞা, মজিদ আলি হক্কলের মনে বিষ ঢালের। সেই বিষ হতেঘাটে মাঠেঘাটে বদইলাদের জেলে মাঝিদেরও মন বিষাই দের। বিষ ঢাইলবার লাই ওরা হাগলা কুত্তার মতো লালা ঝরার। সুযুগ হাইলেই কামরাই ছোলাই ধইরব। ভালামন্দ বিচার কইরবার সময় কনডাই। আঁর হোলা শহরের তুন বাড়ি আইছে। হোলারে দেই ভালা যেমন লাইগল, চিন্তাও বাইড়ল। হোলা মন খারাপ করি বই থায়, কিছু কয়ও না, হেডভরি খানাও খায় না। হেতেরে বুঝাই হারি না। কই, হ্যাঁরে কছ না, কী হইছে। হেথে কয়, আমনে ইগাইন বুইঝবেন না। বুঝাই কইলেই বুঝুম। তোর মারে তুই এত মূর্খ ভাবছ ক্যামনে। হোলা আঁর কাঁদি হালায়। ইনায় বিনায় কত কথা কয়, অদ্ধেক বুঝি, অদ্ধেক বুইঝতাম হারি না। আসলে চোয়ের জলের নাকের জলে হইলে যেইডা হয়। মনের কষ্ট কইমলে বুঝন যায়, হেতের বাপেরে শয়তান গোছের লোকজন মুয়ের সামনে যা নয় তাই বলে গাইল দেয়, হেতেনের পেশার নাম ধরি ভেঙায়। ঘরের মধ্যে ঢিল ছোড়ে। কেন্নে হেগুনের ইতরামি সহ্য কইরব। নালিশ জানাইলে কী ফল হইব, হেতেনে জানে বিধায় চুপ মারি থায়। কারা ইন্ধন যোগায়, হিগাইন না জানার কতা নয়। মুসলিম লীগের মাতব্বররা চায় হিন্দুগো ঘরছাড়া করি দখল করি লইব, তাই গুণ্ডা মস্তানদের লালাই দিছে উত্তক্ত্য কইরবার লাই। এহেন দুষ্কর্ম শহরের হিন্দুদের ঘরে ঘরে শুরু হইছে। কেউ কেউ ঠিকও করি হালাইছে আর থাইকত ন। আঁর যিগুনে হেগুনের কথায় সায় দিই চলে আর যেতাগো কোমরের জোর আছে, হেথাগরে অনও কিছু কয় না। তাই বলি আইজ কিছু কয় না বলি, কাইল কিছু কইত ন, হেইডা ভাইববার কারণ নাই। হোলা কয় আর শহরে বাপের কাছে যাইত ন। আঁর স্বামীরে কইলাম, আমনের মত কী। হেতেনে ত কতাখান হাসিই উড়াই দেয়। ঠিক কইল না বেঠিক কইল, কিছুই বুইঝলাম না, না আঁরে বুইঝতে দিল না, কে কইব।
ইউসুফ মাষ্টার সময়টা তো বড় গোলমালে লাইগতেছে। ব্যাপারখানা বুঝাই কন দেখি হাঁচা হাঁচা এই দ্যাশটা উচ্ছন্নে চলি যাইব না তো! কাগো হাতে রক্ষা হাইব? আমরা কেমন করি বাঁচুম? আঁর কতা হুনি হেতেনে মুখ নাড়াইল না, মাথার চুল মুঠা করি ডাইনে বাঁয়ে কইরল। কিছুক্ষণের লাগি এবার এমন করি মুখ নাড়াইল যেন তাস খেলার চাল দের – ইয়াহিয়া খান না শেখ মুজিব। মুজিবরের কথা আইয়ের কত্তুন, হেথেনে তো অনও ক্ষমতাই হায় ন, দ্যাশ চালাইব কেমনে? হবে তো জেল তুন বার হইছে। মাইনছি লোকে বঙ্গবন্ধু কয়। কিন্তু ছড়িখান তো ঘুরাইতে আছে অনও পশ্চিমারা।
ঠিক পয়েন্টে তো আমনে ক্যাচ করছেন। বেডারা তো খেলাটা খেইলতে আছে। ছিল তো পূর্ববঙ্গ, অন নাম হইছে পূর্ব পাকিস্তান, হেথারা দ্যাশ উপর উপর কইলেও আসলে ভাবে মধু খাইবার বাসা, আঙ্গরে ভাবে মৌমাছি, আগুন দিই মারি হালাইত হাইরলে হুরা সম্পদের মালিক।
কন কী! এত শয়তান ওরা?
আস্তে কন ভাবী, কে কন্নাই ঘাপটি মারি আছে, হুইনত হাইরলে দফা রফা করি দিব। দিনকাল ভালা না।
আমনে কইতে আছেন হিয়েল্লাই কিছু মাইনষেরে কুমন্তর দিই ধম্মে ধম্মে গোলামি লাগাই ফায়দা লুইটত চায়।
দেয়েন তো কেমন সুন্দর আমনে হশ্নও কইরলেন, উত্তরটাও হাই গেলেন।
হায় ভগবান হেতেনের মতো যদি দেশগাঁয়ে আরও কজন মানুষ থাইকত, গাঁ গঞ্জের চেহারাখানই হাল্টি যাইত। কবে যে আঙ্গ দ্যাশে শান্তি আইব, কে জানে। আঁর হোলাডার কথা যত ভাবি, মনটা তত খারাপ হই যায়। এমন একটা দ্যাশে এগুনের ভবিষ্যৎ কী! কেন্নে আঁই কই, ভয় হাস না, দিন আইব, যেদিন তোর বাপেরে কেউ আর হিন্দু বলি ঘেন্না কইরত ন।
কদ্দিন হর হোলা চলি গেল শহরে। যাইবার সময় সদর দরজা হার হই গেলে হিরি হিরি চায়। ওর ভেতরে ভয়টা জাপটাই ধইরছে। এট্টুখানি হোলা, যা দেয় হক্কলটা গিলি লয়। আঙ্গ উঠানের এক কোনায় কলাগাছ মাথা তুলি দাঁড়াই আছে। আঁর হোলাটা বাড়ি থাইকলে কলার কাঁদির দিকে চাই থায়। কী যে ভাবে ওই জানে। হেতে ভাবে এইডা ওর নিজের বাড়ি, নিজের ঘর, নিজের মাডি। আঁরে দুঃখ করি কয়, মা আইজকাল বেক কিছু আঁর হর হর লাগে ক্যান। এই কথার উত্তর আঁই ক্যামন করি দিমু। আঁর হৌড়ি কয়, হোলাটারে বউ তুই জোর করি শহরে হাডাইলি। কত চোয়ের জল হালাইছে, তোর এট্টুখানি মায়াদয়া হয়নি? আঁর হৌড়ি খালি আঁরে দোষ দেয়। মায়ের মন বোঝে না। আরে বাবা হক্কল কিছুর লগে যুজি বাঁইচতে শিখতে হইব। মনে সাহস আইনতে হইব, না হইলে চইলব ক্যামনে! অবস্থাটা যে ভালা নয়, জানি। কী করার আছে, লেয়াহড়া বন্ধ করি বাড়ি বই থাইকলে জাইনব কী করে চাইরদিক দিন দিন ক্যামন হাল্টাই যার। হেতেরে তো শিখত হইব এই দ্যাশটার নাম পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিমাদের হাতের পুতুল, যতই বঙ্গবন্ধু বাংলা বাংলা করুক, হিন্দুদের দ্যাশভাগের আগের সম্মান হিরাই দিতে হাইরব? যারা ভারতে চলি গেছে না থাইকত হারি হেগোরে তো আমরা হিরাই আইনতাম হাইরতাম ন। যারা এত অত্যাচার সহ্য করিও মাডি কামড়াই হড়ি আছে, কী দশা হইব আঙ্গ? মুসলিম লীগ তো কয় এই দ্যাশ হেতাগো দ্যাশ, হিন্দুদের জায়গা হইত না ইয়ানে, আইজ না হয় কাইল চলি যাইতই হইব। কীসের ভরসায় আমরা থাইয়ুম। আঁই কী বুঝি না, আঁর হোলা কিয়ের লাই চোয়ের জল হালায়। ওর লগে কীরম ব্যবহারটা হয় হিন্দুর হোলা বলি। মা, আমার মনে আছে সব, আঁর বাপের দ্যাশের হরিচরণ কাকার মাইয়ারে তুলি লই যাই রাতারাতি মুসলমান করি বুড়া হুজুরের লগে বিয়া দিল, জয়িতা হই গেল আমিনা বেগম। আঁর মাইয়ার লাই চিন্তা হয়, আঁই জানি না দিন হাল্টাইব কিনা, বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলার স্বপ্নে আঙ্গ জায়গা কন্নাই হইব ভগবান জানে।
রেডিওর সাউন্ডটা বাড়াই দিলে হুরা বাড়িটা গমগম করে। ইয়াহিয়া খান আঙ্গ দ্যাশের মিটিং মিছিল লই কত কতাই না বইলল, আঁর মাথায় ওগো কতা কিছুই ঢুইকল না, খালি শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা ভাসানী এই দুইঢা নাম ঘুরিফিরি আইল। বুইঝলাম কতার মধ্যে কোনও ছিরিছাদ যাগো নাই তারা কেন্নে আঙ্গ দ্যাশ শাসন কইরব, আঁঙ্গ মনের কতা বুইঝবার হেথাগো সাধ্য আছে নি। ইয়াকুব খান এই দ্যাশের হর্তাকর্তা, ওরা কয় পাকবাংলার গভর্নর। এই খান সাবরে লই কত কতা হুনি। হেতেনের নাকি বাঙালিদের লাই কত দরদ, বাংলা বলা শিখছে, আঙ্গ দ্যাশের সুখ দুঃখের কতা পশ্চিমাদের জানাইলেও কোনো কামে আয় ন। ইউসুফ মাষ্টার কইছে হেথেনে নাকি এও বিশ্বাস করে শুধু ধম্ম দিই বিচার কইরলে পূব আর পশ্চিমাদের লগে সম্পর্ক টিকি থাইকত ন, আরও ভিতরে ঢুকি দেখার দরকার আছে, না হইলে পাকবাংলা শাসন করা মুশকিল হই যাইব। চোরা না হোনে ধম্মের কাহিনী, যা হবার তা হর। ইউসুফ মাষ্টারের উপরে খড়্গ নামি আইছে। হিন্দু মুসলমানরে এক চোয়ে দেইখলে হেথাগো অসুবিধা হর, হোনা যার মাষ্টারের চাকরি চলি যাইত হারে। বেডারা ইস্কুলডার লাই এক হয়সাও খরচা করে না, নতুন কোনও মাষ্টারও দেয় না। ইসকুলডার দেয়াল ভাঙ্গি হরের। মুরুক্ষু বানাই ধনে হরানে কাঙাল করি আধমরা করি ছাইড়ব। দ্যাশভাগের হরে বিহারী মুসলমানরা যারা এই দ্যাশে আইছে, হেগুনরে উর্দু মাষ্টার বানাই চাকরি দের, ইউসুফ মাষ্টারের মতো বাংলা হড়ানোর মাষ্টার আর কোন কামে আইব।
ভাবী বঙ্গবন্ধু হেই কারণেই এই দ্যাশে স্বশাসন
দাবি কইরছে।
হেইডা আবার কী?
আমাগো দ্যাশ, মানে হল গিয়া বাঙালিদের দ্যাশ বাঙালিরাই শাসন কইরব।
মাষ্টার, আমনে কী ভাইবছেন, এত সহজে হেথারা আঙ্গরে এই অধিকার দিব। এইটা খুব মুশকিলের কাম।
পশ্চিমারা বাহান্ন সালে হেতাগো উর্দু ভাষাখান আঁঙ্গ বাঙালিদের মুয়ে বসাইতে চাইছিল, সফল হয় ন, অন ভাতে মাইরতে চায়। এমন করি কি চলে, মানুষ আইজ না হয় কাইল গর্জি উইঠবই উইঠব।
আমাগো হোলামাইয়াগুলার শিক্ষাদীক্ষা নাই, চাকরি নাই বাকরি নাই, না খাই মরার জোগাড়, আনাজপাতির দাম মাঙ্গা, চাইল, ডাইল, ঢুল্লার শাগ, মাইরার শাগেরও আকাল, আর পশ্চিমারা সিংহাসনে বই হা দোলার। কারে কাছে দুঃখের কতা কই হরান জুড়াইয়ুম কন চাই মাষ্টার। দেইখতে দেইখতে ভাইঙতে ভাইঙতে সোনার দ্যাশটা ক্যামন ঠুণ্ডা হই গেল। আঁঙ্গ দ্যাশের পশ্চিমাদের দোসররা এই সার কথাখান বুইঝত হারেন না, হেতারা আঙ্গ দ্যাশের ধন সম্পত্তি লুডি লই হেতাগো দ্যাশের সিন্দুক ভর্তি করের। অন না বুইঝলে আর কবে বুইঝব। হিন্দু মুসলমান করি করি আঙ্গ দ্যাশটা একবারে উচ্ছন্নে গেল, আর বাকি হরিচয়খান ধুলায় মিশাই দিল। এই জাতটারে কে বাঁচাইব, বেঘোরে মইরব। ইঁংরাজরা যাইবার কালে মারি দি চলি গেছে, পশ্চিমারাও হেই কামাই করের।
এরম করি কইয়েন না ভাবী, বুয়ের ভিতরে চিন চিন করে। তবে আমনের ভাবনার প্রশংসা না করি হাইরতাম ন। এত বোঝেন ক্যামনে কন দেখি।
বুঝি মাষ্টার বুঝি, কত কতাই বুঝি, খালি হোনাইবার লোক হাই না।
ওমা, এরা যায় কনডাই, তাইলে একটা সুরাহা হইল। মাইনষের মনে দ্যাশের লাই হরান কাঁইদল। ভালা লক্ষণ কইতেই হয়। কোনমুই যামু। কুরবান আলী, আকবর, প্রতাপ, অমূল্য, মনসুর আহমদরা জোরে জোরে হা চালায়। হেগুনরে যে চিল্লাই জিগাইয়ুম হেই সুযোগ নাই। চাষের কাম ছাড়ি, বদইলার কাম ছাড়ি, দোয়ান বন্ধ করি, ইস্কুলের হড়া বন্ধ করি গলা হাডাই কত কী দাবির কথা হোনাইতে হোনাইতে ওরা চলি যার। কারে হোনার আর কেই বা হোনের হেসবের তোয়াক্কা করের না। ওরা নাড়া মাড়াই যার, বৈশাখ মাসের চড়া রোদ খাইতে খাইতে যার, উদোম গায়ে একজন অন্যজনের হাতের উপরে হাত রাখি যার, বাঁইচব কি মইরব এই কতা আর কারই বা জানা। হাঁইটত হইব, মাইলের পর মাইল হাঁইটত হইব, কোনো এক ডাক হেগুনরে চুম্বকের মতো টানি লই যার। হতের কথা হুইনত না তো কার কতা হুইনব। এত অন্যায়, এত অবিচার, এত ব্যাভিচার নামি আইছে অন যদি গলা না মিলায়, তবে আর কবে মিলাইব।
আঁর স্বামীর চিন্তা বাড়ছে, হোলাডারে আর ধরি রাইখত হারেন না। হেতে লুকাই লুকাই মিছিলে মিছিলে হা মেলার, শহরের রাস্তার মোড়ে মোড়ে বক্তিমা করের। হুনিয়ের আওয়ামী লীগে নাকি নাম লেখাইছে। চিন্তায় চিন্তায় আঁর ঘুম আইয়ে না, বড় হোলা কইলকাতায়, হেতে বাস্তুহারা আন্দোলনের নেতা হইছে। আঁঙ্গ দ্যাশে এই হোলা বঙ্গবন্ধুর ডাকে ছুডি যার। কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক মিলাইতাম হারিয়েন না। যে মুসলমানের হোলাগুন ওর বাবারে গাইল দেয়, কতায় কতায় মালাওন বলে,মুসলমানের দ্যাশ বলি গলা উঁচা করি ঘোরে, হেগুনের মুয়ের উপর জবাব দিবার লাই কি বঙ্গবন্ধুর দল ওর এত হচন্দ। যে হোলা কোনদিন রা কাইরত না, হেই হোলা ক্যামনে এত কতার জবাব দেয়, বঙ্গবন্ধুর এলেম আছে কইতে হয়। এট্টুখানি নাতির কথা ভাবি ভাবি আঁর হৌড়ি খানাদানা ছাড়ি দিছে, শরীলখান হুয়াই আমসি হই গেছে, আঁই তাকাইতাম হারি না, কত তোষামোদ করিও তালে আইনতাম হারিয়েন না। আর এক চিন্তা আই মাথার উপর চাপি আই বইছে। বাড়ির হোলাগুনও তাঁতি উঠছে। ইসকুল তুন আইবার সময় কত কতা হোনে আর হিগাইন কলম দোয়াত লই হিষ্টা ছিঁড়ি ছিঁড়ি লেয়। আঁর তো মাথায় হাত। মোল্লা হাড়ার হোলাগুনও আই হেগুনের কানে ফিসফিস করি কানে ফুসমন্তর দেয়। হেগুনের বাপেরা বলা কওয়া করে – আঙ্গ যে ঘর গেরস্থালি ভালা ন, দুবেলা হেঢে ভাত হড়ে না, হিগাইনের লাই পশ্চিমারা দায়ি, জোচ্চুরি করি লই যার বেগ্গাইন, অধিকার ছিনাই লইত হইব, হক্কলে প্রস্তুত হ। বঙ্গবন্ধু হক্কল বাঙালিদের এক হইবার লাই কইছে।
বুইঝতাম হারিয়ের আর একখান ঢেউ আইয়ের, হক্কলে এক জোট হনের লাই কোমর বাঁধের।
মনের ঘরে মানুষ খোঁজে কোন জনা
ওরে তোরা খুঁজবি কখন আপন ঠিকানা
কত দিন তো গেল, কত রাইত তো গেল, বড় ঘরটা টুকরা টাকরা হল। বড় হাঁড়ি বড় কড়াই ছোট হইতে হইতে আরও ছোট হইল। লম্বা চিড় ধইরছে কন একতাখান কেউ কইত হারে নি। কইব কি, দেয়ে ন তো কোনদিন। ভিতরে ভিতরে যে হাল্টি যার, নতুন নতুন গন্ধ আই হক্কলের ঘরের কোণায় কোণায় জমা হর, হেইডা টের হাওন যার না যে আর। খালি চোয়ে দেয়া যায়, হুরান কাঠ যিগাইন ঘুনে ধইরছে, যার ভাগে যে কাঠাল গাছ হইড়ছে, হিগাইন চিরাই হাল্টাহাল্টি হইছে হেই কাঠ, তাইতে ঘরের সৌন্দর্য বাইড়ছে ঠিক কথা, হুরান ঘ্রাণ, হুরান ভাব উবে গেছে এট্টু এট্টু করি। হেই হরিবর্তন এত সূক্ষ্ম যে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যন ধাক্কা মারে তন ধাক্কা মারে। বড়া উঠান খান দেয়া যার, আবার দেয়া যায়ও না। খড়ের গাদা ইয়ানে হিয়ানে নতুন করি গজায়। তুরুল হোকা যে মাডি ফুডা করি বার হয় হেইডা আর কে নজর করে। ঘরের মাইঝখানে মাইঝখানে এত পার্টিশন হইলে কার এত দরকার হইরছে গরজ করি চাইব। তবুও কি আকাশের রঙ হাল্টায় না, হাল্টায় তো। তনই তো শুরু হয় আকাশের কোলে কালা মেঘের খেলা। আর ইয়ানে তো আকাশ নয়, স্যাঁতলানো মাডি, হিচল খাইলে আর রক্ষা নাই। দ্যাশভাগ হইছে কমদিন কী হইছে! মনে থাইকবার কথা কি ? সেঝ দেয়রের হৌড় বাড়ির দিক তুন লতায় পাতায় আত্মীয় চম্পক কোন বাইচ্চাকালে বেড়াইতে আইছিল। চম্পকের দুষ্টামির জ্বালায় অতিষ্ঠ হই আঁর হৌড়রা হেথেরে আর রায়নের সাহস করে নি। অন এতদিন হরে ইন্ডিয়ার তুন আই অচেনা মানুষটা হরিচয় দেয় চম্পক বলি। ইনায় বিনায় এমন গল্প ফাঁইদল বেগ্গুনের চোয়ের জল বার করি ছাইড়ল। হক্কলের মনের মধ্যে একটাই হশ্ন হেথে অত দূর তুন বর্ডার হার করি আইল ক্যামনে যন আঙ্গ দ্যাশে টালমাটাল অবস্থা। হিন্দুদের হায়ের তলার জমি দিন দিন সরি যার। দ্যাশের জন্য ওর দরদ নাকি উথলি উইঠছে। দেশভাগের সময় মুসলমানরা ওর বাবা মা কাকারে কচু কাটা করি নদীর জলে ভাসাই দিছে, অনেক খোঁজাখুঁজির হরেও ভাইয়ের খোঁজ হায় ন, জাইনত হাইরছে হেথাগো বাড়ির অন্য মাইয়াদের যে দশা হইছিল বোইনটারও হেই দশা হইছে, নিজের মুয়ে হেই লজ্জার কথা হেতে আর ক্যামনে কইব।
এই তো দেইখছি উল্টা হুরান। দ্যাশ তুন হলাইবার লাই যুগী বাড়ির দুই ঘর গোপনে শলা পরামর্শ চালার। হুইনতেছি অল্পস্বল্প যা চাষের জমি আছে রায় বাবুদের মেঝ হোলা আর ইব্রাহিম মোল্লার কাছে জলের দরে বিক্রিও করি দিছে বুদ্ধি করি চুপিচুপি। এই দুইজনের খাতিরের কথা কে না জানে। একজন হইল ধানের কারবারি আর একজন হইল ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার। হেথেনদের উপর কথা কইব কার এত বুয়ের পাটা। ঘরদোর ভিডা ছাড়ি চলি গেলে কে কব্জা কইরব কে জানে। অন কতা হইল চম্পক উইঠব কনডাই। সেঝ দেওরের ভাগে যে তিনখানা ঘর, হোলা দুইডা বড় হইছে, এক ঘরে থায় আর বাকি দুই ঘরে স্বামী স্ত্রী আর মাইয়া। আগের দিন হইলে না হয় কতা ছিল, এক লগে ঘর ছিল, কোনো এক ঘরে না হয় জায়গা হই যাইত। দিনকাল হাল্টি গেছে, অন যার যার তার তার, কে আর আগ বাড়াই দরদ দেখাইব। তবে কিনা চম্পকের গপ্প গ্ৰামশুদ্ধ মাইনষের মধ্যে ছড়াই গেছে। সন্দেহ দানা বাঁইধতে দেরি হয় না এই চম্পক আসল চম্পক কিনা কে কইব, হেই কবে দেইখছেে, শেষে ঘরে থাইকত দিই আর এক বিপত্তি।
গোয়ালঘর আর কাঁচারিঘরের মাঝখানে একখান ঘর আছে। দলিল মিঞা গরুগোতান আর বাগান দেখভাল করে, হেতে দিনেদুপুরে হেই ঘরে ভাতঘুম দেয়। গরুর গোবর আর চনার গন্ধে ঘরে থাওন যায় না। দলিলের গোয়াল ঘরের গন্ধ ত্রিশ বত্রিশ বছরে গা সয়া হয়ে গেছে। এর তুন ভালা গন্ধ কিছু হইত হারে হেতের কল্পনায় আয়ে না। অবস্থা বেগতিক দেই হেতের মাথায় একটা বুদ্ধি আইল। বইলব কি বইলব না করি বলিই হালাইল।
বাবু ছোট মুয়ে একখান বড় কতা কই। চম্পক বাবু না হয় আঁর ঘরে থাক। আর দেওর কইল, এইডা দলিল তুই ক্যামন কথা কস? তোর কোনও মুয়ের ট্যাকস নাই! দলিল মাথা নিচু করে দাঁড়াই থাইকল কিছুক্ষণ। ভালার বুলি কতাডা হাইড়ল, হেই কতার যে এমন মানে হইব কে জাইনত। চম্পক হড়ি গেল বিপদে।
দ্যাশের মায়ায় হড়ি চোরাহতে দ্যাশে হিরল, ভাইবল কোনও না কোনও একটা থাইকবার জায়গা জুডিই যাইব, এমন টানাটানি হইব জাইনলে দ্যাশেই আইত না। আত্মীয় স্বজন যে এমন হর হই যাইব, হেই কথাডা তো কষ্মিনকালেও ভাবে নি। চেনা দ্যাশটা দিনে দিনে অচেনা হই গেছে হেতের কাছে। আঁইও চম্পকরে যে সান্ত্বনা দিমু তেমন কোনও উপায় খুঁজি বার কইরতে হাইরলাম না। আঁর যদি বাড়তি ঘর থাইকত, দিতাম ওরে ঠাঁই। ঠেস দিই বই রইল হর্মুলের মাচায়। মচর মচর শব্দ হয়, আর হেতে হিচ মোড়া হই গা চুলকায়। দলিল মিঞা হুক্কা খায় আর ধোঁয়া ছাড়ে। আঁই কত চেষ্টা চরিত্র করি ছাল ছাড়াইবার লাই, হারি না, আরও বেশি করি সংসার আই আঁরে বেড়াই ধরে। না হয় কত চেষ্টাই তো কইরলাম, হাড়া হতিবেশীরে ভালোবাসুম, হরেরে আপন করি লমু, হাইরলাম কই, কে যেন আঁরে কয়, লক্ষ্মণরেখার বাইরে যাইস না কিন্তু, মনের মধ্যে যে এত গিঁট আছে, হিয়ের লাই এনা বারে বারে উষ্ট্রা খাই। না হইলে চম্পকরে কইতাম হারিয়েন না কিল্লাই – চিন্তা করিও না আঁই তোঁরে একখান ঘর বানাই দিমু। দলিল মিঞা গলা খাকারি দেয়, কী যেন কইত যাইও দম আঁটকাই আইয়ে। শেষমেশ ঢোক গিললাম মনের কতাডা সাহস করি কয়, দাদা, আমনে আঙ্গ বাড়ি থাইকবেন। বাড়ির হুরুষরা মাইয়ারা হক্কলের এই কথা হুনি মাথায় বাজ ভাঙি হড়ে। এমন একখান কতা দলিল কইত হাইরল। দলিল বুইঝত হাইরল কতাখান হাড়ি হেতে বড় অপরাধ করি হালাইছে, বেআক্কেলের মতো কতা কিনা। দলিল মিঞারে এমনিতে হক্কলে আপনই ভাবে, হেতের দুঃখে মনও কাঁদে, মোসলমান বলি কোনো তফাতও করে না। কিন্তু যে কতাখান হেতে কই হালাইছে এর অর্থখান কী জানে! আঁই খালি ভাবিয়ের চম্পক এই কতাখান কেমন করি নের। চম্পকরে যদি কলমা হড়াই মোসলমান বানাই দেয় হক্কলে মিলে তন কী হইব! আঁর নিজের মধ্যেই ক্যামন হইতে লাইগল। হেতে তো কোনও খারাপ কথা কয় ন। হক্কলে যন তাড়াই দিত চায়ের হেতে তো বুয়ে টানি লর। কারও মুয়ের তুন যন কোনও কতা বার হন না তন আঁইই কইলাম আমনেরা হক্কলে আর একবার ভাবেন, চম্পকরেও ভাইববার অবসর দেন।
দলিল মিঞার প্রস্তাবে যে দোটানা তৈরি হইছে হের সমাধান দূর অস্ত। তাইলে চম্পক থাইকবার জায়গা না হাই হিন্দুস্তানে হেরত চলি যাইব? দ্যাশের মাটির টানেই তো হলাই আইছে ; এই কতাখান আপনজনরা ভাইবত ন একবার। যেতেরা সম্পর্কে আত্মীয় হেতেরাই মুখ হিরাই নিছে অন্যরা ভাইবত যাইব কোন দুঃখে। তার হরেও কতা থাকি যায়, এই যে আঙ্গ দ্যাশে হিন্দুরা বিপদে আছে বলে চেঁচায়, চম্পকের বেলায় এত দরদ কনডাই গেল! যুগী বাড়ির পরেশ আই খবর দিছে, মাঝ রাতে কারোগরে কিছু না জানাই না হোনাই বিভূতি আর নান্টুরা শলা পরামর্শ করি মাঝরাতে বাড়িঘর ছাড়ি চলি গেছে ভারতে। বিলোনিয়াতে হেতাগো আত্মীয়স্বজন আছে যারা ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময় চৌমুহনী তন কোনরকমে হরান বাঁচাই হিয়ানে জমিজমা কিনি আছে। হোনা যায় হিয়ানে যাই মাথা গুঁইজব। পরেশ কয়, জেডি, এক কাম করেন যত দিন না অন্য কোন বন্দোবস্ত না হর, হেথাগো ঘরখান তো খালি হড়ি আছে, চম্পক না হয় হেই ঘরে থাক। কতাটা পরেশ কেবল খারাপ কয় ন। চম্পকের মনে দুঃখ হইল। শেষমেশ, জানা নাই হোনা নাই এমন বাড়িতে বাস কইরত হইব; বড় আশা ভরসা করি আইছিল কিনা। চম্পকের লগে আঁইও গেলাম। ঘর দুইখানার অবস্থা দেই চোয়ের জল আর ধরি রাইখতাম হারিয়েন না। জানলা দরজায় মাকড়সার জাল বিছাই আছে। তেলাপোকা গা’র উপরে আই আছড়াই হড়ে। টিকটিকির গু হারা ঘরে দেই শরীল ঘিনঘিন করি উডে। হায় ভগবান এমন ঘরে হেতে থাইকব কেন্নে!
হশ্নটা এইখানে নয়, নানা হশ্ন আরও মাথাচাড়া দিই উডের। চম্পক যুগীদের বাড়িতে কেন্নে থাইকব। হেতাগো আঁচার ব্যবহারের লগে চৌধুরীদের টক্কর লাইগব কতায় কতায়। কেউ মানিও লইত ন। তবুও নাই মামার চাই কানা মামা ভালা। এমন একখান জাত সংকটে যে হড়ি যাইব, কোনদিন ভাইবত হাইরছে নি। ভালারা বুলি জন্মস্থানে থাইকব বলি হেরত আইছে, দ্যাশের মাডি, আলো বাতাস গায়ে মাইখব বলি মনডা উদাস হই গেছিল, কেউ যে অন এমন করি মুখ হিরাই নিব, কে আর জাইনব। চম্পকরে আর কে খাওন দেয়। আঁই ভাত তরকারি রাঁধি দলিল মিঞারে দিই হাডাই দিই। দলিল মিঞা কয়, হেতেনে হুয়াই কাঠ হই গেছে, চোয়ে দেওন যায় না। কিছু একখান কাম করি খাইত হইব তো, বইয়াই বইয়াই কদ্দিন আর কে খাওয়াইব। চম্পক এমাথা ওমাথা ঘুরি ঘুরি বেড়ায়। শেষমেশ ঠিক হইল আঙ্গ জামাইয়ের দোয়ানে খাতা লেওনের কাজ কইরব। চম্পক ভারতে থাওনের সময় বাড়ি বাড়ি ঘুরি ঘুরি ছাত্র হড়াইত; হেতের কী এই কাম পোষায়! ভাগ্যের লিখন কে আর খণ্ডাইব। যুগী হাড়ার রতন আঁঙ্গ শহরের বাড়িতে মাস মাহিনায় ঘরের কামকাজ করে। হেতে গাল গপ্পে কত কথা কয়।
হুইনছেননি জেডি চম্পকদার চালচলনের কথা। দোয়ানে যায় না, হাগলের মতো গান গাই বেড়ায়। হোলামাইয়াগুন গান হুইনবার লাই হেথেনের হিচন হিচধন ঘোরে। আঁই ভাবি এই হোলাডার হইলটা কী! একলা হই যাই মাথাটাথা খারাপ হই যায় ন তো। এত প্রশংসা হুনি হেতের গান হুইনতে গেলাম। বেডার গলায় নাকি সুর আছে। আমরা তো গান হুনি ; হেই গান হুইনতে হুইনতে রাইত হই যায়, ত্রিনাথ ঠাউরের গান – ও তিন পয়সাতে হয় তার মেলা, কলিতে ত্রিনাথের মেলা। এক পয়সার সিদ্ধি দিয়ে তিন কল্কি সাজাইয়া, গাঁজায় মারছে দোম, বো বোম্ বোম্, বোবোম্ ভোম্ ভোম্, ভোম্ ভোলা।। হেথে আবার কী গান গায়। খঞ্জনি বাজাই গান গার। হেই গানের কলি মাঠঘাট বন বাদার টপকাই চলি আই আঁর কানে বাজে –
হিন্দু আর মুসলমানে, মিলন ছিল প্রাণে প্রাণে
পরস্পর সুখে দুখে সাথী।
উৎসবে কি পালাপার্বণে, নানারকম বাদ্যগানে
আনন্দে কাটাতাম দিবারাতি।
আহাঃ কী গাইল চম্পক! হরান জুড়াই গেল। মনে হইল চুপ মারি বই থাই। হক্কলের অনুরোধে আর একখান গান ধইরল –
সময় গেলে রে ও মন সাধন হবে না।
দিন ধরিয়ে তিনের সাধন কেনে করলে না ।।
জানো না মন খালে বিলে
মীন থাকে না জল শুকালে
কি হয় তারে বাঙ্গাল দিলে
শুকনো মোহনা ।।
আঁর এইডা বুইঝতে দেরি হয় ন, কিয়ের লাই ও হিরি আইছে। মনের আগুন আর গান ছাড়া কে নিভাইব। বুঝিয়েননা মাইনষে কিয়ের লাই ছন্নছাড়া কয়। আহারে আঁর সুযোগ থাইকলে হেথেরে আঁই হিয়ানে হালাই রাইখতাম না। মানুষ মাইনষের মনই চিনল না, কেবল শরীল লই টানাটানি করে। চম্পকরে লই পশ্চিমাপন্থী মোসলমানরা ক্ষেপি যাই যা নয় তাই চার গ্ৰামে হচার করা শুরু করি দিছে – হালার বেটা হালা মালাউন, ভারতের চর, ইয়ানে আই গাঁড়ি বইছে, হেথেরে আচ্ছা করি সবক শিখাইতে হইব।
কতাগাইন হচার করার আগে হেতেরা ভুলি গেল চম্পকরে কারা বাড়ি ছাড়া কইরছে, হেতের বাড়ি কারা অন দখল করি বই আছে। হিরাই দিব নি হেতের অধিকার। কেউ দিতে হাইরত ন এর উত্তর। উল্টা থানার মাধ্যমে সরকারের কাছে খবর গেছে হেতেরে যদি গারদে না হোরে গ্ৰামের বিপদ বাইড়ব। এই বিপদে কে বাঁচাইব ওরে। আওয়ামী লীগের এক নেতা রহমত আলী আই মাথায় হাত বুলাই আশ্বাস দিল – কোনো চিন্তা করিয়েন না আমনেরা আঙ্গ দল চম্পকরে রক্ষা কইরব। ব্যাপারটা যে এত সোজা হইত ন, আঁই জাইনতাম। মুসলিম লীগের নেতাকর্মীরা হুকুম দিই গেছে, ‘তোরা যদি হেতেরে না তাড়াস, যুগী হাড়ার দফা রফা করি দিমু আমরা। হেগুনরে কে বুঝাইব হেথাগো সন্দেহর কোন প্রমাণ আছে নি। দোষটা হইল হেতে ওর নিজের দ্যাশে থাইকত আইছে। বুক ঢিপ ঢিপ করে বেচারার কন আই কোতল করি দিব। যুগী হাড়ার মাতব্বর স্বপন আই হুনিয়ে গেছে উল্টাসিধা কতা ।
তোর লাই আঙ্গ বিপদ হই যাইব, বাড়ি ভাঙচুর কইরব, তুই রাইতের বেলা হলাই যা। তোরে একটা উপায় কই দি, যদি হরানে বাঁইচতে চাস, তাইলে ইউসুফ মাষ্টারের বাড়ি চলি যা।
মাষ্টার হুইনছি ভালা মানুষ, হেতেনেরে আঁই কেন্নে জানিহুনি বিপদে হালাই কন চাই।
তাইলে গুলি খাই মর।
দলিল মিঞা কইল, বুইঝলাম, আমনেগো জাতের কেরামতি। হিল্লাই তো আঙ্গ জাতের মাইনষে আমনেগো ঘরছাড়া করে। কোনো একতা আছেনি আমনেদের, একটা ভালা মাইনষেরে জায়গা দিতে হারেন না, হেতারা আই ধমকাইল আর ডরাই গেলেন। আমনে আঁর বাড়ি চলেন। দেই কার বাপের কত খেমতা আছে আমনের টিকি ছোঁয়।
রাতখাইন কাইটল কোনোমতে। যাই উইঠল দলিল মিঞার ঘরে। বিপদ বলে বিপদ, আর একটা উড়া কথা আই চাউর হই গেল। চম্পকের বোইন স্বপ্নার খোঁজ হাওন গেছে। বেডি কার কাছ তুন খবর হাইছে চম্পক দ্যাশে আইছে। হের তুন হেতির মন উচাটন হই গেছে কেন্নে দাদার লগে দেয়া কইরব। মোসলমানের ঘর তুন কেন্নে কেন্নে হলাই যাই অন্য জেলায় এক হিন্দুর ঘরে আশ্রয় হাইছে। হাইলেই কী হইছে, বদনাম তো ঘোচে ন, হিচন হিচন তাড়া করি মাইরছে। মাইয়া কেন্নে কেন্নে আই আঁঙ্গ বাড়িতে আই হাজির। হিগাইন লই কত কথা। ইগাইন কিচ্ছু হইত ন যদি না চম্পক আই এই দ্যাশে উইঠত। দাদারে না দেই তো আর থাইকত হারে না। হেতের লাই বোইনের শনির দশা, রাহুর দশা এক লগে আই ঘেঁডি চাপি ধইরছে। স্বপ্নার আগের জীবন লই মুসাবিদার শেষ নাই। মা বাপ হারা এই মাইয়ারে ঘরে উডাইবার আগে প্রায়শ্চিত্ত কইরত হইব, মোছলমানের ঘরে থাইকছে। হুরোহিতের বিধান না মাইনলে সমাজে থাকা চলে না। গ্ৰামের মাইয়াদের ভেতরের কতা জাইনবার লাই কত আকুলি বিকুলি, কর্তাদের কতা আর কি কমু, হাইরলে মাইয়ার হেডের নাড়িভুঁড়ি বার করি হালায়। বেচারি এক কোনায় বই নিজের ভাগ্যের উপর দোষ দিই কপাল চাপড়ায়। ভাইবছিল এদ্দিন বাদে দাদার মুখ দেইখব, দাদারে জড়াই ধরি বেবাক জমানো দুঃখ কষ্ট জুড়াইব, দাদারই এতাগো বাড়িতে জায়গা হন অ, হেতির গায়ে তো কত গন্ধ।
স্বপ্নার জায়গা হইছে গোলা ঘরের এক কোনায়। মাইয়া মানুষ কনডাই আর যাইব এমন দোহাই হাড়ি নয়, হিন্দুর মাইয়া বেঘর হইব, কর্তারা এই চিন্তাতেও তাড়াই দিতে হারে ন। ঝিগিরি করি হেতির দিন কাটে। এদ্দিন হইল, দাদার মুখ দেয় ন। দলিল মিঞাদের ঘরের বার হইলে শাস্তির খাড়া নামি আইব, হেইডা তো আর অজানা নয়। পশ্চিমাদের লোক শকুনের মতো ঘুরি বেড়ার হিন্দুর বাড়ি বাড়ি, সুযুগ হাইলেই ঝোপ বুঝি কোপ মাইরব। বোইনের আওনের খবর চম্পকের কানেও গেছে। বোইন যে বাঁচি আছে এইকথা হইলা ওর বিশ্বাসও হয় ন। হেতির লগে বাড়ির বউঝিরা মন খুলি কথাও কয় না। খালি মনে হয় জীবনটা কি হরের খিদমত খাডিই চলি যাইব। কত কতাই হেতি আঁর কাছে কয়। স্মৃতি মনে হেথিরে কুরি কুরি খায়।
যেদিন কলমা হড়াই হেতিরে মুসলমান বানাইবার চেষ্টা কইরল, এক হোলার লগে বিয়া দিব ঠিক কইরল, হেতাগো বাড়ির এক চেনাজানা দাদাই হেইদিন মাঝরাতে লুকাই সাত আট মাইল দূরে এক হিন্দু গ্ৰামে হাডাই দিল।
আঁই মুসলমান হইনি গো, দেয়ন চাই জাতে তুইলবার লাই আমনেরা প্রায়শ্চিত্ত করাই ছাইড়লেন।
কইতে কইতে স্বপ্নার চোয়ের জলের বান আইল। আঁই কইলাম, তুই যাবি নি বৈষ্ণবদের আখড়ায়, তোর মন ভালা হই যাইব। নিতাই-গৌর রাধা-মাধবের বন্দনা হয় হিয়ানে। দেইখবি নি ক্যামন সুন্দর গুণ গুণ করি গান গাইছে, হাখিদের ডাকেও হরেক রকমের সুর, হক্কলের মনের কথা মিলিমিশি একাকার –
দেখে যা নাগরী তোরা কি রসের গৌরা।
গৌরা হাসে কাঁদে নাচে প্রেমে, মুখে বলে রা রা রা ।।
সুরধনীর কুলে কুলে, নাচে হরি হরি বলে,
যারে দেখে তারে বলে, নাম নেই রে তোরা ।।
দলিল মিঞা স্বপ্নারে সান্ত্বনা দেয়, দিদি আমনে কাঁদিয়েন না। আঁই কতা দিচ্ছি, আমনের ভাইয়ের লগে আইজ না হয় কাইল দেয়া করাইয়ুমই করাইয়ুম।
স্বপ্নার ঘোর কাডে না। দিন রাইত এক মনে হয়। কত ছায়ারা ঘুরি বেড়ায়; হেতাগো বাঁধন টপকাই যাওন এত সোজা কতা ন। চম্পক পশ্চিমাদের খপ্পরে হড়ি গেলে ওরে আর কে বাঁচাইব, হেতাগো রাজত্ব চইলছে। ভয়ে চিমসাই আছে। দুই কলি গান যে গাইব তারও জো নাই। মনের দুঃখ ক্যামনে চাপি রাইখব। দলিল মিঞার বউ রুকশানা বিবি যত্ন আত্তী করে এমন করি যাতে হর না ভাবে। রুকশানা কয়, যদি একবার লীগের মেম্বাররা জাইনত হারে, আমনে চম্পকদারে জায়গা দিছেন, আমনের মুণ্ডু চটকাইব। হুইনলাম হিন্দু হাড়াতে ঘোষণা দিছে, ‘কেউ যদি ভারতের চরেরে ঘরে থাইকত দেয়, আল্লার কসম তারে দ্যাশছাড়া করুম।’ আমনে কিন্তু হুঁশিয়ার হই থাইকবেন। হিন্দু বাড়িতে গরু গোতান সামলান, চাষবাসের কাম করেন, হেতাগো চোখা নজর আছে। অবস্থা বেগতিক দেখি আঁই হরামর্শ দিলাম, বিপদ বুইঝলে তোঁর খালাতো ভাই বুলি হরিচয় দিও।
আমনে হুদা হুদা চিন্তা কইরতেছেন, কারও আব্বার সাহস নাই আঁর সামনে দাঁড়াইব, সাচ্চা মোসলমানের বাচ্চা আঁই, বেইমান নয়। হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই। দলিলের চোখ মুয়ের ভঙ্গি দেই মনে বল হাই, ভাবি, নিজের দ্যাশ ছাড়ি কনও যাইতাম ন। মইরতে হইলে ইয়ানেই মরুম।
দলিল মিঞা কয়, দিদি হা চালাই আইয়েন, ভয় হাইয়েন না, আঁই আছি তো আমনের হাশে। আঁই স্বপ্নারে সাহস যোগাইলাম, যা স্বপ্না যা, নিজের দাদারে দেই আয়। আঁই চাই থাইয়ুম তোর লাই। স্বপ্নার চোয়ে মুয়ে আনন্দ, এক যুগ বাদে দাদারে দেইখব, বুকের মধ্যে ভয়। ভরা আঁধার, ডালে ডালে হাখিরা চুপ মারি আছে, হুইরের হাড়ে জঙ্গলের মধ্যে হিয়ালরা কোচর মোচর করে। স্বপ্না বেতাল হা চালাই চলে। জমিতে জমিতে সবুজ রঙে আঁধার ডুব দিছে। দুই মাইল পথ হার করি যাওন তো সোজা কথা নয়। জলা জঙ্গল খাল বিল আরও কত মরা রাস্তা হার করি যাইত হইব; দলিল মিঞা হত্যেক দিন এমন করি আইয়ে, এমন করি যায়, হেতের জীবনের ত্রিশটা বছর ঝড় বৃষ্টি রোদে হার করি আইছে আর আঙ্গরে দিছে বালতি বালতি গরুর দুধ আর গোলা ভরতি করি ধান। দলিল মিঞা লাফাই লাফাই চলে, চেনা হতে হাঁইটতে কত না মজা। আইজ যেন এট্টু অন্যরকম, স্বপ্নার দুঃখটা হেতে হজম করি নিছে বোধ হয়।
আয়েন দিদি আয়েন, হা চালাই আয়েন, মোটেও ভয় করিয়েন না, আঁই আছি তো। স্বপ্নার অবস্থাখান বাঁধা গরু ছাড়া হাইবার মতো। খালের জল চলাচলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হোনে। এত রাতে কারা এমন করি ভাবনারে ভাঙি চুরমার করি দেয়। থৈ থৈ জল, থকথকে হেঁক। ভেয়াল জাল হালাই টঙ্গির উপরে বই ঝিমুয়, জেলে হুঁকো টানে, এই বুঝি কেউ আইল। স্বপ্না যেন দূর গ্ৰাম তুন নাইয়ুর যার। অন্য সময় হইলে জিগাইত, ‘আইয়ে কইথুন, যাইব কোন ঠাঁই’। আইজ কোন হিসাব মিলের না। কোনটা স্বপ্নার দ্যাশ, কোনটা নয় ঠিক কইরব কে? কত জীবনের আড়ালে জীবন, কত ঘরের আড়ালে ঘর, হেই ঘরে বই চম্পক নিজের ঠিকানা খুঁজি মরে –
আমার গেল রে সব ভরসা, আর নাই আশা,
সর্বনাশা দরিয়ার পেটে।
আমার সোনার ক্ষেত ভাঙ্গিয়া করে নোনা জলের চর,
অসময়ে ভাঙল আমার অতি সাধের ঘর।
কে ধইর্ব হাল দ্যাশে উথাল হাতাল
মাইন্ষ্যে কয় ডর নাই, অইব না বেহাল
আঁঙ্গ দ্যাশের হিন্দুরা যে হামুকের খোলসের মত নিজেরে গুডাই হালার এইডা তাদের মিন্মিনানি দেই টের হাওন যার। মনের মইদ্যে বেকের আশংকা কী অইব, কী অইব, কোন হঁতে আগাইলে এই দ্যাশ, দ্যাশ থাইক্ব, ভাব্নাডা ভাব্নাই থাই গেল। চাইরহাশে শুধু আঁন্দার আর আঁন্দার, মনের ভিত্রে আঁন্দার বারে আঁন্দার, ইয়ের লাই কই মানুষ চইল্ছে না, চইল্ছে, বেবোলা অই যার দিন দিন, আগা নাই মাথা নাই, উল্টাহাল্টা বকে যিহানে, হিয়ানে। জিগ্গাই যদি কী কও, উত্তর আইয়ে, কিছু কইনি ত। আঁর মগজে ক্যান যে কত খেলা খেলি যার, নিজেরে কিছু বুজাইতাম্ হারিয়েন না, এরুমডা অর কিয়ের লাই। আঁর এক বেয়াই কয়, আম্নে বেশিই ভাবেনের বেয়াইন, যেমন চইল্ছে ঠিকই চইল্ছে, কোনও গড়বড় নাই, চুপ থান্ দেই। হ্যাতেনে কী করি বুইজ্ব, এরুম এরুম সময় আইয়ে চুপ থাইক্তে চাইলেও চুপ থায়ন যায় না। মাইন্ষ্যের হাবভাব দেই হ্যাতেরা বুজি কিছু বুইজ্তেই হারেন না, আশ্চর্যের কতা ত! আরও চম্কাই যাওনের কতাহান অইল, কতার হিডে কত রকমের কতা বয়াই দের, এত হাবিজাবি অই যার, আসলে যেইডা কইত চায়, হেইডা আর কই উডি হারেন না। দ্যাশের নেতারা কী ঠিক করে, হেইডাই বা বুইজ্তাম কী হারি, হ্যাতেনরা কি হাঁচা কতা কর, না মিছা কতা কর, হেইডাই বা ক্যাম্নে বুজুম। হ্যাতেনগ আবার কত জ্ঞানগম্মি, হেরুম কী আঁঙ্গ আছে? হুইন্তে হয় হুনেন, না হুইন্তে চান, হুনিয়েন না, এরুমই ত মেজাজ মর্জি। যাই হোক হেইডা আঁঙ্গ গ্ৰামের বিষয় ন, তয় কিনা মেঘনা নদীর ঢেউ খাল বাই বাই হুইরে হাঁদাই যার, হিয়ানে আমরা ছেন করি, ডুবাই ডাবাই, হেই জল হ্যাডে হাঁদাই যায় না, যায় ত। তাইলে ক্যামনেই বা কই আমরা চখমুখ বন্দ করি রাইয়ুম্।
আওয়ামী লীগের নেতাগ মনে কী চইল্তে আছে, হ্যাতেনরাই জানে। খেজুর গাছের নলির তুন্ বেক্ রস কি আর আঁড়িত্ হড়ে, কত রস চুয়াই চুয়াই গোড়ায় হড়ে, তার ঠিকানা আছে নি। হ্যাতাগ বেক্ কতা কি আর আঁঙ্গ সদর দরজায় আই হৌঁছায়, কত কতা মুহে হিরি হিরি মাইজ রাস্তায় গড়াগড়ি খায়, অত আর কেউ ইসাব রায় নি। এক কোনায় হড়ি থাই আমরা, দুইন্নাইদারি কোন মুই ছোডের, কেরুম হেইডার ইশারা, বুজন ত যায় না। তয় এক্কান কতা বুজি মাইন্ষ্যের মুয়েরে হেলাফেলা করন যায় না। হেইডা লই ত দ্যাশের কাইজ কারবার, যেই দ্যাশ দ্যাশ করি আমরা মাথা খুডি মরি। কিন্তু কতাগাইন ইয়ানে শ্যাষ অই যায় না। ওমা হাপেও দেই চুক্ চুক্ করি রস খায়। রসের ভান্ডার ছড়াই ভরাই আছে আনাচ কানাচে, যে যতডা হায়, ছোলায় ভোলাই খায়। কে আর দেইখ্ত যার কে আর কতডা খার। টের হায়, যহ্ন দেয় মাডে হসল নাই, বাজারে আনাজ নাই, দোয়ানে তেজারতি জিনিস নাই, রাস্তাঘাটে গাড়িঘোড়া নাই, ইস্কুলে মাষ্টর নাই, ছাত্র নাই, মাইয়ামাইন্ষ্যের হরনের মত কাহড় নাই, হ্যাডে ভাত নাই। তাইলে কী অইব আঁঙ্গ দ্যাশের, কন্ চাই। এই লই না আঁর অষ্টপ্রহর চিন্তা, হেইডা আর কেউ বুইজ্ল কই। একবার ভাবি বেক্গাইন ছাড়িছুড়ি চলি যাই, বুজি ন হ্যাতারা ক্যাম্নে হা হালার। মিছিলের কতা হুনি না বুজি, হুনি, কিন্তু ভাষা যে বুজি না, কতায় হ্যাতাগ কত ওজন।
হোলারা মাডে ফুটবল খেইল্লে হেই বল ত গড়াবই গড়াইব। দেয়নের বিষয় কোন মুই টপ্কাই চালের মইদ্যে হড়ি ভাঙিচুরি না দেয়। হাল্টি যাওনডা খারাপ ন, কিন্তু যহ্ন দেই আঁঙ্গ সম্পর্কে মাইয়ার এক হোলা চাঁটগা তুন্ আই পটর পটর কতা কয়, তহ্ন চিন্তা লাগে। ওমা হ্যাতে আবার কেরুম ধরনের কতা কয়। আগে ত হ্যাতেরে কহ্নও এরুম কতা কইতে হুনি ন, কতার মইদ্যে ঝাঁঝ আছে, মিষ্টি নাই, রাগ ভর্তি হুরা শইর্ল্যে। হ্যাতেরে জিগ্গাই তর আবার এরুম অবস্থা অইল কিয়ের লাই, কামের জাগায় কোন গোলমাল অইল কিনা। হ্যাতে চুপ করি থায়। গলায় গামছাহান হেঁচাই সদর দরজার দিগে আঁডা শুরু করে। হ্যাতের মা কয়, জানেন ত মাসি শহর তুন্ আই আঁর হোলা হারাক্ষণ মন মরা অই থায়, খায় না দায় না। কয় আর কামে যাইত ন। হ্যাতে এক কাহর চোহরের ব্যবসায় ম্যানেজারের কাম করে, মোডা ট্যাঁয়া রোজগার করে। হুইন্তেছি কর্মচারীরা হ্যাতের বিরুদ্ধে ট্যাঁয়া চুরির অভিযোগ আইন্ছে। বেক্গাইন নাকি মিছা কতা, হাঁসাইবার লাই বদনাম রডাই দিছে। আসল কতা হিয়ান ন। বঙ্গবন্ধুর দলে নাম লেহাইছে বিধায় হ্যাতেরে সরাই দিত চায় মালিক, না অয় যে হশ্চিমাগ দলের কোপে হড়ি যাইব। দ্যাশের যে এরুম দুরবস্থা অইব আগে ত কোনদিন ভাবি ন। আঁঙ্গ বাপ ভাইরা ত কামকাইজ কইর্ছে গদিত্, এরুম দুরছাই ত কোনদিন কেউ করে ন। হ্যাতে কয়, বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন যত বড় বড় শহর তুন্ গ্ৰামেগঞ্জে ছড়াই যার হ্যাতাগ টনক তত লড়ের, আর ত চুপ করি থাইক্ত ন, এই দ্যাশের মাইন্ষ্যের ডানা ছাঁডি দিব । হিন্দুরা আওয়ামী লীগরে সমর্থন করে বলে বাছি বাছি অইত্যাচার করা শুরু করে হিন্দুগ উপ্রে বেশি। বিপ্লবী, ছাত্ররা, বুদ্দিসুদ্দি আছে এরুম মানুষজন হ্যাতাগ চক্ষুশূল। হশ্চিমাগ বাড়া ভাতে ছাই দিতে আছে, আঁঙ্গ দ্যাশের ধন সম্পত্তি লুডি লই যার, এই কতাহান দিন দিন আরও হচার হর দেই হ্যাতেরা হাগলা কুত্তার মত অই গেছে। হেগুনে এম্নে এম্নে ছাড়ি দিত ন, ভাতে মাইরব, হানিতে মাইরব। হিয়ের লাই ত ঢাকা, চাঁটগা, রাজশাহী, ময়ময়নসিংহ লই বাঁই জিলার মানুষজন জোড বাঁধের। তাইলে ত আঁঙ্গরে হ্যাতেরা আস্ত রাইখ্ত ন। হ্যাতের মুয়ে এবার বোল হোডের। না গ দিদিমা, এত সহজে বঙ্গবন্ধু লড়াইয়ের ময়দান ছাড়ি দিত ন। আম্নে খালি দেইখ্তে থাহেন, যা দিন আইয়ের দ্যাশের মানুষ বেকে রাস্তায় নামি হইড়ব। তাতি রইছে, জল হইড়লেই হুইট্ব হট্ হট্ করি। ভাষা আন্দোলন যহ্ন অইছে, হশ্চিমা শাসকরা হাইর্ছেনি উর্দু চাপাইতে, লেজ গুডাই ঘরে হাঁদাই গেছে। দ্যাহেন না, কেরুম হয়। হ্যাতের কতায় আগুন আছে, এই হোলা দেইয়ের কোমর বাঁধি নাইম্ছে, এক্কান হেস্তনেস্ত করি ছাইড়ব। আঁই ভাইব্ছি হ্যাতের মার কতা, যদি ভালামন্দ কিছু অই যায়, হেতির কী অইব।
আঁই আঁর মেজ বইনের বাড়িত্ দিন হাতেক বেড়াই ট্রেইন ধইর্ছি, আঁর মেজ বইনের ছোড হোলা জন্টু আই উডাই দি গেছে। হোলা ত মন খারাপ করি হালাইছে। কতদিন বাদে আইছি আবার কবে আইয়ুম – আবার আমু রে, চিন্তা করিচ্ না। আই ত মরি যাইয়ের না। কতা কইতে শুরু কইর্লে কি আর থামে। গৌরিনাথ মাষ্টররে ট্রেইনে দেই ত আঁই চম্কাই উইঠ্লাম। আঁই ত চাঁন আতে হাইলাম্। কুমিল্লা তুন্ বাড়িত্ যার। ইয়ানে এক ইস্কুলে গৌরিনাথের এক কলেজের বন্ধু মাষ্টরি করে। গরমের ছুডিত্ বেড়াইত আইছে। উল্টা দিগে বইছে এক মাড়োয়ারি, লগে বউ আর হোলামাইয়া। মাষ্টরের বন্ধুডা কতা কইতেছিল। মাইঝ হঁতে কন্ ইষ্টিশনে নামি য্যান্ হিশীর বাড়ি যাইব। দেড় মাইল রাস্তা আঁডি যাইত অইব। মনের আনন্দ চাপা না রাইখ্ত হারি কয়, আঁঙ্গ দ্যাশহান হাঁচা হাঁচা যদি কোনদিন রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা অইত। বাঙালিগ লাই এক্কান দ্যাশ অইত, বাংলা ভাষায় বেক্ কাম অইত, কী ভালাডাই না অইত। রেল হুলিশ কান খাড়া করি হুইন্ল। এরুম করি চখ বড় বড় করি চাইল য্যান্ হাইর্লে অন্ই ভষ্ম করি দেয়। এইডা য্যান্ হরাধিন দ্যাশ, মনের কতা কইবার অধিকারডাও নাই। গৌরিনাথ মাষ্টর রাগ চাপি রাইখ্ত হাইরল না।
হশ্চিম হাকিস্তান কী আঁঙ্গ মালিক, উইঠ্তে বইতে চখ রাঙাইব। হুলিশ ব্যাডার আতহান ইস্পিস্ করি উইঠ্ল। কয়, কী কইলি হালার ব্যাডা হালা, যার নুন খাচ্, তার বদনাম করচ্। হটান করি এক চড় কষাই দিল মাষ্টরের গালে আঁঙ্গ হাড়ার মাষ্টরের অপমান! নিজেরে ধরি রাইখ্তাম হাইর্লাম না, দিলাম হুলিশ ব্যাডার গালে উল্টা চড়। চড় খাই ব্যাডা থতমত অই গেল। এরুম একহান কাণ্ড যে ঘইট্ত হারে হ্যাতে স্বপ্নেও ভাবে ন, আঁইও ত ভাবি ন। ট্রেইনহুদ্দা মানুষ হো হো করি আঁসি উইড্ল। ব্যাডা আঁরে কিছু কইবার হুযুগই হাইল না। লাজ শরমের মাথা খাই হরের ইষ্টিশনে নামি গেল। আঁই বুজি গেলাম মানুষ চাইলে কিনা হারে। দ্যাশের মাইন্ষ্যে এক থাইক্লে হশ্চিমারা একদিন বাপ বাপ করি হলাই যাইব। দুই একজন ভিন্ন ঢঙে কতা কইল বটে, দোহে টিক্ল না। হুরা ট্রেইনের মইদ্যে কিছুক্ষণের লাই একহান হিন হড়ার শব্দও অইল না। ট্রেইনডা কিছু তোয়াক্কা না করি হুশ হুশ করি চইল্তে আরম্ভ কইর্ল। কইলার ইঞ্জিলের ধুঁয়া খোলা জানালার হাঁক দি আই আঁর চয়ে মুয়ে হাঁদাই গেল। হরের ইষ্টিশনে আই ট্রেইন থাইম্লে আঁই ভাইব্লাম সব্বনাশা কিছু এক্কান অইব। গৌরিনাথ মাষ্টর নিজের কাঁধে দায় নিতে চাইলে কিছু কতা আপ্সে আপ আঁর মুহে দি বার অইল – মাষ্টর, ভাইব্বার কিছু কারণ নাই, আঁঙ্গ দ্যাশের মাষ্টরের গাত্ আত তুইলব আর আঁই চুপ করি থাইয়ুম্ এইডা অইত হারে না। ব্যাডারা বুজুক এট্টু কত ধানে কত চাল। আর বেশিদিন এরুম লাথিঝাঁডা খাই আঁঙ্গ দ্যাশের মানুষ চুপ করি থাইক্ত ন। বদি, আম্নের মইদ্যে যে এরুম জিদ আছে কোনদিন ত ভাবি ন।
মাড়োয়ারি লোকডা কিছুক্ষণ চাই থাই কইল, আঁইও বাঙালি আঁর বাপদাদা চইদ্দ হুরুষ দেড়শ বছর ধরি এই দ্যাশে আছে, হশ্চিমাগ আত তুন্ এই দ্যাশরে বাঁচাইতে আঁইও আম্নেগ লগে আছি। কোনার সিট তুন্ একজন কইল, ইনশাআল্লাহ্ অইবই অইব। দ্যাশের স্বাধীনতার লাই জান কবুল।
এবার বইনের বাড়ি বেড়াইতে না যাইলে নোয়া বাতাসডারে কোন মতেই বুইঝ্তাম হাইর্তাম না, মাইন্ষ্যের ভিতরডা ধীরে ধীরে কেরুম হাল্টাই গেছে। মুখ বুজি আর থাওনের মত অবস্থা নাই অন্। নিজেরেই নিজে হশ্ন কইর্লাম এইডা ক্যাম্নে অয়? সমাজ মানুষ এই যে হাল্টাই যার হ্যাতেনরা কী টের হায় না! আঁর কাছে বেক্ কিছু বড় আজব লাগে। এই দ্যাশের মাইয়া মাইন্ষ্যের মনেও কি কোন নোয়া চিন্তা আইছে, না কি হোলামাইয়া হামলাই, রাঁদাবাড়ি করি জীবন কাডাইতেই মাইয়াগ আনন্দ। হেগুনের মনের গতি আদ্যি কালের বদ্যি বুড়ির মতই ঘুমাই আছে, ঘরের চৌহদ্দির বারে চলি হিরি ঘোরাডা কলের হুতুলের চাবি দেওনের মত। ডাইনে যাইব, না বাঁয়ে যাইব কোন হোদবোদ নাই, বাঁইচতে হয় বাঁচি আছে। আঁর বইনের লগে কতা কই বুইজ্লাম ঘরবাড়ি, থালাবাসন, কাঁতা কম্বল, হাঁড়িকুড়ি ছাড়া দুইন্নাইর কোন খবরই য্যান্ হেতির গায়ে আঁচড় কাডে না; আঁর মুয়ে দুই-চাইরহান কতা হুনি আঁসি উড়াই দেয়। আঁরে ধাক্কা মারলে মাইরব, মরি ভূত অই যাইয়ুম্, কার কি আইব যাইব।
কতাডা উড়াই হালাইবার মত ন, কারও ত কিছু আওন যায় না, য্যাতের আছে মাথা, হ্যাতের খালি মাথা ব্যথা। বুইজ্বার চেষ্টাও কইর্ল না। এই না বুজ্নই হেতিগরে একদিন হিসি মাইরব। আঁর বইন ত মনেও কইর্ত হারে না দ্যাশের লাই কোন মাইয়ারা হরান দিছে, মাষ্টরদার দলের মাইয়া প্রীতিলতার কতা, কল্পনার কতা কহ্নও হুনেও ন। আঁর মুয়ে হুনি মুখ বন্দ করি চাই থাওন ছাড়া হেতি কিইবা কইর্ত হারে। আঁই না হয় ইস্কুলের মুখ দেইখ্ছি বলি কিছু বিদ্যাবুদ্দি অইছে, কত জ্ঞানের কতা স্বামীর মুয়ে হুইনবার ভাইগ্য অইছে, এরুমডা কজনের জোডে। বইনের বেলা অইছে উল্টা। মাইয়া মাইন্ষ্যের ভাইগ্য চিয়ন হুতার উপ্রে ঝুলে, ছিঁড়ি যাইলে আর উপায় নাই। দেইখ্তে হুইন্তে হেতি মন্দ আছিল না, ভালা ঘর হাই বাইচ্চাকালে বিয়া দি দিছে মা বাপ ভাইরা হছন্দ করি। চাইর হোলামাইয়ার জম্ম দি স্বামী গেল হরকালে। যা অইবার তা অইল। কষ্টমষ্ট করি হেগুনে বড় অইল। হেতি অন্ রোগে হড়ি আধামরা অই বাঁচি আছে। আঁর বইনের মতই গ্ৰামগঞ্জের বেক্ মাইয়াগ অবস্থা। বইন আঁর দিনরাইত বিছ্নাত্ হড়ি থায় আর কেউ আইলে শ্বাস টানি টানি কতা কয়। কি আর সান্ত্বনা দিমু। নিজেরে হামলাই তুলি হেতির আতহান আঁর আতের তাইল্লার উপ্রে রাই পঞ্চাইশডা ট্যাঁয়া দি কইলাম, তোর যে হল্ খাইত মন চায় হোলারে দি আনাই লই খাইছ্। বইন হেতির ঠোঁড দুইহান লাইড়ল, কোন কতা কইল না। চইর তুন্ কোনরমে নামি আই আঁর হায়ে আত দি হন্যাম কইর্ল। হেতির এই অবস্থার লাই কারে দোষ দিমু, ভাইগ্যরে না মাইন্ষ্যের হাগলামিরে! দ্যাশের বাঁদরামিরে না অয় নেতারা সোদ্রাইব, কিন্তু সমাজের নিয়মরে কারা ঠিক কইর্ব, হেরুম মানুষ অন্ কন্নাই আছে?
মাইয়াডার কতা চিন্তা কইর্লে আঁর মাথা ঘুরি যায়। সোমত্ত মাইয়া ঘরে থাইক্লে কোন্ বাপ মায়ের না চিন্তা অয়। হেতিরে কত করি সাবধান করি যহ্ন তহ্ন ঘরের বার অইচ্ না, বিপদ কিন্তু হায়ে হায়ে ঘুরের। আঁঙ্গ দ্যাশের হালচালও ভালা ন, চাইরদিগে অরাজকতা। কহ্ন যে কোন্ ঘটনা ঘডি যাইব, কেউ কী আগাম কইত হারে? হিন্দুর মাইয়ার উপ্রে কারও কারও বাজ হইকের মত নজর। কত কিছুই ত হুনা যার, এই ত তোর ভাইও কইল, তোরে কইতে যদিও মানা কইর্ছে, টাউনে চৌধ্রী হাড়ার কোন মাইয়ারে বলে রাস্তাঘাডে টিট্কারি কইর্ছে, হেই লই হিন্দু মোছলমানের মইদ্যে এক রাইজ্যের অশান্তি। আঁর মাইয়ার কী রাগ, ঐটুক্ মাইয়ার চোহা কম ন। কয়, মাইয়া মানুষ মাইয়া মানুষ হাঁজি থাইক্লে এরুমডা অইবই, মুয়ের উপ্রে কড়া জবাব দিত জাইন্লে এত সাহস অইত ন। আইয়ুক্ না আঁর লগে লাইগ্ত, বাপের নাম ভুলাই দিম্। তুই একদিন সব্বনাশ করি ছাইড়বি। মাইন্ষ্যে কইব যেরুম মা হেরুম মাইয়া। আঁর মাইয়া যে একশ ভাগ ঠিক কইছে হেইডা জাইন্লেও লায় দিলাম না। হড়ালেয়া শিখ্ছে ঘরে বই, মনের জোর যদি না বাড়াইল, এই শিক্ষার কী দাম! এই বাড়ি হেই বাড়ির মাইয়ারা এক লগে জড় অই কত খোশগল্প করে। হেগুনের মা বাপেগ কত দুশ্চিন্তা দিনরাইত ক্যাম্নে হাত্রস্থ কইর্ব। যাও দুই এক্কান সম্বন্ধ আইয়ে, জুইতের ন, হোলা ভালা ত ঘর ভালা ন, কারও ট্যাঁয়ার জোর নাই, কারও আবার কুষ্টি মিলাই দ্যায়ে মঙ্গলের দোষ, ঘটক আবার হুলাই হাঁপাই ইঁদুরেরে বাঘ বানাই দেয়, কারও আবার মাইয়ারে হছন্দ অয় না। এত আয়োজন করি মাইয়া দ্যায়াইল, ভাইগ্যের সিকা ত ছিঁড়ল না। শ্যামলী ত হাউমাউ করি কাঁদি ভাসার, বার বার মাইয়া দ্যায়ার চইদ্দ বছর বয়স থুন, কুড়ি ছুঁই ছুঁই অন্ও কোন গতি অইল না। কতায় আছে কুড়িত্ বুড়ি, আবার গায়ের রঙ কালা অইলে ত কতা নাই, মাইয়ার আতে দশডা ট্যাঁয়া দি মণ্ডা মিডাই খাই অইন্য বাড়িত্ দৌড়ায়। শাশ্বতীর মনের মইদ্যে আনন্দে খই হোডের, হেতির আতে কুড়ি ট্যাঁয়া দি গেছে হোলার বাপ, এবার এক্কান গতি অইব। অঞ্জলি ত লইজ্জায় মরি যায়, ক্যাম্নে বিয়ালের গালগপ্পে মুখ দ্যায়াইব। মাইয়া সন্তান কী বাজারের আনাজহাতি, দরদাম করি বাজার তুন্ কিনি আইন্ব, ঘরে আনি হঁচাগলা মনে অইলে মেলা মারি হালাই দিব। মাইয়াগ এরুম দশা দেই বুয়ের মইদ্যে খাঁ খাঁ করে। হেগুনেরে ক্যাম্নে হঁত দেয়াইয়ুম চিন্তায় ঘুম আইয়ে না। বাপ মার কত চিন্তা মাইয়ার বিয়ার বন্দোবস্ত কইর্ত হারেন না, এদিগে বয়স বাড়ি যার, কত দুখ করি কয়। বাপ মার চিন্তা দ্যাই মাইয়াগ কম চিন্তা! হড়ালেয়া জানে না, হরের বাড়ি যাই ডেগ্ মাষ্টরি কইর্ত অইব, অইন্য উপায় ত নাই। বয়সের জ্বালা ত কম ন, হিয়ালেরা মুখ বাড়াই রইছে কহ্ন খপ করি ধরি টানি লই যাইব, হেগুন ত তক্কে তক্কে থায়।
লক্ষ্মীহুর তুন্ খবর আইছে। হিয়ানে এক লম্বা মিছিল বার অইছিল, মিছিলের উপ্রে হুলিশ গুল্লি চালাই দিছে। দুই চাইর জন মারাও গেছে। হেই লই কী কম কাণ্ড! বেগমগঞ্জ হইয্যন্ত অশান্তির জের চলি আইছে। মানুষজন ডরে আঁড্বাজারে বার অয় না, কি জানি ভালা মন্দ কিছু যদি অই যায়। য্যাতাগ হোলারা হঁতেঘাডে আছে, হ্যাতাগ মাথাত্ বাজ ভাঙি হড়ের। যদি হুলিশ ধরি লই যায়, হাজত বাস করাইব তিন দিন তিন রাইত, আর ভাইগ্য খারাপ থাইক্লে জেলের ঘানি টানাইব। আঁর হোলার মাথায় আওয়ামী লীগের ভূত হাঁদাইছে, কহ্ন আতে হোষ্টার লই দলে ভিড়ি যাইব, মাইক লই হশ্চিমাগ আকাম কুকামের বিরুদ্ধে গলা হাঁডাইব, কে জানে। আঁই মাইয়া মানুষ, ঘরের এক কোনায় বই থাই আকতা কুকতা ভাইব্তেই থাই। গুল্লি চইলছে বিধায় দোয়ানহাড্ বন্দ করি আঁঙ্গ বাড়ির কত্তারা বাড়ি চলি আইছে। হশ্চিমাগ সহযোগী ভাইরা আমোদ আহ্লাদে মাতি রইছে, হ্যাতারা তাল মিলাই চলে, গোপন খবরাখবর দি নিজেগ আখের গোছায়। দ্যাশের মাইন্ষ্যে হরান দেয় আর ব্যাডারা হুর্তি করে, এরুম বেইমান জম্মে দেই ন। চাইর মুই আগুন জ্বলের। আঁর স্বামী এক মুহুরী দি খবর হাঁডাইছে আঁই য্যান্ শীঘ্রই বাড়ির কাওর লগে টাউনের বাসায় চলি আই। হুলিশের লাডির বাড়ি খাই হোলার হাঁ ভাঙ্গি গেছে। এরুম দুঃসময়ে আঁই মাইয়ামানুষ ক্যামনে যাই। আঁর দেয়রের হোলারে লই বার ত অইলাম ঘর তুন্। বুইজ্লাম সোজা হঁতে যাওন যাইত ন, ঘুরহঁত ধইর্লাম। আঁর হৌড়ি বার বার করি সাবধান করি দিছিল – বৌ দিনকাইল ভালা ন, হঁতেঘাডে যদি কোন বিপদ হয়, কে তোরে বাঁচাইব, গোপাল ড্যাগা হোলা, কোন ভরসা আছে নি। কি কন্ আম্নে অনের ষোল বছরের হোলা দুইন্নাই উল্টাই হালার, হ্যাতে হাইর্ত ন! আঁই অ্গ্গা বুড়ি মাইয়া কেউ কিছু কইর্ত ন । তুলসী তলায় হন্যাম করি মুয়ে ঈশ্বরের নাম লই আঁডা শুরু কইর্লাম। হাঁচ মাইল গ্ৰামের হঁত দি আঁডার হর এক হান-বিড়ির দোয়ানে বইলাম। দোয়ানদার কইল, আম্নেরা হাগল অইছেন নি, টাউন ইয়ান তুন্ আরও দশ মাইল দূর, হৌঁছাইতে হৌঁছাইতে রাইত অই যাইব, এক কাম করেন রতনহুরের বাজারে চলি যান, হিয়ান তুন্ রিক্শা করি হাকিমহুরের গঞ্জ, দুই তিন মাইল আঁইড্লেই ইষ্টিশন, হরে আর চিন্তা নাই। কোন দুর্ঘটনা ঘইট্লে সইত্যহীরের নাম জইপ্বেন, বিপদ কাডি যাইব, হীরবাবারে জান হরান দি্ ডাইক্লে কেউ হিরে না। বাসাত্ হৌঁছাই দেই হোলা আঁর যন্তনায় কাত্রার। হাঁড়ভাঙা তৈল লই গেছিলাম লগে। আঁরে দেই হোলার বেদনা অদ্দেক য্যান্ কমি গেল। যাইতে যাইতে দেইখ্লাম মানুষ ক্ষেপি গেছে। এই সরকারের উৎখাত করি ছাইড়ব।
আঁর স্বামীরে কইলাম, আম্নে অন্ও ডাক্তর ডাহেন ন। অইছে কি হ্যাতেনে হোলার এই অবস্থা দেই থতমত খাই গেছে। কোনদিগে হোতাইলে হোলার হা রাইখতে সুবিধা অইব, হেইডাও বুই্জ্ত হারেন না। বারে অন্ ঘোর আঁন্দার, কোন্ ডাক্তর আইব অসময়ে। আঁর মনের অবস্থা দেই, ছুইড্ল মাইল খানেক দূরে মোয়াজ্জেম ডাক্তাররে ডাইক্ত। হ্যাতেনে ত আইতই চায় না, কত বলি কই আতে হায়ে ধরি ডাকি আইন্ল। কারণডা হুনি ত চমকাই গেছে – এরুম বেআক্কলে কাম আম্নের হোলা কিয়ের লাই কইর্ত গেছে। হ্যাতের হা সারাইত যাই আঁই না ধরা খাই যায়। হারিকেলের দঁইডা বাড়াই দিলে ঘরডায় আলো ছড়াই যায়। হোলার মুখহান এতক্ষণ দেয়াই গেছিল না। এরুম হুয়াই গেছে য্যান্ কদ্দিন অইল খায় ন। হ্যাতেনেরে দুই কতা হুনাই দিলাম। তোঁর হোলা আঁর কতা হুনে নি। এরুম বাচাল, কোন কতা কওন যায় না। য্যান্ হ্যাতেই বেক্গাইন বুজে, আর বাঁইগুন মূরুখ্য। ডাক্তরের ওষুধ আর আঁর তৈল মালিশে শ্যাষমেশ হোলা হাহান লাড়াইত হাইর্ল। চই তুন্ উডাই চেয়ারে বয়াইলাম। হায়ের জোর বাড়াইলে ত শুধু অইত ন, শরীল আর মনের জোরও ত বাড়াইতে অইব। মা অই আঁই ত চুপ করি বই থাইক্তাম হারি না। ছনের ছানি আর মুলি বাঁশের বেড়ার এই ঘরহান নোয়া অইছে। সামনের ঘরে দুইহান চই হাতা আছে। এক চইয়ের উপ্রে খোকন্ হোতে। খোকন্ বাড়ি দেখভাল করে। আর এক চইত্ হোলা আর হোলার বাপ ঘুমায়। মাইঝহানে গোলটেবিল আর দুইদিগে মোট তিনহান চেয়ার। চেয়ারে বই হ্যাতেনে মক্কলগ লগে মুসাবিদা করে। কতরকমের মানুষ যে আইয়ে। হ্যাতাগ পটর পটর কতা হিচন তুন্ হুনা যায়। জমি জমার মামলা, খুনাখুনি, রাহাজানি কোনডা আর বাদ যায়। হুইন্তে হুইন্তে কানে তালা লাগি যায়। কিছু ত কন্ যায় না, এইডা ত হ্যাতেনের হেশা, হেই ট্যাঁয়ায় আঁঙ্গ সংসার চলে।
রাস্তার হাশে আঁঙ্গ ঘর। দিনরাইত কত কতা না হুইন্তাম হাই। কেউ বলাবলি করে, মুজিব বড় বাড়াবাড়ি শুরু কইর্ছে, ইয়ার হল্ ভালা অইত ন। এত বড় কতা হেগুনে কইত হাইর্ল! হুইন্তাম চাই না, তবুও য্যান্ কানে চলি আইয়ে। আরে না না, বঙ্গবন্ধু য্যাতারা বানাইছে, বানাইতে দে। কয়, হিন্দু মোছলমান বেকের এক লগে থাইক্ব, অইত ন। এইডা মোছলমানের দ্যাশ, মোছলমানরাই থাইক্ব, হিন্দুরা থাইক্ব কিয়ের লাই? কী কতার যুক্তি আছে নি? বাংলা ভাষা শিখনের কী দরকার! সরকার যেরুম কয় উর্দু শিখত অইব, অইব, দুরকম কতা চইল্ত ন। হিন্দুরা বাঙালি অইত চায় হোক, আমরা অইতাম্ না। মুসলীম লীগ আঁঙ্গ হাটি, হাকিস্তান আঁঙ্গ দ্যাশ, মুজিব বাংলাদেশ বাংলাদেশ করের, এরুম শিক্ষা দিব না ইয়াহিয়া হান, হলাইবার হঁত হাইত ন।
আঁই হুনি আর কানে য্যান্ তুলা দি রাই। হুরা দ্যাশের মাইন্ষ্যে হশ্চিমাগ কবল তুন্ মুক্তি হাইত চায়, এই ব্যাডারা কয় কি। আঁর স্বামীর বন্ধু মনতোষ বাবু উকিল কোটের তুন্ আই আঁঙ্গ ঘরে গালগপ্প করে, নানা রমের রঙ্গ রসিকতায় আঁইস্তে আঁইস্তে মরি যাই। হ্যাতেনে হুনে আর আঁসে আর হা দোলাইতে দোলাইতে কয়, এই হনুমানগুনের মাথা খারাপ অই গেছে, উল্টাসিধা বক্বক্ করে, কবে যে এগুনের জ্ঞানগম্মি অইব কে জানে। হাল্লায় হইরত সেলিম সাবের, এরুম বিচারক লাখে একজন, এগুনের বাপের নাম ভুলাই দিত, কোশ্চেনের হর কোশ্চেন করি, কাহর খুলি দৌড় মাইর্ত। আর স্বামী জিগ্গায়, মনতোষ বাবু কইতে হারেন এই দ্যাশহানের হাল কি অইব ? এক কতায় কমু, রসাতলে যাইব। ভোটের ঘন্টা ত বাজি গেছে। হ্যাঁ, আইজ উকিল বারেও কতা কাডাকাডি অয়ছিল। কে যে কোন দলে বুজা ভার। এই দ্যাশডার চরিত্র কী দাঁড়াইব কেউ কইত হারে না। মনের কতাহান বারে আইনতে শিক্ষিত মানুষরাও ভয় হায়, যদি সরকারের বিরুদ্ধে চলি যায়, বিনা বিচারে জেলে ভরি দিত হারে। হেই কতাগাইন যেমন হাঁচা হেরুম এত এত মিটিং এত এত মিছিল এত এত শ্লোগান, হুলিশের গুল্লি খাওন ইগাইন ত মিছা অই যাইত হারে না। হিয়ানে ত হিন্দু মোছলমান বাছবিচার অর না। বুইজ্জনি খোলা মনে দেইখ্লে এরুম, আর মনের দরজাহান বন্দ রাইখ্লে আরেকম।
হ্যাতেনগ কতা হুনি আর চুপ করি থাইক্তাম হাইর্লাম না। হিচনের ঘর তুন্ জানালার ফাঁক দি মুখ বাড়াই কইলাম, আইচ্ছা এত আগের তুন্ বেক্গাইন কওন যাইত হারে। দিনের কতা আর রাইতের কতায় কত হারাক, আন্দোলনের মুখ কোন মুই যাইব, আন্দোলনই ঠিক কইর্ব, শেখ মুজিব নিজেও ত জানে না, দ্যাশের মাইন্ষ্যেরে কী কতা কইব, কেরুম কতা কইব, কোন ভাষায় কইব, দ্যাশের লক্ষ লক্ষ চাষাভুষা মুডেমজুর হ্যাতেনের কতার কী অর্থ কইর্ব। কেবল ত ভোটের ঘন্টা বাইজ্ছে, ঠিক কইর্ব মানুষ দ্যাশের চেআরা কেরুম অইব, আম্নেরা বারে বই ঘরে বই উকিল মোক্তার আর বিচারকরা ঠিক কইর্লে ত অইত ন। অশিক্ষিতের মাথায় ত কিছু বিদ্যাবুদ্দি আছে। উকিলবাবু কয়, বদি, আম্নে ত কোন খারাপ কতা কন্ ন, অত তলাই ত আঁই ভাবি ন।
দাদা, আম্নেরা ত মাইয়া মাইন্ষ্যের মাথার কোন দামই দেন না, ভাবেন হেতিরা মাথায় ঘোমডা দি ঘরের কোনায় হড়ি থায়, আর চুলা ঠেলে, হেগুনেরে গনায় ধরি কী লাভ, আম্নেরা যেই দলেরে কইবেন, হেই দলেরে ভোট দি দিব, না এসব আর অইত ন, আঁঙ্গ এক্কান ভিন্ন মত আছে, এই কতাহান মানি লন, মাইয়া মাইন্ষ্যেগ আর হিছে হালাই রাইয়েন না, আঁঙ্গ চেহারা না দেই মগজহানের মূল্য দেন। কতাগাইন কইলাম বলি রাগ করিয়েন না। উকিলবাবু থম্ মারি বই রইলেন কিছুক্ষণ, হ্যাতেনে কল্পনাও করেন ন টাউনের নামজাদা উকিলরে কেউ এরুম হশ্ন কইর্ত হারে।
বদি, আম্নের মনের ভিত্রে এরুম এক্কান চিন্তার উদয় অইল কেরুম করি? এই হশ্নের উত্তর দেয়ন উচিত কি উচিত ন আঁই ঠিক কইর্তে হাইর্লাম্ না। হিছের তুন্ হাকের ঘরের হাশ দি মনে বল লই হা হালাই সামনের ঘরের মুই আগাই গেলাম। দুইডা কারণ আছিল এই যাওনের হিছে। হতমটা অইল আঁর বাঁই কতাগাইন হ্যাতেনে যাতে মন দি হুইনত হারে, আর এক্কান কারণ অইল, আঁর স্বামীরে বুজানো, হুযুগ হাইলে মাইয়ারাও জবাব দিত হারে, তাও কিনা এরুম মানুষের সামনে, হুইনছি কোটে বিচারকরা বলে সওয়াল জবাবের সময় ঢোক গিলে, চইদ্দবার ভাবে। আঁই হুনাইতে ছাইড়্লাম্ না, দাদা, সামনের ভোটে মাইয়ামাইন্ষ্যেরা হুরুষেগ লগে গলা মিলাইত যদি হারে, হশ্চিমারা হারি ভূত অই যাইব। পাটির নেতাগ কন্ বউঝিগ ঘরে আঁটকাই না রাই মাডে ময়দানে নামাইতে। আম্নের কতার মূল্য আছে, কিন্তু আঁঙ্গ সমাজ যে অইন্য কতা কয়। আরও অপেক্ষা কইর্ত অইব। আঁই মনে মনে আঁইসলাম, কতার অর্থহান বুজি ঘোমডা মাথাত্ দি বাগানে আইলাম, হিয়ানে গেঁন্দা জবা টগর হুলেরা গায়ে গা লাগাই কত কতাই না কয়, কান হাইত্লেও যার অর্থ উদ্ধার করন যায় না। আঁর কতা আর অন্ কে হুইনব!
বিয়াল অইলেও আঁন্দার ঢাকি হালাইছে চাইরদিগ। মেঘ উড়ি উড়ি বেড়ার আকাশের কোণায় কোণায়। হোলামাইয়ারা মাডে ফুটবল লই লাথালাথি করে। কোন্ দলের বল কার হা’র তুন্ হইড়ল যাই হুলিশের গাড়িত্। আঁঙ্গ ঘরের লগেই মাড্। মাডের লগে হুইর। হুলিশের লাডির বাড়ির চোডে ছুডি যাই ঝাঁপ মারে হুইরে। হেই এক দৃশ্য, বেক্গুন ডুব মারে, মাঝেমইদ্যে মুখ বাড়ায়, বুড়বুড়ি ছোডায়, আবার হুলিশের বন্দুক দেই ডুব মারে। এইডা ত গ্ৰাম ন, টাউন, কেউ আর ঘর তুন্ বার হয় না। কদিন ধরি হুনিয়ের হুলিশ নানান ছুতায় জোয়ান জায়ান হোলাগ ধরি লই যার। হ্যাতাগ চর লাগাই রাইখ্ছে কেউ কোন ষড়যন্ত্র কইর্লেই খবর দিব। দ্যাশের মাইন্ষ্যে যে এভাবে ভাগ অই যাইব কে আর বুইজ্জে। ঘেডি ধরি ঠেইল্তে ঠেইল্তে একজনেরে জিপ গাড়িত্ উডাইবার সময় আঁর স্বামী যাই কারণ জাইন্তে চাইলে কাডা কাডা কতা হুনাই দেয় এরুম করি য্যান্ আমরা এই দ্যাশের মানুষই ন। নিজ দ্যাশে হরবাসি। আঁর স্বামীরে ত হেনস্থা কইর্লই, এই জিলার মাইন্যগইন্য মানুষজনের মইদ্যে হইড়লেও হ্যাতাগ কাছে হত্তুর। ঘুম তুন্ উডি দেই এক লম্বা মিছিল ইষ্টিশন তুন্ আঁঙ্গ বাসার রাস্তা ধরি জিলা ইস্কুলের দিগে চলি যার। হোলাগা জিলা ইস্কুলের ছাত্র, হিডাই হিডাই বিনা দোষে আধমরা করি ছাড়ি দিছে; এত বিষ হশ্চিমাগ মনের মইদ্যে, এর এক্কান বিহিত একদিন অইবই। হ্যাতাগরে বধিব যে গোকুলে বাইড়্ছে সে। মিছিলের জোয়ান হোলাগ চখমুখ দেই বুইজ্তে হাইর্লাম্ ঢাকা হৌঁছাইতে আর বেশি দেরি লাইগত ন। আঁর হোলাডা যে কোন হাঁকে ভাঙ্গা হা লই ভিড়ের মইদ্যে মিশি গেছে ক্যাম্নে কইয়ুম। এরুম দিনও আইয়ে, মাইন্ষ্যে নিজের চেহারাহান নিজে দেই শরম হায়, আঁঙ্গও কী এরুম দিন আইছে! যদি তা না অইব আঁঙ্গরে উচ্ছন্নে হাঁডাইবার লাই হ্যাতাগ এত তোড়জোড় কিয়ের লাই। এরুম কাণ্ড ত কহ্নও দেই ন, আঁর স্বামী চেয়ারে বই মক্কলের লগে মুসাবিদা করে আর দ্যাশের হত্তুর বিভীষণ আই দরজার সামনে আত হা নাচায়, মুখ দি এরুম সব কতা কয়, মুয়ে আনন্ যায় না, কানে হুনন্ যায় না, দিন দুহরে ঘরের চালে হাতর ছোঁড়ে। আঁচ কইর্তাম্ হারিয়ের, বড় এক্কান কিছু ঘইট্ব। আঁর স্বামী ভাইব্ল কোটে কেইস কইর্ব। আঁই বুইজ্তাম্ হারিয়ের কেস করি কোন লাভ অইত ন, দূর তুন্ কেউ দান চালের। হরে হরে হুইন্লাম বাছি বাছি আওয়ামী লীগের নামের লিষ্টি ধরি ধরি এরুম কাণ্ড ঘডার। উকিলবাবুর বউ আই কইল, দিদি, আঁঙ্গ সামনে বড় বিপদ, হ্যাতেরা এই দ্যাশ তুন্ আঁঙ্গরে দোড়াই দিব। হ্যাতেরা উকিল হাড়ারে দখল কইর্ত চায়। চাইলেই অইল, হরান থাইক্তে এই দ্যাশ ছাড়ি আমরা যাইতাম্ ন, কিয়ের লাই বা যাইয়ুম্, হাত হুরুষের বাড়িঘর, জমিজমার তুন্ দৌড়াক্ চাই দেই, হরান থাইক্তে যাইতাম্ ন। ভাগ কর্লেই অইল, মাইন্ষ্যের আবার কিয়ের ভাগাভাগি। আগের বার যহ্ন ভাগ অইল আমরা জাইন্তাম্ও হারি ন, ক্যাম্নে ক্যাম্নে ভাগ অই গেল। যাইতে হয়, হশ্চিমারা আঁঙ্গ দ্যাশ তুন্ যাইব। বাঙালিরা এক ছাতার নিচে থাইয়ুম্। মারুক্ কিলাক্ হিডাক্ এইডা আঁঙ্গ জমি, আঁঙ্গই থাইক্ব। উকিলবাবুর বউ আঁর কতা হুনি মনে বল হায়, কয়, আম্নেরে হন্যাম করি, দাদা কোয়াল গুনে আম্নের মত বউ হাইছে। দিদি আম্নে উল্টা কতা কনের, আঁই ক্যামে্নে আম্নের দাদার যোইগ্য অইলাম, কন্ চাই, কন্নাই হ্যাতেন, কন্নাই আঁই।
স্বপ্নে ভাঁয়ে হোনার তরী
মিলবে যহ্ন হাড়ের কড়ি
হুজার মাস আইছে। হোলার মনে আগের মত আনন্দ নাই। মাইয়াডারে হেতির বাপ কি মনে করি গ্ৰামের তুন্ টাউনে লই গেছে। জানি না হ্যাতেনের মনের মইদ্যে কি চলের। মাইয়া থাইক্বার লাই আর এক্কান ঘরও বানাই দিছে। হড়ালেয়ার লাই টেবিলও কিনি আইন্ছে। মাইয়ারে লই এরুম উৎসাহ আগে দেই ন। কেউ না কেউ কইছে আম্নের মাইয়ার মাথা ভালা, গড়গড় করি বাংলা ইংরাজি কবিতা তর্জমা করি দিত হারে, কবি মধুসূদনের দত্তের সনেট মুখস্ত কয়। শেলি কিটস ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতাও ঠোঁডের ডগায়। হেতির বাপ ভাবে মাইয়ার যহ্ন নিজের এত আগ্ৰহ, একবার চেষ্টা চরিত্র করি দেয়া যাক। কতদূর যাইত হারে, ইস্কুলে যাইবার হুযুগ গ্ৰামের দ্যাশে অয় ন, নিজের কাছে রাই হড়াই, যদি কোনদিন মাইয়ার ভাইগ্যে থায়, প্রাইভেটে হরীক্ষা দিব। হেইসব না অয় অইল, বেক্ সাধ ত হুরণ অয় না, দ্যাশেরও যা টালমাটাল অবস্থা, ভবিষ্যৎ বলি ত কিছু নাই, দ্যাশডাই ত একদিন উজাড় অই যাইব, হোলামাইয়ার ভালামন্দ দূর অস্ত। উকিলবাবুর বউ টাউনের মাইয়াগ ইস্কুলে হড়ায়। আঁঙ্গ ঘরে আই হত্যেকদিন বিয়ালবেলা হেতির লগে বই ইস্কুলের হাইট্য হুস্তকগুন লাড়েচাড়ে। হাতার হর হাতা উল্টাই বুজায়। মাইয়াও মনযোগ দি হুনে। হেতির লাই বউডার মনের মইদ্যে কেরুম মায়া হড়ি গেছে। বউডা আঁর মাইয়ার এক নোয়া নাম দিছে। কয়, জেডিমা তুলিরে একবার আঁঙ্গ বাসায় হাডাই দিয়েন। হরে জাইন্লাম বউডার মাইয়াডার অকালে মরি যাওনের শোক আইজও ভুইল্ত হারে ন। বাঁচি থাইক্লে হেতির কাছাকাছি বয়স অইত। আঁর মাইয়ারে ভালবাসি আঁকড়াই ধইর্ত চায়। আঁই বউডার দুখ্ডা বুজি এই সম্পর্কডারে মানি লইছি। আঁর হৌড়ি কয়, বড়বউ তুই অন্ তোর মাইয়ার কাছে যাই থাক্, আঁরে মাঝে মাঝে চাই যাইচ্, অন্ আঁই ছোডবউয়ের ঘরে খামু। আমরা ত হড়ালেয়া কইর্তাম হারি ন, নাতিনডার যদি এক্কান গতি হয়। আঁর হৌড়ির মুয়ে এরুম কতা হুনি নিজেরে আর ধরি রাইখ্তাম হারি ন, হ্যাতেনেরে বুয়ে জড়াই নিলাম।
বিরাট বড় রায়বাহাদুর বাড়ির খিলান দি হাঁদাই গেলেই তিন চাইরডা কোডায় বাস করে উকিল বাবুরা। মাইন্ষ্যের মুয়ে মুয়ে হিরে এই বাড়ির কতা। গালগপ্পও কম নাই। যত ভিত্রে ঢুকন্ যায় কত গাছগাছালি মাথা তুলি খাড়াই রইছে, হাপখোপ ত হইত্য সময় দেয়া যায়, ঘসা ভাঙাভুঙা ইটের মাইজহান দি মুখ বাড়ায়। দেড়শ বছরের হুরান বাড়ির কাছে মাডে ত্রিপল টাঙাই চইল্ছে অখিল পালের দুগ্গা ঠাকুর গইড্বার কাম। কত মাইন্ষ্যের আওন যাওন। কোন টানে আইয়ে, কিয়ের লাই চখ মেলি চাই থায়, ঠাউর দেইখ্তে দেইখ্তে জ্যান্ত অই উডে। এই বুজি নামি আই কতা কইব। অল্প অল্প বাতাসে গাছের হাতাগুন দুলি দুলি উডে। মেঘেরা আঁচল হাতি বই রইছে আকাশে, কার এত ক্ষমতা আছে যে টানি নামাইব। হোলামাইয়াগ লগে লই আঁইও চাইতে গেলাম। এই হঁত দি যাইবার সময় হইলা ঘোষাল বাড়ি, হরে হরে দত্ত বাড়ি ডাইন হাশে, বাঁ হাশে ছদ্রি বাড়ি। বেক্ বাড়ির বউঝিরা আইছে মার রূপ দর্শন কইর্ত। আর চাইর হাঁচ দিন বাদেই হূজা আরম্ভ অইব, ঢাকঢোল বাইজ্ব। আনন্দের সীমা নাই। বউডা আঁরে হেতিগ ঘরে টানি লই যাই বয়ায়। হুরান যে ঘর এই কতা আর কইবার অপেক্ষা রায় না, চেয়ার টেবিলের কম বয়স ত অয় ন। বালু সিমেন্টের হলেপ অইড়ছে দেয়ালে, চুনকাম্ অয় ন। মেরকডির জাল কোনায় কোনায় ঝুলের। ব্যাঙের ছানারা চইয়ের হায়ার কাছে ঘুরঘুর করে। তবুও এই বাড়ির কৌলিন্য উপেক্ষা করন যায় না। হুনা যায় এই বাড়ির মালিকরা মরি ভূত অইছে। কেইস্ কামারি চইলছে, কোনানের জল কোনাই গড়াইব কে কইত হারে। এক শেখ পরিবারের হইসাওলা মোছলমান জমিদার বাড়ি জবরদখল কইরবার লাই উডিপড়ি লাইগছে। এত সহজে কি স্বত্ব আতছাড়া করন যায়। উদ্দার কইর্বার দায় হইড়ছে আঁর স্বামীর উপ্রে। লোয়ার কোরটে হারি গেলেও হাল ছাড়ে ন। এক মাস বাদে তারিখ হুইরছে ঢাকা হাইকোটে ।
আঁর স্বামী আবার এক কতার মানুষ। হরান দি হালাইব তবু কতার খেলাপ কইর্ত ন। এদিগে চাইরদিগে ত হুলস্থুল কাণ্ড! হোলাহাইন, জোয়ান হোলা, জোয়ান মাইয়া, এরুমকি বুড়াগ মনেও জোয়ার আইছে। এই জোয়ার য্যান্ তেন্ জোয়ার ন, ভোটের জোয়ার, বেকেরে ভাসাই লই যার। মুজিবের চাপে হড়ি ইয়াহিয়া খান শ্যাষমেশ রাজি অইছে নির্বাচনের ঘোষণা দিতে। তারিখ ত এক্কান দিব, এই লই অন্ও নির্দিষ্ট কোনও কতা অয় ন। কে কয় এইডা হুদা ভোট। কত আশা ভরসা, কত স্বপ্ন আছাড় হিছাড় খাই মরের। কালা আর ধলা মিশি যাই কল্পনারে দূর তুন্ ছায়া ছায়া লাগে, ধরইতে গেলে হুরুত করি উড়ি চলি যায়। কন্নাই কি ভুল অই গেছে? ভুলের মাশুল তাইলে গুইনত অইব! এই দ্যাশের মানুষ আর কত খেসারত দিব? হশ্ন ত মনের মইদ্যে ঘুরি ঘুরি আইয়ে, উত্তর দিব কে। শেখ মুজিব ত কবে তুন্ কত খাডাখাড্নি করের। আঁঙ্গ গ্ৰামেও ত রিক্শাআলাগরে জড় করি হেগুনের অভাব অভিযোগ হুনের কবে তুন্। চাষা, জাইল্লা, দোয়ানের কর্মচারী বেক্গুনেরে লই সভা কইর্ছে, বাড়ি তুন্ বাড়ি ঘুরের্, কম হরিশ্রম ত করে ন। কে আর তহ্ন চিন্ত। মাওলানা ভাসানী আর সোহরাওয়ার্দীর লগে হাশে খাড়াই রইছে খবরের কাগজে এরুম ছবি থাইক্ত। অন্ না হয় এত বড় নেতা অইছে, দ্যাশ হুদ্দা মাইন্ষ্যে জানে হুনে, সম্মান দেয়, হ্যাতেনের এক ডাকে লক্ষ লক্ষ লোক জড় অই যায়, হরান দিতেও কসুর কইর্ত ন, এরুমও হুনা যায়। এদ্দিন হাকিস্তানীগ য্যাতারা এত হত্তুর বলি মনে কইর্ত না, হ্যাতেরাও আস্তে আস্তে হাল্টি যার।
মানুষডার কতার মইদ্যে জাদু আছে, না হয় মন্তর টন্তর জানে। কন্নাইর তুন্ এসব কতা শিখছে! দ্যাশের মাইন্ষ্যের জন্য হরান না কাঁইন্লে নিজের জীবন কেউ এরুম করি বাঘের মুয়ে ঠেলি দিতে হারে! গুল্লি খাইব, তবুও হিছে হইড্ত ন। তাও ত কম দিন অয় ন, আওয়ামী মুসলিম লীগ যে আওয়ামী লীগ অইছে। মাইন্ষ্যে অন্ বুইজ্ত হারের এট্টু এট্টু করি বেক্ মাইন্ষ্যের কাঁধে ভর দি চইল্ত অইব যদি দ্যাশডারে বাঁচাইতে হয়। দ্যাশের মানুষ বুইজ্ত হারের হুব বাংলারে হুব হাকিস্তান বানানোর বিপদ, হশ্চিমাগ বানাইন্না জিনিষ তৈল সাবান মাজন লোহা সিমেন্ট তুন্ কলকব্জা, নিত্য নৈমিত্তিক জিনিস হুরা দ্যাশে ছাই গেছে। আঁঙ্গ দ্যাশ তুন্ জিনিষহত্র লই যাই হ্যাতাগ দ্যাশে এসব বানায়, হইসাকড়ি লুডি লই যার, ইস্কুলগাইন দিন দিন বন্দ অই যার। হেই কতাগাইনই ত বঙ্গবন্ধু বক্তিতা করি করি বুজার – অন্ সময় আইছে বাঙালিগ বেকেরে এক অইত অইব। নৌকা মার্কায় বেশি বেশি করি ভোট দিত অইব যদি সোনার বাংলা গইড়্তে হয়। ভোট বোধ হয় আগাই আইছে, না হয় আঁঙ্গ বাড়ির বেড়ার গায় এত হোষ্টার মাইরল কারা। নৌকা আর মুজিবুর রহমানের ছবিহান মানাইছে। মাইন্ষ্যে আবার খাড়াই খাড়াই চায়। চয়ের সামনে এরুম জলজ্যান্ত স্বপ্নরে কাছের তুন্ দেইখ্লে কার না ভালা লাগে। এরুম অবস্থা অইছে মাইন্ষ্যে য্যান্ কাইল্যাই হাকিস্তানি সরকাররে হালাই দিত হাইরলে বাঁচে। হত্তুররা যে ঘুর ঘুর করের না এরুম না, হ্যাতেরাই ত বই রইছে বড় বড় চেয়ারে। আঁর স্বামী ত বার বার করি কয়, এগুনেই ত শতানের গোড়া, হশ্চিমা সরকার এগুনেরে কাজে লাগাই আঁঙ্গ উপ্রে ছড়ি ঘুরায়, হেগুনে উর্দু জানা হশ্চিম হাকিস্তানের লোক, আঁঙ্গ সুখ দুখ্, হাবভাব, চালচলনের খবর হেগুনে জাইন্ব ক্যাম্নে! বাঙালিগ শিক্ষিতও কইর্ত ন, জাগাও দিত ন। হ্যাতাগ হুকুমেই বলে সব চইল্ব। হিয়ের লাই ত বঙ্গবন্ধু কয়, আমরা অন্ও হরাধিন দ্যাশে বাস করিয়ের, আঁঙ্গরে স্বাধীন অইতে অইব। ছোড ছোড হোলারা সার কতাহান বুজি গেছে। হেগুনে সাদা কাগজে নৌকার ছবি আঁকি আঁকি নাইরকল গাছে, বাদি গাছে, রিক্শার হিছে আডা দি লাগাই দের। আঁঙ্গ ঘরের জানালার হাঁকে দি চাইলেই চয়ে হড়ে, মাঝি য্যান্ দাঁড় বাই নৌকা লই চলি যার কল্পনার দ্যাশে।
কে আর জাইন্ব, সব্বনাশডা এরুম করি আই বেকেরে কাবু করি হালাইব। এই ভোট ত যেরুম হেরুম ভোট ন, হা’য়ে যে বেড়ি হরাই রাইখ্ছে হশ্চিমারা, ছিঁড়ি বার অইবার ভোট, মুয়ের উপর জবাব দিবার ভোট, নিজেগ দ্যাশ হিরি হাইবার ভোট। টগবগ করি ছোডের মাইন্ষ্যের মন, এরুম সময় বাজ ভাঙি অইড়ল, আকাশের রঙ বেরঙ অইল, বাতাসের দপ্দপানিতে মানুষ অইল দিশাহারা। রেলগাড়ি উল্টি যাইবার জোগাড়। আঁর স্বামী ধনুর্ভাঙ্গা হন্ কইরছে যেই করি হোক কাইল যাই ঢাকা হৌঁছাইব, জমিদারি বেআত অওনের তুন্ বাঁচাইতেই অইব। বিলাই কাঁদে, কুত্তা কাঁদে, যত হারে কাঁদুক, আঁর হৌড়ি কত বারণ কইর্ছে, কে হুনে কার কতা। উল্টাই হালাই দেয়, বাতাসে উড়াই লই চলি যায়, গাছের মগ ঠাইল ভাঙি আই হড়ে হা’য়ের কাছে, দৌড়ি চলি যাই ইষ্টিশন মাষ্টরের ঘরে হাঁদায়। চয়ে মুয়ে মাষ্টরের আতঙ্ক, কয়, স্যার, আম্নে কইর্ছেন কী, হইকও ত বাসা ছাড়ি এই দূর্যোগে বার অয় না, আম্নে কিনা এত বড় ঝুঁকিডা লইলেন। কি করুম মাষ্টর কও, কতা যে দি হালাইছি, ক্যাম্নে কতার খেলাপ করি।
বোচ্কাবুচ্কি লই আঁর স্বামী গাড়িত্ ওডে, অগ্গা মানুষ নাই বগিত্, খালি এক হৈর এক কোনায় বই থাই ভয়ে আল্লার নাম জপে। এরুম ঝড় তুফান কেউ কোন কালে দেইখ্ছে নি। নদীর চরের মাইন্ষ্যের কী অবস্থা কি জানি। আঁঙ্গ চাষের জমি আছে সন্দীপের চরে। এই ত হেইদিন আবিদ আইছিল তিলক কচ্কচি, সাক্করখোরা ধান লই – বাবু আম্নে ত কিছু দাবিও করেন না, খোঁজও নেন না, বেক্গাইন আতেভূতে খায়, আম্নের লাই দুই মন ধান লই আইছি, খাইলে খুশি অমু। কী যে কও আবিদ, এত কষ্ট করি চাষবাস কর, তোঁরা হোলামাইয়া লই খাইদাই বাঁচি থাক, তাইলেই আঁই খুশি, ধান কিয়ের লাই দিত অইব, ধর এই ট্যাঁয়াগুন রাখ, হোলামাইয়ারে ভালামন্দ কিনি খাইতে দিও। এই ট্যাঁয়াগুন আম্নে হিরাই লন, আঁর বিবি হুইনলে রাগ কইরব, আম্নের লগে আঁর কি খালি মালিক আর বর্গাদারের সম্পর্ক?
আঁর স্বামী গাড়িত্ একলা বই চিন্তায় মরি যায় এই চালচুলা ছাড়া মানুষগুনের কী অবস্থা অইব, ঘরে জল উডি মরি যাইব। গাড়ি ছোডে, চাইরহাশের তুন্ ভাঁই আইয়ে মাইন্ষ্যের কাঁদাকাঁডি আর গাছগাছালির মড়াৎ মড়াৎ আবাজ। হিছন হিরি চাইবার সময় নাই। এজলাসে সওয়াল জবাব চইলছে, কী অয়, কী অয়, কেইস্ হারি গেলে মান সম্মান থাইক্ত ন। মনতোষ উকিলের হরিবার খালি ন, ওই চৌহদ্দির দশ ঘর হরিবার হঁতে বইব। আইজ্ হ্যাতেনে বাবা মার নাম জইপ্ল মনে মনে, বলও হাইল। বিচারের রায় রায়বাহাদুরের হক্ষেই গেল। কিন্তু হকৃতির তাণ্ডব মাইন্ষ্যের বিপক্ষে গেল, এইডারে সাম্লাইব ক্যামনে। ঘরে আয়ে ন, ট্রেইন তুন্ নামি সোজা গেল নদীর চরে। কিচ্ছুই চয়ে হড়ে না, শুধু জল আর জল, একডাও মাইন্ষ্যের মাথা নাই। এই বিপদের তুন্ কে বাঁচাইব চরে হড়ি থাইন্না আধামরাগুনরে আর কারাই বা লাশগুনের কবর দিব। গরু ছাগল কুত্তা বিলাই মাইন্ষ্যের লাশের লগে এক লাইনে হুতি রইছে। আঁর স্বামী আর দেইখ্ত হারে ন, ছুডি চলি আই হতিজ্ঞা কইর্ছে, এভাবে চুপ করি থাইক্লে অইত ন, এক্কান বিহিত করবই কইরব।
ওমা এ ত দেইখ্ছি সরকার চুপচাপ অই রইছে, কোনও কতা কয় না। মাথার উপ্রে চাল নাই, হ্যাডে ভাত নাই, চাইরধারে মরা মাইন্ষ্যের হঁচা গন্দ। হাড়গোড় ছিট্কাই হড়ি রইছে। সরকারের কাছে দাবি তুইল্লে মুখ হিরাই লয়। আরে বাঙালি মইর্ছে, মরুক, ছাহোষা গরু ছাগলের জাত, খামাখা হ্যাতাগ মজুত ট্যাঁয়া আঁঙ্গ লাই খরচা কইর্বার কী দায় হইড়ছে। এইডা কী হ্যাতাগ দ্যাশে ঝড় তুফান অইছে, কাঁদাকাডি করি চয়ের জলের বুকে ভাসাই দিব। হ্যাতারা ত আঁঙ্গরে মানুষই মনে করে না, চুঁই লই যাইবার যম, রক্তচোষা জোঁক ছাড়া আর কী! য্যান্ বাংলার মাইন্ষ্যেরে দয়া করের, আঁঙ্গ দ্যাশের ট্যাঁয়া লই যাইবার সময় আর মনে থায় না। রাগে মাথায় রক্ত চড়ি গেছে বিধায় এত কতা কইয়ের। কমু না, রক্ত রক্তের লাই কাঁদে, এইডা হাঁচা কতা, বাংলার মানুষ আর হশ্চিমারা এক ন, হ্যাতেরা আঁঙ্গ কষ্টের কতা বুইজ্ব ক্যাম্নে? হিয়ের লাই ত যেই যেরুম হাইর্ছে, আগাই আইছে; হরানহান কাঁইন্ল বলিই না গর্জি উইঠ্ছে। ঘিন্না লাগের, হ্যাতেরা ক্যাম্নে সুহে থাইক্ব আঁঙ্গ সম্পদ লই, উচ্ছন্নে যাইব, আঁঙ্গ বঙ্গবন্ধুর তেজের কাছে হেগুনে ছাই অই যাইব, বেশি দিন নাই। উকিলবাবুরে কইলাম, দাদা হ্যাতেরা কী হাষান, রিলিফ হাডাইতে এত দেরি করের! খাড়ান খাড়ান, ভোটের বাক্সে বেক্ জবাব বাঙালিরা ঠিকমতই দিব, এই কতাহান মিলাই লইয়েন। ভোট বলে দাদা হিছাই যার? হেরুমই ত হুনিয়ের। ইয়ার মইদ্যে হ্যাতাগ ভিন্ন কোনও হন্দি নাই ত, এই জাতডারে ত বিশ্বাস করন যায় না। দৈনিক কাগজে হইড়লাম, ঢাকাত্ বলে বইন্যার ক্ষয়ক্ষতি লই হ্যাতাগ বিরুদ্ধে মাইন্ষ্যে সোচ্চার অইছে। হ্যাঁ, আঁঙ্গ টাউনেও ত কাইল জনসভা অইব। হ্যাতাগ গাফিলতি বাংলার মাইন্ষ্যে আর মাইন্ত ন। কিছু চশমখোর, বেইমান আঁঙ্গ মইদ্যেও আছে য্যাতারা হ্যাতাগরে সমর্থন করে । এগুনের লজ্জা শরম কিছু নেই! হেই দলেরই ত এক মিঞা রায়বাহাদুর বাড়ি ভোগদখল কইরবার হাঁদ হাইত্ছিল। হেইদিন আম্নের স্বামী জীবনের ঝুঁকি লই গেছে বলিই না রায় আঁঙ্গ হক্ষে গেছে।
দ্যাশের মাইন্ষ্যের কতা যে সরকার ভাবে না এই আবার কিয়ের সরকার। এই কতাডা ত একবারও ভাবের না, আইজ্ যেভাবে মুখ হিরাই রইছে, এরুম একদিন আইব মানুষও মুখ হিরাই লইব। আবাজ কিন্তু কানে আইয়ের, হ্যাতেরা হুনের না, হুইন্ত চায়ের না। এই আবাজের মইদ্যে মাইন্ষ্যের মনের কতা আছে, রাগ আছে, ঘেন্না আছে, কান্দন আছে, আরও যে কত না-হাওনের বেদ্না আছে কে আর বুইজ্ব। সরকারের মনের মইদ্যে কী ভাব্না চইল্ছে হেইডা ত আমরা ক্যাম্নে কমু। তিন চাইর জন বউঝি এক লগে জড় অইলে কত কতা বার অই আইয়ে। ঘরের দুয়ারে দুয়ারে রাস্তায় রাস্তায় কত কত নোয়া মাইন্ষ্যের চেয়ারা দেই। এগুনে বেক্গুনে চরের কোলের মানুষ, হোলামাইয়া বউ বুড়া মা বাবারে লই টাউনে চলি আইছে যদি মাইন্ষ্যের কাছে চাই চিন্তি খাই হরি বাঁইচ্ত হারে এই আশায়। ছোড জাগা, কন্নাই আর উইঠ্ব, ই্স্কুল ঘর, মাদ্রাসায় মাডেঘাডে আই তাবু খাডাই মাথা গুঁজি কোনমতে রইছে। চাইরদিক জঞ্জালে ভর্তি অই গেলে ভদ্রলোকেরা ক্ষেপি যার, কিন্তু ক্ষেইপ্লে কী অইব, এই মানুষগুন যাইব কন্নাই। আইজ্ না হয় হ্যাতাগ ঘরবাড়ি বানের জলে ভাঁই গেছে, কাইল ত আঁঙ্গও এই দশা অইত হারে। কিছু মানুষ আগাই আইছে, তাতে কি চিঁড়া ভিজে। কলেরা অই, না খাই, না দাই কত লোক মরি যার, কে আর ইসাব রাইখ্ছে। লীগের নেতারা চেঁচার, সরকারি আফিসের সামনে জড় অই রিলিফের লাই দাবী করের, হ্যাতাগ কতায় কে আর কান দেয়।
একদিন দেই আঁঙ্গ ঘরের সামনে আই আবিদেরা হরিবার লই হাজির। হ্যাতাগ এই অবস্থা দেই ত আঁর মাথায় আত। বাবু আঁঙ্গরে বাঁচান, বানের জলে বাড়িঘর গরু গোতান বেক্ ভাসাই লই গেছে, হঁতে বই গেছি, উপায়ান্তর না দেই শ্যাষমেশ আম্নের কাছে চলি আইছি। আঁর স্বামীর দয়ার শরীল, থাওনের ব্যবস্থা করনের লাই উডিপড়ি লাইগল। হাশে এক উকিলের ঘর খালি হড়ি আছিল, হেই ঘরেই আশ্রয় হাইল। কিন্তু মুশকিল অইল এক মুয়ের ভাষাহান ছাড়া খাওন দায়ন চালচলনে আঁঙ্গ লগে কোন মিল নাই, তবুও ত আঁঙ্গ দ্যাশের মানুষ, অমিল আছে ঠিক কতা, কত কিছুর জোগান দেয়, এক নদীর জলে ছান করে, এক ক্ষেতের ধান খায়, এক রম করি আঁসে, এক রম করি কাঁদে, বিপদে হড়ি আইছে, কিছু এক্কান না কইর্লে অমানুষের কাম অইব। ভাবি দেইখ্লাম, হেগুনে হেগুনের মত থাক্, মিলাইতে গেলেই না যত বিপদ, হেইডা ত অনেক দিনের কাম, আগে ত জীবন বাঁচুক, হরের কতা হরে ভাইব্লেই চইল্ব। ভোটের কতা মনে উইঠ্ল, হিয়ানে আবিদগ আর আঁঙ্গ মইদ্যে ত কোন হারাক নাই। য্যাতারা মরিধরি গেছে, তা ত গেছে, য্যাতারা উঁচা জাগায় ছড়াই ছিডাই আছে, কম ত নয়, হ্যাতারা ভোট দিব ক্যাম্নে। ভিডামাডি জমিন হুকনা অইলে আবিদ কইল, বাবু এইবার আঁঙ্গরে ঘরে হিরি যাইবার অনুমতি দেন। সরকার ত দেয় ন, আম্নে ধারদেনা করি আঁর হোলামাইয়ারে বাঁচাইছেন, আম্নের এই উপকারের কতা কোনদিন ভুইল্তাম ন। অন্ সময় অইছে, ভোট দিতে ঘরে যাইয়ুম।
এই দৃশ্য জীবনে দেই ন, জীবনে দেইয়ুম্ বলি কল্পনাও করি ন। শয়ে শয়ে মানুষ আঁডি আঁডি চলি যার। যাওনটা আনন্দের না দুহের ক্যাম্নে কইব। হেগুনে ত জানে না, কতবার হোঁচট খাইব, কতবার উডি খাড়াইব, জাইন্বার কোনও নিয়ম ত জানা নাই। কেউ ত কোনদিন আত ধরি শিখাই দেয় ন। এইডাও ত জানে না, কোনও বিষধর হাপ হণা তুলি ভিডার উপ্রে বই আছে কিনা, যাইলেই সুযুগ বুজি ছোবল মাইরব। সাবধান অইত চাইলেই ত সাবধান অওন্ যায় না, কত রম কারসাজি হ্যাতেরা জানে, আঁঙ্গ দ্যাশের সাদাসিধা মাইন্ষ্যের বুইজ্বার বাপের হাইদ্য আছে নি। হেগুনের মাথায় হোট্লা হু্ট্লি লই এক আতে লাডি আর এক আতে হোলার আত ধরি মা, আর মাইয়ার আত ধরি বাপ, চইল্ছে ত চইল্ছেই। বেক্গুনে ঘরের দূয়ার তুন্ চাই থায়। কন্নাই আছিল এদ্দিন? য্যাতারা জানে তারা জানে আর য্যাতারা জানে না আবোদা অই হশ্ন করে। না, হ্যাতেরাও জানে ইয়ানে হ্যাতাগ জাগা অইত ন, সময় হুরাইলে একদিন চলি যাইত অইব নিজের জাগায় যিয়ানে ব্যারামের ওষুধ নাই, গলা ভিজাইবার হরিষ্কার জল নাই, গাত্ মাথাত্ মাই্খ্বার তৈল নাই, গায়ে চড়াইবার জামা নাই, বউঝিগ হরনের শাড়ি কিনবার হইসা নাই, খালি আছে চ্যাটচেটে গরমের ভ্যাপসা জ্বলন, চৈত বৈশাখের হাগলা বাতাসের দাপট দিনেরাইতে। আর ইয়ানে বাবুগ আত বাড়াইলেই মুডা মুডা ট্যাঁয়া, যা খাইতে মন চায় খায়, যা হইরত চায় হরে, মজবুত দালানে আরামসে হুই বই থায়, এরুমই ভাইব্তে ভাইব্তে হঁত মাড়ায়। হ্যাতাগ ভাবনাডা বেঠিক কন্নাই। এক দ্যাশের মানুষ অই কিয়ের লাই এত হিছে হড়ি আছে, এর উত্তর খুঁইজ্তে চাইলে চুল ছিঁড়ি হালান ছাড়া উপায় নাই।
হেগুনের আলোর হিথিবীডায় খালি দুই চয়ে আঁন্দার আর আঁন্দার। কারা করি রাইখ্ছে এরুম আঁন্দার, ভোটের বাক্সে কী উত্তর লেয়া থাইক্ব? তবুও ভোট দিবার লাই হ্যাতাগ মন উচাটন করে কিয়ের লাই? দ্যাশের লগে য্যাতারা ল্যাপ্টাল্যাপ্টি করি আছে দ্যাশের মানুষ ক্ষমতা হাইলে হ্যাতাগ লাভ অইব, এতাগ কী লাভ অইব? মিছিলে যাইবার ডাক দিলে হ্যাতেরা ছোডে কিয়ের লাই? কীয়ের টান হেগুনের, খালি আশায় আশায় বুক বাঁধে, আইজ্ না হয় কাইল সূর্য উইঠ্বই উইঠ্ব, না হয় কোনদিন উইঠ্ত ন। এই কতার উত্তর আঁর কাছেও কী আছে! টাউনের মাইন্ষ্যেরা কিয়ের লাই যে হ্যাতাগ হাডা হাডা মুখগুনের মুই চাই থায়, কী খোঁজে হ্যাতাগ হুকনা হোড়া আত আর হোড়া হা’র ভিত্রে! নাকি হাজার বছরের বাপ-ঠাদ্দার ঋণের জ্বালা শোধ কইর্ত চায়, না কোনও হায়চিত্ত কইর্ত চায় জমাইন্না হাপের!
ঝড়ের তাণ্ডবে কারা লণ্ডভণ্ড অই গেছে আঁঙ্গ দ্যাশের মানুষ না হশ্চিমাগ হাজানো বাগান। হ্যাতারা কী টের হায় ন শক্তহোক্ত ভিত্হানে হাঁটল ধইর্ছে এট্টু এট্টু করি। হিয়ের লাই কী কাঁপন ধইর্ছে। হ্যাতারা লাডির বাড়ি দি এক্কারে আঁঙ্গ মাথা হাডাই দিব, যেরুম লাথি মারি মাডিত্ হালাই আঁর হোলার হা ম্চ্কাই দিছে। জোয়ান হোলারা কই বেড়ায়, ‘মার দুধ খাই বড় অইছি আমরা, আঁঙ্গরে দমাইত অইলে গুল্লি মাইর্লে অইত ন, কইল্জার জোর চাই।’ হেগুনের কতা হুনি আঁর ডর লাগে, হা ঠক্ ঠক্ করি কাঁপে। মুয়ে আগুন ঝরে, কী কইর্তে কী করি বয়। ইয়াহিয়া খানের হুমকির মইদ্যে ঝাঁজ আছে, সিংহাসনে হা দোলাই চম্কার, মনে কইর্ছে বঙ্গবন্ধু ডরাই যাইব, হ্যাতেনে যে বাঙাল বাপের ব্যাডা এইডা মাথায় হাঁদাইতে অন্ও সময় লাইগ্ব।
মাষ্টরনি কয়, ছয় দফারে পশ্চিমারা কতার কতা মনে কইর্ছিল, ভাইব্ছিল তুড়ি মারি উড়াই দিব। কিন্তু ব্যাপারডা অত সোজা আছিল না, কোমরে গামছা বাঁধি নাইম্ছে যে। মাইয়ার এলেম আছে, কতার মত কতা কয়। ধুঁয়াডা গল্গল্ করি উইঠ্ছে, কেউ দ্যায়, কেউ দ্যায় না। হ্যাতেনে মাখন জিনের কোট প্যান্ট হরি আফিসে যায়, আর বিয়াল অইলে আঁই চাই থাই কহ্ন রিক্শার টুং টাং শব্দ হুনুম, রিক্শার তু্ন্ নামি গট্ গট্ করি ঘরে হাঁদাইব, আত হা ধুই চেয়ারে ড্যালাম্ দি বইলে তালহাখা দি বাতাস কইর্ব। বাতাস খাইতে খাইতে যত রাজ্যের কতা বার অই আইয়ে। আইজ্ হ্যাতেনের মেজাজ সপ্তমে চড়ি গেছে। কে আবার কন্নাই কি কইল কে জানে। খোঁচাইতে খোঁচাইতে মুখ খোলে। বিচারক তোফাজ্জল ইসলামের বিচারের মইদ্যে আছিল অনিয়মের গন্দ! এক ইস্কুল মাষ্টররে বিনা কারণে চাকরি তুন্ ছাঁডাই কইর্ছে বলি মামলা গেল কোটে। মাষ্টর আত জোড় করি কইল, ‘হুজুর আঁই এক গরীব মাষ্টর। ছাত্রগুনরে কই নিজের ভাষারে ভালবাইসবা, মায়ের ভাষা মায়ের দুধের হমান আর বাংলা তোগ মা, এই কতাডা মনে রাইখ্বা। এই কওনডা আঁর অপরাধ, আম্নেই কন্!’ বিচারক কতাগাইন হুইনল। মাষ্টর আছিল আঁর স্বামীর মক্কল। গম্ভীর অই থাই কিছুক্ষণ হরে আঁর স্বামীরে উপলক্ষ করি ভালামন্দ কতা কইল, ‘আম্নেরও কি একই মত, মক্কল দ্যাশের বিরুদ্ধে যাই কতা কইছে। এই দ্যাশডার নাম হাকিস্তান, বাংলা নয়। আম্নের মক্কলের চাকরি বাতিল।’ রাসেল মাষ্টর হাউ হাউ করি কাঁইন্তে কাঁইন্তে আদালত তুন্ বার অই গেল। যাইবার সময় কই গেল, ‘এরা বেক্গুনে বেইমানের জাত, আল্লাহ এগুনের বিচার কইর্ব।’ হরে হরে জানা গেল তোফাজ্জল ইসলাম জামাতের মেম্বার, তলে তলে হাকিস্তান সরকারের কাছে খবর পাচার করে। আঁর স্বামীও হতিজ্ঞা কইর্ল এর শ্যাষ দেই ছাইড়ব। অইত হারে দ্যাশের নাম ‘বাংলা’ কইছে, মিথ্যা কতা ত কয় ন। হাকিস্তান মালিক অইত হারে, মাডি ত বাংলারই, এই কতা অস্বীকার কইর্ব কার এত বুয়ের হাডা। আওয়ামী লীগ ধিক্কার মিছিল বার কইর্ছে। মাষ্টররে মিছিলের সামনে খাড়া করাই হাজার হাজার মানুষ শাসকের এই অবিচারের বিরুদ্ধে হতিবাদ শ্লোগান দিছে – হাকিস্তান মুরদাবাদ। হুলিশের লাডির মাইরে মাজা হাঁইড্ছে কত মাইন্ষ্যের। মিছিল কি আর থামে, আদালত ঘেরাও অইছে হপ্তাহ খানিক ধরি। অবস্থা বেগতিক দেই সরকার আর আগাইবার সাহস করে ন, এই বিচারকরে হাঁডাই দিছে অইন্য জিলায়। অইন্য বিচারকের রায়ে আগের আদেশ বাতিল অই গেল। আঁর স্বামীরে বেক্গুনে মালা হরাইল। হিছনে হড়ি গেছে জামাতিরা, হাইর্লে ছোলাই হালায়। নিজেগ মইদ্যে এরুম হত্রুতামি বাপের জম্মে দ্যাই ন। এক্কান কতা সাফ্ অই গেল শুধু ধম্ম ধম্ম করি দ্যাশডারে বাঁচান যাইত ন, ধম্মে ধম্মে রেষারেষি করিও দ্যশডারে বাঁচান যাইত ন। তয় দ্যাশের মাইন্ষ্যের মনের গতি একমুখী অইছে, কারণ অইল মাইন্ষ্যে এতদিনে হাঁচা হাঁচা দ্যাশডারে ভালাবাইসতে শিখছে। এক্কান হশ্ন মাথাচাড়া দি উডে এই প্রেম ভালবাসা কদ্দিন থাইক্ব, ক্যাম্নেই বা ধরি রাইখ্ব। বিশ্বাস যে রাওন যায় না এরুমটা ন, বঙ্গবন্ধুর মত মানুষ আছে না, মানুষডা খুবই ভালা, খাডি মানুষ, বেকে মনের মইদ্যে এক্কান বড় জাগা দি রাইখ্ছে। আঁই মাঝে মাঝে ভাবি ভারত যহ্ন এক আছিল দ্যাশের মানুষ মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুরে নেতা মাইন্ত, হ্যাতেনেগ কতায় কত মানুষ হরান দিছিল, হিগাইন ত চুঁইবুঁই গেল, এদ্দিন বাদে আর একজন নেতারে হাইল, যাঁর ডাকে আগুনেও ঝাঁপ দিত হারে। আঁর স্বামীই ত গদ্গদ্, বঙ্গবন্ধুরে নেতা মাইন্ছিল, হ্যাতেনের ছবিহান বাঁধাই ঘরে টাঙাইছে, বিশ্বাস কইর্ত শুরু কইর্ছে যদি কেউ বাঙালিরে রক্ষা কইর্ত হারে, এই মানুষডাই হাইরব, মনের জোর আছে, অনেক দূর দেইখ্ত হারে। এরুম আস্থার খবর সরকারের কাছে যায় ন! নিশ্চয়ই গেছে, হিয়ের লাই ত হেই লিষ্টিতে নাম উইঠ্ছে, টাউনের কারা কারা হাকিস্তান সরকারের কামকাইজে খুশি ন। হেই খবর আওয়ামী লীগের নেতারা আঁর স্বামীর কাছে হৌঁচাই দিছে, কইছে সাবধানে থাইক্তে। কতা অইল হরানডা ক্যাম্নে যাইব, দ্যাশের বেইমানরা নিব, না চশমখোর হাকিস্তানের সেনারা গুল্লি করি মাইর্ব। আঁর স্বামী আঁসে, কয়, ভালা কতা, আঁর হরান দিলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন যদি হুরণ হয়, হেইডাই সই।
জাগে রে মানুষ, জাগে রে দ্যাশ
নিজের দ্যাশে গইড়্ব স্বদ্যাশ
বেক্গুনে কতা কইছে চিল্লাচিল্লি করি, ভাষা বুজন দায়। একলগে কতা কইলে কোন কতার অর্থ হরিষ্কার অয় না। তয় যে কতাগাইন কইছে, নোয়া কতা, ভবিষ্যতের কতা। কতার লগে মাইন্ষ্যের আঁচার আচরণেরও অইছে কতরমের হরিবর্তন। এক্কান ঢেউ ত আই আছড়াই হরের, ভাসাই লই যার যেমুই যাইত চায়। ভোটের ঘন্টা বাজি গেছে। এই ভোটের রঙ ঢঙ আলাদা। সাড়ে সাত কোটি মাইন্ষ্যের মনের গতি টের হাওন যাইব। আওয়ামী লীগ এরুম ঝাঁপান ঝাঁপাইছে, জামাতে ইসলামী, পিডিপি, হাকিস্তান মুসলিম লীগ কুল কিনারা খুঁজি হার না, ঘেডি চাপি ধইর্ব না আত টানি ধইর্ব, না কোন মাইন্ষ্যের মনে কুমন্তর দিব, বুজি উইঠ্ত হারেন না। মাইন্ষ্যের মন বুজা কি এত সোজা, কহ্ন যে কোন মুই ঘুরি যাইব হেইডা কে কইব। মাইন্ষ্যের মনের লাগাম ধরি রাওন মুশকিল। হা’র তলার মাডি শক্ত কইর্ত অইব। মোছলমান ভাই বইন্গ মনের হদিশ খুঁইজ্লে বুজা যায় কেউ কেউ অইন্য সুরে কতা কয়। হেগুনের মন আওয়ামী লীগের দিগে ঘুরাইবার লাই কত হচার, কত কতার মালা কাব্য করি করি ঘরের দূয়ারে দূয়ারে আওড়ায়, কেউ হুনে কেউ হুনে না। আওয়ামী লীগের হাল্লা যে ভারি টের হাওন যার দিনে রাইতে। আঁঙ্গ ঘরের উল্টা দিগে ঘোষেগ বাড়ির তিন তিনডা মাইয়ার হিছে লাইগ্ত কারা য্যান্, নানা কতা কইত। একবার ঠিকও করি হালাইছিল হেগুনের জ্বালায় বাড়ি হাল্টাই হালাইব। ওমা চয়ের সামনে দেইখ্লাম ক্যাম্নে ক্যাম্নে বাতাস ঘুরি গেল, হেগুনের মুখ দি আর কতা হরে না। ঘোষেগ বউগ জিগ্গাইলাম জাননি এর রহস্যহান কী? বউ চালাক কম ন। কয়, আর কইয়েন না দিদি, বেক্গাইন ভোটের রঙ্গ। হইলা বুজি উইঠ্তি হাইর্লাম না কি কয়, হরে হরে বুইজ্লাম হাটির তুন্ নিদ্দেশ আইছে অন্ হিন্দুগ হিচনে লাগন যাইত ন, হাইর্লে এট্টু আধটু তৈল মালিশ কইর্ত অইব, ভোটডা যাতে হ্যাতাগ হক্ষে হড়ে। সাবধান থাইক্ত অইব, চাইরদিগের বাতাস গরম, বুজি হুনি চইল্ত অইব। আওয়ামী লীগ যে হাওয়া ঘুরাই দের, বিরোধীরা হাড়ে হাড়ে টের হার।
হ্যাতারা বেক্গুনে মিলি বলাবলি করের, বেশ অইছে, এদ্দিন আঁঙ্গরে কি কম জ্বালান জ্বালাইছে, এবার হালাগ উচিত শিক্ষা অইব। চাইরদিগে ভিত্রের কতাগাইন বার অই আইয়ের। মাইন্ষ্যে বুজি উইঠ্ত হারের কত কারসাজি হ্যাতেরা গোপনে গোপনে কইর্ত লাইগ্ছে। ছয় হাজার সেনা অফিসারগ মইদ্যে বাঙালিরা মাত্র তিনশ, তাও কি নিচের দিগের অফিসার, হেথাগ হা’র নিচে রায়। আঁঙ্গ নাকি নিরাহত্তা নাই, অস্ত্রসস্ত্র পাঁচানব্বই ভাগ হশ্চিম হাকিস্তানে আছে, অনুমান কইর্ত হারেন নি আঁঙ্গ দ্যাশের অবস্থাহান, বেক্গুনে মিলি হ্যাতাগ আত তুন্ দ্যাশডারে উদ্দার কইর্ত অইব। বেল্লাল মিঞা আর অশোক ডাক্তর দুইজনে মিলি হুইর হাড়ের সিঁড়িত্ বই আরও কত কতা যে কয়, আঁই বেক্ কতা বুইজ্তামও হারি না, তবু ঘরে বই বই কান হাতি হুনি। খালি ভোটের কতা লই চট্কাইলে ত আঁর চইল্ত ন, ঘরে মেলা কাম হড়ি রইছে।
আঁর এক দূর সম্পর্কের মাসি আছে মাইল আষ্টেক দূরে থায় কেতুহরে, কদ্দিন ধরি ভাইব্ছি হ্যাতেনরে চাই আইয়ুম, সময় আর কইর্তাম হারিয়েন না। আঁই চলি গেলে হোলামাইয়ার হড়ালেহার অসুবিধা অইব, রাঁধাবাড়ি করি কে আর খাওয়াইব, কাজের হোলাডাও হেই যে বাড়ি গেছে আর আওনের নাম নাই। তাই বলে কি আত্মীয় হজনের খোঁজখবর লইতাম্ ন। মাডির রাস্তা, ধুল উড়ের, ঝোপঝাড়ের কিনার দি এট্টুহানি আঁটলেই নোয়া বৌয়ের মত লাগের দুইহাশ, হরাই হরাই যাওন লাগে, লতা আই হড়ে মাথার উপ্রে, যন্তনার আর শ্যাষ আছে নি, কহ্ন যে যাই হৌঁছাইয়ুম ঈশ্বর জানে। আঁডি আঁডি, হা’র গোড়ালির ছাল উডি যার, তবুও আঁডি। আঁর মুসাত বইন দেই চখ বড় বড় করি কয়, ও দিদি, তোর হা হাঁডি ত রক্ত ঝরের। হেতি তাড়াতাড়ি উডানের এক কোণার তুন্ গেন্দা হাতা ছিঁড়ি আতের তাইল্লাত্ কচ্লাই আঁর গোড়ালিত্ চাপি ধরি রায়। রক্ত বন্দ অই যায়। আঁর মাসি চিৎকার দি কয়, কার লগে কতা কচ্ রে শেফু। অষ্টমীদি আইছে গ। মাসি ত আহ্লাদে আড্খানা। আতে আতে তালি দি কয়, অষ্টমীরে আঁর কাছে লই আয়, কদ্দিন মুখহান দেই ন। এদ্দিন বাদে মাসির কতা মনে অইড়ল বুজি। মাসি আঁর থুত্নিহান আল্তো করি ছুঁই বিলাপ কইর্তে শুরু করে। মাসিরে ক্যাম্নে হাম্লাইয়ুম, চয়ের জল হালায় ঝরঝর করি।
বুড়া অই গেছি মা, কদ্দিন আর বাঁচুম ক, তুই যে দেইখ্তি আইছস আঁই কত যে খুশি অইছি, কী কমু। ও শেফু, অষ্টমীরে এক গেলাস জল আর দুই চাইরহান বাতাসা দে, তাঁতি পুড়ি আইছে, বয় মা বয়, আঁর কাছে বয়। আঁর মাথাগাইন টানি গালে একহান চুমা দেয়। মাসির মাথার আগার সাদা চুলগুন হরাই আত বুলাই দিলে মাসির আরাম হয়। আহ্! কদ্দিন বাদে কেউ এরুম করি মাথাত্ আত বুলাই দিল। বাঁচি থাক্ মা, বাঁচি থাক্। হতায়ু হ। মাগ, আর কইছ না, কি কষ্টে যে আছি, শরীলডারে লাড়াইতাম হারি না, ডাইন আত ডাইন হা অবশ অই গেছে। মাসির কষ্ট দেই হরানডা আঁর জ্বলি গেল। বুড়াবুড়িগ কত যে কষ্ট!
বাঁইচ্তে ইচ্ছা করে না রে মা, এবার যাইতে হাইর্লে বাঁচি। অমলটা ত আঁরে রাই স্বর্গবাসী অইছে। নাতিডারে আঁর কাছে রাই চলি গেছে। হান্ডাগুলি মারি বেড়ায় হারাদিন, ভোট লই মাতামাতি করে, কহ্ন কোন বিপদ ঘডায় কি জানি, মুয়ে ঐ হ্যাতের এক বুলি – নৌকা মার্কায় ভোট দিন। বউডা থাইক্লে না অয় কতা আছিল, হেই যে শ্রাদ্ধশান্তি শ্যাষ করি গেল, আর এমুখো অয় ন। অন্ ত হুনি হেতির মা বাপে আবার বিয়া দিব। শেফুডার ত কবে বিয়ার বয়স হার অই গেছে। আঁই দুই চখ বুইজলে এগুনের যে কী গতি অইব, আঁই চিন্তায় চিন্তায় মরি যাই। মাইয়া গোঁ ধরি বই আছে, বিয়া কইর্ত ন, হেতি চলি গেলে আঁরে কে দেইখব এই ভাবনা মাথাত্ গাঁড়ি বইছে, দেয়চ্ নারে মা, এক্কান হোলা যদি হাছ্,কানা খোঁড়া যা হোক, খাওয়াইতে হরাইতে হাইর্লেই চইল্ব। না অয় যা দিনকাইল হুইরছে হিয়াল কুত্তা টানি লই চলি যাইব। মাসি এত কতা কইয়েন না, যার কেউ নাই, তার ভগবান আছে। নাতিডারে এট্টু বুজাই ক য্যান্ আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগ না করি কোন ধানের গোলায় খাতা লেওনের কামে ঢুকি যায়।
আঁই মাসিডারে উল্টা দিক করি হোতাই দিলে যতিন আই হাঁদাইল। কয়, বুড়ি আবার বক্ বক্ শুরু কইর্ছে বুজি। আরে হ্যাতেনে কয় আঁই বলে খালি বেগার খাডি। রাজনীতির কিছু ত বুজে না। আরে বঙ্গবন্ধুরে না জিতাইত হাইর্লে হাঞ্জাবীরা হিন্দুগ কচুকাডা করি ছাইড়ব। এই দ্যাশে হিন্দুরা আর থাইক্ত হাইর্ত ন। কতাডা যতু এক্কারে ভুল কয় ন, চিন্তার বিষয় আছে।
দিন ত চলিই যায়। মাসিও যাইত দেয় না। কয় আরো দুই দিন থাক্। ওমা যে ছাগলডা গাছের গোড়ায় বাঁধি রাইখ্ছে ম্যাঁ ম্যাঁ করি ডাকে। কি জানি ছাগলডাও বুজি হালাইছে অতিথ্ এবার বিদায় লইব। ঘাস সামনে ধইর্লেও খাইত চায় না। মায়া মমতা এরুম জিনিষ আডার মত লাগি থায়, ছাড়াইতে চাইলেও ছাইড়তে চায় না। যতু আইজ্ লাফাইতে লাফাইতে বাড়ি আইছে। আওয়ামী লীগের সভায় চাইর মুই তুন্ দলে দলে মানুষ আইছে। আততালিতে হাঁডি অইরছে জীবনতলার মাড। এরুম উচ্ছ্বাস দেই জামাতীগ হুঁশ উড়ি গেছে। মাসি বিছনার তুন্ চিৎকার করি কয়, হারামজাদা, তোরে মানা কইর্ছি নি কোনও সভাত্ যাইতে না। কী যে কও ঠাম্মা, আওয়ামী লীগ এবার হচুর ভোডে জিতব। বঙ্গবন্ধু কইছে স্বাধীন বাংলা অইব। হশ্চিমারা আঁঙ্গ ট্যাঁয়া হইসা, কাঁচামাল বেক্ কিছু চুরি করি লই যার, হ্যাতাগ দ্যাশের কারখানাত্ জিনিস বানাই আঁঙ্গ দ্যাশে চড়া দামে বেচে। বেক্ সরকারি দপ্তর হশ্চিম হাকিস্তানে। আঁঙ্গ হোলারা চাকরি হায় না। এরুম তফাত করন আর চইল্ত ন। এটা আঁঙ্গ জাগা, বেক্ অধিকার অন্ অইতে আমরা বুজি নিমু। মাসি রাগি টঙ অই যার। বিছ্না চাপরায়। হ্যাতে কি কয় রে অষ্টমী, আঁই ত কিছুই বুজি না। আম্নের বুজনের দরকার নাই গ মাসি, হ্যাতে যা কয়, ঠিক কয় গ মাসি। তুইও হ্যাতের কতায় তাল দেছের, তোরা বেক্গুন আঁর হত্তুর, আঁই মরলেই তোগ শান্তি। মাসি আম্নে খালি মরার কতা কন্ কিয়ের লাই। যতু আছে, শেফু আছে, আঁই বাঁচি আছি, আম্নের এত চিন্তা কিয়ের লাই।
তোরা বুইজ্তি হাইর্তি ন আঁর মনের কতা, এই দ্যাশে হিন্দুগ কোন দলের নেতারা মানি লইত ন। আঁর যতুর যদি কিছু অই যায়, বংশে বাতি দেওনের লাই কেউ থাইক্ত ন, আঁই আঁর দ্যাশের মাইন্ষ্যেরে চিনি, হ্যাতারা বেক্গুনে ভাই ভাই। দ্যাশ ভাগের সময় দেই ন, কেউ আঁঙ্গরে বাঁচাইত আইছিল নি, হুইরে ডুবি থাই মাইয়ারা হরান বাঁচাইছে, বাড়ির কত্তারা হলাই আছিল হাট ক্ষেতে। হেই দিন যে হিরি আইত ন, কে কইত হারে। মাসি হেই দিনের কতা কী আঁই ভুলি গেছি। সময়ও হাল্টায়, মানুষও হাল্টায়। অন্ ত বঙ্গবন্ধু কইছে আমরা হিন্দু মোছলমান মিলি নোয়া দ্যাশ বানাইয়ুম। আরে মুজিব কী এই দ্যাশের মালিক, না হ্যাতেনের কতা দ্যাশের বেক্ মানুষ হুইনব। আ্ম্নে মাসি হাঁচা কতা কইছেন, চেষ্টা করি দেইখ্তে ক্ষতি কী! অইন্য আর কী উপায় আছে হিন্দুগ সামনে, আম্নে ক্ন্।
অষ্টমী হিশী, ঠাম্মা কউক্ আঁই হুইন্তাম্ ন, হুরান দিন আঁই দেই ন, আঁই এই দিন দেইয়ের, বঙ্গবন্ধুর কতা আঁর ঠিক মনে অর, আঁই হ্যাতেনের লগে আছি, যা অয় হরে বুজুম। শেফু আর কতা কইত হারে না, বোবা অই গেছে য্যান্। কার কাছে যে কইব। হেতিরে হাঁপাইতে দেই আঁই কইলাম, কী অইছে রে? দম আট্কাই আইয়ে, তবু নিজেরে হামলাই লই শব্দগুন উড়াই দেই। আর কইছ না দিদি, ঐ যে নিরু কাকিমার ছোড বইন, কাকিমার লগেই থায়। কোনও উপায় না দেই নিজের কাছে আনি রাইখ্ছে। হেতির মাথায় এরুম গোলমাল অইছে, ধরি রাওন যায় না, ঘরের মইদ্যে যা জিনিসহত্র আছে বেক্গাইন ভাঙিচুরি হালার, যারে সামনে দেয় বেক্গাইন মেলাই মেলাই হালাই দের।
শেফুর কতা হুনি মাথাডা ঝিম মারি আইয়ে। মাইয়াডারে কি জানি ভূতে ধইর্ছে নি, গরমে ভালা মাইন্ষ্যের মাথা হাডি যার, আর হেতির ত মাথার দোষ আছে। কাঁচা বয়সে বিধবা অই গেছে, সাদা থান হরি থায়, চুলগাইন বাডি ছাঁডের মত কাডি দিছে। হেতির বয়সী মাইয়ারা রং চং মাই ঘুরি বেড়ায়। হেতি ত বেদিশা অই গেছে, কোন মুই যাইব, হাগলের মত হুইরের ঘাডে বই থায়। নিজের মনে গাছের ঠাইলের লগে কতা কয়। একবার সদর দরজার মুই যায় আবার বেতইন গাছের ছায়ার লগে ঘষাঘষি করে, ডুয়র গাছে উডি লাফায় ঝাঁপায়, কে আর তহ্ন জাইন্ত এরুম অইব। দিদির বাড়ি আই হাগলামিডা এত জাপটাই ধইরব, হাড়া হতিবেশী কেউই ত বুইজ্ত হারে ন। কারও মাথায় যহ্ন হোকে বাসা বাঁধে, নিজেও ত টের হায় না, কুরি কুরি খায়, জোরে লড়ি উইঠ্লে হামলাইত হারে না। দরজাহান খুলি মাইয়াডার কাছে যাই হিডে আত দিলে ছেঁকা খাওনের মত লাফাই উডি আঁর গলা চাপি ধরে। মনে অইল এই বুজি শাঁস বন্দ অই মরি যাইব যাইয়ুম। ওমা কী মনে করি আঁর চয়ের মুই কিছুক্ষণ চাই রেহাই দিল। মাইয়ডার এই রোগের কারণডা আঁর কাছে ধীরে ধীরে হরিষ্কার অইল। কত কষ্ট হেতির বুকে চাপা হড়ি আছে, কে এক্কান রাস্তা দেহাইব? অল্পবয়সী গ্ৰামের বিধবার যে কত কঠিন হরীক্ষা দিত হয় সূর্য উডার তুন্ সূর্য ডুবা হইয্যন্ত, কেউ কি চখ মেলি চায় একবার, খালি ছোলাই খাইত চায়। আঁই যহ্ন কইলাম্, বইন তোরে আঁই আর একবার বিয়া দিমু, হচন্ড গরমে শইর্ল্যে বিষ্টির জল অইড়লে যেরুম হয়, চয়ে মুয়ে এক টুকরা আলো য্যান্ ঠিকরাই বার অইল। হ্যাঁরে হাগলি, হিন্দুগ মইদ্যে বিধবা বিয়া হয়, তুই জানছ্ না। হুনি ত হেতি আকাশ তুন্ হইড়ল। ঘাড় লাড়াই কইল, না। আঁর আত দুইডা চাপি ধরি কইল, কন্নাই লেয়া আছে। মাইয়া ত হড়ালেয়া জানে না, ক্যাম্নে বুজাই, এ ত ভারি বিপত্তি। আঁঙ্গ দ্যাশের মাইন্ষ্যেরা স্বাধীনতা চাই, স্বাধীনতা চাই বলি হরান দি হালার, আরও যে কত আঁন্দারে গ্ৰামগঞ্জ ডুবি রইছে, হেই খবর কেউ রায়ে না, বঙ্গবন্ধুরে আরও কত কিছুই না হাল্টাইতে অইব। মনে মনে কইলাম্, মাইয়াডার মঙ্গল হোক। দুই দিন বাদে হুইন্লাম্, হেতির মাথার হোকাডা এট্টু কমই লড়ে চড়ের। আঁর সান্ত্বনার কতা হুনি মনে অয় হেতির বিশ্বাসডাও হিরি হাইছে কে জানে। হেতি বলে বন্দ ঘরের জান্লা দি আঁঙ্গ মাসির ঘরের উডানের মুই চাই থায়। কী মনে করি বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ বইহান হেতির আতে দি আইলাম। হেতি বইহান উল্টাই হাল্টাই দেইখ্ল।
আঁর মাসি অগ্গা ছাগল হাইল্ত। কত আদর করি লালী কই ডাইক্ত। মাসি ঘুমের তুন্ উডি দেইখ্ল আই বেয়ানের আলোডা তেছরা অই ঘরের মইদ্যে হইড়ছে। হেরুম তেজও নাই, শীত এরুম কাবু কইর্ছে, আলোর ক্ষমতা নাই ঠেহায়। মাসি ত ঠক্ ঠক্ করি কাঁপে। কাঁথার তলার তুন্ কয়, লালীর ডাক হুনিয়ের না কিয়ের লাই রে শেফু। দড়ি ছিঁড়ি উডানে চড়িবড়ি খার বুজি? শেফু ঘরের দরজায় আই দেইখ্ল লালী নাই, গোডা বাড়ি খুঁজি দেইখ্ল কোন হদিসই মিলল না লালীর। কী জবাব দিব অন্! উত্তর না হাইলে মাসি বাড়িহুদ্দা চেঁচায় হাডাই হালাইব। খোঁজ্ খোঁজ্ এই বাড়ি হেই বাড়ি। কেউ কইল, দেইখ্ছিলাম বটে, দত্তগ বাগান বাড়িত্ হাঁদাইছে। আর রক্ষা নাই লালীরে হিডি মারি হালাইব। এই খবরহান ক্যাম্নে দেই! আবার অইন্য খবরও ত ভাঁই বেড়ায় – জয়নাল হাড়ার এক দুষ্টু হোলা গলার দড়ি ধরি টাইন্তে টাইন্তে লালীরে লই চলি গেছে। সব্বনাশ! অন্ কি অইব, মাসির কানে গেলে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধাইব। দুই রম কতার ফাঁদে হড়ি দূর্বিষহ কইরব অবস্থা। দত্তবাবুরা কী ছাড়ি কতা কইব। গাছের আগা খাইলে গুষ্টির তুষ্টি কইর্ব। আর যদি জয়নাল হাড়ায় যায় হ্যাতাগ এত ছাগলের মইদ্যে তুন্ লালীরে খুঁজি বার করন সহজ কাম অইত ন। যতু বার অইছে লালীর খোঁজে, কোন মুই যাইব উত্তর মুই দত্তগ বাগানে না দইন মুই জয়নাল হাড়ায়। মইনুল আগ বাড়াই জিগ্গায়, কীরে যতু কন্নাই যাছ্, ছাগলের খোঁজে বুজি? ছাগল কিয়ের লাই কছ্, হিগার এক্কান নাম আছে। তুই ক্যাম্নে জান্লি আঁঙ্গ বাড়ির লালী চুরি অইছে। তোরে কইউম্ কিয়ের লাই ক্যাম্নে জাইন্লাম। ও তাইলে তোগ হাড়ার কেউ চুরি কইর্ছে। কী কইলি, আমরা চোর। চোর যদি না অবি, জাইন্লি ক্যাম্নে! হরমান দে তাইলে।
ছাগল দল বাঁদি মাডে চরে, আলাদা করি লালীরে চিন্ত ত হাইর্ত ন। মাইন্ষ্যের মত নাম ধরি ডাইক্লে সাড়া দিব। হ্যাতেরা ত চোর বদনাম দিছে, ইয়ের লাই বেক্গুনে মিলি মাইর্ত আইয়ে। হুলিশের কানে এই খবর যায়। যতুর আবার আওয়ামী লীগের সমর্থক বলি হরিচিতি আছে হাঁচ গ্ৰামে। নালিশ গেছে হ্যাতে জাত তুলি গালাগাল দিছে। হুলিশ দেইখ্ল এই হুযুগ – দে হালারে লক আপে ভরি, মালাউনের জাত, ইসাব করি কতা কইতি শিখছ্ ন।
হাটিত্ খবর গেলে এক নেতা আই আর এরুম কইর্ত ন এই কই মুচলেকা দি জামিনে ছাড়াই নিল। যতুর কানে কানে কইল, ভোটের সময় এরম কইর্তে আছে বাপ। জয়নাল হাড়ার আওয়ামী লীগের সমর্থকরা এবারের মত তোরে বাঁচাই দিছে। এরম কতা আর কইছ্ না, পার্টির উপ্রে মাইন্ষ্যে অযথা আঙুল তুলি দিব, তোর গাত্ নৌকা মার্কার ছাপ্পা মারা আছে, হেইডা বুজচ্ না, মন দি পাটিডা কর। দাদা, আঁর লালীর কী অইব? রাখ্ ত তোর লালী, হশ্চিমাগ আত তুন্ দ্যাশ রক্ষা কইর্ত অইব, কঠিন সময়, চাইর মুই আগুন জ্বলের। খবর কিছু ত রাখছ্ না। আঁর ঠাম্মা, ছাগল না লই গেলে কাঁদিকাডি মরিই যাইব, লালী হ্যাতেনের হরান। আইচ্চা, তোর দাদীরে আঁই বুজাই কই দিমু, তুই চিন্তা ছাড়ান দে।
মাসির আঁর হারা রাইত ঘুম নাই। যারে মনে হুষি রাই জীবন চলে, অন্ হিগারে যদি টোকাই না হাওন যায়, তাইলে মনে এট্টু আদ্টু দুখ্ ত অইবই, অবাক অইবার মত ত কিছু নাই। এত সহজ কতায় কী উড়াই দিলে চলে! মাসি টপাটপ চয়ের জল হালায়, কিছুতেই বুজাই কইত হারিয়েন্ না। মাসি বুড়া অইছে, জীবনের কত রঙ্গ দেইখ্ছে, তবুও কি কইত হারে নি অন্ও কোনডা ঠিক, কোনডা বেঠিক। আর যদি বুজেও হ্যাতেনের কতাহান কে আর অত মাইন্য করে। কবে ত জম্মাইছে, দ্যাশের অবস্থাহান তহ্ন কেরুম আছিল, হাবভাব আর চিন্তা করনের ঢঙ, ডাকাডাকির রমসম এক লগে মিয়াইলে ভিন্ন জগৎ। হেই জগতের স্বাদ আইজকাইলকার ছুট্কিয়ারা ক্যাম্নে আর বুইজ্ব।
আইচ্চা মাসি, আম্নে গণতন্ত্র, আন্দোলন, স্বাধীনতা, ধর্মঘট এই কতাগাইন কহ্নও হুইন্ছেন নি? অষ্টমী, তোর এত ভারি ভারি কতা হুনি আঁর কাম নাই। তোর আন্দাজ আক্কল কিচ্ছু নাই রে। মারে, এসব কতা হুনুম ক্যাম্নে, য্যাই কারণে ইগাইন্ অর, হিগাইন্ ত আগে আছিল না। ঘরে ঢুকাই দিছিল তহ্নকার মাইন্ষ্যে গরু দৌড়ানর মত করি। আম্নের অন্ ইচ্ছা করে না হুরা বাংলারে ঘুরি দেইখ্তে যেরুম করি মুজিব দ্যায়ের। এই দ্যায়াডা বড় আজব দ্যায়া। কত মায়া, কত মমতা, কত রক্তের ঢেউ খেলা, কারা যে মাইজ্ মাডের দহল নিব কেউ জানে না।
জানে জানে, কইত হারে না। আঁঙ্গ আর এক দ্যাশ আছিল, হেই দ্যাশডা ছিল হুরা আঁন্দার, হারিকেন আর কুপির আলোয় সংসার দ্যায়া, মাইয়া মানুষ আর বাইচ্চাকাইচ্চার মুখ খালি কিলবিল কইর্ত। মশামাছি আই ভ্যান ভ্যান কইর্ত কানের কাছে। তেনাতুনা কাহড়চোহড় হরি লইজ্জা নিবারণ, কে বুইজ্ব রে এই জ্বালা, কোন্ডা সুখ কোন্ডা দুখ্, বুজানর কে আর আছিল। আঁসি মস্করা আমোদ আল্লাদ কন্নাই আর, চয়ের জলে রাইত দিন হার অই যাইত। কে আর গপ্প হুনায়, কত কিছুই না ঘইট্ছে এই দুইন্নায়। কারা আইল, কারা গেল টের হাই ন, আইজও হাই না। এ য্যান্ এক জেল। হাঁচিল কই, দ্যায়া ত যায় না, ঘিরি রইছে ছায়ার মতন, হ্যাতেনে গুমরাই মরে।
ঠিক কতা কইছচ্ রে মা, মনের কতাহান কইছচ্। চুলের মুডি ধরি মা ঠাম্মারা টাইন্তে টাইন্তে লই যাইত চুলার কাছে, কইত ইয়ান তোগ জাগা। ধোঁয়া উইঠ্ছে ত উইঠ্ছে, লাকড়ির ধোঁয়া হাকের ঘরে, হাঁক খাইতে খাইতে শরীলডা উপ্রে উইঠ্ছে আর নাইম্ছে, যাইবার জাগা নাই। হুইর হাড়ে লাডি লই বই রইছে গুরুজনরা, কয়, ‘ঐ মাইয়া কন্নাই যাবি, এক হা যদি আগাছ্ লাডির বাড়ি দি ঠ্যাং খোঁড়া করি দিমু।’ আঁঙ্গ ইচ্ছাগাইন এক ধমকে চুরমার অই যাইত, হেই যে যাইত আর জোড়া লাইগ্ত না। কত হোলার ইচ্ছা হুরন অইত, ড্যাং ড্যাং করি চলি যাইত। যিয়ানে যাইবার যাইত, আমরা ঘরের চৌকাডে বই মাথা খুঁড়ি মইর্তাম। তুই অন্ আঁরে কত কতা হুনাচ্। আঁর মত মুরুখ্য মানুষ ইগাইনের অর্থ বুজা ত দূরের কতা জম্মে হুনিও ন। তুই যতুরে ক আঁর লালীরে খুঁজি আনি দিত। হেতির মুই চাই থাই ত আঁর দিন কাডে, তোরা বুজচ্ না, আঁই অন্ ক্যাম্নে সময় কাডাইয়ুম, হেই বেডি আঁরে না খুঁজি হাই কত কাঁদাই না কাঁইন্ব, অন্ ত হেতিই আঁর দ্যাশ। তোগ দ্যাশ তোরা খোঁজ, আঁই আঁর লালীরে চাই।
যতুর মন আইজ্ খুশি খুশি। বাতাস বইছে এলোহাতাড়ি, কে যে কোন মুই যাইত চায় কেউ জানে না। কতা জিগ্গাইলে কেউ উত্তরও দেয় না মন খুলি। কেউ একজন কই চলি গেল বিড়বিড় করি, দিনক্ষণ ঠিক অই গেছে। কেউ কোন চিন্তা করিয়েন না, আমরা জিতুম। আমরা আবার কারা! কে যে কোন দলের, কে জানে। এক দল মানুষ হাকিস্তানের হতাকা উঁচাই বড় নৌকাত্ করি বড় রাস্তার মাইজহানে আই জমা অইছে। হ্যাতেরা যে এই গ্ৰামের মানুষ ন, হেইডা বুইজ্তে দেরি লাগে ন। যতু বাড়িত্ আই খবর দিল এক্কান গোলমাল লাইগ্ব আইজ্, অবস্থাহান সুবিধার ন। কী জানি কি অইছে। দ্যাশ যহ্ন ভোটের বাতাসে হুরা গরম, তহ্ন এরুম এক্কান দশা অইব কিয়ের লাই। এরুম এক্কান ঘটনার যে সাক্ষী অইত অইব, ভাইব্তাম্ও হারি ন। মাসির বাড়ি আইবার তুন্ কত কিছুই যে মনডারে বিগ্ড়াই দের, ভিজা কাপড় চিবানোর মত, জল গড়ায় টলটলাই হড়ে হোঁডা হোঁডা। কী কইয়ুম, কোন দিশা খুঁজি হাইয়ের না। এরুম এক্কান কাণ্ড কী করি ঘইট্ত হারে! ড্যাগা ড্যাগা হোলারা হুক্না মুহে চখ কচ্লাই আইলের হঁত ধরি আঁইড্তে আঁইড্তে বইখাতা শিলেট, হিন্সুলের থলি মাথাত্ লই ঘরে চলি আইয়ের অসময়ে। এত মুখ এক লগে দেই আঁই ঘাব্ড়াই গেলাম। ঝড় উইঠ্লে এরুমডা অয়। ব্যাদিশা অই কত মানুষ যে হঁত ভুলি যায়, তার কি ইয়ত্তা আছে। বুইজ্লাম আবার হশ্চিমারা আর এক চক্রান্ত কইর্ছে। দ্যাশের মাইন্ষ্যের মাজা ভাঙ্গি দিত অইলে এক্কানই অস্ত্র হেগুনে ধার দেয়, হড়ালেয়া শিহান চইল্ত ন। হোলাআইনের হশ্ন করার ক্ষমতারে নষ্ট করি দ্যাও। হল্ যে উল্টা অইত হারে এটা হশ্চিমা সরকার দেরিতে অইলেও বুইজ্ব। হোলাগুনের মুয়ে হেই এক কতা ‘আঁঙ্গ ইস্কুলহান বন্দ করি দিল, অন্ আমরা হড়ুম ক্যাম্নে?’ এই ছাত্রগুন অন্ কন্নাই যাইব, দশ মাইলের মইদ্যে কোনও ইস্কুল নাই। সরকারি আদেশে নাকি হুরা দ্যাশে অনেক ইস্কুল বন্দ অই গেছে। আওয়ামী লীগের নেতা এই বন্দের বিরুদ্ধে রাস্তায় নাইম্ছে। নেতারা কর, আঁঙ্গ দ্যাশে ইস্কুল চালাইবার লাই সরকারের কাছে ট্যাঁয়া নাই, হশ্চিম হাকিস্তানে এক্কান ইস্কুলও ত বন্দ অয় ন। আঁঙ্গ দ্যাশের ট্যাঁয়াগুন লই যাই নিজের দ্যাশে সম্পদ বাড়ার এইডা ক্যাম্নে মানি লওন যায়। হ্যাতারা এই কতা লই গর্জি উইঠ্ছে, ছাত্ররা যাই যোগ দিছে। আঁর মাসিগ গ্ৰামের হোলারাও কম যায় না, হেগুনেও ছুইট্ছে হেই মুই। ভোট যত আগাই আইয়ের, সরকারের মতলব ঘরে ঘরে হৌঁচাই দেওন শুরু করি দিছে নেতারা – শিক্ষার অধিকার হিরাই দিত অইব। ইস্কুল আবার খুইল্ত অইব। এই আন্দোলনের চেহারা দেই সরকার বুজি গেছে হ্যাতারা এই নির্বাচনে গো হারা হাইর্ব। দ্যাশের মানুষ এইডাও বুজি গেছে মঙ্গা রুইখ্ত গেলে, বাঙালিগ সরকারি চাকরি হাইত গেলে হশ্চিমা শাসন তুন্ হুব হাকিস্তানরে বার করি আইন্ত বঙ্গবন্ধুর দ্যায়ান্না হঁতেই চইল্তে অইব।
ওমা হোলামাইয়ারা হঁতেঘাডে, আঁডে বাজারে বলা শুরু করি দিছে – ‘ নৌকা মার্কায় ভোট দিন।’ ঘরে ঘরে নৌকার ছবি আঁকি, বুয়ে লাগাই ঘুইর্তে আছে। যতুও ত কম যায় না। হ্যাতে ত বাড়ির উডানে নাইচ্তে নাইচ্তে চিল্লায়, ‘জয় আওয়ামী লীগের জয়, জয় বঙ্গবন্ধুর জয়।’ ড্যাগা ড্যাগা মাইয়ারাও হ্যাতের হিচনে হিচনে ঘুরি ঘুরি গোল অই কতার লগে তাল মিলায়।
কীরে অষ্টমী, ঘরের বারে এত চিল্লাচিল্লি কীয়ের লাই? জালে কোন বড় বোয়াল ধরা অইড়ছে নি? মাসি চুপ করেন, কোন কতা কইয়েন না। জামাতে ইসলামীর নেতারা ভোট চাইত আইছে। জনে জনে জিগ্গায়, এই বাড়ির মানুষরা কোন দলেরে হছন্দ করে। আই কইলাম, হেইডা এক্কান কতা অইল নি বাপেরা, আঁই ক্যাম্নে জানুম কার মনের মইদ্যে কে আই বাসা বাঁইনেছে। এক এক জনের এক এক রকম সমইস্যা। যার চাকরি দরকার, য্যাতারা তার চাকরির বন্দোবস্ত করি দিব, হ্যাতাগ দিগেই ভোটটা যাইব, যার দোয়ান দরকার, তারে হুঁজি দিলেই খুশি, যে মানুষ শহরে আওন যাওয়া করে, তার এক্কান ভালা রাস্তা অইলেই আর কিচ্ছু চায় না। এই ধরেন গ্ৰামের ইস্কুলহান সরকার বন্দ করি দিল, মাষ্টর চায় ইস্কুলহান আবার চালু হউক তাইলেই মনে শান্তি। মনের শান্তিই ত আসল, ভোটটাও হেই পার্টির দিগে যাইব। আম্নেরাই কন্, আঁই কতাগাইন মন্দ কইছিনি। হ্যাতেনরা কয় আ্ম্নে ত বড় কটর কটর কতা কন্। এই বাড়ির বুড়া মাইন্ষ্যেরে ডাকিয়ের লাই চাই, হ্যাতেনের লগে আঁঙ্গ কিছু কতা আছে। কী যে কন্, হ্যাতেনে ত বুড়া মানুষ, বিছ্নায় হুতি থায়, কিছু কওনের থাইক্লে আঁরে কন্। আঁই আ্ম্নেগ বেক্ কতার জবাব দিমু। হ্যাতেনরা অবাক অই আঁর মুয়ের দিগে কিছুক্ষণ চাই থাই কইল, ‘এই বাড়ির কার কতগাইন জমি, আম্নে হেইডার ইসাব জানেন নি?’ জমির ইসাব আম্নেগ কোন্ কামে আইব? আইব, আইব, ভোটের হরে বেক্ ইসাব অইব ত। আমরা ক্ষমতায় আমু না। আওয়ামী লীগ তহ্ন কলা চুইষ্ব। বাপেরা, আম্নেরা ত আঁঙ্গ আপনজন, হতিবেশী, এরকম করি কতা কন্ কিয়ের লাই? কতা কই কি আর সাধে, মুজিবুর রহমান আঁঙ্গ হিচনে এরুম লাগা লাইগ্ছে, আমরা নিজের দ্যাশেই বেকের চক্ষুশূল অই গেছি।
মতিনের গলা হাইয়ের মনে হর, তুই আবার কবে এই দলে নাম লেহাইচস্? হ্যাঁগ দাদী, ঠিকই চিন্ছেন। বেক্গুনেরে কইয়েন ভোটটা য্যান্ আঁঙ্গরে দেয়, দিনকাল ত ভালা ন, কহ্ন কি হয় কওন কি যায়। সোন্দর করি ক, ডর দেয়াইলে কী লাভ অইব। তোরাও এই দ্যাশের মানুষ, আমরাও চইদ্দ হুরুষ ধরি এই দ্যাশে আছি, এই কতাহান মনে রাইচ্।
ঘরে ঘরে হ্যারিকিয়ের লাই টিম টিম করি জ্বলে। কেরসিনের আকালে কেউ আবার কুপি জ্বালাই রাইখ্ছে। দূর তুন্ দেইখ্লে লাগে গাছগাছালি দি ঘেরা গ্ৰামখানা য্যান্ সূর্য ডুবি যাইতে না যাইতেই ঝিমাই অইড়ছে। কী অইব কাইল এই লই বুয়ের মইদ্যে হাথর চাপা দি রাইখ্ছে, মুখ দি কারও কতা হরে না। হুসুরহাসুরের শ্যাষ নাই। মাগরিবের নামাজ শ্যাষ অইছে ঘন্টা খানিক অইল। মন্দিরে মন্দিরে শঙ্খও বাজের, কাঁসরঘন্টাও বাজের। কাইল্লার দিনডা কেরুম যাইব, কি জানি। হিন্দু মোছলমান বেক্গুনের মনে এক এক রমের চিন্তায় কেউ দুই চয়ের হাতা এক কইর্ত হারেন না। কুত্তা বিলাইও বিপদ বুজি এরুম কুডাক ডাকে, মাইন্ষ্যের বুক কাঁপে। বনেবাদাড়ে কোন শব্দ অইলে বেক্গুনে ঘর তুন্ এক লগে বার অই দেইখ্ত যায় আবার কিছু এক্কান অইল বুজি। নৌকাত্ চড়ি কারা য্যান্ দূর দূর তুন্ আই রাইত থাইক্তেও বাজারে জড় অর। চাষাভূষা, কামার কুয়ার, তাঁতি ধোয়া নাপিত কেউ কি আর বাদ যায়। এক্কানই চিন্তা কাইল্লা ঠিক অইব, এই দ্যাশের শাসন কোন্ দল কইরব। আওয়ামী লীগ যে দাবীগাইন রাইখ্ছে, হশ্চিমা সরকার কিছুতেই মাইন্ত ন, তাইলে কী অইব!
মাইন্ষ্যের মনে এইডাই ভাবনা, এই দ্যাশ ত অনেক ভাঙন দেইখ্ছে, বাংলা ধম্মের নাম করি, শাসনের নাম করি কত ভাগাভাগি অইছে, হশ্চিমারা আঁঙ্গ লাই করদ রাজ্য বানাই রাইখছে, ইয়ার তুন্ এইবার মুক্ত হওন চাই। ঘরের দরজার আড়াল তুন্ টিকটিকিটা টক্ টক্ টক্ করি উই্ঠ্ল, তিন হাঁচা অইলে দ্যাশের যাতে মঙ্গল হয় মাইঝরাইত হর্যন্ত জাগি থাই হেই কতাই ভাবি। উদ্ বিলাই সড়াৎ করি এই ঝোঁপ তুন্ এই ঝোঁপে লাফাই গেলে চিন্তাগাইন ভাঙি হান হান অই যায়। দুই এক্কান হঁইক কিয়ের লাই এই অসময় ডাকি উডে। মন মাইন্ত চায় না। হেগুনের মইদ্যেও কি শুরু অইছে নোয়া কোন ছট্ফটানি! মাইন্ষ্যের লগে হেগুনেও ডরে কাবু অই যার। দ্যাশের গন্দ ভাঁই বেড়ার গাছের গোড়ায়, গাছের ডগায়। চাইর হাঁচগা কুত্তা হুতি আছিল, কী এরুম অইল হেগুনে ঘেউ ঘেউ করি উডের। এত্ত বড় বাড়িডায় কোন সাহসে চোর ডাকাইতের উৎপাত অইছে আইজকার রাইতে, যহ্ন বাড়ির বুড়া জোয়ান বেক্গুনে জাগি রইছে, জোনাকিগুন মিট্ মি্ট্ করি জ্বলি উডানের চাইরদিগের হুলগাছেরে জাগাই রাইখ্ছে। কারা যে্ন্ ঘরের চালে ইডা মারি চলি গেল। হ্যাতারা আবার কোন আপদ! কোনও সাড়াশব্দ নাই। এক আতে লাডি আর এক আতে টর্চ মাইর্তে মাইর্তে চলি যার। আলোর আভায় কত খাল, কত বিল, কত জলা, কত হঁত, কত মাইন্ষ্যের মুখ দেয়া। আলো হুরাই যাইব, মানুষগুনও হাল্টি যাইব – অচেনা মুখ, অজানা কতা, অজানা জীবন, অজানা দ্যাশ। মানুষরা দৌড়াই চলি যাইব জান হরান দি ঐ ঘরের দিগে, ভোটার কার্ড, ভোটার লিষ্ট, ব্যালট, আঙুলের কালি, ভোটের বাক্স হিয়ানে মাইন্ষ্যের চিন্তারে জাপটাই ধইর্ব। ইয়ার হরে আর কিছু নাই, আলোডা নিভ্তে নিভ্তে আঁন্দারের দিগে চলি যাইব এরুম করি, কেউ জান্তই হাইর্ত ন, কোন কালেও হাইর্ত ন। মাসি আধা ঘুমে গোঙায় – বেয়ান অইতে আর কতক্ষণ লাইগ্ব। এরুম করি কইল য্যান্ এতদিনের নাড়িডা ছিঁড়ি রক্ত ঝরি হড়ের, ঘরের মেঝে চৌকাড ভিজি যার। এট্টু হরেই এক্কান শব্দ হুনা গেল – যা তোরা গোয়াল ঘরের বেড়া খুলি দে, হাম্বা হাম্বা করি ডাকের, হুনছের না।
দিনটা নোয়া, আকাশটা নোয়া, মেঘেরা ভাঙা ভাঙা, হঁইকগ ডানায় নানা রঙের খেলা। আঁর মনে অইল গ্ৰামের বাড়ি যাইত অইব, কিয়ের লাই যামু, নিজের ভোট নিজে দিত অইব। একবার মনে অইল আঁই এরুম এক্কান দ্যাশের নাগরিক, যেই দ্যাশে আঁঙ্গরে মাডিত্ আঁছাড় দি মারি হালাইত হাইর্লে ভাবে, যা মইর্ছে, দ্যাশ তুন্ এক্কান আপদ বিদায় অইল। কিয়ের লাই আঁর এরুম মনে অর, এই দ্যাশে আঁই জন্মাইছি, আঁর শ্বাসে মাডেঘাডের টান, সন্তানের জন্ম দিছি, কত আত্মীয় স্বজনের আত্মা ঘুরি ঘুরি মরে আঁরে খোঁজে, মাইন্ষ্যের এত দরদী ডাক ‘এরিও কন্নাই চইল্লেন, বেক্গুনে কুশলে আছে ত?’ কন্নাই গেলে হাইয়ুম এরুম মানুষ, কেউ চিন্ত ন, দূর দূর করি দৌড়াই দিব। কী আশ্চার্য ত! আঁর মনে দুই রমের কতা ঘুরের কিয়ের লাই? এর উত্তর আঁরে খুঁজতই অইব। তাইলে কী দ্যাশডারে আঁই কম ভালবাসি? ফাঁকি রই গেছে? নাকি ভয়! এরুম দোটানায় ভুইগ্তে ভুইগ্তে আঁর দ্যাশ আঁর সামনে এক নোয়া আশার জম্ম দিল। জাইন্ত চাইল, কে তুই? আঁই ত মা, দ্যাশও আঁঙ্গ মা। কদ্দিন অইল মার রূপটা দেইন মন ভরি। মার দিগে চাইবার অবসরও অয় ন। আইজ্ দেইউম্ আঁই, গোটা দুইন্না হুদ্দা মানুষও দেইখ্ব। আঁঙ্গ দ্যাশের মাইন্ষ্যের চেহারা সুরত কেরুম, রাগে হাডি হুইরলে কেরুম লাগে, আনন্দ অইলে কেরুম লাগে। শয়ে শয়ে মানুষ চইল্ছে ইস্কুলে, কাঁচারি বাড়িতে, ভোট দিব কি না । হ্যাডে ভাত নাই, হরনে কাপড় নাই, হকেটে হইসা নাই, ঘরে চাইল ডাইল নাই। কিয়ের টানে চইল্ছে ঘর ছাড়ি খালি ওই মানুষটার কতায় বিশ্বাস করি! কি না – হশ্চিমারা আম্নেগ যা কিছু কাড়ি লই গেছে, এক এক করি বেক্গাইন আঁই হেরত দিমু, আম্নেরা আঁরে বঙ্গের বন্ধু বানাইছেন, বেক্গুনে মিলি দ্যাশডা গড়ি তুলুম্। এই কতাগাইন কী কল্পনা, এ কী দিনের আলোর মায়া স্বপন, নাকি হাঁচা কতা। এই দ্যাশ কারা আই মেঘনার জলে ডুবাই দিছে, মানুষ উদ্ধার করি আনার স্বপন দেয়ের। এক্কান ভোট বাক্সে ঢালি মহান নেতার আত শক্ত কইর্ত হাইর্লেই কেল্লা ফতে। হিয়ের লাই ঘরদূয়ার ছাড়ি রাস্তায় চইলছে ত চইলছে। যে যিয়ানে আছিল আতে বঙ্গবন্ধুর ছবি লই চিল্লাইতে চিল্লাইতে আই অইড়ছে। হরান দি হালার যেই করি হোক হৌঁচাইতে অইব। কন্নাই যানের গ? আরে হেইডাও জান না, দ্যাশ আঁঙ্গ আদা মরা অই গেছে, বঙ্গবন্ধুরে যেই করি হোক সিংহাসনে বয়াইত অইব, জান কবুল। আঁন্দা নি আম্নে, দেহেনের না চাইরদিক আঁন্দার, হঁতঘাড্ উঁচানিচা, খানাখন্দে ভরা, কেউ আছে নি উডাই তুইলব। উষ্টা খাই হড়ি যাইয়ের, যেই করি হোক যাইত ত অইব। আঁরে লগে নিবেন না, একলা একলা চলি যাইবেন। হাঁ চালান বদি।
এরুম দ্যাশের চেহারা ত আগে দেই ন কহ্নও। হ্যাতেরা বাঙালির মনের ভাব বুজি হালাইছে। আর উপায় নাই, এইবার অইন্য চাল দিত অইব। সিংহাসন হ্যাতেরা কোনমতেই ছাইড়্ত ন। তার আগে হরখ করি নিত চায়, বাঙালিরা হ্যাতাগ লগে ঘর কইর্তে চায় কি না, যদি না চায় অইন্য ঔষধ দিব। হশ্চিমাগ মতলবহান বুইজ্তে কী আর বাঁই আছে, এমনিতে কই বেড়ার, ‘খাবাই দিমু বাংলা’। ভোটের শেষের ঘন্টা বাইজ্ল, জনগন নাই্চ্তে নাইচ্তে ঘরেও হিরল, মনে অইল, থ্ম্ মারি আছে হুরা গ্ৰাম।
দ্যাশ চিনে না, ঘর চিনে না
মাইন্ষ্যের বিচার করে
এ কেরুম আজব দ্যাশ
ধম্মের নামে মানুষ দৌড়াই মারে
মইদ্যে যে ঘর একদিন হুড়মুড় করি ভাঙি গেছে হেই ঘর যে জোড়া লাইগ্বার লাই ছটফট কইর্ব, কেউ কোনদিন ভাইব্তে হাইর্ছে নি। বেক্ কিছু চয়ের নিমিষে হাল্টি যাইব, হাঁচা কতাহান অইল আঁই বিশ্বাস কইর্তাম্ হারিয়েন্ না, এইডা ক্যাম্নে সম্ভব অইল। ইয়ান এক্কান বড় ঝড় আঁই কমু, মাইন্ষ্যের মনের মইদ্যে হেই ঝড় উইঠ্ছে, বুইজ্ত হারেন না, কোন্ হঁত ধরি যাইলে হুরান চিন্তা দূর অই নোয়া চিন্তার উদয় অইব, শিকল ভাঙি হালাই মানুষ হাঁপ ছাড়ি বাঁইচ্ব, জোরে শ্বাস নিত হাইর্ব, দুম্ড়াইন্না মোচ্ড়াইন্না ঘর বাড়িগাইন ঝারিঝুরি খাড়াই উইঠ্ব। আঁর দেয়রের হোলা রতনের মনের মইদ্যে কী চন্মনা ভাব আছিল যহ্ন ড্যাগা ছুটকিয়া আছিল, যেই না জোয়ান অইল, হোলাডার শরীল যে হাল্টাইল এরুম ন, হাবভাব, চলাহিরা হাল্টি গেল। মন মরা অই হড়ি থাইক্ত ঘুমটি ঘরে। বাড়ির বেক্গুনে ত হাল ছাড়ি দিছে এই হোলা আর ঘুরি দাঁড়াইত না। অন্ই ত বুইজ্তাম্ হারিয়ের হ্যাতের ভিত্রে কত কষ্ট চাপি রাইখ্ছিল, কাউরে কহ্নও কইত না। কন্নাই গেলে দিশা হাইব হেইডাও হ্যাতের জানা আছিল না। বাপ-দাদার আমলের চাষবাসের জমি আছে। চাইল, হাক্ সব্জিগাইন অই যায়। হপ্তাহান্তে হুইরের দুই এক্কান রুই মাছ, মেনি মাছ, গোটাকতক হুডি মাছও কোয়ালে জোডে। কিন্তু ইগাইনই কী সব নি, হড়ালেয়া শিখছে, নিজের হাঁয়ে ত দাঁড়াইত হারে ন। হেই দোষ হ্যাতের উপ্রে চাপান যায় না। গ্ৰামেগঞ্জের হোলা কদ্দিন আর আইবুড়া থাইক্ব। বাপ মা-ও চায় হোলাডারে সংসারি করি দিতে। কিন্তু চাইলেই ত অইল না, হরের মাইয়ারে খাওয়াইব কী। এদিগে গ্ৰামহুদ্দা মানুষ কই বেড়ায় হোলাডার অইলডা কী! মনের রোগের ওষুধ যে কন্নাই আছে হেইডা আর কে জাইন্ব! অন্ দ্যাশে যহ্ন হরিবর্তনের ঢেউ উইঠ্ছে, হেই ঢেউ আই লাইগ্ছে ঘরে দূয়ারে, হ্যাতে অন্ টের হাইছে কিছু এক্কান অইব।
খবরাখবর আইয়ের বানের জলের মত, কোন্ডা ঠিক, কোন্ডা বেঠিক কে কইব। জাইন্বই বা ক্যাম্নে কী অইত চলের, দ্যাশের নেতারাও হুরাহুরি জানে না। আশা ভরসা এক জিনিস বাস্তব আর এক জিনিস, অইত হারে আবার না-ও অইত হারে। আশায় আশায় বুক বাঁধে মুডে মজুর চাষাভুষা বেক্গুনে। এদ্দিন যা হায় ন, এবার য্যান্ হাইব, হুইন্ব মন ভালা করা কত কতা। কোন মুই দৌড়াইব, যেদিগে চখ যায় মাইন্ষ্যে ভরা। ভিড়ের মইদ্যে চাপা হড়ি গেলে জয়ের আনন্দের অংশীদার অইব ক্যাম্নে। এই জয়রে খালি জয় হিসাবে দেইখ্তে চায়, না বাড়তি অইন্য কিছু। আইজ্ যে ঘরে হাঁড়ি চড়ে ন, হেই কতাও ভুলি গেছে। নৌকা মার্কা ছাপহান ছিঁড়তে গেলে বুয়ে লাগে। ওরে তোরা কী করচ্ ইয়ানে? এত হোষ্টার হালি কন্নাই? বাজার তুন্ টোকাই আইন্ছি। ভালা কইর্ছচ্, আগুন জ্বালাইবার কামে লাইগ্ব। আম্নের কী মাথা খারাপ অইছে! বঙ্গবন্ধুর ছবি আছে না, ইগাইন হোড়ান যাইত ন, ঘরের মইদ্যে হটো বাঁধাই টাঙ্গাই রাইয়ুম। কিয়ের লাই রে হ্যাতেনের লাই এত হরানহান কাঁদে। ওমা, আম্নে হুনেন ন ভোটের হল্ বার অইলে বুজা যাইব এই দ্যাশ চালাইব কে? আঁঙ্গ ইস্কুলহান বন্দ অই হড়ি রইছে। আঁঙ্গ মাষ্টররে সরকার ইস্কুল তুন্ বার করি দিছে, হেরত আইন্ত অইব ত। ইস্কুলহান হ্যাতেনের হরান, বাড়ি বই থাই চয়ের জল হালাইছে এদ্দিন। আর কত হুইন্বেন। বিনা দোষে যেগুনেরে জেলে ভইর্ছে, হেগুনের নোয়া করি বিচার অইব। আঁঙ্গ দ্যাশ আমরাই চালামু। হেগুনের মুয়ে এত কতা হুনি আঁই আশ্চায্য অই গেলাম। তাইলে কী কওন যায় – দ্যাশের মানুষ জাগি গেছে। আঁঙ্গ দ্যাশে কত অভাব, ক্যাম্নে হুরন অইব জানি না, কিন্তু এই কতাহান হাঁচা, আঁঙ্গরে আর বোকা বানান যাইত ন। মোছলমানরা রোজার হরে চাঁদ দেই ঈদ হালন করে, কোরবানি ঈদের আনন্দ করে, হিন্দুগ বারো মাসে তের হার্বন, কই এরুম মোচ্ছব ত কন্ও দেই ন, এক লগে বেক্গুনে মিলিমিশি আত হা নাচার, আখাই গুড় দি মুড়ি খাইতে খাইতে গালগপ্প করের! গ্ৰামের মাইন্ষ্যের মনের জ্বালা এদ্দিনে কী তাইলে জুড়াইল! কত হশ্ন ত ঘুরি ঘুরি আইয়ে, উত্তর হাই না। ঘরের এক কোনায় বই যহ্ন চিন্তা করি, এই জীবনে আর কত উথালহাতাল দ্যাইয়ুম্, কোনদিন কী শান্তির মুখ দেইখ্তাম্ ন ? বিলাইডা আঁর দিগে চাই মিঁউ মিঁউ করে, লেজ লাড়ায়। হাইল্লা হইকগুন উডানে বই ঝগড়া কইর্তে কইর্তে কত শোধ হতিশোধ লয়, আবার হা নাচাইতে নাচাইতে চাইর্দিগ ঘুরে, উড়ি চলি যাই চালের উপ্রে বই থায়, নাই কোন ঝড় জলের চিন্তা, চাই চাই কোন দ্যাশের কতা ভাবে, কী জানি হুরা হিথিবীডারে নিজের দ্যাশ ভাবে কিনা। আঁই ভাবি, আঁঙ্গ মাইন্ষ্যের বেলায় কিয়ের লাই এরুম অয় না?
ভোটের খবর আইয়ের। বাড়ির বেক্গুনে ধেই ধেই করি নাচের। গড়ের উল্টাদিগে জমির আইল্ বরাবর হাঁডি হাঁডি দেই ধানের চারাগুন কেরুম সুন্দর বাড়ি উইঠ্ছে। মনডা জুড়াই যায়। বাইল্লা, হাইল্লা, বক হইকগুন উড়ি উড়ি চক্কর দেয়। হেগুনেই ত জমির মালিক। হসলের অধিকার লই কোন কাড়াকাড়ি নাই, মনের সুয়ে ঠোঁডের ডগায় তুলি চম্পট দেয়। আঁর ইচ্ছা অয় কত কতা কই। ক্যাম্নে কইয়ুম্ ছুঁই ছুঁই করিও ছুইতাম্ ত হারি না। চালাক ত কম ন, আয় আয় করি ডাকি, গ্যারাজ্য করে না। হেগুনে কী জানে আইজ্ আঁঙ্গ দ্যাশডার রঙ ঢঙ বেক্ কিছু হাল্টি যার। এই ত অয়, এরুম এক্কান দিন আইয়ে, যার লাই মাইন্ষ্যের ঘুম আইয়ে ন কত রাইত, স্বপ্ন দ্যায় কন্নাই য্যান্ ভাঁই যার দিন দুইন্নাই, কোনও কুল কিনারা হাই না। ভাঙা ভাঙা স্বপ্ন চয়ের সামনে হাজির অই কয়, আঁরে দ্যাহেন। কী আর কইয়ুম্, মুয়ের কতা মুয়েই থাই যায়, মনে কয় জড়াই ধরি, ছায়ারে ত জড়াই ধরন যায় না, তবুও কতাগাইন বাতাসে ভাসতেই থায়, যে যেমন খুশি ধরে, আর একজনের কাছে হৌঁচাই দেয়। দেওনের মইদ্যেই কত আনন্দ, কত মজা। রেডিওডারে যক্ষের ধনের মত আগ্লাই রাইখছে এই বাড়ি হেই বাড়ির মাইন্ষ্যে। এই একদল আইয়ে, ত আরেকদল ছুডি চলি যায়, অইন্য দল আবার অইন্য গ্ৰামের দিগে ছোডে। বদইল্লাগ আইজ্ মাডের কামে মন নাই। গরু ছাগলগুন মুখ উডাই আকাশের দিগে চাই থায়। আঁর নিজেরও কামে মন বইয়ের না। হোলামাইয়াগুনরে খাইতে দিমু, হেইডাও ভুলি গেছি। আঁর স্বামীর মনও উচাটন্ অইছে, বুইজ্তে দেন না। আইজ্ আর সদরে থায় ন, বাড়ি চলি আইছে। বাড়ির চাইর হাশে যদি কোন গোলমাল হয়, হামলাইব কে। য্যাতারা হাকিস্তানের লগে এঁটেল মাডির মত লেপ্টাই থাইক্ত চায়, হেগুনের সংখ্যাও ত কম ন, হুযুগ হাইলে ঘাড় মট্কাইতে আত কাঁইপ্ত ন, তহ্ন ভুলি যাইব আমরা এক মাডির মানুষ। নাইর্কল গাছ, সুয়ারি গাছ, তাল গাছের নিচে বই সুখ দুহের কতা কইছি, আম জাম নাইর্কল খাইছি, ঠাণ্ডা বাতাসে হরান জুড়াইছি। ছোরা ঢুকাই দিব মন মত না অইলে, রক্তের স্বাদ না চাইট্লে চইল্ব ক্যাম্নে।
এই ত আজব দুইন্নাই। খালি কি দ্যাশ, ভাঙা ঘরের মাইন্ষ্যে জোড়া লাইগ্বার লাই এঘর ঐঘর করে। এদ্দিন মনের যেই জানালাগুন ছুতানাতায় বন্দ কইর্ত হাইর্লে সোয়াস্তির নিঃশ্বাস হালাইত, আইজ্ হাশার দান হাল্টি গেছে। খুচুরমুচুর করের কহ্ন যাই কাকা কাকি জেডা জেডি ডাকি মনের সাধ মিডাইব। কি জানি হয়ত মধুর চাক্ডা এত বড় একা খাইলে বদহজম অইব, হিল্লাই ভাগাভাগি করি খাইত চায়। না, খবরডা আই হৌঁছায় ন। রতন ঘর তুন্ বার অই জিগ্গায়, আম্নেরা কোন ঘোষণা হুইনছেননি? যে রতনের মুয়ের তুন্ কতা বার কইর্ত অইলে মুখ ব্যথা অই যাইত, হ্যাতে অন্ টন্টইন্না কতা কয়। হ্যাতে কি হোনার কাডির ছোঁয়ায় জাগি উইঠ্ছে?
জেডি, আঁই এট্টু বড় রাস্তায় যাইয়ুম্, মানুষ দেইয়ুম্, মাইন্ষ্যের কতা হুনুম। কদ্দিন মানুষ দেই না, রাস্তাঘাড দেই না, মাইন্ষ্যে কত রমের কতা কয়, হুইন্তে ভালা লাগে, আলম মাঝির গান হুনুম, কী সুন্দর ভাটিয়ালি গায়, মনের ভিতরডা খাঁ খাঁ করি উডে, ইচ্ছা অয় মাঝির লগে চলি যাই, ঘরে আঁর মন টিয়ে না। তাইলে এদ্দিন চুপ মারি আছিলি কিয়ের লাই? এই উত্তর ত আঁই জানিনা, দিমু কত্তুন।
রতন ছুডি চলি যায়, এরুম করি যায় য্যান্ হ্যাতের চাইর হাশে কোন মানুষজন নাই, গাছগাছালি নাই, কোনও মেঘ ভাঁই ভাঁই যার না, চিল উড়ি উড়ি বেড়ার না, মাছেরা ডুবাডুবি খেলের না। কত কিছুই না জাপটাই জাপটাই ধরে, হুরুত হারুত করি বার অই যার। রতনের এইরম হাগল হাগল অবস্থা দেই আঁর কেরুম লাগে। আঁর ভিত্রেও কোন এরুম কতা আট্কি আট্কি আছিল নাকি, যা আঁই কারোরে কইতাম্ হারি ন। বুয়ের ভিত্রে চাপা কষ্টে চুয়া ঢেঁয়ুর উডে – আঁই এই দ্যাশের মাইয়া বলে, আঁর অগ্গা মাইয়া আছে বলে, এই মাইয়ারে হামলাইবার হঁত খুঁজি হাই না বলে! আঁর ঘরের হাশে ঘর। রতনের মনের গতি আর আঁর মনের গতি একমুই ছুডি চলি গেছে, টেরও হাই ন। আঁঙ্গ বাড়ির আরও ত মানুষ আছে, হ্যাতাগ কার মনে কত রোগ বাসা বাঁধি রইছে জাইন্বার চেষ্টাও ত করি ন, গ্ৰামের মাইন্ষ্যের ব্যথা, দ্যাশের মাইন্ষ্যের ব্যথা ত শত যোজন দূরে।
মাইন্ষ্যের মনে আনন্দ অইলে এরুমটা হয়। না অইলে আঁর জা ক্যাম্নে মাইয়ারে কয়, যা তোর জেডিরে যাই ক এট্টু ভাত দিত, আঁই ত অন্ও হাক্ চাপাই ন। বেশি দিন ত অয়ন, মাইয়াডা চুপেচুপে আঁঙ্গ ঘরে আই মুরি খাওনের লাই আবদার কইর্লে হেতির মা কী হিডান হিডাইল, মাইয়াডা এরুম কাঁদন কাঁইন্ল চয়ে দ্যায়ন যায় না। আইজ্ নিজেই আই কইল, মাইয়াডারে আম্নের কাছে রাই গেলাম, চয়ে চয়ে রাইখ্বেন, কোনও সব্বনাশা কাণ্ড না বাঁধায়, হেতিরে ত আঁই হাম্লাইতাম্ হারি না, রাজ্যের ঘরের কাম হড়ি থায়, কহ্ন ছান, কহ্ন হুজা বেক্গাইন মাথায় উইঠ্ছে। আম্নের দেয়র দোয়ান তুন্ আই ভাত না হাইলে বাড়ি হুদ্দা চিল্লাই মাথা উডাইব, যা এক্কান মাথা গরম মানুষ, আম্নে ত জানেন চুন তুন্ হান খইস্লে আঁর চুল ছিঁড়ব।
কদ্দিন বাদে আঁর জা আঁর লগে মন খুলি কতা কইল, সুখ দুহের গপ্প কইর্ল। হেই দিনগুন আঁই ভুলি ক্যাম্নে ভাগাভাগি করি নিজের সংসার নিজে বুজি লইবার লাই দিছিল ত ঘরের মাইজহান দি মুলি বাঁশের বেড়া, ঝন্ঝন্ করি থালা বাসন হালাই ছড়াই জানান দিছিল। হেতির কী রাক্ষুসে চেহারা! মনডা আর গলি গেল, বুকে জড়াই ধইর্লাম। এইডার নামই সংসার, বুজন্ও যায় না, চিনন্ও যায় না, কহ্ন কোন মূর্তি ধরে! ঘরের মন হাল্টাই গেলেও বারের মন কী আর এত সহজে হাল্টায়, অইন্য কতা কয়। আঁর হৌড়ি অন্ আর কতা কইত হারে না, কানেও কম হুনে। মরার মত হরি থায়। তবুও কিছুডা আঁচ কইর্ত হাইর্ছে। বউ, হেতি বুজি মিডা মিডা কতা কই তর মন ভিজাইত আইছে।
মা, আম্নে চুপ করি থান, বেশি কতা কইয়েন না, শেষে লঙ্কা কাণ্ড বাঁধাইব। যদি কাছে আইবার লাই মন টানে আইয়ক্ না। দ্যায়েন না, যে হিন্দু মোছলমান কাডাকাডি মারামারি কইর্ছে, মুজিবের ডাকে অন্ হ্যাতাগ ধম্মের অনেকেই আবার এক সুরে হশ্চিমাগ বিরুদ্ধে গর্জি উইঠ্ছে। ও তোর বুজি হেরুম লাগে। আবার কোনদিন কইব, এই জাগা জমিন আঁঙ্গরে ছাড়ি দে, না হয় আঁঙ্গ ধম্মে নাম লেয়া। মা, যহ্ন কইব তহ্ন দেয়া যাইব। সময় যহ্ন আইছে একলগে মিলবার, মিল্লে ক্ষতি কী! অইলে ত ভালাই অইত কিন্তু অইত ন, আদায় কাঁচকলায় মিল অয়? এই এক বিরাট যুদ্দ রে মা, এই যুদ্দে তোগই মরণ অইব। চেষ্টা করি যাইতেই অইব, হাশাহাশি বাস করন লাইগ্ব ত। আইজ্কাইলকার যুগে খালি মোছলমানের দ্যাশ আর খালি হিন্দুর দ্যাশ বলি কিছু অয়! য্যাতারা ইগাইন কয়, অবুজের মত কয়।
তুই ভালা ভালা কতা রাখ্ ত, নোয়া বউয়ের কতায় মজি যাইস্ না, হেতির মতলবহান ভালা না, আঁর তুন্ কে হেতিরে ভালা চিনে। মুজিব সাধে হশ্চিমাগ তুন্ ভিন্ন থাইক্ত চায়, ভিন্ন খাইত চায়। কিছু জিনিস আছে, কিছুতেই জোড়া লাগান যায় নারে মা।
কতায় আঁর ভাবনাচিন্তাগাইন গুলাই যায়। মন মাইন্ত চায় না। শরীল তুচ্ছ অই যায়, মন জাগি যায়। মনের কতা হুইন্তাম হাইর্লে ভালা লাগে। আঁই মাডির চুলাত্ ভাত চাপাই লাক্ড়িগাইন ভিত্রে ঠেলি দি আগুন বাড়াই দি। গন্গন্ করি জ্বলি উইঠ্লে ভাত ভুট্ভুট্ করি হুঁডে। আঁর নজর হেই দিগেই থায়। লাকড়ির গাদা তুন্ তিন চাইরহান লাকড়ি নামাই আনি। হাশের চুলাত্ নাড়ার আঁচে মাইরার ডাঁডা আর ঢুল্লার হাক রান্না অইলে হোলামাইয়াগুনরে খাইতে দিমু। কদ্দিন বাদে মাডির চুলার রান্না খাইব। গন্দ আর স্বাদ দুডাই ভিন্ন রম, লোভ লাগে। শহরে ইগাইন আর কন্নাই হাইব। যেই না ড্যাগের তুন্ আতা কাডি ভাত দিতে যামু, রতন নাইচ্তে নাইচ্তে আই কয়, জেডি এক্কান জব্বর খবর আছে।
আওয়ামী লীগ মেলা আসন হার, ঐ হালারা আরি ভুত অই যার, আঁঙ্গ ইয়ানেও লীগের প্রার্থী তরতর করি আগাই যার। কারও এরুম ক্ষমতা অর না হমানে হমানে লড়াই করে। আম্নের বাপের বাড়ির দ্যাশেরও খবর কইছে। হিয়ানেও জয়ে জয়কার আওয়ামী লীগের। একবার বার আই দ্যায়েন না, হিন্দু মোছলমান বেক্ মানুষ গলাগলি করি কয় – জয় বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা। মনের মইদ্যে খচ্খচ্ করে, এই সম্পর্কডা ঠিক থাইক্ব ত, না ভোটের হরে মাইন্ষ্যের মনে কেউ আই বিষ ঢুকাই দিব ধম্মের নাম করি, কে কইত হারে। ঘরের বার অই দেই দশ বার জন করি ভাগে ভাগে গোল অই বেক্গুনে কত কতা বলাবলি করে – যদি আওয়ামী লীগ জিতেও যায়, হাকিস্তান সরকার এত সহজে ক্ষমতা ছাড়ি দিত ন……এই হার হ্যাতারা মাইনত ন…এত বড় দ্যাশের সম্পদ লুইঠ্ব ক্যাম্নে…….হিন্দু মোছলমানের মইদ্যে গণ্ডগোল লাগাই দ্যাশের মইদ্যে অশান্তি লাগাই দিব…….এই ভোট বাহানা বানাই বানচালও করি দিত হারে……হড়ালেয়া জানা বাঙালিগ মারি হালাইব না অয় জেলে ঢুকাইব। হেই জায়গায় হ্যাতাগ মন মত মানুষ বয়াইব…… আইয়ুব হান, ইয়াহিয়া হানগ অন্ও যদি না চিন্তে হার, মায়ের হ্যাডে রইচ তাইলে…….আগে ত হুরা হল্টা বার অইতে দে, আওয়ামী লীগের নেতারা ইয়ার হরে কী হদক্ষেপ নেয়, হেইডা আগে হুনি……..দ্যাশের জনগণ ত লোম ছিঁড়বার লাই চুড়ি হরি থাইক্ত ন। রক্ত ত হশ্চিমারা অনেক নিছে, আরও রক্ত দিমু, ছয় দফা মাইন্তে বাধ্য করুম্ই করুম্। হেগুনের কতা হুনি আঁই কোয়াল চাপড়াই, বিপদ এক্কান যে আইয়ের হিয়ান লই কোনও সন্দেহ নাই, আরও কতকিছু যে জলাঞ্জলি দিত অইব শতানগ চালাকির কাছে, অন্ অনুমান করন এক্কারে দুহাইদ্য।
ঝড় এক্কান আইয়ের বুজা যার যহ্ন মাইন্ষ্যে উল্লাস আর ধরি রাইখ্ত হারে না, হকাশ করণের লাই এদিক ঐদিক ছুডি মরে। তবুও ঝড় আইয়ে, ঝড় কি থামাই রাওন যায়। করিম মিঞার ইগাইন লই খুব এক্কান মাথাব্যথা নাই। হ্যাতের মইদ্যে এরুম উদাসীন ভাব দেই আঁই চিন্তায় হড়ি যাই। লাঙ্গল লই গরুর হালের হিছনে হ্যাট্ হ্যাট্ করি মাডের মুই ছোডে। এই য্যান্ হ্যাতের নিত্যকর্ম, যা কিনা না কইর্লে হ্যাডের ভাত অজম অইত ন। ফজল হন্তদন্ত অই ছুডি আইয়ে, কয় ও করিম, কোন মুই যাও, দ্যাশ-গ্ৰামের খবর টবর কিছু কি রাও নি, বেক্গাইন উল্টাই যার, তুঁই দেইয়ের নিজের জগতেই ঘুরিহিরি মর। ক্যান্, কী অইছে এরুম চিল্লাও কিয়ের লাই?
আরে নজরুল সদরে গেছিল ভাইয়ের লগে জমি লই মামলা লইড়তে। আইজ্ মামলার দিন আছিল। হেই এক রক্তারক্তি কাণ্ড! আওয়ামী লীগের সভার উপ্রে গুল্লি চালাইছে হুলিশ। এক হিন্দুর হোলা ভিড়ের মইদ্যে বক্তিতা হুইন্ত গেছে, দিছে মারি, এক গুল্লিতেই সাবাড়। গুল্লির বাজ হুনি নজরুলের মাথা ঘুরি গেছে, হাথালি অই হড়ি গেছে রাস্তার উপ্রে। আঁঙ্গ বাড়ির রুস্তম দেই চিন্ত হাইরছে, না অইলে কী দশা অইত, কও দেই। বুইজ্জনি দ্যাশের অবস্থাহান! তুঁই দেইয়ের কিছুই খবর রাও না।
আর কইওনা ভাই, কাইল রাইত তুন্ আঁর মাইয়াডার ভেদ্বমি অর, কোনরমে রাইতডা আল্লার নাম করি কাডাইছি। হরে কবিরাজ আই জড়িবুটি দেওনের হরে মাইয়া চখ খুইলছে, না অইলে চখমুখ উল্টাই হালাইছিল, ভাইব্লাম আর রক্ষা নাই, মাইয়া আঁর শ্যাষ! বড় আদরের মাইয়া। ভালা হোলা দেই হেতির বিয়া দি দিমু। মাইয়ার বয়স কত? তের হার করি চইদ্দত্ হইড়ছে। তোঁয়ার ত চাইর মুই যাতায়াত আছে, খুঁজি দেও না এক্কান সমজ্দার হোলা, আঁঙ্গ মত হরের জমিত্ খাডুক, হানবিড়ির দোয়ানদারি করুক, বোজা বইয়ুক, মোড কতা দুইবেলা দুই মুডা জোগাড় কইর্তে হাইর্লেই চইল্ব। মোক্তারবাবু কইছে, ‘তোর মাইয়ার বিয়ার খরচা আঁই দিমু।’ মাইয়ার জম্মের খবর হুনি হ্যাতেনে আঁরে কতা দিছে।
তোঁর দেইয়ের এই সংকটের দিনে দ্যাশ লই কোনও চিন্তা নাই! হরু ইস্কুলের মাডে লীগ এক্কান মিটিং ডাইক্ছে, হাজির থাইক্তে অইব যেভাবে হোক। বুইজ্জ না, দ্যাশ বাঁইচ্লে গ্ৰাম বাঁইচ্ব, গ্ৰাম বাঁইচ্লে তুঁই বাঁইচ্বা, তুঁই বাঁই্চ্লে হোলা মাইয়া বাঁইচ্ব। আর রোগশোক লই অত চিন্তা করিও না, আইব আর যাইব, হিয়ানে কী আঁঙ্গ আত আছে, উপরওয়ালা যা লেই রাইখ্ছে, হেইডাই অইব। করিম মিঞা কইল, ভাই, এরুমই যদি অইব, অত লড়াই সংগ্ৰাম করেনের কিয়ের লাই? বাঁইচ্বার লড়াই কোন অংশে কম নি ?
কোন কতাডা যে হালাইব আর কোন কতাডা যে রাইখ্ব বুজি উইঠ্বার আগেই আর এক্কান কতা আই গাঁইগুঁই করে। কিত্তাম কন্ চাই? মাইন্ষ্যেরে বাদ দি নিজের কতা কইয়ুম ক্যাম্নে, ভালা দিন না মন্দ দিন। দরজাত্ আই দুমদাম আবাজ করি কয়, ‘কে আছ ভিত্রে, দরজাহান খোল, খবর আছে।’ কী জানি কে আইল কিনা। রামহুর তুন্ টুবাই আইছে। আরে হ্যাতেরে আঁই দেইখছি হেই কবে। মুয়ের চোয়াল ভাঙিচুরি গালে গাল লাগি গেছে, হায়জামাডা তালি মারা, গা’ত জামা হইয্যন্ত নাই। ঠিক দেইখছি ত, আঁর বাইচ্চাকালের কিত্কিত্ খেলার বন্ধু চন্দনার হোলা। চন্দনা কন্নাই যে আরাই গেছিল কেউ জানে না। একদিন আঁর মাসির বাড়ি যাইবার সময় ভুল করি আগের ইষ্টিশনে নামি দেই এক্কান মাইয়া বোরখা হরি ছোট্ট হোলার আত ধরি বই রইছে সিঁড়ির উপ্রে। আঁরে এমুই ওমুই চাইতে দেই হেতি হোলার আত ধরি আগাই আই কয়, ‘অষ্টমী না, আঁরে চিনতি হারচ্ ন, আঁই চন্দু।’ হ্যাডের কতা হ্যাডেই রইল, হেতিরে জড়াই ধরি কাঁইন্লাম্, গাড়ির হর গাড়ি চলি গেল, হেই কাঁদন্ আর থাইম্ল না। শ্যাষে আঁর আঁচল দি হেতির চখ মুছি দি কইলাম্, তোর এই দশা ক্যাম্নে অইল ক, এইডা তোর হোলা, তোর নাম কিয়ারে ? চন্দুই উত্তর দিল, টুবাই টুবাই কয় বেক্গুনে, ভালা নাম মুস্তফা। হেতির দুহের কাহিনী হুনি আর এক দফা কাইন্লাম। কারা হেতিরে তুলি লই গেছে কইত হারে না। মৌলবী আই কলমা হরাই বুড়া ব্যাডার লগে বিয়া দিছে। হেতির নাম দিছে রুকসানা বিবি। সন পঞ্চাইশের কতা। হাঁচ বছর ঘর করার হর হ্যাতেনের ইন্তেকাল অইছে। হেই যে টুবাইরে এক নজর দেইখছি হেই চেহারাহান মনে আছে। আঁঙ্গ বাড়ি চিনছচ্ ক্যাম্নে? আম্মা মরি যাইবার আগে কইছিল, ‘আঁই মরি গেলে তোর অষ্টমী মাসির কাছে চলি যাইচ্, আঁর হরিচয় দিচ্, তোরে হিরাইত ন।’
আঁর কী করন উচিত, কোন দিই বা হামলাই। হোলাডারেই বা ক্যাম্নে ঘরে তুলি? মোছলমানেগ হোলারে আঁর ঘরে জাগা দিছি হুইন্লে আত্মীয়হজনরাই কিভাবে নিব। আঁর সহেলির হোলা বিশ্বাস না করতই হারে। টুবাইরে কইলাম্, হোন, ভুলেও কন্ও কইচ্ছা তোর নাম মুস্তফা, তাইলে কিন্তু কেলেঙ্কারি অই যাইব। সাহস করি হ্যাতেরে হিছনের এক্কান ঘরে থাইক্তাম দিলাম। ঘরহান হড়িই আছিল, হুরান আমলের থালা বাসন আর ভাঙা এক্কান চই, তাও এক্কান হায়া লড়বড়ে, ভুলেও কেউ হেই ঘর মাড়ায় ন। হেই কত আগে আঁর ছোড হোলা বাইচ্চাকালে কোনা ঘুপচি অন্ধকার ঘরে চুপ করি বই থাইক্ত আঁর ছেঁড়া কাহড়হান দি ঢাই। কন্নাই গেছত্ রে, ডাইকলেও কতা কইত না, শব্দ কইর্ত না, বেক্গুনের তুন্ দূরে যাই আরাই যাইতেই হ্যাতের আনন্দ। আজ এদ্দিন বাদে এই ঘরহান যে এরুম করি কামে লাগি যাইব, কে আর ভাইব্ছে। ঘরহান ঝাড়িঝুড়ি দিলাম, টিক্টিকির গুয়ের গন্দ আর তেলাহোকার বাইচ্চা দেই আঁর শরীলডা ঘিন্ঘিন্ করি উইঠ্ল। কিন্তু ইয়ান ছাড়া আঁই কীইবা কইর্তাম্ হাইর্তাম। তুই ইয়ানে থাইক্তি হার্বি ত বাপ।
খুব হারুম, আম্নে কিচ্ছু চিন্তা করিয়েন না মাসি। আঁর হোলার এক্কান হুরান জামা দিলাম হরনের লাই। যা বড় হুইরে যাই ডুব দি আয়। আঁর হোলাই লগে করি লই গেল। কাউরে আঁই কিচ্ছু জানাইলাম্ না। আঁর হোলার মনে হঙ্গী হাই কী আনন্দ। হ্যাতেরে কি খাইত দিব, কন্নাই বয়াইব, ঘুরি ঘুরি আঁঙ্গ হুরা বাড়িহান হ্যাতেরে দেয়াইব। আঁঙ্গ বাড়ির কাম কাইজ করে মনা, হ্যাতেরে দি গাছ তুন্ ডাব হাড়াই ড্যাগা ডাবের জল খাওয়াইল। হোলাডা এমনিতে তাঁতি হুড়ি আইছে কত দূর তুন্, আহারে! বাপ মা মরা হোলা, চয়ে দেওন যায় না এত কষ্ট। ভোটের হলের আর বেশি বাঁই নাই। রেডিওর উপ্রে বেকে য্যান্ ঝাঁপাই হইড়ছে। কেউ আবার চেঁচাই কয়, সাউন্ডডা আর এট্টু বাড়ান যায় না.. আর ঘুরাইলে ভাঙি যাইব…ব্যটারি ড্যাম্প অই গেছে নি, চাও না খুলি…অন্ আর অবেলায় কন্নাই হাইবা ব্যাটারি, বেকেই ত বাড়ি হলাইছে। এতগুন মাথা গোল অই রেডিওত্ কান হাতি রাইখলে কেইবা হুইনত হাইর্ব। টুবাই কয়, আঁরে একবার দেন চাই টেরাই করি চাই। টুবাইয়ের বাপ রেডিও সারাইয়ের কাম কইর্ত, বাপ চলি গেলে বাড়িত্ হড়ি থাওন্না ভাঙাচুরা রেডিও লড়াচাড়া কইর্তে কইর্তেই শিখি হালাইছে কিছু কিছু, হেই বিদ্যাহান এই সময়ে যে কামে লাগি যাইব, কে জাইনত। হিন্দু মোছলমান মিলি দুই গ্ৰামের জনা পঞ্চাইশেক মানুষ য্যান্ ঝাঁপাই হইড়ছে। যত বেলা বাড়ছে, তত মাইন্ষ্যের সংখ্যাও বাড়ছে। এত গ্ৰাম মিলি এক্কান মাত্র রেডিও, কোন চ্যানেল তুন্ খবর কইছে কে জানে। টুবাই সাউন্ড ত ঠিক করি দিল, চ্যানেল ত খুঁজি হায় না, মাইন্ষ্যের মইদ্যে উস্খুস্ উস্খুস্, মাথায় রক্ত চড়ি যার, হাইর্লে টুবাইরে দুই চাইর কিলঘুষি লাগাই দেয়। মাইন্ষ্যের আর তর সয় না, শ্যাষে চ্যানেল খুঁজি হাইলে হ্যাতারা শান্ত অইল। এর মইদ্যেই কত কতা। কাছারি ঘরেও গ্ৰামের মাইন্ষ্যে ভিড় জমাইছে, বুয়ের মইদ্যে বেকের ঢিপ্ ঢিপ্ করে যদি আশা ভরসায় জল ঢালি দেয়, তহ্ন কী অইব। অলক্ষইন্না কতা হেগুনে হুইনতও চায় না। চাতক হইকের মত উবুড় অই বই থায়, কহ্ন খবর আইব, দুই আত তুলি নাইচব।
খবর আইল, বেক্গুনের ধড়ে হরান হিরল। অন্ করনের আছে কেউ ঠিক কইর্ত হাইর্ল না। হেগুনে কেউ কেউ লম্বা শ্বাস হালাই কইল, সুবহানাল্লাহ, কেউ কইল, জয় বঙ্গবন্ধুর জয়, অনেকে কোলাকুলিও কইর্ল। কেউ হর্মুলের আঁটি বাঁধি আগুন জ্বালাই আকাশের দিগে মুখ করি নাচানাচি কইর্ল, কেউ আবার মনের আনন্দ কী করি দ্যায়াইব বুইজ্ত না হারি উডানের এমাথা ঐমাথা চাইর হাক দৌড়াই নিল। আঁঙ্গ বাড়ির হোলাগুন শিস দিল জোরে জোরে, মাইয়ারা শঙ্খ বাজাইল, জোয়ার দিল। টুবাই আনন্দ অইলে যেরুম কয় হেরুমই কইল – ইন্শাআল্লাহ। বেকে মুখ চাওয়া চাওয়ি কইর্ল, এইডা কী অইল! বেকে হ্যাতের কতাহান লই হিস্হিসানি শুরু করি দিলে ভাইব্ল কিছু ভুল কই হালাইছে কিনা। কারও কারও মনে সন্দেহ অইল মোছলমানের হোলা নয় ত! তাইলে হিন্দুর ঘরে জাগা দিল ক্যাম্নে! মোছলমানের হোলারে হিন্দু বানাই হালাই ন ত। হিন্দুগ মনের মইদ্যেও সন্দেহ জাইগ্ল, কিছু এক্কান গোলমাল আছে। আঁর হোলাও কেরুম ভ্যাবাচ্যাকা খাই গেল। বেক্গুনের আনন্দের মইদ্যে এক হোঁডা চুনা অইড়ল য্যান্। বেক্গুনে মূর্তির মত বোবা অই খাড়াই রইল। আঁর খুড়া হৌড়ের ঘরের সেঝ দেওরের ছোট্ট হোলা ভিড়ের মইদ্যের তুন্ জোরে চেঁচাই উইঠ্ল – জয় বাংলা। এট্টুক ছুটকিয়া মাথায় কী এক্কান বুদ্দি খেইলল। যেতাগ মুহে দি এতক্ষণ এক্কান কতাও বার অইছিল না হ্যাতেরাও এক লগে কওয়া শুরু কর্ইল – জয় বঙ্গবন্ধুর জয়। কত রমের হোষ্টার উপ্রের মুই তুলি ধরে। কোনটায় লেখা ‘সোনার বাঙলা শ্মশান কিয়ের লাই?’ আবার অইন্যটায় লেখা ‘আপনাদের মুজিবর রহমানকে নৌকা মার্কা বাক্সে ভোট দিয়ে গরীবের স্বার্থ রক্ষা করুন’। টুবাই নিজেও য্যান্ দোটানায় হড়ি গেল। বেকে যে দ্যাশের কতা ছাড়ি হ্যাতেরে লই নানা গপ্প বানাইব, হেইডা আর কেরুম করি জাইনব। কেউ কয়, এইডা এত সোজা ব্যাপার ভাবিও না ভাই। গ্ৰামের মাতব্বরগ কানে তুইল্তে হয়। মাইন্ছি আমরা হিন্দু মোছলমান বেকে আওয়ামী লীগের সাপোর্টার, আঁঙ্গ সম্পর্কহানও ভালা, তাই বলি মোছলমানের হোলা হিন্দুর ঘরে থাইক্ব, এইডা এক্কান কতা অইল নি, ধম্ম বলি এক্কান বস্তু আছে ত। মৌলবী সাব ছাড়ি কতা কইব নি। মৌলবী সাব যা চেতা মানুষ, হ্যাতেনের কানে গেলে তৈলে বাইয়ুনে জ্বলি উইঠ্ব, কয়, ‘কত বারণ কইরছি হিন্দুগ লগে এত মিলামিশা করিছ্ না, হোনচ্ না, এবার আক্কেল অইল ত, দিল ত কষি এক্কান থাপ্পর, জাত মান দুই গেল। অন্ ভাব ক্যাম্নে হোলাডারে হিন্দুগ খপ্পর তুন্ বার করি আনবি। আমরাও দেই।’ বুইজ্লাম গোলমাল এক্কান বাঁধাইব। হিন্দুরাও ত কম যায় না, চাইরবার আই আঁরে ধমক্ দি গেছে। মুক্তার বাবু সজ্জন মানুষ, হ্যাতেনে এই অসামাজিক ঘটনার এক্কান বিহিত কইর্ব।
টুবাইরে লই আঁই কি করি। না রাইখ্তাম হারিয়ের্, না হালাইতাম্ হারিয়ের। চন্দুর শ্যাষ ইচ্ছাহান আঁই হুরণ কইর্তাম্ ন? আঁর স্বামী কইল, হুরা ঘটনাডা তুঁই গ্ৰামের বেকের সামনে খুলি কও। হ্যাতারা যা বিচার করি ঠিক কইর্ব, তাই অইব। কাছারি ঘরে সভা অইল। টুবাই বেচারা মাইজ্হানে জড়সড় অই বই রইল। হ্যাতে বুইজ্তেই হারেন না, কোন মুই যাইব। একজন গলা উঁচাই কইল, রায়েন ত ভাই আম্নের মিডা মিডা কতা, ধম্ম আগে না আওয়ামী লীগ আগে? সভা তুন্ উত্তর আইল, ধম্ম আগে। হ্যাতেও হেইদিন আওয়ামী লীগের জিতার আনন্দে চেঁচাইছে, হোষ্টার তুলি লাফাই উইঠ্ছে। আঁর স্বামী হাজার বুজাইলেও কেউ কানে তুইলল না, না মোছলমানরা, না হিন্দুরা। সভায় সিদ্ধান্ত অইল টুবাইরে হ্যাতাগ গ্ৰামে হেরত যাইত অইব। আঁই ভালা করি জানি, হিয়ানে হ্যাতেরে দ্যায়ার মত কেউ নাই, যত্ন আত্তী না হাই না খাই না দাই অকালে মারা অইড়ব। টুবাই আঁঙ্গ ঘর ছাড়ি চলি যাইবার সময় নিজেরে আর ধরি রাইখ্তাম হাইর্লাইম না, হাউমাউ করি কতক্ষণ কাঁইনলাম। কইলাম, চিন্তা করিছ্ না টুবাই, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন হাঁচা অইলে দ্যাশের মাইন্ষ্যে বেক্গাইন বুইজ্ব, তহ্ন একদিন না একদিন আঁঙ্গ আবার দ্যায়া অইব। টুবাইও কিছুক্ষণ কাঁইনল, হ্যাতের মার কতা মনে করি চয়ের জল হালাইল, না আঁর কতা মনে করি কে কইব। মনে মনে ভাইব্লাম্, হায় হায় রে, এই দ্যাশের মাইন্ষ্যে কবে আর মাইন্ষ্যের ভালা মন্দের কতা বুইজ্ব।
দ্যাশের মইদ্যে লাইগ্ছে গজব
বাঁইচ্বার হুযুগ নাই
হশ্চিমাগ হাঁদে হড়ি
হরান চলি যায়
ভোটের হল্ ত বার অইল, আওয়ামী লীগ জিতিও গেল। কিন্তু শতান হশ্চিমারা বঙ্গবন্ধুরে জিত্তে কী দিল! ইয়াহিয়া হান সভা ডাইক্ল, জুলফিকার আলী ভুট্টো উল্টা কতা কইল। বেকে কইল, এত দুষ্টু বুদ্দি যদি মনে আছিল, হুদা হুদা ভোট করানোর কী দরকার আছিল! লোকে ত হাঁচা কতাই কইছে। হশ্চিমারা ভাবে হ্যাতারাই চালাক, আঁঙ্গ দ্যাশের মাইন্ষ্যে কিছু বুজে না। আসলে হ্যাতারা কল্পনাও কইর্ত হারে ন, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ঠিক কতা অই মাইন্ষ্যের মনের মইদ্যে হাঁদাই গেছে, দিনরাইত খালি জইপ্ছে কহ্ন বাঙালিরা নিজের ক্ষমতা হাইব। গৌরিনাথ মাষ্টর ত কইছে, ‘দেয়েন ত হশ্চিমারা কী চালাকের চালাক কবিগুরু আর বিদ্রোহী কবিরে লই হিন্দু মোছলমান শিবিরে টানাটানি করে, কী মূরুখ্যের মুরুখ্য, কবি ভালা থাইক্লে নিজেও শরম হাইত। এতই যদি হ্যাতাগ ধম্ম হিরিত, তাইলে বঙ্গদেশেরে এত চোষে কিয়ের লাই, বৈষম্য কিয়ের লাই, গরীব অশিক্ষিত বানাই রাইখ্ছে কোন দুহে? মাথা মুড়াই খাইতে সুবিধা অইব বুজি।’ অন্ দেইখ্ছি মাষ্টর ঠিকই কইছে। হুইন্ছিলাম্ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হ্যাতাগ আইনমন্ত্রী থাই আপোষ করি হালাইছে। বঙ্গবন্ধু ত গুরুর কতা হুনে ন। হ্যাতাগ চালাকিহান ধরি হালাইছে। যতই চাপ দিক, বঙ্গবন্ধু মাথা নোয়ায় ন। গ্ৰামের বেক্ মাইন্ষ্যে চাই রইছে দ্যাশের হরিস্থিতি কোন মুই গড়ায়। হেই ব্যাডাগ ঠিক নাই যা খুশি তাই কইর্ত হারে। সৈয়দ আহমদ বলে একসময় কইছিল হিন্দু মোছলমান এই দুই জাত কহ্নও এক লগে থাইক্ত হাইর্ত ন। দ্যাশডা ভাগও অইছে হেই ধারণা লই। মারামারি কাডাকাডি অইছে ঠিকই, অনেক মানুষ চলিও গেছে অনের ভারতে কিন্তু এদ্দিন ত আমরা এই দ্যাশে আপন ভাবি এক লগে আছিলাম। হিয়ের লাই ত কইছি আঁঙ্গ বেকের সামনে এক বড় হরীক্ষা। ভোটের হরীক্ষায় ত আমরা হাশ কইর্ছি, সামনের দিনে এইডাই প্রমান অই যাইব আসলে দ্যাশডারে আমরা কেরুম দেইখ্তে চাই। কত লোক ত আই কত কতা কই যার, আঁই ত কোনও কতাতেই কান দি ন। মাডে আমন ধান হাইকছে। বদইল্লারা ধান কাডি আনি এক প্রস্ত হুয়াই বোজা বাঁধি আনি উডানে জমা করের। হ্যাতাগ গাত তুন্ দরদর করি ঘাম ঝরে, হাশ দি হাঁডি গেলে গা’র গন্দে ভুত হলায়। মাথায় গামছা জড়াই হাগড়ি বাঁধে, ফুক ফুক করি বিড়ি ফুঁকে। এত খাড্নি খাডে, হরিশ্রম অই যায়, কয়, মা এট্টুহান গুড় আর এক গেলাস হানি দিবেন। খালি গার মুই চাইলে হাড়গোড় ছাড়া আর কিচ্ছু দ্যায়া যায় না। হেই যে বেয়ানে মরিচ আর হান্তা ভাত মাই খাই আইছে আর কিছু হ্যাডে হড়ে ন। গরুগোতানগুন এরুম জোরে জোরে হাম্বা হাম্বা করি ডাক দেয়, আঁই ঘর তুন্ হেই ডাক হুনি। ঘাস খাইছে, হ্যাড্ ভরে না। করিম হেগুনের স্বভাব চরিত্র বুঝে, খের খল্লি দি খাইত দেয়। হুরমতির মা এই কড়া রইদের মইদ্যেও গড়ের হাশে জঙ্গল তুন্ ঢেঁইর হাগ, মাচার তুন্ হলই হাগ, কচুর লতি তুলি আনি ঘরে ঘরে ভাগ ভাগ করি দেয়। বেক্গুনেরে ডাকে, আঁই হাগ তুলি আইন্ছি গ দিদি, এক্কান ভান্ড দেন। বেকে হেতির আঁচল ভর্তি করি যার ঘরে যা আছে হেই মত খইমুড়ি দেয়। মনের আনন্দে টু্ক্ টুক্ করি খায়, খাওন অই গেলে ঢক্ ঢক্ করি জল গিলি ঘরের দিগে আঁডা দেয়। ঘর বইলতে মুলি বাঁশের বেড়া দি খেরের চাল, এক ঝড়েই কাইত, আবার বেক্গুনের তুন্ চাই চিন্তি হত্যেক বছর ঘর বানায়।
মুজিবর রহমান দ্যাশের মাইন্ষ্যের লাই লড়াই করের, এইডা বুইজ্তে সময় লাগে নি। হুরমতির মা হেইডা আর কতডা বুঝে। তয় হেতিও ভালবাসি হালাইছে কিয়ের টানে য্যান্। কী জানি বঙ্গবন্ধুর কতা হুনি হুনি বুজি হালাইছে যে কতাগাইন কর হেতিগ মনের কতা, হরানের কতা, টানডা আরও বাড়ি গেছে হেই কারণে। দ্যাশের মইদ্যে ঘূর্ণি আই ইয়ানে হিয়ানে থাবা মারের, মাইন্ষ্যে দিশাহারা অই যার। চাইর মুই হাহাকার, রাক্ষুইস্যা ঝড়ে ঘরবাড়ি ভাঙিচুরি একসার, চাইল ডাইল তৈল বাজার তুন্ উধাও। ভোলা, সন্দ্বীপ, হাতিয়া তুন্ আধা নেংডা, অভুক্ত মানুষজন ক্যাম্নে ক্যাম্নে আঁঙ্গ গ্ৰামে আই হইড়ছে বাঁইচ্বার আশায়। হশ্চিমা সরকার হিরেও চায় ন। লক্ষ লক্ষ মাইন্ষ্যের লাশ দেই বেকে হুঁশ আরাই হালাইছে। হিয়ের লাই আরও ক্ষেপি গেছে মানুষ। মুয়ে মুয়ে হিরে ‘যেরুম করি হোক, মরি আর বাঁচি হশ্চিমাগ দ্যাশ তুন্ দৌড়াই ছাড়ুম।’ আঁঙ্গ গ্রামের মাইন্ষ্যের চিন্তা গেছে বাড়ি, নানাজনে নানা কতা কয়। এইডা বুইজ্তাম হারিয়ের আগের মত বেক্ কিছু চইল্ত ন। আঁর হোলা অন্ আর সদরে যাইবার সাহস করে না। আঁর স্বামীরে কইলাম, কোটে আর যাওন লাইগ্ত ন, আম্নে ঘরে চলি আইয়েন। আদালতের কামকাইজও আগের মত নাই, মক্কল আর মামলা মোকদ্দমায় ঢিলামি আইছে। আঁর স্বামীর মুহে চিন্তার ভাঁজ অইড়ছে। বিপদ ঘনাই আইয়ের। ভুট্টোর লগে বঙ্গবন্ধুর মিটিং ভেস্তে গেছে। আঁর স্বামী ঘাব্ড়াই গেল, ডাকে আঁরে, তুঁই হুইনছনি ইয়াহিয়া খানের ডাকা জাতীয় হরিষদের বৈঠক ভুট্টো বয়কট কইর্ছে, হ্যাতেনে দুই হদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দলেরে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানাইছে। বঙ্গবন্ধু কইছে হেই দাবি হুরাডা অযৌক্তিক। আওয়ামী লীগের কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর কইর্ত অইব, ক্ষমতার মালিক অন্ হুব বাংলার জনগণ। বঙ্গবন্ধু ত দ্যাশের মাইন্ষ্যের মনের কতাই কইছে। আঁঙ্গ গ্ৰামের আওয়ামী লীগ সমর্থনকারীরা এক্কান মিছিল বার কইরছে। জামাতিরা হেইডা হছন্দ করে ন। গোলমাল এক্কান যে অইব বুজাই যার। হোলাডা আই কইল, হুইনছেন নি মা, ইয়াহিয়া খান ঘোষণা দিছে জাতীয় হরিষদের বৈঠক বলে অনির্দিষ্টকালের লাই বন্দ। কী অইব গ!
বাড়ির মাইন্ষ্যের চয়ে মুয়ে আতঙ্ক দ্যায়া দিছে। হরতাল শুরু অই গেছে হুরা দ্যাশে, বেকে ঘরে হাঁদাই গেছে। আঁর মাইয়া গেছে মন্দিরে হুজা দিবার লাই। ঘন্টা আর শঙ্খের শব্দ হুনি বুইজ্লাম আর বেশি বাঁই নাই। মাইয়ারে কত করি কইলাম অন্ ঘরের বার অইচ্ না, হুইন্ল না আঁর কতা। ভয়ে ভয়ে কাডে আঁঙ্গ দিন। আইজ্ রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দিব। কান খাড়া করি বেকে হুনের – এবারের সংগ্ৰাম আমাদের মুক্তির সংগ্ৰাম, এবারের সংগ্ৰাম স্বাধীনতার সংগ্ৰাম, জয় বাংলা… প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল…রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো। হুনি ত বেক্গুনের রক্ত গরম অই গেছে, য্যান্ হশ্চিমাগ আতের কাছে হাইলে চিবায় খাই হালাইব। বাজার গরম অই যার। বাঙালি অন্ আর হশ্চিমা সরকারের কতা মানে না, বঙ্গবন্ধুরেই অন্ দ্যাশের জনগণ হত্তাকত্তা মানে। লোম খাড়া অই গেছে যহ্ন হুইন্লাম হরে হরে হ্যাতাগ লগে কতাবাত্তা কোন কামে আইয়ে ন, হাকিস্তানি বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করি দিছে। অবস্থা বুজি মাইজ্ রাইতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করি দিছে বঙ্গবন্ধু। হ্যাতেনরে ধানমন্ডির বাড়িত্ তুন্ সেনারা গ্ৰেফতার করি লই চলি গেছে। আঁই ত হুনি আকাশ তুন্ অইড়লাইম এইবার বড় রকমের কিছু এক্কান অইব। দ্যাশের মাইন্ষ্যের উপ্রে বিপদের খাড়া নামি আইয়ের বুজা যার। চাইরদিক তুন্ খবর আইয়ের শয়ে শয়ে নিরীহ মাইন্ষ্যেরে গুল্লি করি মাইরছে হাঞ্জাবীরা। হ্যাতারা যে এবার হুরা দ্যাশে কব্জা কইরবার লাই লঙ্কাকাণ্ড চালাইব, ভাব দেই বুজা যার। আঁঙ্গ গ্ৰামের জোয়ান হোলারা জোড বাঁধের, জামাতিরা ছাড়া বেক্ হিন্দু মোছলমান এক অই গেছে। আঁর হোলাও বায়না ধইর্ছে হ্যাতাগ লগে যোগ দিব। আঁই মানা করি ক্যাম্নে।
দ্যাশে হশ্চিমারা বলে অনেক অস্ত্র আনি জড় করের। বঙ্গবন্ধুর ডাকে আঁঙ্গ দ্যাশের হোলারাও দলে দলে মরণহন করি ঝাঁপাই হড়ের, দ্যাশের মাইন্ষ্যেরে হাঞ্জাবী সেনাগ অইত্যাচার তুন্ বাঁচাইত অইব ত। কেউ আর হিছের দিগে হিরি চায় না। এরুম অইছে রাস্তাঘাডে জোয়ান হোলাপইনরে আর দ্যায়নই যায় না। কী যে অইব! হাঞ্জাবীগ গুল্লি খাই কত তরতাজা হোলাগ যে হরান চলি যার। মা-রা ঘরের মইদ্যে বই বুক চাপ্ড়ায়, কে আর দিব সান্ত্বনা। বাজারের দোয়ান আট বেক্গাইন বন্দ করি দিছে, কহ্ন আই লুটহাট করি লই যাইব, অরাজকতা চইল্ছে। আনাজহাতি তৈল নুন সাবান কিচ্ছুই হাওন যায় না, বেকে হেনেভাতে খাই জীবন কাডায়। এরুম এক্কান দিন যে আইব, কেউ কল্পনাও কইর্ত হারে ন। ঢাকা চাঁটগা ময়মনসিংহ সিলেট কুমিল্লায় কী অর জাইন্বার লাই একজন আরেকজনের ঘরের মুই ছোডে। জিলা শহরে অনেকের হোলারা কাম কাইজ্ করে ত। কোনরমে ঘুরহঁতে চাইর হাঁচ দিন ধরি কেউ বাড়ি হৌঁছাইল ত চাঁদ আতে হাইল। হ্যাতেরে ঘিরি চাইর বাড়ির মানুষ জড় অই নানা কতা জিগ্গায় – ক্যাম্নে আইছ?… সৈন্যগ গুল্লিগালা চইলছে হুইনলাম। … ধরি ধরি হিচমোড়া করি বাঁশের খুঁডিত্ ঝুলাই বন্দুকের নল দি হিডায়।…কতাগাইন হাঁচা নি।…বৌঝিরে হেনস্থা করের বুজি অসইভ্য হাক সেনারা? ভূপতি কয়, সেনারা খালি নয়, লগে আঁঙ্গ দ্যাশের রাজাকাররাও ছাড়ের না, আর হিন্দুর মাইয়া হাইলে ত কতাই নাই, শরীল ত খাবলাই খুবলাই খার, শ্যাষমেশ জাতধম্মও রসাতলে যার। বেকে গালে আত রাই কতাগাইন গিলে আর ডরে চখমুখ চিমসাই যায়। আঁঙ্গ দ্যাশের আলাভোলা মাইন্ষ্যের উপ্রে এত অইত্যাচার চালার দুষ্টরা! এর বিচার একদিন অইব। আইজ্ না হয় শহর তছ্ন্ছ্ কইর্চে, কাইল যে গ্ৰামে আই থাবা বয়াইত ন, কে কইত হারে। কইত হারে কীগ বদি, সৈন্যরা হেনি, লাকসাম, চৌমুহনী হইয্যন্ত ঢুকি গেছে। ব্যবসা বাণিজ্য ছত্রছান করি দিছে, কারবারিগ গাছে বাঁধি গুল্লি করি মাইরছে, মাথার খুলি উড়াই দিছে। মাইন্ষ্যে হাগলের মত হরান বাঁচাইবার লাই ছুডি বেড়ার। এই আঁচ আঁঙ্গ ঘরে আই হইরতে বেশিক্ষণ লাইগ্ত ন।
বেকের চয়েমুয়ে এক আতঙ্ক, কহ্ন কী অইব, কেউ কইত হারের না, খালি হায় হুতাশ করে। হাঞ্জাবীরা চাইর দিগের তুন্ ঝাঁপাই হড়ের। এরুম কতগুন মাইন্ষ্যের মুখ দেয়ন যার, আশেহাশে আগে কহ্নও দেয়ন যায় ন। হ্যাতারা কত কতার হ্যাঁচাল হাড়ে। হেগুনের খাইচ্চত এত খারাপ আঁঙ্গ বাড়ির করিম আই কয়, কী কইয়ুম জেডি, এরুম গাইল দেয়, হালা হমন্দি ছাড়া মুয়ে কোন কতা নাই, খালি বঙ্গবন্ধুর গুষ্টির তুষ্টি করে। খালি আম্নেগ চইদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করের, আঁঙ্গরেও ধম্কায় আর কয়, ‘মালাওনেগ লগে মিলামিশা করবি ত তোগরেও দেই লইয়ুম, অন্ও সাবধান অই যা।’ বিপদ আইয়ের গ জেডি, আম্নেগ আর এই দ্যাশে থাইক্ত দিত ন। আঁর বড় জা কয়, কী কছ্ রে করিম সব অলক্ষুণে কতা! তাইলে আমরা যাইয়ুম কন্নাই? আর এক জা জিভ ভ্যাঙায় কয়, যমের দুয়ারে। কতাডা যে হেতি ভুল কর্, হেইডাই বা ক্যাম্নে কই। ওমা কিছুক্ষণ বাদে দেই অনন্তহুর তুন্ আঁর ননদের দুই হোলা আর হেতির জামাই গাট্টি বোঁচকা লই হাজির। আঁই ত দেই আকাশ তুন্ অইড়লাইম। কীরে ক্যাম্নে অইল তোগ এরুম দশা! আর কইয়েন না বদিগ কোনরমে হরানে বাঁচি আইছি। রাজাকাররা লাডিসোডা লই আই আঁঙ্গ বাড়ি ঘিরি হালাইছে মাইজ রাইতে। হুরুষ মাইন্ষ্যের হ্যাডে হিডে কিল চড় থাপ্পর লাত্থি গুঁতা। যে যেমুই হাইর্ছে হলাইছে। আমরা রাত বিরাইতে আর কিঅরুম, ধানক্ষেত হাটক্ষেত দি জল ভাঙি ভাঙি আইছি। বয় বয়, আগে জিরাই ল, তোগরে আগে জল দি। তোর মাইয়াগুনরে কন্নাই রাই আইছচ্? হেগুনের কোন খবর নাই গ বদি।
আঁর ননদ ত উত্লাই উত্লাই কাঁদে। হেতির কাঁদা থামাইতাম্ না হারি মাথাডা আঁজা করি বুয়ের মইদ্যে চাপি ধরি। আঁর কাহড় ভিজি যায়, হেতির কাঁদন্ কী আর থামে! বাড়ির বেক্গুনে চাই থায়। কারও মুয়ে কোন কতা নাই। কী অইতেছে আর কী অইব, কেউ বুইজ্ত হারেন না। বিপদ যে আঁঙ্গ বাড়ির কাছে আইতে আর বেশিক্ষণ লাইগ্ত ন, বেকে টের হাই গেছে। রেডিওত্ কান হাইত্লেও কোন খবর নাই। আওয়ামী লীগের নেতারা খবর কয়, আম্নেরা ঘাবড়াইয়েন না। আঁঙ্গ দ্যাশের শয়ে শয়ে জোয়ান হোলারা মুক্তি বাহিনীতে যোগ দের। ইনশাল্লাহ হেগুনে জোর লড়াই করি জয় ছিনাই আইন্ব। ভারতীয় সেনারা বডারের ওপারে প্রশিক্ষণ দেওন শুরু করি দিছে। ডরাইয়েন না, মোডেই ডরাইয়েন না, স্বাধীনতা হাওনের দিন আর বেশি দূরে ন।
চয়ের নিমিষে সময়ডা হাল্টাই গেছে। দিন দুইন্নাই আর আগের মত নাই। আগুন জ্বইলছে ত জ্বইলছেই। হেই আগুনে হুড়ি মইর্ছে হুব হাকিস্তানের বাঙালিরা। জ্যান্ত বাঙালিগ মইদ্যে ভেদাভেদ থাইক্লেও থাইক্ত হারে, মরা বাঙালিগ মইদ্যে এক্কানই হরিচয়, বাঙালি হরান দিছে, বাঙালিরে গুল্লি করি মাইরছে হাঞ্জাবীরা, হেই অমানুষগ শাগরেদ অইছে আঁঙ্গ দ্যাশের বেঈমানরা যেগুনে ভাইয়ের রক্তে নিজের আত রাঙায়, কিয়ের লাই করের হেগুনে নিজেরাও জানে না। হিংসার আগুন লক্লক্ করি আইয়ের। আরে, ধম্মের দোহাই দি সীমানা দখল কইর্তে হাইর্লেও মন দখল করন যায় না। আগুন দিও এত বাড়ি ঘরদোর হোড়ান যায় না। কত জলা, কত হুইর, কত খাল, কত বিল কত নদীর কত জল থাওনের হরেও নিবাই ত হারে ন। মনের মইদ্যে আঁর কত কতা যে হুডের ভট্ ভট্ করি, আঁই ধইর্তাম হারিয়েন না, হুরুত হারুত করি হলাই যায়। মনের কতা আর কারে কমু। বাড়ি ত আর বাড়ি নাই, বেকের আত্মীয়স্বজন আই হুরা বাড়ি ভর্তি অই বাড়ির চেহারাহান অইন্যরকম অই গেছে। বদলের মইদ্যে এক অইছে আঁঙ্গ জাম্বুরা গাছে এবার এত এত জাম্বুরা ধইর্ছে, আমলকি গাছে এত হল্ ধইর্ছে, ঠাইল হুদ্দা ভাঙি হড়ি যার। হড়ি আর কী যাইব, আবার ঝারিঝুরি উডি খাড়াইব। আঁর হৌড়ি কর, বৌ এবার স্বাদ করি আঁচার বানাইচ্, ভাত দি খামু। হ্যাতেনের কতাগাইন হুনি চখ দি জল বার অই যার। বুড়িমানুষডা জাইন্তই হারেন না, দ্যাশডা যে হুড়ি ছাই অই যার, মাইন্ষ্যের লাশ হিয়াল কুত্তা টানি টানি ছিঁড়ি খার, কত মার কোল খালি অই যার। সময় আঁর হৌড়ির কাছে এক হাও আগায় ন, থম্কাই আছে হ্যাতেনের ঘরে, মানুষজন বাড়িঘরের চেহারা সুরত একমই ঘুরি হিরি থায়। আঁই যদি দ্যাশের চেহারাহান এরুম করি দেইখ্তাম হাইর্তাম। আঁর দ্যাশ, স্বপ্নের দ্যাশ, বঙ্গবন্ধুর দ্যাশ এক রম থাইক্ত। এই মানুষডারে লই কতজনে কত কতা কয়, দ্যাশের লাই হরান দিবার হতিজ্ঞা ত মিছা কতা ন। না জানি ইয়াহিয়া আর ভুট্টো যুক্তি করি জেলের মইদ্যে রাই না মারে। হায় হায় রে মানুষডার কতা হুইনলে মনডা জুড়াই যায়। হুইন্লাম হ্যাতেনরে রাষ্ট্রপতি করি সরকার বানাইছে আওয়ামী লীগ। কী জানি কতাহান হাঁচা কিনা। তাইলে কী আঁঙ্গ দ্যাশ স্বাধীন অই গেছে, আহারে স্বপ্ন!
ঘরে ঘরে কতা কাডাকাডি, বোঁচকা বুঁচকি লই লাড়াচাড়া শুরু অই গেছে। ভাবহান এরুম য্যান্ বিপদ দ্যাইলেই ছুডি হলাইত হারে, গ্যাঁতি গুষ্টির আওন যাওন আর থামে না। কত ত শলা হরামর্শ, বেক্ কতার মইদ্যে ডরভয় মিশি রইছে, কতা কইতে গেলে জিভ হুয়াই যায়, এক কতা কয় ত আর এক কতা বার অই আইয়ে। হুনা যায় কাঁশ পিতলের ঠন্ঠনাঠন্ ঠন্। টঙের তুন্ নামাইবার সময় ধুম্ করি হড়ে, হাঁড়গোড় ভাইঙলেও ভাইঙত হারে, আঁডু আর গোড়ালির ব্যথায় উঃ আঃ করে বুড়াবুড়ি। বিপদটা আগাম আঁচ কইর্ত হারি ঘরের বউঝিরা বিলাপও করে – কী উপায় অইব গ আঁঙ্গ দিদি, এই চোট্টারা ত হাঁড়ি হাতিল, হোনাদানা লুট করি লই যাইব। যিয়ান হুনিয়ের হাঞ্জাবীরা খুনখারাবি গুল্লিগালা তুন্ শুরু করি কোনডাই বাদ দেয় না, মাইয়া মাইন্ষ্যের ইজ্জত লই খেলের। যদি একবার খাল হার করি করিমগঞ্জ থানা হার অই বাজারের রাস্তাহান চিন্ত হারে তাইলে আঁঙ্গ মরণ ত অইবই অইব। শ্মশানের মঠ রাজাকাররা চিনাই দিলে ত কোন কতা নাই, হিন্দুর বাড়ি বুজি যাইব। এত ভাবাভাবির মাইজহানে রমজান আলি আই খবর দিল, বাবু আম্নেরা তাড়াতাড়ি হলাই চলি যান আরও ভিত্রের গ্ৰামে, আঁই নৌকাত্ করি জীবনহুর হৌঁচাই দিমু, ইয়ার হরে আম্নেরা যুক্তি করি যেইডা ভালা মনে কইর্বেন, কইর্বেন, আঁর কিছু কওনের নাই। আন্দাজ করি আঁর সেজ দেয়র কয়, রমজান আঁঙ্গ বাড়িঘর ক্যাম্নে রক্ষা অইব। আরে বাবু, আগে ত জান বাঁচান, বাড়িঘরের কতা হরে ভাবিয়েন। দরকার অইলে ত আমরা হারা দিমু দিনরাইত। হ্যাতের কতা হুনি হুরুষ মাইন্ষ্যেরা চখ চাওয়া চাওয়ি কইর্ল। রমজানের কতা উড়াই দেওন যায় না। হ্যাতেরে আবার আওয়ামী লীগ তদবীর করি চাষাগ নেতা বানাইছে, মিছা কতা কইত ন। আঁর এক খুড়াহৌর কয়, হুন, আমরা বাড়িঘর হালাই কোনহানে যাইতাম্ ন, আঁঙ্গরে যদি মারিকাডি হালায়, হালাক্। রমজান এবার গালের চোয়াল শক্ত করি কয়, হুনেন বাবু, আসল কতা কই, আঁর কাছে খবর আইছে, আম্নেগ চাইর হিন্দু বাড়ি আইজ্ রাইতে আক্রমণ অইব। আজীবন আম্নেগ নুন খাইছি, চয়ের সামনে গ্ৰামের মাইন্ষ্যেরে কচুকাডা কইর্ব, এইডা সইতে হাইরতাম্ ন, হিয়ের লাই সাবধান করি দিতাম্ আইছি। বিশ্বাস কইর্বেন কি কইর্বেন না, হেইডা আম্নেগ মর্জি। যেগুনে এতক্ষণ মাথা ঘুরাই ঘুরাই খাইজ্জাইতেছিল, হ্যাতের কতায় বিশ্বাস অইল, কতাডার ওজন আছে, চালাকি না।
কুত্তাগুন ঘেউ ঘেউ করে, বিলাইয়ের কান্দন সইয্য করন যায় না, মনে অর মাইন্ষ্যের বাইচ্চা কাঁদের। হোলামাইয়াগুনের মুয়ের দিগে চায়ন কী যায়, আতঙ্ক আর ভয় আই হেগুনেরে ঘিরি ধইর্ছে, আঁঙ্গ মুয়ের দিগে চাই থায়, কোন কতা কয় না, খেইলত যায় না, মুয়ে খানা রচে না। হেগুনেও কী বুজি হালাইছে ভয়ানক কিছু এক্কান অইব, হিয়ান তুন্ রেহাই হায়ন এত সহজ অইত ন। আগের মত ঘাডে আই নৌকাও ভিড়ে না, মাইন্ষ্যের কোনও সাড়াশব্দও নাই, দেয়র ভাইয়ুররা দোয়ানেও যায় না, বেজার মুয়ে গালে আত দি ঘর দুয়ারে বই থায়। আগে ত ভালামন্দ জিনিস আনি আতে দিত, নাইচ্তে নাইচ্তে খাইত। হেই দিন আর নাই। মাইন্ষ্যের মনে কোনও সুখ নাই, বেক্ আনন্দ রসাতলে গেছে। জীবন যে কোনওদিন এরুম শিক্ষা দিব, কে জাইন্ত। গুম মারি আছে চাইরদিক। হুইরের জলও লড়ে না। গাছের হাতাগুন নিজের খেয়ালে ঘুইরতে ঘুইরতে জলে হড়ি হাড়ে আই জড় অইত, জলের হোকারা লাফাই লাফাই উইঠ্ত, ঝুপঝাপ হেই শব্দও হুনা যায় না। ব্যাঙেরা ঘ্যোঁতঘাঁত করি নিজের মনে, হাপেরা কহ্ন যে খপাৎ করি গিলি হালাইব টের হায় না। মাইয়ার ঘরের নাতি আই আঁর কাহড়ের আঁচল ধরি টানি ইনাই বিনাই কত কতা কয়, হিয়ানের মাথামুন্ডু বুজি না। আসলে হ্যাতের রাগ অইছে মা বাপের চলি যাইবার লাই তোড়জোড় করের। আপন ঘর ছাড়ি কেউ কহ্নও যাইত চায় নি। এট্টু্ক্ ছুটকিয়া ক্যাম্নে বুইজ্ব দ্যাশের মইদ্যে কী কাণ্ড চলের। এই ঝড়ের দাপট যে আঁঙ্গ বাড়ি আইতে বেশি দেরি নাই, হেই চিন্তায় বেকে দিশাহারা। কন্নাই গেলে হরানে বাঁইচ্ব হেইডাই বুইজ্ত হারেন না। এই বিপদের তুন্ কেই বা উদ্দার কইরব কেউ কইত হারেন না। বেকে বেকের চয়ের দিগে চায়। কী অইব উপায়! রাত বিরাইতে কীয়ের য্যান্ দড়াম্ দড়াম্ আবাজ হুনা যায়। কারা য্যান্ টিনের চালে ইডা মেলা মারে, ঝন্ঝন্ করি উডে। এই বুজি রাজাকাররা আই হইড়্ছে। হরানডা ধু্ক্ ধুক্ করি ওডে। গাছের হাতা ঢুলি হড়ি যায়, কোনরমে রাইত কাডে। বেয়ান না অইতেই দেই আঁর খুড়া হৌড়ের মেজ হোলা বাক্সহোট্লা লই বাড়ি ছাড়ি চলি যার। হ্যাতাগ ঘরে আঁঙ্গ এম্নেই আওন যাওন নাই, ভিন্ন অই গেছে ত কম দিন অয় ন। হেই কারণে কোন শলা হরামর্শ নাই। তবুও মনের টান ত যায় না, নিজে যাই জিগ্গাইলাম ঠাউরপো কন্নাই যাও। মন তুন্ বার অয় ন, মুয়ের তুন্ যে কতাগাইন ছুড়ি দিল – যে দিগে দুই চখ যায়, চলি যামু, এম্নেও মরুম, হেম্নেও মরুম, মরণ যহ্ন কোয়ালে লেয়া আছে, যা অইবার তা অইব। বুইজ্লাম হ্যাতে রাই ঢাই কতা কর। আঁর বাপের বাড়ির দ্যাশ তুন্ রাধানগর ত বেশি দূরে ন, হিয়ান দি ত্রিপুরা চলি যাইব। ইয়ার হরে এক্কান ব্যবস্থা অইব। ঐহাড়ে আত্মীয় হজন আছে, না খাই মইর্ত ন। আঁর হৌড়ি কয়, কে যায় রে বউ? বরেন ঠাউরপো গ মা। ও বরু, হ্যাতে শ্যাষমেশ দ্যাশ ছাড়ি, বাড়ি ছাড়ি, আঁঙ্গরে হালাই চলি যার! কী অইব রে বউ, বেক্ যদি এম্নে চলি যায় আঁঙ্গ কী দশা অইব! আরে বেকে ত যার না, আরও ত বাড়ির লোক আছে, এত চিন্তা করেন কিয়ের লাই?
এরুম দিন যে কোনদিন আইব, ভাইব্তাইম্ও হারি ন। এক ঘর তুন্ দুই ঘর, দুই ঘর তুন্ তিন ঘর, তিন ঘর তুন্ চাইর ঘর, চলি গেছে ভারতে এক এক করি। কারোগরে কিছু কইবার নাই। বাঁইরাও হা বাড়াই রইছে। দ্যাশগ্ৰামের মাইন্ষ্যের চয়ের সামনে দি চলি যার, কারও মাথাব্যথা নাই, হ্যাতারা ত রক্ষা কইর্ত হাইর্ত ন। যেই জালিমরা তৈরি অইছে, এক কোপে সব সাবাড় করি দিব, ভিডামাডির লাই মায়া করি শ্যাষে কী হোলামাইয়া লই নিজেগ হরান দিমু! হেগুনে কয়, যদি বাঁচি থাই, ভাইগ্যে যদি লেয়া থায়, একদিন না একদিন দ্যাশে হেরত আমু আর যদি হঁতেঘাডে মরি যাই, হিয়াল কুত্তায় টানি ছিঁড়ি লই যাইব। মাইয়াবউরে কইছি, শতানরা ইজ্জত লুইট্ত আইলে, হুট্লির মইদ্যে ধুতরা হল্ হুল্ আছে, খাই মরবি। বেক্গুনে হেই কতা হুনি ঝরঝরাই কাঁদে, বউ মাইয়ারে বুয়ে জড়াই ধরে। হুনিয়ের আঁঙ্গ হাশের বাড়িঘরও খালি অই যার। হ্যাতাগ বাড়ির ক্রিয়াকম্মে আমরা অসজ হালন করি না, ছয় হাত হিঁড়ি আগের কিনা, গ্যাঁতির মইদ্যে অন্ আর হড়ে না কিন্তু সম্পর্কের জোর কেবল কম ন, আপদে বিপদে ছুডি আইয়ে, ঝগড়া বিবাদ অইলে আপষে মিমাংসার লাই ডাক হড়ে। কীর্তনে, হালা হার্বণে, মোচ্ছবে, মুয়েভাতে, বিয়াশাদিতে নিমন্তন্নও করে, ডাকখোঁজের অন্ত নাই কিন্তু এরুম অশান্তির দিনে ক্যাম্নে যে মুখ হিরাই লইল কি জানি, যার যার তার তার হঁত দ্যায়। বেক্গুনের এই অবস্থা দেই মনডা ভাঙিই গেল। আবার ভাইব্লাম, ঠিকই কইরছে। এতগুন মানুষ, নানা মুনির নানা মত, কেই বা কার কতা হুইন্ত। কার লগে কার আত্মার সম্পর্ক আছে কে কইত হারে। বড় সংসারডা কহ্ন যে লম্বা অই যায়, আবার কহ্ন যে ছোড অই যায়, বেক্গাইন ত মনেরই খেলা। আঁর স্বামীর মা’র হ্যাডের ভাইগ মইদ্যেও নানা রমের ভাবনাচিন্তা চলে। আঁর ননদরাও কেউ নরোত্তমপুর, কেউ আবার হতাপহুর। কত কতা আচম্বিত্ কানে হুনি। হ্যাতারাও যার যার মত ছড়াই ছিডাই গেছে। বড় ননদেগ করিমগঞ্জে ধান চালের ব্যবসা, আর ছোড ননদেগ হেনী শহরে তেজারতির কারবার, ট্যায়াহইসা, মালহত্র বেক্ কিছু লুটপাট অই গেছে, আগুন দি জ্বালাই দিছে দোয়ানহাট। হ্যাতারা বিলইন্না বডার দি হার অই গেছে কিনা, তাও জানি না। মরণ যদি অয়ও, রুইখ্ব কে?
মনস্থির করি হালাইলাম্, যে যার খুশি যাক, হাঞ্জাবীগ গুল্লি খাইলে খাইয়ুম, নিজের দ্যাশ ছাড়ি যাইতাম্ ন, আঁর স্বামীও আঁর লগে এক মত অইল। আঁর মেঝ, সেঝ, নোয়া, ছোড দেয়ররা আঁর সুরে সুর মিলাইতে রাজি অইল না। হইলা দোটানা কইর্লেও হ্যাতারা বাড়িঘর ছাড়ি হাঁডা ধইরল ঘুরহঁতে, আপন হরান বাঁচাইতে কে আর না চায়। হোলাহাইনগুন আঙ্গঁরে একলা রাই যাওনের লাই দুখ্ কইরল, শ্যাষে বাবা মার যুক্তির কাছে হার মাইনল। এইডা ত হাঁচা কতা ভিডামাডির মায়া করি হড়ি থাইক্লে চইল্বনি। হেইডা যে বোকামির কাম অইব, হেইডা আঁইও বুজি। যাইবার কতা মনে অইলেই ভিতরডা কেরুম করি উইঠ্ল। একবার শ্যাষ চেষ্টা করি দেই না যদি ধন হরান দোনডাই বাঁচাইতাম হারি। গ্ৰাম কে গ্ৰাম উজাড় অই যার, দলে দলে মানুষ দ্যাশের মায়া ছাড়ের। হতিবেশী মোছলমান ভাইরা কেউ কেউ যে দুখ্ করে কয় ন এরুমডা ন, ‘আম্নেরা চলি গেলে আমরা বাঁচুম ক্যাম্নে!’ কিন্তু ভরসাও ত জোগাইত হারে ন। আঁর স্বামী সেজ জামাইরে কইল, ‘তোঁঙ্গ গ্ৰামে ত অন্ও এত উৎপাত শুরু অয় ন, এক হাঁকে তোঁর হালা হালীগরে ঐহাড়ে বড় মাইয়ার কাছে যদি রাই আইতে হার, একটু নিশ্চিন্ত অই। জামাই আঁর ডাকাবুকা মানুষ, এক কতায় রাজি। দিন দশেক বাদে মঙ্গলমত হেগুনেরে রাই আই জামাই হেরত আইছে। হিগার মুখহান দেই ত আঁই চম্কাই উইঠ্লাম।
কিয়া কাইয়ুম মা, যা দেই আইলাম, নরক ছাড়া আর কিছু ন। জলা জঙ্গল হার অই মাইন্ষ্যে বডার হার অই যার, মাঝেমইদ্যেই দড়াম করি মাথা ঘুরি হড়ে। খানা নাই, দানা নাই, এক গেলাস খাওনের জলও নাই, ঝর্নার জল দুই আতে কোশ করি খায়, কে কারে দিব, এক্কান মানুষ নাই যে আগাই আইয়ে। বউঝিগ কাহড় চোহড় ছিঁড়িভিড়ি এরুম দশা, চয়ে দেয়ন যায় না। কও কী! আরও হুইন্লে ত আম্নে ভীমরতি খাইবেন। তাঁবুত্ হুতি হেনেভাতে খাই দিন কাডায়। হ্যাডের অসুয়ে কাত্রায়। হ্যাতাগ সরকার খানাও দের, যত আঁঙ্গ দ্যাশের মানুষ ঢুকের, আশ্রয়ও দের, ইয়ার তুন্ বেশি আর কী কইর্ব। আঁঙ্গরে হেই দ্যাশে কয় শরণার্থী। কোনরমে মাথা খুঁজি রইছে গাদাগাদি করি। কী যে হঁচা গন্দ, হায়খানা হেচ্ছাবের মইদ্যে বউরা সন্তান হসব করের গ মা। লেংডা হোলাগুন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে। কারও দয়া অইলে দুমুডা দেয়, না হয় মুখ হিরাই লয়। লাজ শরম বেক্গাইন মাথায় উইঠ্ছে। হিগাইন দেই আঁর হেই দ্যাশে যাইবার মন উডি গ্যাছে।
তোঁগ গ্ৰামহান ত অনেক ভিত্রে, মানুষগুন ভালা, আঁঙ্গ ইয়ানের মত এত অইত্যাচার কইর্ত ন। দ্যাশের অবস্থা যে কোনদিগে গড়াইব কিছুই অনুমান কইর্তাম হারিয়েন্ না। খান সেনারা আঁঙ্গরে কী মারিই হালাইব। হ্যাতারা যদি মুক্তিযুদ্ধে জিতিও যায় হোড়া দ্যাশ আর মরা মানুষ লই দ্যাশ শাসন কইরব ক্যাম্নে। আঁর জামাই কয়, আম্নের এই কতার উত্তর মা অন্ কেউ দিত হাইর্ত ন। লাশ আর রক্তের দাগ মাড়াই মাড়াই অন্ আঁঙ্গরে ঘরে হিরতে অইব। না জানি বাড়ির অবস্থা কী অই রইছে, আর আম্নের মাইয়ারাও কে কেরুম আছে। হেরুম বুইজ্লে কই আইছি জঙ্গল ঘিরা এক্কান হুরান বাড়ি আছে, হাপখোপের বাসা, মাইন্ষ্যের চয়ের আড়ালে থায়, খাল হার অই হিয়ানে য্যান্ যাই মাথা গোঁজে।
আনন্দ আর ক্যামনে ধরি রাই
দ্যাশ আঁঙ্গ স্বাধীন অইছে
মনের কষ্ট ভুলি যাই
ক্যাম্নে আর থাইয়ুম এত্ত বড় বাড়িত্। ঘরের মইদ্যে একলা বই কাঁদে আঁর হৌড়ি। হ্যাতেনের মনের মইদ্যে বড় দুখ্। বাড়িডা খাঁ খাঁ করে। হুতি বই থাইক্লেও হারাদিন কত বক্বকানি আই কান ঝালাহালা করি দিত। অন্ কোনও কোন্দল নাই, হাওনা গণ্ডার ইসাব নাই, হ্যাডের ভাত জোগানোর কোনও তোড়জোড় নাই, জায়ে জায়ে কোনও ঝগড়া নাই। তহ্ন ঘরের মইদ্যে হড়ি থাইক্লেও মনে অইত, কত আত্মীয়স্বজনরা আই গিজ্গিজ্ করে। এমুই হেমুইর তুন্ হিস্হিস্ হুশ্হাশ্ শব্দ বাতাসের লগে ভাইসতে ভাইসতে আই ঘরে হাঁদাই যাইত, রোগে ভুগি ভুগি শরীলডা লাড়াইত চাড়াইত না হাইর্লেও কী ভালা যে লাইগ্ত হ্যাতেনের, মুয়ের উপ্রে আঁসির ঝলক দেখলেই আঁঙ্গ হরানহান জুড়াই যাইত। মনে বড় কষ্ট লই বেজার মনে অন্ বকবক করে। মুশকিলডা হর অইন্য জাগায়। চাইরদিগে হুড়মুড় করি শুধু কী ঘরবাড়ি ভাঙের, মাইন্ষ্যের মনও ভাঙি যার, কারও কোনও ক্ষমতা নাই যে এই অবস্থাডারে আঁট্কাইব। আঁই আঁর হৌড়িরে কইলাম, মা এইবার যাইত অইব। হ্যাতেনে কইল, কিয়ের লাই যামু, কন্নাই যামু? তোরা কী আঁরে মারি হালাইতে চা? আঁর কাছে হেই কতার কোনও জবাব নাই। তয় যাইত যে অইব হেইডা হুরাহুরি ঠিক। দুই এক হান ট্রাঙ্কে আঁর বিয়ার হিতল কাঁসার থালা গেলাস, হাঁচ হুরুষের নাম ঠিকানার ঠিকুজি কুষ্টি ভরি আর এক বোঁচকাত্ চিড়া খই মুড়ি গুড় লই ঘরের এক কোনায় রাইখ্লাম, বাঁই ঘরদোরে তালা মারা। গমগম করা বাড়িহান এইরম যে শুনশান অই যাইব, কল্পনাও ত কইর্তাম্ হারি ন। আঁর স্বামীরে কইলাম আর মায়া বাড়াইয়েন না। আঁর স্বামী কইল, বুইজ্লা না, মনের দুঃখে বনে যাইত অইব আর কি। এই কাঁচারি বাড়িত্ চেয়ার টেবিলে বই কত মুসাবিদা কইর্ছি, গ্ৰামের কত মাইন্ষ্যের দুহের কতা হুইনছি। ভাইবছি, এইডা আঁঙ্গ গ্ৰাম, ইয়ানের মানুষ কত দুখি, সামান্য জমিজমা লই চাষবাস করি খায়, হ্যাতাগরে লই আঁঙ্গরে বাঁইচ্ত অইব, আলাদা করি কহ্নও ত ভাবিন, ক্যাম্নে এরুম অইল কও ত।
কে আম্নের মনের কতা হুইন্ব? হশ্চিমারা আই চালাকি করি বেকের মনের মইদ্যে আরও বিষ ভরি দিছে হ্যাতাগ সুবিধার লাই, আম্নে কী মনে করেন, আর কোনদিন জোড়া লাইগ্ব। হুনেনের না কীরম রক্ত লই দোল খেলের? মানুষ আর মানুষ আছেনি অন্, হশু অই গেছে দিন দিন। হুরান দিন আর ফেরত আইত ন, হেই আশা আম্নে ছাড়ান দেন। চলেন ঘর ছাড়ি বার অই হড়ি, কোয়ালে যদি লেয়া থায় একদিন হেরত আইয়ু্ম্, আর না হয় ভাইগ্যে যা আছে অইব। করিমরে কইছি মারে কাঁধে করি যদি আঁঙ্গ লগে লগে যাইত হারে। অন্ কই বলি ঘোষ বাড়িত্ রাই দিমু, জানাহুনা বাড়ি, আঁঙ্গ বাড়ি তুন্ মাইল পনের ভিত্রে, ডরভয় এট্টু কম। যদি সময় বুজি আর কোন ব্যবস্থা কইর্তাম্ হারি আর যদি মা’র আয়ু থায়, তয় মা’র লগে দ্যায়া অইব, ভগবান ভরসা।
আঁর হৌড়িরে কাঁধে লই করিম হাঁডে, আমরাও হাঁডি। হাঁডার আর বিরাম নাই। যাইতে যাইতে মাইজ্হানে দুই এক্কান মোছলমান গ্ৰাম হড়ে। হ্যাতেরা আঁঙ্গ দিগে চায়। জিগ্গায়, কোন গ্ৰাম তুন্ আইছি। রাস্তার হাশে আম গাছ, অশ্বত্থ গাছ, বাদি গাছ হড়ে, দুই অগ্গা দিঘিও হড়ে। গাছের ছায়ার নিচে এক্কানা আরাম করনের লাই জিরাই লই। জলের তৃষ্ণা লাইগ্লে হাড় ভাঙি নীচে নামি ঘডি ভরি জল লই নিজেরাও খাই, হৌড়িরে করিম কাঁধের তুন্ নামাই দিলে খাওয়াই। হ্যাতেনের কষ্ট সইহ্য অয় না, চুপ করি থায়। বুইজ্ত হাইর্ছে কিচ্ছু করার নাই। হায় হায় রে এইত এক্কান জীবন, নিজের বাড়িঘর ছাড়ি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি মরি। দুহের কতা কারে কইয়ুম্, গা দি দরদর করি ঘাম ঝরে। হৌড়িরে ঘাম মোছাই দিলে করিম কাঁধে উডাই লয়। করিমের কষ্টও কী কম, হ্যাতের মইদ্যে হিন্দু মোছলমান আই অন্ও কচ্লাকচ্লি করে ন। হিগাইন ভাইব্বার মত হ্যাতের মনের মইদ্যে কোনও হুযুগও অয় ন। কত ত খোঁচাখুঁচি অইছে, হ্যাতে আঁসি উড়াই দিছে। মনের সম্পর্ক অস্বীকার কইর্ব এরুম সাহস হ্যাতের নাই। আঁর স্বামীর মনেও কত ত খচ্খচানি। এসব রাস্তা মাড়াইব কোনদিন ভাবেও ন, আইজ্ য্যান্ বিপাকে হড়ি এই ঠাঁডা মাইরা রইদে, রাইতের ঘুড্ঘুইড্যা আঁন্দারে হা চালাইতে অর। মনডা উথ্লাই উডি জাইনবার ইচ্ছা অয় কোনওদিন ত সজ্ঞানে কারও কোনও ক্ষতি করে ন, এরুম হল্ ভোগ করের কিয়ের লাই তয়? অনেক হশ্নের উত্তর মাইন্ষ্যে খুঁজি বেড়ায়, মিলে না ত, মিলব ক্যাম্নে! মাইন্ষ্যের হাপে যিয়ানে মাইন্ষ্যে দগ্ধ অয়, হেইডার কারণ খুঁইজ্ত চাওন বোকামি ছাড়া আর কি। বরঞ্চ চুপ করি অপেক্ষা কইর্লে এক্কান রাস্তা বার অইত হারে। হাপখোপ কত আছে। মাইন্ষ্যের কামড়ের তুন্ বাঁইচ্তে হলাই যাইয়ের, হাপের কামড়ের তুন্ নিস্তার হাইলে তয় নয় আবার বাঁইচ্বার কতা ভাবুম। মাইন্ষ্যের মনে যে বিষের থলি আছে হেইডা ত কম বিষাক্ত ন, জ্বালাই হোড়াই শ্যাষ করি দেয়। করিম আঁঙ্গরে তাগাদা দেয় – বাবু, হা চালা, হত্তুর ত অভাব নাই, কোনহানে ঘাপটি মারি বই রইছে। হ্যাতের কষ্ট দেই কইলাম্, করিম, এট্টু জল মুড়ি খাও, গায়ে বল হাইবা। অত ভাবি কাজ নাই, আঁঙ্গরে মারি হ্যাতাগ যদি মনের শান্তি হয়, অইব। হাঞ্জাবীগ গুল্লি খাই না মইরলেই অইল, দ্যাশের মাইন্ষ্যের আতে মইরলে ভাবুম্ হেগুনের মাথায় খুন চাইপছে, হত্ মিত্র চিন্ত হারে ন। কইতে না কইতেই এক দল মানুষ আই আঁঙ্গ উপ্রে ঝাঁপাই হইড়ল, করিমের দিগে আঙুল তুলি কয়, বেডা, মোছলমান অই তুই মালাওনরে কাঁধে তুইলছচ্, তুই নিজের আতে এই বুড়িরে খতম করবি। করিম কয়, আম্নেগরে কে কইছে আঁই মোছলমান, হিঁদুর হোলা আঁই, নরহরি দাস, বলরামহুর গ্ৰাম। রেজাউল করিম সাবের দ্যাশের মানুষ। যাছ্ কন্নাই? আত্মীয়র বাড়ি। কী মনে অইল ছাড়ি দিল, এই যাত্রায় রক্ষা হাইলাম। সামনে কী বিপদ অপেক্ষা করি আছে কী জানি।
হাঁ চালাই চইল্লাম। করিম কয়, বাবু, এক্কারে ভয় হাইয়েন না। আঁই আছি ত। আঁর যতক্ষণ জান আছে, কেউ আম্নেগরে কিছু কইর্ত হাইর্ত ন। হায়ে হায়ে চইল্তে চইল্তে মেঘনার বড় খাল আই হইড়ল আঁঙ্গ সামনে। এই খাল পার অই ঐ হাড়ে যামু ক্যাম্নে। ঘাডে একহান নৌকা আছে কিন্তু মাঝি নাই, ঝাঁপ বন্দ। খুঁডিত্ নৌকা বাঁধি ঘরে চলি গেছে। আঁর স্বামী মাথাত্ আত দি বই হইড়ল। করিমরে কইলাম, খালের হাড়ে কী রাইত কাডাইতে অইব করিম ? হ্যাতে মাথা খাউজ্জায়। অনেক দূরে গ্ৰামে মিট্ মিট্ করি আলো জ্বলে। নিজের গ্ৰামের কতা মনে হড়ি গেল। আঁর স্বামী কয়, দ্যায় চাইন, হ্যাতারা নিজেগ ঘরে কেরুম ঘুমায়, আর আমরা রাস্তায় রাস্তায় এই আঁন্দার রাইতে নিজেগ ঠিকানা খুঁজি মরি। হুরা রাস্তায় আঁর হৌড়ি এক্কান কতাও কয় ন। মিন্মিন্ করি কিছু কইত চায়, ক্যাম্নে কতা কইব, শরীলহান হুকনা অই গেছে, চয়ের কোনায় কালি হইড়ছে, চুলে চুলে জট লাগি গেছে। মাথায় আত বুলাই দিলে আর নিজেরে ধরি রাইখ্ত না হারি কয়, আঁই আর বাঁইচতাম্ ন রে বৌ। নিজেরে নিজে বুজাইলাম্ নরম অইলে চইল্ত ন, শক্ত অইত অইব। সান্ত্বনা দি কইলাম্, আম্নের হোলা আছে, বউ আছে, মরার কতা ভাবেন কিয়ের লাই! এতক্ষণ চয়ে হড়ে ন আঁন্দারের লাই, বালুর উপ্রে এক্কান মাছ ধরার নৌকা কারা য্যান্ উবুড় করি রাইখছে। করিম কইল, আজ রাইতটা হিয়ানেই কাডাই দিমু। হ্যাতের কতাডা মন্দ লাইগ্ল না। হোট্লা তুন্ কাঁথা বার করি হৌড়িরে গাত দি হোতাই দিলাম। খালের ধারের ফিন্ফিন্ বাতাসে হ্যাতেনে ঘুমাই হইড়ল। আমরা দূরে চুপ করি বই রইলাম। করিম রাত জাগি হরা দেয়। বিপদডা আইল মাইঝ রাইতে। রাজাকাররা ক্যাম্নে টের হাইল বুইজ্তাম হাইর্লাম্ না। হেগুনে হা টিপি টিপি আই রাইক্ষসের মত দাঁত বার করি শাঁসাইলো। এত রাইতে ধানসিঁড়ি গ্ৰামে কিয়ের লাই? তোগ মতলবহান কী। করিম কইল, ভাই, বিপদে হড়ি আইছি, নদীর ঐপারে যামু আত্মীয়র বাড়ি। নৌকাহান উল্টাইছচ্ কার অনুমতি লই। ইয়ানে কে হুতি রইছে, তোর বাপ। বাপ নয় গ, ঠাম্মা। তয় ত বাঁচি রাওন যাইত না। হিন্দুর বুড়ি, দে খতম্ করি, অনেক জ্বালান জ্বালাইছে মোছলমানরে। করিম হা জড়াই কইল, ভাই, গোঁস্যা করিয়েন না, এবারকার মত মাপ করি দ্যান। শ্যাষে আঁর স্বামী আই আত জোড় করি মাপ চাইল, হ্যাতাগ গোঁস্যা চাইরগুন বাড়ি গেল। আঁর বুক ত ধুক্ ধুক্ করে। দিল বড় দাহান দি এক কোপ বইয়ায় আঁর হৌড়ির গলায়। ঘুমাই আছে আর হৌড়ি য্যামনে আছিল, খালি ওয়াক করি শব্দ অইলে আঁর স্বামী অজ্ঞান অই হড়ি গেল খালের হাড়ে। বুইজ্লাম আত্মা খাঁচা ছাড়ি চলি গেছে। রাজাকাররা গামছায় আত মুইছ্তে মুইছ্তে আঁন্দারের মইদ্যে মিশি গেল। দম বন্দ অই যার আঁর। আঁন্দার হ্যাতাগরে ছাড়ি আঁরে ঘিরি ধরি দলা হাঁকাই গেল। যাইবার সময় কই গেল, তোগরে ছাড়ি দিলাম। রাইত তহ্ন অনেক, কন্নাই আর হোড়াইয়ুম মরা মানুষডারে। করিম কইল, মাডির নীচে চাপা দি দেন জেডি। আঁর স্বামীর মুয়ের দিগে চাইতাম্ হারিয়েন না। হ্যাতেনরে ত আর ধরি রাওন যার না। আঁই চিল্লাই চিল্লাই কাঁইন্লাম্। কে হুনে আঁর কাঁদা। সূর্যের আলো গাছের হাঁক দি আই ঘাসের উপ্রে হইড়লে আঁন্দার মুছি গেল, আঁর হৌড়ির মুখহান হেই আলোতে আর দেয়া গেল না। মাঝি ঘাডে আইলে করিমরে কইলাম্, তুঁই হিরি যাও। আঁই আর তোঁর জেডা খাল হার অই চলি যাইয়ুম্। বাড়িঘরের দিগে খেয়াল রাইও। করিমের মন ত কিছুতেই মাইন্ত চায় না। কয়, আম্নেরা যাইতে হাইরবেন ত? হারুম্ হারুম্। তুঁই যাও, হিচুটান থাইক্তে নাই। ঘরে তোঁর বালবাইচ্চা আছে, বউ আছে, চিন্তা করের। গরুগোতান গুনরে খাওয়াইও। অবলা জীব খালি হ্যাডে থাইক্লে অমঙ্গল অইব।
খালের জল নদীত্ গা ভাসাইতে ভাসাইতে কহ্ন যাই সাগরে মিশ্ব আঁই জানি না। মাঝি ত হার করি দিল। আঁর হৌড়ি হুতি রইল মাডির নীচে। এত সাধের ঘরে হ্যাতেনের আর হিরা অইল না। চিনা কোন মাইন্ষ্যেরে আর দেই না। মন্ডারে সাত্বনা দি একদিন না একদিন হুদিন আইব। কত মানুষই ত হাঁডি চলি যার নিজের মনে, আঁর কিয়ের লাই একলা লাগের। কত কতা আই মনের মইদ্যে ঘাঁই মারের। আঁর স্বামী চলের আবার চলেরও না। কইলাম্, দুখ্ করি মন ভার করিয়েন না। চুপ করি থাইক্ল কিছুক্ষণ। ভয় অইল কতা কয় না কিয়ের লাই। শ্যাষে ভালামন্দ কিছু অইলে হাম্লাইয়ুম্ ক্যাম্নে। এই অচিনা জাগাত্ আই একলা মাইয়া মানুষ কী করুম। অনেক ক্ষণ হরে কতা কইল, ডরাইও না, শোকে আঁই হাথর অইছি ঠিক কতা, অন্ও জ্ঞান আরাই ন। এক চিন্তা দূর অইল, আর এক চিন্তা আই চাপি বইল। চাইর মাথার মোড়ে আই এরুম অবস্থার মইদ্যে হড়ি গেলাম যা আঁই চিন্তাও কইর্তাম্ হারি ন। এক মুইর তুন্ এক দল মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়ি আঁর মত রাস্তা খুঁজি বেড়ার, আর এক রাস্তা ধরি আইয়ের আডার ঊন্নিশ বছরের জোয়ান হোলারা, কাঁধে বন্দুক, চয়েমুয়ে কোনও ডরভয় নাই। আশ্চর্য এক ভাব তৈয়ার অইছে হুরা শইরল্যে। কারা এগুন, কন্নাই যার, খান সেনা ত নয়! কার ঘরের হোলারা ঘর তুন্ বার অইছে যুদ্ধে যাইবার লাই এরুম বেশভূষা লইছে। হেগুনের মইদ্যে একজন আই কইল, খুন করি হালাইছে রাজাকাররা ত, হেই খবর আঁঙ্গ কাছে আছে, হেগুনেরে আমরা খতম করি দিমু। হাঞ্জাবীগ লগে আত মিলাই দ্যাশের মাইন্ষ্যেরে মারের, দ্যাশের লগে বেইমানি করের, এই বেইমানি আমরা সইহ্য কইর্তাম্ ন। আম্নেরা আগাই যান, আর কিছু কইর্ত হাইর্ত ন, আমরা হরায় আছি। হেগুনে সেনাগ মত লেফ্ট রাইট্ লেফ্ট কইর্তে কইর্তে চলি গেল। অনেক দূর তুন্ হুনা যার্ হেগুনের মুয়ের কতা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা। দ্যাশডা কেরুম দেইখ্তে দেইখ্তে হাল্টি গেল। স্বপ্নের মত মনে অইতে লাইগ্ল, এরুমও হয়! কী অইতে আছে, কিয়ের লাই অইতে আছে, ইগাইনের শ্যাষ কন্নাই, আমরা কী এরুম করি ভাঁই ভাঁই বেড়াইয়ুম্? এরুম অরাজকতা জম্মে দেই ন। দুই একজন মানুষ খেরের চালের বাড়ি তুন্ বার অই আই আত ধরি টানি লই যাই কয়, ‘বইয়েন, এট্টু জিরাই লন, কতদূর তুন্ আইছেন’। জলের গেলাসটা দি কয়, ‘হানি খান।’ আমরা ঢক্ ঢক্ করি দুজনেই জল খাইলাম্। অইন্য সময় অইলে মোছলমান বাড়িত্ জল খাইলে জাত যাইবার ভয় হাইতাম্। অন্ বেক্ আচার বিচার য্যান্ চুলায় উইঠ্ছে। এই মানুষগুনরে মনে অইল আপনের আপন। দুইন্নাইত্ ভেদাভেদ করিই যে আমরা মইর্ছি এই কতাহান আঁরে কুঁরি কুঁরি খার। এদ্দিন কী ভুলডাই না কইর্ছি, শইল্যের ভার বইছি, মনের ভার দূর করি ন। হ্যাতারা কইল, বইয়েন না, ভালা করি বইয়েন, এত হর হর ভাবেন কিয়ের লাই, আমরা বেক্গুন ত এক দ্যাশের মানুষ। হ্যাতাগ কতা হুনি ভাইব্লাম আমরা এক্কারে আস্তা মুরুখ্য। যাইবার সময় কইলাম্, ভালা থাইয়েন্। কয়, সাবধানে যাইয়েন্। কোনও অসুবিধা অইত ন। সামনের মোড়ে মুক্তি বাহিনী আছে, আম্নেগ রাস্তা দ্যায়াই দিব। বেডা কয়, দ্যাশরে স্বাধীন কইর্বার লাই হরান দিওম্। ঘরের বার অই না আইলে বুইজ্তাম হাইর্তাম্ না দ্যাশের চেহারাহান আসলে কেরুম। এই মুক্তিযুদ্দ আই আঁঙ্গরে মাইন্ষ্যের মত মানুষ করি দিছে।
কত আর আঁডুম, আঁইড্তে আঁইড্তে হাহান ব্যাথা অই গেল। আঁর স্বামীরে কইলাম, আর বেশি দূর আঁডন লাইগ্ত ন, আর এট্টু কষ্ট করেন। আঁর বাপের বাড়ির দ্যাশের গন্দ হাইয়ের। হ্যাতেন রাগিমাগি করি কয়, তোঁর মাথা খারাপ অইছে? আরও এক দিন এক রাইতের হঁত পার অইলে তয় যদি হৌঁচাইতাম্ হারি। কতাডা হুনি আঁর মাথায় য্যান্ বাজ ভাঙি হইড়ল। না জানি আরও কত বিপদ অপেক্ষা করি রইছে। আদবেলা ঠাঁডা রইদে আঁইড্বার হর এক্কান মাড হইড়ল, মাডের কিনারে গাছের তলে বই রইছে এক মাইয়া ভাইয়ের আত ধরি, টুক্টুইক্কা চেহারা হেতির, আঁর মাইয়াডার কতা মনে হাড়ি গেল, কেরুম যে আছে, হোলাডাইবা কেরুম আছে। মাস ছয় আগে বড় হোলার চিঁডি আইছিল। হ্যাতে এক্কান কামে যোগ দিছে। এই গণ্ডগোলের মইদ্যে হ্যাতের আর কোন খোঁজ খবর হাই ন। মাইয়াডা আঁর দিগে রেনি আঁইসল, আঁই জোর করি অইলেও আঁইসলাম। হেতির বাবা বর্গাদারের কাম করে, ক্ষেতে ধানের চারা লাগাইত গেছে, গত সন হেতির চাচা বড় ঝরে ঠাঁডা হড়ি মরি গেছে। আগে কাহড়ে হ্যাঁচাই দুইজনের লাই ভাত লই আইত, অন্ আব্বার লাই আনে। হারাদিনে ওই একবার হান্তা ভাত নুন, হোড়া মরিচ আর কাঁচা হিঁয়াজ দি মাই খায়। করিমের লাই মনডা কাঁদি উইঠ্ল। মাইয়াডার বাপ আজিজুল মিঞা হারা শইর্ল্যে ঘাম লই আই গাছের তলে বইছে। বয়স অইছে, তবুও খাডি খার, চুরি ত করেন না। জিগ্গায়, কন্নাই যান আম্নেরা এই ভর দুহরে। হ্যাতে কিয়ের লাই এত খবর লর? কাউরে গোপনে হাচার কইরবার চোরা বুদ্দি ন ত। হ্যাতে আঁর মনের কতা বুইজ্ত হারি কয়, বিশ্বাস কইর্ত হারেন ন বুজি। হুনেন ভালা করি, আর আগাইয়েন না এট্টুও। জোর লড়াই চইল্ছে ছদ্রি বাড়ির নাট মন্দিরের কাছে মুক্তি বাহিনীর লগে খান সেনাগ। মুক্তিযোদ্দারা কম যায় না। ভারতের সেনার কাছের তুন্ টেনিং, অশ্র গুল্লি বন্দুক লই আইছে। খালের জল রক্তে লাল অই গেছে। কার হোলা শহীদ অইছে কে কইব। আঁর হোলা আই কর, জাগায় জাগায় গুল্লিগালা চলের। যুবতী মাইয়াগ ইজ্জ্বত লই টানাটানি করের, আঁঙ্গ দ্যাশের মাইন্ষ্যে ক্যাম্নে চুপ করি থাইক্ব কন্ ত। আঁই ত এসব কতা হুনি আর আগাইবার সাহস কর্ইলাম না। আজিজুল মিঞা কয়, হুনেন বাবু আম্নেগ মাইঝ রাইতে হাট ক্ষেতের ভিত্রে দি হানি টপ্কাই নসিহুরের জঙ্গল হার করি দিমু, ইয়ার হরে হঁত হরিষ্কার। হ্যাতের কতা ত হালাই দেওনের মত না। হাট ক্ষেতের পর হাট ক্ষেত। আঁডু হমান জল ভাঙি চইল্ছি ত চইল্ছিই, রাস্তা কী আর হুরায়। একে ত আঁই মাইয়া মানুষ আর আঁর স্বামীরও বয়স অইছে, কোয়রের জোর গেছি কমি। আঁই নিজেও চইল্তাম্ হারিয়েন্ না, হ্যাতেনেরে ক্যাম্নে টানি আনি। আজিজুল মিঞারে কইলাম্, ভাইসাব, এট্টু না জিরাইলে অইত না। বদি, আজানের সময় অই গেলে বড় বিপদ। ইয়ানে বাঁইচ্তেন ন। হানির মইদ্যে খাড়াই থাইক্বেন ক্যাম্নে! হানির হোকগুন মাইন্ষ্যের গন্দ হাইলে মুশকিল অই যাইব। অবস্থা বেগতিক দেই জল কাডিই চইল্লাম। মনেরে বুইঝালাইম্ যেই করি হোক যাইত অইব, বাপের বাড়ি না হৌঁচাইতে হাইর্লে নিস্তার নাই। হ্যাতেনেরে কইলাম্, আঁর কাঁধে ভর দি চলেন। ওরে বাপরে সামনে ত ভারি সংকট। আজিজুল মিঞা আঁঙ্গ দুইজনেরেই হামলায়। লম্বা অই হাঁচ ছয় আত কী য্যান্ হাট গাছে হেঁচাই হুতি রইছে। মনে মনে কইলাম্ আস্তিক মুনি, আস্তিক মুনি। ডাঙায় মানুষ ছোলায় আর জলে মা মনসার ছোবলের ভয়, কোন মুই যাই?
ভোর রাইতে হাট গাছ হরাই যেই না মুখ বাড়াইছি দেই আঁন্দার রাইতের ছম্ ছম্ আবাজ আকাশ আর মাডিরে জড়াই কেরুম বোবা অই আছে। আল্গা আল্গা অই ঘিরি ধরি রইছে ঝোঁপঝাড় জঙ্গল আর গাছগাছালির ভুতুরে ছায়ারা। কাউরে কিছু কইবার নাই, হ্যাতেনে আঁর মুই চায়, আঁই হ্যাতেনের মুই চাই। আজিজুল মিঞা কয়, আম্নেগরে আগেই কইছিলাম্ ইয়ানের ভাবসাবহান কিন্তু অইন্যরম। তবুও জলের মইদ্যে আর কতক্ষণ খাড়াই থাইয়ুম। এক ঝাঁক হোনা কৈমাছ আর টেমবৈচা হা’র কাছে আই কামড়ায়। মাইয়া মানুষ, লাজশরম আছে ত, কাপড় তুইল্তাম্ ত হারি না, হ্যাতেনের লাই চিন্তা বাড়ি যার। আজিজুল মিঞা কয়, আঁন্দার থাইক্তেই মাইল খানেক হঁত হার অই যাইত অইব। হাট ক্ষেত তুন্ বার অই আই অইড়লাম ধান ক্ষেতের আইলে। আজিজুল মিঞা আর আঁঙ্গ লগে আইবার সাহস কইর্ল না। কারণডা বুইজ্লাম্ একটু হরে। তবুও কইলাম্, আম্নে এত কষ্ট কইর্ছেন, আম্নের লগে চিনা নাই, জানা নাই, তবুও আম্নে নিজের মনে করি এত উপকার কইর্ছেন। হ্যাতেনে কয়, আঁই কিচ্ছু উপকার করি ন। আঁঙ্গ জাত ভাইরা আম্নেগ যা ক্ষতি কইর্ছে, হের কিছুডা শোধ দিলাম। হ্যাতেনের কতা হুনি ত আঁই আকাশ তুন্ অইড়্লাইম, এ কী কতা কয়! এই মানুষডার ছিঁডাহোঁডাও যদি ওই শতানগুনের মইদ্যে থাইক্ত, আর হৌড়ির জীবনডা এভাবে চলি যাইত না। ভাইসাব, আম্নেরে সালাম। হ্যাতেনে কোয়ালে আত ঠেঁয়াই সেলাম কই চলি গেল। আজিজুল মিঞা আঁর আর স্বামীর মনের মইদ্যে হেই যে ঢুকি গেল, আর বার অইল না। কিন্তু আঁঙ্গরে ত বার অইতে অইল। দনিয়া গ্ৰামের হঁতে উইঠ্লাম। উডি কী দেইখ্লাম। যত গ্ৰামের হঁত দি হাঁডি, খাঁ খাঁ করের ঘরের হর ঘর। মানুষ ত নাই, বেক্গুনে গ্ৰাম ছাড়া অইছে। হা’র মইদ্যে কী য্যান্ ঠেইক্ল, মাইন্ষ্যের মাথা। আমরা আর এট্টু আগাই গেলাম, মিলল কাডা আতের হাশে জ্যান্ত অগ্গা মানুষ হড়ি ছট্ফটায়, হরানডা বার অইবার লাই ধু্ক্ধুক্ কইর্ছে। এক বড় হুইর, হুইরের হাশে গর্ত খোঁড়া, মাডি এরুম করি হড়ি রইছে, য্যান্ মাডির উপ্রে রাগ করি মাডি মেলাই মেলাই রাইখ্ছে। আঁঙ্গ গা ইগাইন দেই থরথর করি কাঁপে। কাওরে জ্যান্ত কবর দেওনের কতা আছিল, হারে ন। কন্ মুই যাইয়ুম্, যাইবার রাস্তা ত নাই, ছুডি হলাইতে হাইর্লে বাঁচি। আঁর স্বামীরে কইলাম্ কী করুম কন্? হ্যাতেনে কইল, হিছনে যাওনের উপায় নাই, আগাই চল। এক্কানা আগাইলে দেইখ্লাম এক মন্দিরের চাতালে কারা য্যান্ বন্দুক কাঁধে লই বই রইছে, আর এক দল হায়চারি করের, খিলান অলা দালানবাড়ি, হইসাকড়ি আছে, ব্যবসাবাণিজ্য কইর্ত, না অয় অঢেল জমিজমার মালিক আছিল। যেই মানুষগুনেরে দেইয়ের, হেগুনে কী রাজাকার! আঁর স্বামী বাঁচার আশা ছাড়ি দিছে। কয়, ইষ্টনাম জপ কমলের মা। আঁঙ্গরে দেই হেগুনে বন্দুক তাক্ করে। ইয়ার পরে আঁঙ্গ অবস্থা দেই বন্দুক নামাই হালায়। কয়, হরু রাইতে এই গ্ৰামে রাজাকারেরা হামলা কইর্ছে, কচুকাডা কইর্ছে, য্যাতারা হাইর্ছে হরান লই হলাইছে, আমরা মুক্তি বাহিনী, রাজাকারেগ খোঁজে আইছি। হালার বেডারা বাঙালি জাতের কলঙ্ক, খান সেনাগ লগে যাই ভিড়্ছে, হশ্চিমাগ চর। আঁঙ্গ কতার মাইজ্হান দি হুইন্লাম এক বাইচ্চা হোলার কাদন্। আঁঙ্গ কতা হুনি ভরসা অইছে। মুক্তিযোদ্ধারা দৌড়ি যাই দরজা ঠেলি বার করি আইন্ছে। কাঁইন্দ না, মাইর্তাইম্ ন আমরা, হোলাডারে হানি দে। বাপ মা হোলাডারে লই যাইত হারে ন। হোলাডা চখ কচ্লায় আর কয়, আঁর বাপ মা ভিত্রে হুতি রইছে, দুই দিন ধরি কত ডাইক্ছি, কতা কয় না। বুইজ্লাইম, গুল্লি করি মারি হালাইছে।
বাপের বাড়ি আই উইঠ্লাম্, লগে হোলাডারে লই আইলাম্। বাড়িহানের হিছনে এক বিল। বিলের মাইজ্হানে হিলার গাঁথি দুই দ্যাশের সীমানা বানাইছে। ভারতের মাইন্ষ্যের খাওন দাওন, উডন বইয়ন, বাজার আঁড, ইস্কুল বেক্গাইন এহাড় তুন্ দেয়া যায়। মজার কতা অইল, আঁঙ্গরে হ্যাতারা বাঙাল কয়, বাঙালরা হেই দ্যাশে যাই বাঙালি অইছে, আর হশ্চিমা কুত্তাগুনরে দৌড়াই বাঙালি অইবার লাই আঁঙ্গ হোলারা হরান দের, আঁঙ্গ মাইয়ারা ইজ্জ্বত খোয়ার। হিয়ানে টিব্রারাও থায়। আঁর বাপেগ ব্যবসাহাতি আছে, করিকম্মি খায়, হিয়ানে যাই কী কইরব, চাইলে ত যহ্ন তহ্ন যাইত হারে। বাপ ত চুয়ান্ন সালেই গত অইছে। আঁর কোয়াল ভালা বুড়ি থুরথরি অইও মা আঁর বাঁচি আছে, ঈশ্বর আঁরে চয়ের দ্যায়া দ্যায়াইছে। সংসারের জ্বালায় আইতাম্ হারি ন, এত বড় সংসারের বড় বউ ক্যাম্নে আই, ঘরে বয়ষ্কা হৌড়ি আছিল। হেই হৌড়িরে ত জালিমগ আতে খোয়াই আইছি। মা এই ঘটনা হুনি ত মুচ্ছা যায়। বিয়ার হরে এত বছর অইল এবার লই তিনবার আইছি, শ্যাষ আইছি মহামারীর বছর, মার হেইবার যায় যায় অবস্থা। হ্যাঁ, ইয়ান আঁঙ্গ দ্যাশ, দেই না কে আঁঙ্গরে দৌড়ায়। ইয়ান এরুম এক্কান জাগা হিন্দু মোছলমান বেক্ বেকেরে চিনে। চিন্ত ন বা কিয়ের লাই! আঁর জন্ম যহ্ন অইছে, বড় যহ্ন অইছি, হেই গ্ৰামের হোলারা আঁঙ্গ মাডে ফুটবল খেইল্ত, কুস্তি লইড়ত, বিয়াসাদি অইত। আমরা ভারতের মানুষ হেই হরিচয়ের তুন্ এই গ্ৰামের মানুষ হেইভাবেই চিনত, দ্যাশ এক্কান আছে ত আছে, ত কী অইছে। ভাগ বাডোয়ারা অইবার হরই ত দ্যাশের হরিচয়ের দরকার অইল, খুনাখুনি অইল। হশ্চিমারা হেই কতা ভালা করি বুজাই দিল। যেই হঁতে আঁর হোলামাইয়া ভারতে গেছে, হেই হঁতহান সেনাগ দখলে, অন্ হেই দ্যাশে। আঁঙ্গ কাছে অন্ও বেক্ হমান। বাপের বাড়ির দ্যাশে আই হিয়ের লাই স্বস্তি হাইলাম্। ভাগাভাগির যন্তনার তুন্ রেহাই ত হাইলাম। আওনের হর তুন্ ভাইয়ের বৌরা আঁরে কোন কামকাইজ কইর্ত দেয় না। কী যে করি, আতের কাম ত কাড়ি লইতাম হারি না। তয় এইবার উডিহড়ি লাইগ্লাম্ বেকে মিলি হৌড়ির শ্রাদ্দশান্তি কইর্তে। কত কামকাইজ দিনরাইত। কত মাইন্ষ্যের নিমন্তন্ন, মসজিদ হাড়ার বুড়াবুড়িরা নিমন্তন্নে আইছে। আঁর মাইয়াকালের বন্দু গৌরীও আইছে। হেতি বালবিধবা, বাপের বাড়িতেই থায় ভাইগ সংসারে, আঁরে দেই ত গলা জড়াই ধরে, আর ছাইড়্তেই চায় না। কত কতা দুখ্ করি কইল। হরের সংসারে থাওনের কষ্ট ত আছে, বেকে ত হমান ন। আঁর ভাইয়ের বউ ট্রাঙ্ক তুন্ বার করি দুইহান নোয়া কাহড় দিছে, ছায়া ব্লাউজ দিছে। কইল, যদ্দিন দ্যাশের অবস্থাহান ভালা না হয়, ইয়ানে থাইক্বা, কহ্নও হর মনে করিও না।
কত ঘটনাই ত ঘডি যার দ্যাশে, আঁঙ্গ বাপের বাড়ির গ্ৰামে এসবের বিন্দু বিসর্গও বুজা যার না । যাইবই বা ক্যাম্নে, কোন আঁচই ত লাগে ন। এদ্দিন বাদে খবর আইছে এই গ্ৰামের দুগা হোলা মিজানুর রহমান আর পরিমল দাস হুরান ঢাকার চকবাজারের কাছে সেনাগ লগে লইড়্ত যাই গুল্লি খাইছে। হেই লই গ্ৰামে শোকে ভাঙি হইরছে বেকে। সঙ্গী সাথীরা অনেক চেষ্টা চরিত্র করিও লাশ উদ্দার কইর্ত হারে ন। হুনা যার বুড়িগঙ্গার জলে মেলা মারি হালাই দিছে আরও অনেকগুনের লগে হেগুনের হঁচাগলা শরীল । হ্যাতাগ বাড়ির কেউ জানেনা ক্যাম্নে ক্যাম্নে হেগুনে মুক্তি বাহিনীত্ নাম লেয়াইছে। হাড়ার ইস্কুলেই নাইনে এক লগে হইড়ত। রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা হুনি হেগুন দুগা মিলি গাছতলা বই বই গুজুর গুজুর কইর্ত, ইয়ার হরে ত উদাও অই গেছে, অনেক খোঁজখবর করিও লাভ অয় ন। অন্ হুনা যার দুগাই ভারতে যাই অশ্র চালাইবার ট্রেনিং নিছিল গোপনে। গ্ৰামের মাইন্ষ্যে কাঁদিকাডি করি বুক চাপড়ার। কে কারে দিব শান্তনা। দুই দিন ধরি গ্ৰামের কোন ঘরে চুলা জ্বলে ন, এক গ্লাস জলও কেউ মুয়ে দেয় ন, ঘুমান ত দূরের কতা। অবস্থাহান এরুম অইছে মানুষরা বাজারআঁডও হেরুম করে না। মালহত্র যে কিনি আইনব হেরুম সুবিধাও নাই। কাঁচামালেরও আকাল। আঁর ভাইগ মহাজনরা বাঁইতে মাল দেয় না, কামকারবারও লাডে উইঠ্ছে। গাট্টি গাট্টি কাহড় আইত নৌকাত্ করি, অন্ আর আইয়ে না। আঁর বাপেগ হইসাকড়ি আছে, ইয়ের লাই চাইর গ্ৰামে ধনী বলি নাম ডাক আছে, বিপদে আপদে গরীব মাইন্ষ্যেগরে সাইয্যসান্তিও করে। অন্ এরুম এক্কান সময়, নিজেগ অবস্থাও দিনকে দিন খারাপের দিগে চলি যার, অইন্যগুনের মুয়ের দিগে আর কত চাইব। য্যাতাগরে কোনদিন আত হাইত্লে হিরায় ন, হ্যাতারাও নিরাশ অই হিরি যার। বাপের বাড়ি যে হড়ি আছি, নিজেরে অন্ অপরাধী লাগে। রোজ হাতে আগে রুই, কাতলা, তৈল কই, না হয় ইলিশ হইড়ত, অন্ হপ্তাহে দুই দিন হড়ে। আঁর ছোড ভাইয়ের বউ অমৃতা কয়, দিদি, আম্নে কিচ্ছু ভাবিয়েন না, ব্যবসায় মন্দা আইয়ে, আবার চলিও যায়, বিয়া অই যেদিন তুন্ আইছি, এরমই দেইয়ের, ঠিক অই যাইব। অমৃতা বুজের না, এই অবস্থার লগে অইন্য সময়ের তুলনা চলে না। হুরা দ্যাশে এখন হাহাকার চলের। এভাবে বেশিদিন চইল্লে মাইন্ষ্যের চামড়া মাইন্ষ্যে খাইব। আঁর ভাইয়ের বন্দু রতন হন্তদন্ত অই খবর দিছে, হুইনছেন নি আম্নেরা, যতন খুড়া হ্যাতেনের গোয়ালের গাঁই গরু আঁডে বেচি হালাইছে দেনা শোধ কইর্বার লাই। মহাজন তুন্ ট্যাঁয়া ধার লই বর্গায় চাষ কইর্ছে, হসলের দাম হায় ন। য্যাতারাই বর্গায় চাষ কইর্ছে, বেক্গুনের একই অবস্থা। মদন জেডার মেঝ হোলা শহর তুন্ হেরত চলি আইছে। হ্যাতের মালিকের চডের ব্যাগের কারবার, হ্যাতে ইসাবহত্র দেইখ্ত। খান সেনারা ধরি ধরি বেক্গুনেরে মারি হালার, হিয়ের লাই হলাই চলি আইছে, অন্ ত না খাই মরি যাইব। আমরা সংসারে আইছি বলি বাড়তি বোজা। খাইতে বই ভাইয়েরা মাথা নিচু করি থায়, শুধু ডাইল, আলুভাজা আর কাঁচা মরিচ মাই ভাত খাওন যায়! ভাত হাতেই খবর আইল মুকবুল চাঁচা দুই দিন হোলামাইয়ার মুয়ে খাওন না দিত হারনের জ্বালায় গলায় দড়ি দিছে। আঁর ভাই ত ভাতের থালা হালাই উডি মসজিদের হাশে হ্যাতাগ ঘরে দৌড়ি গেল। আঁর মা ডাকি কয়, আরে হুন, খালি আতে যাইছ্ না, লগে কিছু চাইল ডাইল আর হইসাকড়ি লই যা, হেগুনের কামে লাইগ্ব। দুইন্নাইদারি দেইখ্তে দেইখ্তে কেরুম য্যান্ অই যার। রক্তের হলি খেলা চলের। বঙ্গবন্ধু কইছে রক্ত দিতে, হিয়াল কুত্তার মত হঁতেঘাডে গুল্লি খাই মানুষ হড়ি কাত্রাইতে কাত্রাইতে লাশের উপ্রে লাশ অই যার। বাঙালির এ কী দশা! হায়নারা এই হাপের হল্ একদিন হাইবই হাইব। হেই দিন বেশি দূরে ন।
মুক্তিফৌজের গেরিলারা স্টেনগান, পিস্তল, হ্যান্ড গ্ৰেনেড লই এই গ্ৰামে অ্যাকশন্ চালাইবার লাই এক বেড়ার ভাঙাচোরা ঘরে আই জড় অইছে। গ্ৰামের লোক দেই ত অবাক। ঠান্ডা শান্ত গ্ৰামে এরুম ভেজাল অইলে মাইন্ষ্যে টিক্ব কেরুম করি। এদ্দিন হুইন্লাম হত্যেক দিন মিলিটারির লগে যুদ্দ অর ঢাকা শহরের ধানমন্ডিতে, রংপুরে, দিনাজপুরে, যশোরে, কুষ্টিয়ায়, হেনীতে, লাকসামে, ব্রাক্ষণবাড়িয়ায়, কুমিল্লা টাউনে। স্বাধীন বাংলা বেতার আর আকাশবাণীত্ হেই সংবাদ হুনি ত শিউরি উডি। ইয়ানে অন্ গেরিলারা হুইরের হাড়ে, গাছতলায়, মাডের কিনারে ঘুর ঘুর করের। হেগুনে এত অশ্র যোগার কইর্ছে কত্তুন। মেলাঘরে নাকি ক্যাম্প বানাই ট্রেনিং দের টিলার উপ্রে। আর এক বিপদে বেকে দিশাহারা। এক নতুন রোগ আই হইড়ছে, চখ লাল অই যার। কেউ জানে নি ক্যাম্নে এই রোগ ভালা অইব। মাইন্ষ্যে চয়ে জল মারে। হরে হুনা গেল এই রোগের নাম দিছে মাইন্ষ্যে ‘জয় বাংলা’। হোমিও ডাক্তর যতিনের কাছে হুরা গ্ৰামের মানুষ লাইন দিছে। এই রোগের একমাত্র ওষুধ নাকি ‘বেলেডোনা সিকস্’। হেই ত গেল। হুনা যার, শহরে নাকি বিচ্ছুগ দাপাদাপি শুরু অইছে, বোমা মারি, শেল ছুঁড়ি খান সেনাগ খতম্ কইর্ছে হেগুনে। মিলিটারিরা ডরাই যাই রাজাকারেগ আতে দামি দামি ভারি ভারি অস্ত্র তুলি দের। জোয়ান হোলাগুনের শরীল তুন্ রক্ত বার করি হরান চলি গেলে খালের জলে ভাসাই দের। হ্যাতাগ বলে সৈন্যগ বাঁচাইবার লাই মেলা রক্ত দরকার, হিয়ের লাই গা’র হশম খাড়া করি দেওনের মত কাণ্ড ঘডার। গেরিলারাও হতিশোধ লইবার লাই ঝাঁপাই হইড়ছে, সহজে ছাড়ি দিত ন। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হোলারা, চৌকস্ খেলুড়েরা, যুদ্দ কইরবার লাই গেরিলা হর। আবার রক্তচোষা হশ্চিমারা হচার করের ভারত নাকি হত্রুতামি করি হামলা করের, মুক্তিযোদ্ধারা নাকি ‘গাদ্দার বাঙালি’ হাঁজি সাহায্য করের, হিয়ের লাই হেগুনে ভারত দমনের খেলায় নাইম্ছে, বাছি বাছি হিন্দুগ গলা কাডের। বেডারা যেই যুক্তি খাড়া করায়, মিছা কতা! হিগাইন বেক্গাইন বাঙালিগ হেনস্থা কইর্বার লাই ইয়াহিয়া খানের কারসাজি, যাতে করি আঁঙ্গ দ্যাশ স্বাধীন অইত না হারে। অন্ নাকি আল-শামস, আলবদর বানাইছে, হেগুনে কী কম নষ্টের গোড়া! বিহারীরা নাকি হ্যাতাগ সঙ্গ দি বাঙালি খেদার। গেরিলারা নৌকাত্ করি বস্তা বস্তা কী য্যান্ আনি জমা করের, বোমা অইত হারে। কোমর বাঁধি নাইম্ছে, হ্যাতাগ জয় ঠেয়াইব কে! দিন চলি যায়, রাইতও চলি যায়, বোমা গুল্লিগালার শব্দ বাড়তেই থায়। এদ্দিন বাদে মুক্তিযুদ্ধের জের আই অইড়ছে আঁঙ্গ ঘরের কাছে, না অইলে কী বুইজ্বার কোনও উপায় আছিল আঁঙ্গ দ্যাশ নিজের দ্যাশ হাইবার লাই লড়ের। মুক্তিবাহিনীর বন্দুক যুদ্দ যে এরম জোরদার অইত হারে, কেউ কোনওদিন ভাইব্ছে নি। হুরা দুইন্নাই ভাইব্ত আঁঙ্গরে ছা হোষা বাঙালি, হাকিস্তানিগ অধীনে হরাধিন অই বাঁচে, হেগুনের কতা আর কে হুনে। অন্ মনে অর, হুইন্ত অইব। আঁঙ্গ বাপের বাড়ির দ্যাশের নিরীহ মানুষ, চাষবাস করি খায়, ব্যবসাহাতি করে, মন্দির মসজিদ লই কাইজ্জা কহ্নও করে না, হেগুনে যে এরম করি জাগি যাইব, কে জাইন্ত। খবর ত আইয়ের, খনসেনাগ খবর। জোয়ান হোলারা কর, আইয়ক দেই মিলিটারি, দ্যাইযুম্ কেরুম জব্দ করে। বুক চিতাই খাড়াইয়ুম, গুল্লি খাইয়ুম, গ্ৰামে হাঁদাইতাম দিতাম ন। ঐপারে ভারতের সেনারা টহল দের, এক্কান এস্পার ওস্পার অইবই। ১৯৬৫ সালে ইন্ডিয়া হাকিস্তান যুদ্দ অইছে, এবার নতুন্ করি যুদ্দ অইব, বাংলাদেশ স্বাধীন কইর্বার যুদ্দ। মুক্তিযোদ্দারা এক লগে গান ধইর্ছে – এ তরী বাইতে হবে, আমি যে সাগর মাঝিরে। মাঝেমাঝে হেগুনে এক লগে গলা কাঁপাই কয় – জ……য় বাংলা।
ওমারে যুদ্দ বলে যুদ্দ, এরুম যুদ্দ কোন কালে দেই ন। আকাশ বাতাস হাডাই গুল্লির লড়াই, গ্ৰেনেডের শেল আই হড়ের যিয়ানে হিয়ানে, মন্দির মসজিদ কিছুই মানেন না। ভারত হাকিস্তান যুদ্দ তাইলে লাগিই গেছে। জোর লড়াই করের মুক্তি বাহিনী। মিলিটারিরা যাতে জিপে করি গ্ৰামে হাঁদাইত না হারে চাইর মুই তুন্ আগেভাগেই গেরিলারা তাগড়া হোলাগ লগে লই হাথালি করি রাস্তা কাডি দিছে। বোমার আক্রমণ তুন্ গ্ৰামবাসীগ রক্ষা কইর্বার লাই বড় বড় সুড়ঙ্গ বানাইছে। আমরা হেই সুড়ঙ্গেই হাঁদাই রইছি। ভারতের সেনা আর গেরিলাদ গোলার সামনে খান সেনারা কাবু অই গেছে, খাড়াইত হারের না। হ্যাতারা ভাইব্ছিল সহজে জিতি যাইব, এরুম ফাইট্ দিব ক্যাম্নে বুইজ্ত হারে ন। হেগুনে ব্যাদিশা অই হিছনে হইঠ্ছে। বাংলার মাডি ত চিনে ন, হাঞ্জাবে থাই গোঁপে তা দি ভাইব্ছে, যাইব আর বোকাসোকা বাঙালিগ মাথা মুড়াই খাইব। আরে বাঙালিরা খাডি খাইবার জাত, ঘাম ঝরাই লড়াই করি বাঁচে, মাইর্তেও জানে, মইর্তেও হারে। হেগুনেরে রাস্তাঘাড চিনাই আইন্ছে রাজাকাররা। দৌড়ানি খাই রাস্তাঘাড না চিনি খানাখন্দে হড়ি খান সেনাগ অবস্থা অইছে জঙ্গলে বাঘের সামনে হরিণছানার মত, আর লইড়ত চইড়ত হারে না। এরুম এক্কান অবস্থা যে দেইখ্ব, কল্পনা করুম ক্যাম্নে। খান সেনারা যে এক এক্কান চামার, আগে হেই কতা কত হুইনছি, এবার হচক্ষে দেইখ্লাম। মানুষ ত ন, জন্তু, নামাজিগরেও ছাড়ে ন, হ্যাতেরা ধম্ম লই বড়াই করে, এইডা নাকি হ্যাতাগ ধম্ম, মা, বইন, দাদি, নানিগ ইজ্জত নষ্ট কইর্তে শরম করে ন। এই হশ্চিমারা কোনদিন টিক্ব! কোয়ালে দুখ্ আছে। নিজের দ্যাশের জনগণের কাছে ভালা হাঁইজ্লেও, তোরা আঁঙ্গ বাঙালিগ কাছে সম্মানের যুগ্গি ন, কুত্তার তুন্ও অধম। টেরও হাই ন, কহ্ন যে সুবলের সামনে হ্যাতের মার ইজ্জত লুইট্ছে, কাফের কই গাইল দিছচ্, ছি। বুন্দকের আগা দি মুক্তিফৌজের দুইজনেরে খোঁচাই খোঁচাই মাইর্ছচ্। গলা উঁচা করি কচ্ হাকিস্তান। খাবাই দিব, বঙ্গবন্ধু হিরি আইলে, কদ্দিন আর গারদে আটকাই রাইখ্বি। হিন্দুর ঘরের মাইয়া, কাফের ন, আঁই এই দ্যাশে জন্মাইছি, এই দ্যাশেই মরুম, কোনহানেও হলাই যাইতাম্ ন। এই দ্যাশ, আঁর দ্যাশ, বাংলাদেশ।
আনন্দে আর বাঁচি না, ভয়ডাও খিঁচি ধরে – কী অইব! কী অইব! আঁর মা বুড়া অইছে, আবাজ্ হুইন্লেই কাঁপি কাঁপি উডে। এক্কান উড়াজাহাজ আর এক্কান উড়াজাহাজরে দৌড়ানি দিছে এত জোরে যে কান হাডি যায়। আঁঙ্গ ঘরের কাছে যুদ্দ অইছে। অন্ আকাশে যুদ্দ শুরু অই গেছে। লক্ষণডা ভালা ঠেকের না, যা কিছু ঘডি যাইত হারে। যদি বোমা এক্কান হালায়, সুড়ঙ্গে হাঁদাই যামু লগে লগে। একে ত শনির দশা, ইয়ার উপ্রে রাহু আই গ্ৰাস কইর্ছে। চাষীরা মাডে যায় না, আঁড্বাজারও নম নম করি খোলে, হোলাগরে জানি হুনি কে আর ইস্কুলে হাঁডায়। শহরের তুন্ বেকে চাকরিবাকরি ছাড়ি ঘরে চলি আইছে, ডরে ডরে। হিঁন্দুর হোলা অইলে ত কতা নাই, চিবাই খাইব আল বদর আর রাজাকাররা। ভারতের সেনারা কী হাইর্ব এই হাকিস্তানি ডাকাইতগুনের লগে। আঁঙ্গ ইয়ান তুন্ ত দাব্ড়ি খাইছে কিন্তু শহর যদি চুরমার অই যায়, দ্যাশের কী অইব। আকাশবাণী খবর কইছে, ভারত বাংলাদেশেরে স্বাধীন জাতি বলি স্বীকৃতি দিছে। এদ্দিন বাদে এক্কান সুখবর আইল। আঁর মার কানেও গেছে রেডিওর ঘোষণা। মা আনন্দে লাফাই উইঠ্ছে, খবরহান হাঁচা ত, না মিছা কতা। হ্যাঁগ মা, হাঁচা খবর। মারে ক্যাম্নে কই, স্বীকৃতি ত দিছে, কিন্তু তছ্নচ্ অই যার সব। মুক্তি বাহিনী ঢাকা টাউনে হাঁদার, কিন্তু কারফিউ, ব্ল্যাকআউট কীসব কয়, এতদিনে দ্যাশডা আস্ত থাইক্লে অয়। বেকে যে অতিষ্ট অই যার। ক্যাম্নে যে দিন গুজরান অর, ঈশ্বর জানে। লক্ষ লক্ষ মাইন্ষ্যের হরান চলি যার, সরকার জোর করি ইস্কুল কলেজ অফিস আদালত খুলি দি দুইন্নাইর মাইন্ষ্যেরে দেয়াইত চায় বেক্গাইন ঠিক চলের, এভাবে কদ্দিন চইল্ব। যা চাইল ডাইল আছিল, হুরাই গেছে। মুক্তিফৌজরা ত ঘাঁডি গাঁইড়্ছে, ভারতের সেনাগ গাড়ি ভোঁ ভোঁ করি আই ঐপার তুন্ হাঁদার। আঁঙ্গ ঘরের হাঁক দি তোড়জোড় বেক্ দেয়া যায়। আঁর ভাই যাই কোনরমে বাজার তুন্ যা হাইছে, লই আইছে। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করি হিছনে হাকের ঘরে চুলা ধরাই হাকশাক করি হোলাহাইনের মুয়ে খাওন দেয়। আমরা বড়রা এক বেলা খাই, এক বেলা উবাস করি। সইন্দ্যা অইতে না অইতেই ঘরের মইদ্যে হারিকেন, কুপি কিচ্ছু না জ্বালাই চুপ করি বই থাই। বুক ঢিপ্ঢিপ্ করে। বোমের শব্দ হুইনলে হোলাগুন কাঁদি উডে, মুয়ে চাপি ধরি থামাই। আর ত থাওন যায় না, কোন মুই আর যামু। গুল্লিগোলা চইল্ছে দিনরাইত, বিরাম আর কন্নাই, হইকেরাও সাড়াশব্দ করে না, মানুষ ত কোন ছাড়। জলে ডুবি মরণ ছাড়া আর কোন রাস্তা নাই। আট নয় দিন আঁঙ্গ চয়ে ঘুম নাই। হুনিয়ের বেক্ বডার এলাকায় জোর লড়াই চইল্ছে। আমার মা টের হাই কর, বেক্গাইন ছারখার অই যাইব। আঁর স্বামী কয়, ইয়ানে সাত সমুদ্দুর তের নদী হার করি নিরাপদ ভাবি আইছি, এই ত উল্টা হুরাণ। আঁঙ্গ গ্ৰামে কী অবস্থা চইল্ছে কী জানি। আঁর কালুডা কেরুম আছে ত কিচ্ছু জানি না, হিগা ত না খাইত হাই মরি যাইব। আঁর স্বামীর চয়েমুয়ে আতঙ্ক দেই আঁই নিজেরে হামলাইতাম্ হারিয়েন না। মরণের ভয় আই জাপটাই ধইর্ছে। কয়, চল বেক্গুনে মিলি ভারতে চলি যাই। আঁই কইলাম, আমরা কী দ্যাশে একলা, এত মানুষ আছে, যা অইবার তা অইব, এত চিন্তা করেন কিয়ের লাই, দ্যাশের অবস্থা কী কোন দিন হিরত ন? কয়, তুঁই হেই আশা লই বই থাও, খবরে কী কর হুইন্ছ না। আমেরিকা হাকিস্তানেরে সমর্থন দের, লগে জুইট্ছে চীন। আমেরিকা সপ্তম নৌবহর হাঁডার আর সোভিয়েত ইউনিয়ন হাঁডার ষষ্ঠ নৌবহর বঙ্গোপসাগরে। সব্বনাশ অই যাইব গ, মানুষ মরি ছাপ অই যাইব। আম্নে খালি দুশ্চিন্তা করেন। অন্ও হাঁডায় ন। ভারত অত বড় দ্যাশ, ছাড়ি কতা কইব নি, এক্কান ব্যবস্থা নিশ্চয়ই কইর্ব। আঁর ভাইয়ের বউ অত চেঁচায় কিয়ের লাই। ও দিদি হুইন্ছেন নি, আফজল চাচার ছোড হোলা হেণীতে কাম কইর্ত না হোনার দোয়ানে, হ্যাতেরে খান সেনারা এরুম মাইর মাইর্চ্ছে রাইফেলের বাঁট দি, মাজা ভাঙি দিছে, ঠ্যাং আত আর আস্ত রায় ন, হ্যাতের বন্দু ইনাই বিনাই কয়, আর বাঁইচ্ত ন মনে হয়, চাচা কী কাঁদন কাঁদের। হালারা মরেনা কিয়ের লাই। গেরিলারাও ছাড়ে ন, চাইর জন খান সেনারে খতম করি দিছে। বোমা মারি হ্যাতাগ জিপ উড়াই দিছে। আঁর স্বামী কয়, হুইন্ছনিগ, ভালা খবর আছে। ভারতের সেনা আর মুক্তিফৌজেরা মিলি খান সেনাগর্ তুন্ বলে ২৫,০০০ বর্গমাইল জাগা মুক্ত কইর্ছে। ধরা আরও খাইব। হরের জমি দখল করি রাওন এত সোজা কতা ন, বাপেরও বাপ আছে। আম্নের মুয়ে হুল চন্দন হড়ুক, এদ্দিন বাদে এক্কান খবরের মত খবর হুইনলাম, এবার কিছু এক্কান অইব। দিন যায় রাইত হোয়ায়। ভারতের সেনারা আঁঙ্গ দ্যাশে হাঁদাইছে, বার তের দিন ত অই গেল। ওমা, আঁর ভাইয়ের হোলা চন্দন খুশিতে ডগ্মগ্। কীরে কী অইছে, নাচনের কি অইল? আরে বাংলাদেশ স্বাধীন অইছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা দিছে। নিয়াজী নব্বই হাজার সেনা লই আত্মসমর্পণ কইর্ছে। আরে তুই কী কছ্ রে, আঁঙ্গ দ্যাশ স্বাধীন অই গেছে, হাঁচা কতা নি। মিছা কতা আঁই কই না কহ্নও। হুইন্ছেন নি, চলেন্ কাইলই আমরা আঁঙ্গ গ্ৰামে রওনা দি।
স্বাধীন অওনের মর্ম বুজা দায়
কারা এরুম দ্যাশের হানে চায়
গ্ৰামে আইলাম্ হিরি, ভয় ডর কন্নাই উড়ি চলি গেল। সদর দরজা তুন্ হাঁডি হাঁডি ঢুইক্তে না ঢুইক্তেই করিম আই সেলাম ঠুকি জিগ্গাইল, কেরুম আছেন জেডা? উত্তর দিমু কী, তার আগেই ঝরঝর করি কাঁইনতে আরম্ভ কইর্ল। হ্যাতের কাঁদার কারণডা টের হাইলাম আরও হরে। আঁঙ্গ হিছে হিছে খালের হাড়ের গ্ৰামের অনেক মোছলমানরাও আইল। এদ্দিন বাদে আঁঙ্গরে দেই হেগুনে অবাক অই চাই রইল। ভাইব্ল এদ্দিন কন্নাই আছিলাম, কন্ তুন্ আইছি, এরুম কত কতা জিগ্গাইবার ইচ্ছা অইল। আত্মীয় হজনেরে অনেককাল না দেইখ্লে যা মনের অবস্থা অয়, হেগুনে আঁঙ্গ গা ঘেঁষি খাড়াইল। আরও কত কতা জিগ্গাইতে মন চায়, গুছাই কইত হারে না। আর একটু আগাই যাইবার হর আমরা আকাশ তুন্ অইড়লাইম। এই আমরা কন্নাই আইলাম। আঁঙ্গ বাড়িঘর কন্নাই গেল, খালি ভিডাহান হড়ি রইছে, আর কতগাইন হোড়া কাঠ, জ্বলিহুড়ি যাওনের হর রইদে হুড়ি, বিষ্টিতে ভিজি থাইক্লে যেরম লাগে, বাশ গন্দ কিচ্ছু নাই, ঘরের খুঁডিগুন ঠুন্ডা অই খাড়াই রইছে। বিদ্যাসাগর,রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের হোড়া হোড়া ছবিগাইন এক কোণায় উল্টাই হড়ি রইছে। যেই ভিডাহানরে এতকাইল লেয়াহোচা কইর্ছি, গোবর ছিডাইছি, যেই এত্তবড় ঘরহানরে যত্ন আত্তী করি রাইখ্ছিলাম্, যেই ভিডায় আঁর হোলামাইয়ারা খেইল্ছে বেড়াইছে, জালিমরা এত নিষ্ঠুর যে ঘরবাড়ি হোড়াই নিশ্চিন্ন করি দিল। হ্যাতাগ ধম্মে সইল! আঁর হৌড়হৌড়ির ঘরহান মাডিতে মিশাই দিল। হ্যাতাগ দেহা হাইলে জিগ্গাইতাম হেগুনে কী মাইন্ষ্যের বাইচ্চা না হশু! অন্ কন্নাই যাই গা ঢাকা দিছে। আঁর স্বামী কয়, বুক চাপ্ড়াইলে কী হিরি হাইবা। অন্ ভাব থাইক্বা কন্নাই! কত কইছি ইন্ডিয়া চলি যাই, এগুনে আঁঙ্গরে থাইক্ত দিত ন এই দ্যাশে, হুইন্লা না। অন্ নিজের চয়ে দেহ কী অবস্থা কইর্ছে, বাসের অযোগ্য করি রাইখ্ছে। বাঁই গ্যাঁতিগুষ্টিরা যহ্ন দ্যাশে হিরি আইব, কন্নাই থাইক্ব, কী খাইব। বেক্গুনে খাড়াই খাড়াই চাই রইছে, কোন জবাব আছে নি হ্যাতাগ কাছে?
ঘরদোর চুলায় গেছে, অন্ কার দূয়ারে যাই ঘুরি মরুম, নিজের ভিডাতেই হর্মুলের বেড়া দি গোবর লেপি ছনের ঘর করি হড়ি রইলাম। এক বেলা খানা জোডে কোনরমে, আর এক বেলা জল খাই থাই। ওই হোলাডারে লই তের মুশকিলে অইড়ছি। দিনরাইত মা বাপের লাই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করি কাঁদে। ক্যাম্নে হ্যাতেরে বাড়িঘরে হৌঁচাই দি। আত্মীয় স্বজন কে বাঁচি আছে, আর কে বাঁচি নাই, খবর লইয়ুম ক্যাম্নে। আঁর স্বামী ইস্কুল ঘরে লাইন দি ছাতু জোগাড় করি আইন্ছে, মাই মাই খাই। রেডক্রস তুন্ সাহায্য আইছে। বাড়িঘর দোর বানাইবার লাই টিন দের। লিষ্টে আঁঙ্গ বলে নাম উইঠ্ছে। আঁর হোলামাইয়ারা ভারত তুন্ হেরত আইছে। আঁঙ্গরে জড়াই ধরি হেগুনের কী কান্দন। কত কই কান্দছ্ কিয়ের লাই? হেগুনের কান্না কী আর থামে! বাড়িঘর দোরের এইরম অবস্থা দেই আরও মন খারাপ অই গেছে। আঁঙ্গ বাড়ির মানুষ, অইন্য বাড়ির মানুষরাও যে যিয়ানে আছিল হিয়ান তুন্ এক এক করি হেরত আওন শুরু করি দিছে। যেই গাঁট্টি লই অইয়ে, এক প্রস্ত হাউমাউ করি কাঁদে – দিদিগ, যেই কষ্টে দিন কাইট্ছে, আম্নেরে কী কমু, নরকের দূয়ার তুন্ হেরত আইলাম। এক এক জনের এক এক রমের ঘটনা, কয়, কত জনরে যে কচুকাডা কইর্ছে, কত মাইয়ারে চয়ের সামনে ইজ্জত নিছে আর কী কইয়ুম, এই দৃশ্য মনে হইড়লে অন্ও গা কাঁপাই উডে। হিছনের বাড়ির অপূর্বর মাইয়া গর্ভবতী অই গেলে লোক শরমের ভয়ে গলায় দড়ি দিল। হায় হায় রে, ঐটুক্ মাইয়া, হবে ঋতুস্রাব অইছে, হেই মাইয়ার এরুম সব্বনাশ করি দিল, হেগুনে কী মাইন্ষ্যের বাইচ্চা, জানোয়ার, ঘরে মা বইন নাই। বঙ্গবন্ধু ত দ্যাশে হিরি আইছে, দেই অন্ কী বিচার করে জালিমেগ। মেলেটারিরা ত আত্মসমর্পণ করি ছাড়্ হাই গেছে, হেগুনের ত কোন বিচার অইত ন। দ্যাশে যাই ভালা মাইন্ষ্যের হোষাক হরি বুক হুলাই ঘুরি বেড়াইব। আঙ্গ দ্যাশের যেগুন দ্যাশের লগে গাদ্যারি কইর্ছে, হেগুনের বিচার করনের লাই হ্যাতেনে দালাল আইন করি কগা গাদ্যাররে শাস্তি দিছে। বঙ্গবন্ধুর ত দয়ার শরীল। হ্যাতেনে বাঁইগুনেরে সাধারণ ক্ষমা করি দিছে। কামডা যে হ্যাতেনে ভালা কইরছে এইডা কই ক্যামনে। ভারত এত সাহায্য কইর্ল, কত সৈন্য মুক্তিফৌজের লগে মরি গেল, কেউ কেউ অন্ উল্টা গান গাইছে, হেগুনরে বেইমান ছাড়া আর কী কইতাম্ হারি। আরে ভারত সরকার বডার খুলি দিছে বলিই ত অনেক মানুষ হরানে বাঁচি গেছে, না অইলে কী দশা অইত। বিদ্যাশ বিঁভুয়ে এক গেলাস জলও ত কেউ কাউরে দেয় না, হ্যাতারা আঁঙ্গরে নয় মাস ধরি রাইখ্ছে, খাওয়াইছে, হরাইছে, হেইডা কী কম কতা! শুধু কী সরকার, স্থানীয় মাইন্ষ্যেও কম করে ন। হরের দ্যাশের মানুষ বলি দূর দূর করি তাড়ায় ন, হেই ত বাপের ভাইগ্য। কত জাগা যে হাল্টাই হাল্টাই থাইক্ছি, হোট্লাহুট্লি চ্যাঁচাই চ্যাঁচাই লই গেছি, হ্যাডের ব্যারামে অইছিলাম একসার । কারো কারোরে লই গেছে উড়িষ্যা, আসাম, মধ্যপ্রদেশ, আমরা ত আছিলাম বিলইন্না, উদয়পুর আর হরে হরে আগরতলা অই সর্বশ্যাষ ধম্মনগরে, ক্যাম্পে ক্যাম্পে দিন গেছে। বাদাইম্যারা ছোঁক ছোঁক কইর্ত না ক্যামনে কই। হুসলাই একবার নিত হাইর্লে ত ষোল কলা হুরণ অয়। মান সম্মান বাঁচাই যে আইতাম্ হাইর্ছি আম্নের বাপ মার আশীর্বাদ আছিল বলিই না। অন্ শইর্ল্যের মইদ্যে কী রোগ বাসা বাঁধি আছে, কে জানে। কত দুহের কতা আঁরে হুনায়। আঁর হৌড়ির মরণের কতা হুনি মাথাও চাপড়ায়। ওমা হরে হরে দেই আরও বাড়ির গ্যাঁতিরা আই ইনায় বিনাই দুহের কতা কই আছড়াই হড়ে। লেদা হোলাডাও কইতে ছাড়ে না।
ঘরে ঘরে ব্যারাম লাগিই আছে। ওষুধ হইথ্যর আকাল। ঘোর অরাজকতা চইল্ছে হুরা দ্যাশে। খান সেনারা যাইবার আগে বেক্ সম্পদ লুডি লই গেছে, ট্যাঁয়া হইসার ভান্ডার শূন্য করি দি চলি গেছে। মাইন্ষ্যের রোজগারহাতি নাই। বঙ্গবন্ধু অইন্য দ্যাশের কাছে চাই চিন্তি দ্যাশের মাইন্ষ্যেরে বাঁচাইবার চেষ্টা করের। দ্যাশের মইদ্যে অন্ও হত্তুর ত কম নাই। রাজাকার আলবদররা ঘাপটি মারি রইছে। যুদ্ধের সময় মুক্তি বাহিনীর গেরিলাগরে কম ত খতম করে ন। হেগুনে চাইছিল দ্যাশডা হাকিস্তানের লেজুড় অই থাক্, তাইলে আখের গুছাইতে হেগুনের সুবিধা অইব। এই কতাগাইন অন্ ড্যাগা ড্যাগা হোলাহাইনেরাও বুজি হালাইছে। দ্যাশ যে স্বাধীন অইছে হ্যাতাগ হছন্দ অয় ন। বঙ্গবন্ধুরে মারি হালাইলে খুশি অইত। হিন্দুরা কোন দিগে যাইব, এই হশ্নটা উইঠ্ছে ক্যাম্নে। আঁই মাইন্ছি অন্ও অনেক হিন্দু ভারতের ক্যাম্পে আছে। হিন্দুগ উপ্রে অইত্যাচার অইছে বিধায় সাহস করি আইত হারেন না। কে নিশ্চিত কইর্ব নিরাহত্তা! দিনের আলো আর রাতের আঁন্দার আত ধরাধরি করি চলে, কোনটাতেই মুখ দ্যায়ানো যায় না। বিশ্বাস হিরাই আইন্ত হাইর্লে এরুমডা অইত না। এই দ্যাশডা হিন্দুগ দ্যাশ ন, এই কতা উইঠ্তে বইতে কিছু মানুষ বুজাই দের। বুজা, কত বুজাইবি বুজা, আঁই কইতেই থাকুম্, এই দ্যাশ হিন্দু মোছলমান বেকের আর য্যাতারা য্যাতারা বসবাস কইর্ছে এত হুরুষ ধরি বেক্গুনের। মাইন্ছি অন্ও স্বীকৃতি দেয় ন বেক্ দ্যাশ, দিব স্বীকৃতি আস্তে আস্তে। আঁর স্বামীর মনে দুখ্ লাইগছে, কয়, হুইন্ছনি, রাষ্ট্রসঙ্ঘে চিনারা আঁঙ্গ দ্যাশের বিরুদ্ধে ভেটো দিছে, হেই দ্যাশ মাইন্তেই চায় না বাংলাদেশের মাইন্ষ্যের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আছে, মা-র যেমন হোলামাইয়ারে বুয়ে জড়াইবার অধিকার আছে, ভাষা কৃষ্টি লই বাঁইচ্বার অধিকার আঁঙ্গ আছে। আইজ্ না হয় কাইল বিশ্বের বেক্ দ্যাশের মাইন্ষ্যেরে এই কতাগাইন মাইন্তেই অইব। না অইলে দ্যাশের ভিত্রে বারে বেকেরে এই ভুলের মাশুল দিতই অইব। হ্যাতেনের মুখহান এই কতাগাইন কইত যাই জ্বলজ্বল করি উইঠ্ল। আঁর মায়া লাইগ্ল, ছোড হোলার লাই মার মনে যেরুম লাগে, খালি দিব, লইত না কিছুই। ঘর আর ঘর নাই, বাড়ি আর বাড়ি নাই, দ্যাশ আর দ্যাশ নাই। এক কোনায় বই চুপ করি থাই নিজের মনে। আঁঙ্গ বাড়ির সামনের শ্মশানের মঠ কত সুন্দর, ধরি রাইখছে বেক্গাইন, অতীতের লগে কেরুম সুন্দর মিলাই দিছে বর্তমান আর ভবিষ্যত। চলেন আমরাও মিলাই দি। বড় সুন্দর কতা কইছ তুঁই, আঁর মনে ধরি গেল।
যন্তনাডা এরুম করি গাঁতি যাইব, কে জাইন্ছে। জীবনে যে অইন্য রঙ লাইগ্ব, কে আর ভাইব্ছে। অনেক চেষ্টা চরিত্র করিও আগের ঘরে, আগের বাড়িত্ হিরি যাইতাম হারিয়েন না। ভাবনায় আর সম্পর্কের মইদ্যে চিড় ধইর্ছে। আঁর হৌড়ি যে জাগায় ঘুমাইত, অন্ হেই জাগায় হোড়া হোড়া গন্দ জমাট বাঁধি আছে। হাকের ঘরের চুলা দুইহান কাঁচা মাডি দি লেপি দি রান্না বয়াইছি। হর্মুলের ধোঁয়া থাইক্বার ঘরে ছড়াই গেলে চখ জ্বালা জ্বালা করে। কদ্দিন অইল বিলাইডা হিরি আইছে। কন্নাই আছিল কী জানি। বুইজ্তাম হাইরছি, মনই আপন, আর বেক্গাইন হর, শত চেষ্টা করিও স্বাধীন দ্যাশের ভাঙাচুরা হরিবেশটারে কোনমতেই আপন কইর্তাম হারিয়ের না। হইসাকড়িও হুরাই আইছে, কিছু সাহায্য আইছে, হেইডা দি কদ্দিন চইল্ব। বাজারেও আগুন লাইগ্ছে, বেক্গাইন মাঙ্গা, আত ছোঁয়াইলেই আত হুড়ি যায়। আমেনার বাপ আই কয়, হাঁস এই চাইরহান ডিম হাইড়্ছে, আম্নেরা হান। আঁই কইলাম, এই দুর্দিনে তোঁরা খাইবা কী, লই যা। হ্যাতে কিছুতেই নিতে রাজি অইল না। হোলামাইয়াগুনের মুখগাইন হুক্না অই আছে। বাড়িহুদ্দা মাইন্ষ্যের মুয়ে কোন কতা নাই। হ্যাডে ভাত নাই, আর কী কতা কইব। নেতারা আইছে এদ্দিন বাদে। কয়, দেইখ্তেই ত হাইর্ছেন দ্যাশের অবস্থাহান, সরকার যট্টুক হারের, অইন্য দ্যাশের তুন্ চাই চিন্তি আনের, এট্টু হাম্লাই টাম্লাই চলেন, দিন এরুম থাইক্ত ন, দুখ্কষ্ট কাডি যাইব। ভাঙ্গি ত দিছে বেক্ কিছু হশ্চিমারা, গইড়্তে ত সময় লাইগ্ব। হ্যাতাগ কতা হুনি এরুম এক্কান দশা অইছে, স্বপ্নগাইন আই জড় অইলেও, ছিট্কাই চলি যায় চয়ের নিমিষে। অফিস কাচারিও খুলে ন। আদালতে মুজিবুর পন্থি বিচারকেগ ধরি ধরি নাকি খান সেনারা মারি হালাইছে। ইস্কুলও তছ্ন্ছ্ করি দিছে, চেয়ার টেবিল বেক্ ভাঙ্গাভুঙ্গা, ইস্কুলে যাইবার উপায় আছে নি। দুই একজন হিন্দু মাষ্টর আছিল, হ্যাতাগরে মারি মাথা হাঁডাই দিছে। তবুও আঁর স্বামী কয়, কদ্দিন আর বই থাইক্ব, এবার সদরে যাইয়ুম্, কদ্দিন অই গেল, কারও মুখ দেই না। আঁই আর মানা করি ক্যাম্নে, মনের উপ্রে কারও ত দখলদারি নাই।
আমন ধান অইছে। মাঠভরা ধান দেই অস্থির মনডা কিছুডা শান্ত অয়। আঁঙ্গ হোষা কুত্তা কালু আগের মতই লেজ নাচায়। গরুগুন আর হৃষ্টপুষ্ট নাই। চয়ের কোনায় কালি, মুয়ের চোয়ালে চোয়ালে ভাঁজ আর ডাক দিলে মনে হয় কত কষ্ট দুখ্ হেগুনের মনে। আঁই গলা ধরি আদর কইর্লে মাথাডা বাড়াই দেয়। উডানে মাড়াই অইছে হুব পাকিস্তানে, অন্ অইছে আঁঙ্গ স্বাধীন দ্যাশ বাংলাদেশে। মাডি ত স্বাধীন অইছে, গাছ স্বাধীন অইছে, মনের খুশি মত ঠাইল লড়ায়, হঁইকরাও স্বাধীন অইছে, মনের খুশিমত ডাকে। হেগুনের মনের মইদ্যেও খুশির জোয়ার আইছে, না অইলে এরুম চড়িবড়ি ঘুরি বেড়ায়! কান্তিলাল আর সুরেন্দ্ররা আর ঘরে হিরে ন, ইন্ডিয়ার কোন জাগাত্ ডেরা বাঁইনছে, হেগুনের মুখ আর কোনদিন এ জীবনে দেইখ্তাম ন। কাইজ্জা না কইর্লে হ্যাডের ভাত হজম অইত না, বাড়িহান গরম করি রাইখ্ত। ঢেঁই ঘরহান আর নাই, ভাঙিচুরি চুরমার করি দিছে। আঁঙ্গ বড় এক্কান কত বছরের মোডা আমগাছ আছিল, হিঁন্দুইরগা রাঙা আম ধইর্ত, হেই উঁচা য্যান্ আকাশ ছুঁই হালায়। কাডি লই গেছে চোরারা, গরমের দিনে গাছহান আঁঙ্গরে ছায়া দিত, গাহান ঠাণ্ডা অই যাইত। মানুষ মইর্ছে, গাছ মইর্ছে, দিন গেছে। হুইরের জলও হুয়াই গেছে। কত ভাব যে মরি গেছে, গেছে ত গেছে, উদ্দার করার আর কোন উপায় খুঁজি হাই না। হুনিয়ের বঙ্গবন্ধু দ্যশডারে নতুন্ করি গইড়্বার লাই দ্যাশের মাইন্ষ্যেরে ডাক দিছে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ধম্মনিরপেক্ষতারে সম্বল করি হ্যাতেনের স্বপ্নরে হুরণ কইর্ত চায়। এই কতাগাইন রেডিওত্ হুনা। কেউ কেউ আবার মুসলিম ধম্মরে সামনে রাই সংবিধান বানাইত চায়। চাইবার অধিকার বেক্গুনের আছে, কইবার অধিকারও বেক্গুনের আছে, কিন্তু মনডা যদি খচ্খচ্ করে তাইলে এই নতুন্ দ্যাশে আঁঙ্গ জাগা কন্নাই অইব। মনে হশ্ন জাগে, বেক্ ধর্মের মানুষ এক লগে থাইক্লে সমইস্যাটা কীয়ের। ধম্ম ধর্মের জাগায় থাইক্ল, মানুষ মানুষের জাগায় থাইক্ল, সোজা সরল ইসাব। হথ্যম হথ্যম রিলিফ দিছে। যত দিন যার, দেয়নের হরিমাণডা আগের মত নাই। বিদ্যাশের মাইন্ষ্যে বুইজ্ছে বাংলাদেশের বাস্তুহারারা নিজের খানা দানা নিজেরাই জোগাড় করি হালাইত হাইর্ব এদ্দিনে। কিন্তু আঁঙ্গ যে দিন চলে না কে আর হেই খবর রায়। দুই এক গিরি য্যাতারা ছড়াই ছিডাই আছিল, হ্যাতাগ মইদ্যে কেউ মরিধরি গেছে, কেউ হিরি আইছে। এম্নে কী আইছে, নিজেগ ভিডামাডির মায়ায় হিরি আইছে। মানুষ য্যান্ আগের মত নাই, ঝিমাই গেছে। স্বাধীনতা হাওনের লাই যেরুম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গ দিছিল, গড়ার কামে আর হেরুম উৎসাহ দেই না। নিজেগ হাওনাগণ্ডা বুজি নিত চায় আগে, বাঁইরা মইর্লেও ভালা, বাঁইচ্লেও ভালা। সরকার যেই ট্যাঁয়া হাঁডায়, ছোলাই ভোলাই খায়। হিয়ের লাই কী এত তরতাজা হোলারা, ভারতের সেনারা হরান দিছে। যার গেছে, তার গেছে, কার কী, হ্যাতারা গুছাইগাছাই লয়, মৌজ করে। হেইডা ভাবে না, নতুন্ দ্যাশ, সরকার কী আকাশ তুন্ দিব, সময় দিত অইব। আরে স্বাধীনতা কী মধুর ভাণ্ড, খান সেনাগ দৌড়াই গাছ তুন্ হাড়ুম আর চুক্ চুক্ করি টানি খামু।
কী আনন্দ, কী আনন্দ আঁঙ্গ দ্যাশে মুদ্রার নাম ট্যাঁয়া অইছে। আঁর হোলা বাজার তুন্ যাই নতুন্ হাঁন্ডি হাতিল কিনি আইন্ছে। হাকের ঘর এদ্দিন উদাম আছিল, অন্ উপ্রে টিনের চাল অইছে, থাইক্বার ঘরের লগে জোড়া লাইগ্ছে। বিষ্টির সময় এঘর তুন্ হেই ঘরে যাইতে ভিজ্তে অইত ন। হাকের ঘরের হাশে লাকরি হর্মূল রাওনের গুদাম ঘর অইছে। অন্ চাইর মুই রেইন্লে ঘর ঘর মনে হয়। হাঁজাই গুছাই রাইখ্বার লাই ইচ্ছাও জাগের। মাঝে মাঝে উপ্রের দিগে রেনি থাই, বড় টঙডা আর দেই না, কোন কালেও হাইতাম্ ন, ভষ্ম অই গেছে, টঙডা আঁরে দেয় না, আঁইও টঙডারে দেই না। আঁঙ্গ ঘরের লগে আগে এক্কান শেফালি হুল্ গাছ আছিল, ঝারা দিলে সাদা সাদা হুল্ হড়ি উডান বিছাই থাইক্ত, জঁইয়া হোকা আডার মত লাগি থাইকত গাছে। দিন দিন ঘরহান মানুষ অই উইঠ্ছে, গোডা ঘরের চেহারাহান অইন্যরকম, কিন্তু আগের চেহারাহান কী ভুলন যায়! নৌকা আই সওয়ারি লই ভিড়ছে ঘাডে, দূর দূর তুন্ চাষীরা শাকসব্জি হল্হলাদি লই আইয়ের আঁঙ্গ আঁডে, লোকে লোকারণ্য। ইস্কুলে যোগ দিছে মাষ্টর সাবেরা, ছাত্ররা বই খাতা হিন্সুল লই যার মনের আনন্দে দলে দলে। জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ বেক্গুনের মিষ্টি গলায় কী ভালা যে লাগের, বাতাসে হেই সুর ভাইস্তে ভাইস্তে চলি আইয়ের হঁতে মাডেঘাডে। মাইন্ষ্যে ভাবের ঘোরে কেউ নাচে, কেউ গায়, কেউ এই গানের কতায় বুঁদ অই থায়। আঁঙ্গ দ্যাশহান আঁঙ্গ কাছে হিরি আইছে, এই খুশি রাওনের জাগা নাই। আঁই ঘরের উত্তর মুই বড় গাছের হাশে অগ্গা শেফালি হুলের গাছের চারা রুই দি, উডুক না বাড়ি যদ্দিন সময় লাগে, তদ্দিনে ঘরগাইন জোড়া লাগি যাইব আগের মত এক এক করি।
কইল্কাতা তুন্ চিঁডি আইছে বড় হোলার। হ্যাতে লিখছে বড় কোম্পানিত্ চাকরি অইছে। শহর তুন্ দুই মাইল দূরে জাগা কিনি কাকার ঘরের লগে ঘর বানাইছে। হাকা বাড়ি, মোজাইক্ করা মেঝে, সেগুন কাডের দরজা জানালা, তিনহান ঘর, খাট, আলমারি, সোফা, ডাইনিং টেবিল, এক্কান বড় রেডিও আছে। অ্যাকুরিয়ামে লাল সাদা নীল মাছেরা ঘুরি ঘুরি বেড়ায়। ঘরের মইদ্যে মাছের চাষ, হুনি ত আঁর আক্কল গুড়ুম। দেয়রের সংসারও বড় অইছে, হ্যাতেরে আদর যত্ন করে নোয়া কাকিমা, ভালামন্দ রাঁধিবাড়ি করি খাওয়ায়। হিয়ানে একশ বাঙালি মিলি এক্কান কোঅপারেটিভ বানাইছে। বড় বড় তিনহান হুইর আছে। হটিকের মত জল। আঁর হোলা বেয়ান অইলে হুইরে সাঁতার কাডে। বুইজ্লাম আঁর হোলার উন্নতি অইছে, সুয়ে শান্তিতে আছে জানি আঁর মনেরও শান্তি অইল। চিঁডির ভাষাহান আর ভাবহান আঁঙ্গ দ্যাশের মত আর নাই। কইল্কাত্তাইয়া গন্দ লাইগ্ছে। লাইগ্বই ত। এত বড় দ্যাশ, স্বাধীন অইছে হাতচল্লিশ সালে, হেই দ্যাশ কী আঁঙ্গ দ্যাশের মত হিছাই থাইক্ব। এদ্দিন ত হশ্চিমারা আঁঙ্গরে হরাধীন করি রাইখ্ছে, এই ত মাত্র স্বাধীন অই গা ঝাড়া দি উইঠ্ছে, আঁঙ্গ হা’র নীচের জমি অন্ও নরম, থল্থইল্লা, শক্ত অইব তয় না। ভালা ভালা রাস্তাঘাড অইব, হড়ালেহার হুযুগ অইব, কল্কারখানা অইব, অফিস আদালত বাইড়্ব, চাকরিবাকরি অইব, গ্ৰামে গ্ৰামে বিজলী বাতি আইব, তন অইব সুয়ের দিন। যহ্ন এসব কতা ভাবি, আঁর শরীলডা শিরশির করি উডে। মাইয়াডারে কইলাম্, দ্যাশের অবস্থাহান অন্ শান্ত, ভালা করি হড়ালেয়া কর, তয় না দাদার মত উন্নতি করবি। দেয়চ্ না তোর বাবা কয়, স্বাধীন দ্যাশেরে আগাই নিত অইলে মাইয়াগুনেরও আত লাগাইত অইব। তোর বাবা এট্টু ঝাড়ি ঝুরি উডি কোটে কামকাইজ শুরু করুক, তোরে আবার শহরে হাঁডাই দিমু, প্রাইভেটে জিলা ইস্কুলে একবার যদি হাঁস কর্তি হারছ্, আর হিছে হিরি চাইত অইত ন। মা, দিদিরে এক্কান চিঁডি লিখি দ। আঁর ভাগ্না ভাগ্নীরা কী ভালা, এই ক’মাস আঁঙ্গরে কী আদরেই না রাইখ্ছে, এই যে এত বড় দূর্যোগ গেল, এট্টুও কিছু বুইজ্ত দে ন। দুইজন মাইন্ষ্যের খানাদানা, আঁঙ্গ অসুখবিসুখ বেক্ কিছু মুখ বুজি হামলাইছে। দিদির ঋণ আমরা কোনদিন শোধ কইর্তাম্ হাইর্তাম্ ন।
মাইয়া আঁর ছোড হোলার আত ধরি শহরে গেল। যাইবার সময় কই গেল এবার জয় করি হিরুম। শহরে অন্ গরমের ঠেলায় হরান যায় যায়। গা ঝাড়া দি উইঠ্তে সময় লাইগ্ব। মাইয়া ত আঁর সাহস করি গেল, ভয় কাডি গেছে এই কতা ক্যাম্নে কই। ঘরবাড়ি লুটহাট ভাঙচুর অইছে, হেই ক্ষতের দাগ ছড়াই ছিডাই আছে ইয়ানে হিয়ানে। ডাকখোঁজ করি যে সান্তনা দিব, হেইরম মাইন্ষ্যের অন্ও দেয়া নাই। রাস্তাঘাডে গাড়িঘোড়া হেরুম চলে না। দুই এক ঘর মানুষ হিরি আইছে, ডাকি ডাকি কতা কয়। হাকশাক করি যে খাইব, হেই বন্দোবস্ত নাই। দুই এক্কান ভাতের হোটেল নোয়া করি খুইল্ছে। মাইয়াডার লাই হোটেল তুন্ খাবার আইয়ে। দেবদেবীর হতিমাগুন আর আস্ত নাই। মিটিং মিছিল বেক্ কিছু থামি রইছে, চুপচাপ, মনঃকষ্টে ঝিম মারি রইছে, বেক্ ঘর তুন্ একজন, দুইজন করি শহীদ অইছে, শোক ভুলন এত সহজ কতা নি। মাইন্ষ্যের মনে হিংসার ভাব আগের তুন্ কমি আইছে। যুদ্দ থাইম্ছে যে কয় মাস ত কাডি গেছে, অভাবের জ্বালায় অন্ও ঘুরি ঘুরি মরে। হস্তায় আডা, চাইল বিলি অর যিয়ানে, লম্বা লাইন দি খাড়াই রইছে হিয়ানে ঘন্টার হর ঘন্টা মাইন্ষ্যে। মাইয়ার বাপ আই কয়, ভালা করি হড়ালেয়া শুরু কর, সরকার ধুলাবালি ঝাড়ি, চেয়ার টেবিল ঠিক করি ইস্কুল কলেজ খুইলবার ব্যবস্থা কইর্ব শীগ্গির্ই। মাষ্টরেরা য্যাতাগরে মারি হালাইছে, হেই জাগায় নোয়া মাষ্টর নিব। বাবুরে, মক্কলরা শহরে মামলা কইর্বার লাই আওন শুরু করে ন, রোজগারহাতি নাই, ক্যাম্নে যে চালাইয়ুম, চিন্তায় আছি। মাইয়া আঁর দিন রাইত হড়ে আর দুই এক ঘর টিউশনি করে যদি বাবার কষ্ট কিছুডা অইলেও লাঘব্ কইর্ত হারে। কী জানি ক্যাম্নে ক্যাম্নে যোগাযোগ অইছে, হিন্দুর মাইয়া অইলেও টাউন হলে রচনা প্রতিযোগিতায় হথ্যম অইছে। যে মাইয়া জীবনে কোনদিন ইস্কুলে যায় ন, বাড়িত্ হড়ি হড়ি যে এদ্দুর আগাইব, কল্পনাও কইর্তাম হারি ন। জিলার ম্যাজিস্ট্রেট আশীর্বাদ করি কয়, আরও মন দি হড়ালেখা কর, অনেক দূর যাইত অইব।
মাইয়া আঁর প্রাইভেটে হরীক্ষা দি মাধ্যমিক হাস কইরছে হায়ার সেকেন্ড ডিভিশনে। বেক্গুনে বাহবা দি কয়, এই হাশ হার্স্ট ডিভিশন-এর হমান। ঘরে বই হড়ালেহা করি অসাইদ্য সাধন কইর্ছে। মাইয়ারে লই গর্বে আঁর মাথা উঁচা অই গেছে। ইয়ার হরে হেতি মহিলা কলেজে ভর্তি অই উচ্চ মাইদ্যমিকও হাশ কইর্ছে। সরকার অন্ বেসরকারি ইস্কুলগুন সরকারি কইরছে, কত শিক্ষক নের। আঁর মাইয়ার চয়ে বিরাট স্বপ্ন, ইস্কুলের মাষ্টারনি অইব। ইয়ের লাই পিটিআই ট্রেনিং কইর্ত অইব, সোজা কতা নি। কইলাম্ মাইয়ারে, মা, হুদা হুদা স্বপ্ন দেখছের কিয়ের লাই, কত হোলামাইয়া হরীক্ষা দিব, হাইর্বি নি তুই। মাইয়া জিদ্ ধইর্ছে, হশিক্ষণ নিব, মাষ্টরের হরীক্ষাও দিব । ও মাগ, দিনরাইত কী খাডান খাডে, গাধার খাড্নি, দরজা বন্ধ করি দিনের বেলায় হড়ে। কেরসিনের আকাল, রাইতের বেলায় হইড়ব ক্যাম্নে। শ্যাষমেশ মোমবাতি কিনি দিছে হেতির বাপ। হেই পরীক্ষায়ও হথ্যম অইলে বেক্গুনে ধইন্য ধইন্য কইর্ল। মাইয়া আঁর বাড়ির কাছের ইস্কুলের মাষ্টারনি অইল। জীবন যে কহ্ন বাঁকিবুঁকি যায়, কেউ টেরও হায় না, কিন্তু যে নিজের লইক্ষ্যে হৌঁচায়, হেই কেবল বুইজ্ত হারে কত কাডখড় হোড়াইলে এরুম দিন দেইখ্ত হারে। হথ্যম হথ্যম কত দুশ্চিন্তা আছিল, একে মাইয়া মানুষ, ইয়ার হরে হিন্দুর মাইয়া মুয়ের হরিক্ষায় কী জিগ্গাইতে কী জিগ্গায়, হেতি হাইর্ব ত। আঁর মাইয়া যে ভিত্রে ভিত্রে হড়ালেয়া করি এরুম ঝুনা নাইর্কলের মত অইছে, মা অই আঁই বুইজ্তাম হারি ন! আঁর মাইয়া অন্ রোজ হড়াইত যায়, আঁই ঘরের মইদ্যে বাইচ্চাগুনরে হড়াই আর ইয়ার হাঁকে চুলায় আগুন জ্বালাই রাঁধি। ধোঁয়া গল্গল্ করি উডে। আকাশের মুই উডি হুরা উডানের বাতাসে ছড়াই নাইর্কল সুয়ারির ডাইলের কাছে ছোডে।
দিন যত হার হর, মাইন্ষ্যের মন য্যান্ কেরুম হাল্টাই যার। আঁঙ্গ ঘরে আগে এক্কান ঘড়ি আর ক্যালেন্ডার আছিল, শহর তুন্ আনি দিছিল আঁর স্বামী। আনি কইছিল, সময় আর তারিখ দেই চইল্বা, তাইলে বুইজ্তে হাইর্বা, সময়ের কাম ক্যাম্নে সময়ে কইর্ত অয়। কতাহান হ্যাতেনে হাল্কা চালে কইছে বটে, অন্ বুজি এর এক্কান গভীর অর্থ আছে। কত কিছুই ত আমরা বুইজ্তাম্ হারি না। কন্নাই ঢাকা শহর আর কন্নাই আমরা, ক্যাম্নে আর বুজুম সরকার গরীব মাইন্ষ্যের কতা কতডা ভাবনা চিন্তা করের। আগে ত নিজেরা আলাদা করি ভাইব্তাম, হেই ভাব্না দূর অই গেছে। অন্ য্যান্ বেক্ কামে জমির মালিক, বর্গাদার, চাষা, কামার কুয়োর যুগী ধোয়া নাপিতের হোলারা এক লগে গায়ে গা লাগাই লাইন দেয়। বেক্গাইন অইছে অভাবে হড়ি। চাইর মুই খালি নাই নাই। ইংরাজরা যাইবার আগে যেমন দ্যাশের রস টানি নি আধা ছিবড়া করি দি গেছে, হাকিস্তানিরা হুরাডাই ছিবড়া করি দিছে, টাঁকশালে ট্যাঁয়া নাই, কারখানায় হুরান জমানার মেশিন, চাষের বীজ নাই, সার নাই, চিকিৎসায় ওষুধ নাই, হড়ইব যে বই কিনবার হইসা নাই। মাইন্ষ্যে বুজে না, সরকার ত বিনা হইসার বই দের, এক এক করি কইর্ব, ধইর্য্য ধরন লাইগ্ব। শ্রীরামকৃষ্ণ কইছে না, যে সয়, সে রয়! যে না সয়, সে নাশ হয়। মনের কতা কইছে, মাইন্ষ্যের মত কতা কইছে, মহাহুরুষ কিনা জানিনা, হণ্ডিত মানুষ, জ্ঞানী মানুষ, কে আর বুইজ্ল। আঁর হৌড়ি থাইক্লে কইত, বউ ঘডি কহ্নও উবুড় করি রাইছ্ না, তাইলে ধন মান দুইডাই যাইব। বুড়াবুড়িরা যা কয়, মন তুন্ কয়, হুনি হুনি শিখ্ছে, আঁঙ্গরে শিখাই যার, কামে ত কোনদিন আইব। মানুষ চলি যায়, কতা থাই যায়। আঁঙ্গ দ্যাশের ধন বেক্গুনে মিলি বাড়াইত অইব, একার কাম ত ন। মুজিব ত ভগবান ন, আল্লাহ ন, চাইলেই ঘডি ভরি দিব। মাইন্ষ্যের মন কোন মুই যার, বুজা মুশকিল, আজাইরা কতা কয়, গালমন্দ করে। অন্ যা অবস্থা অইছে নদীত্ বাঁন দিলেও মুশকিল, না দিলেও বেক্ ভাঁই চলি যাইব।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)