সৌমিতা রায় চৌধুরী

পর্ব – ৬

বাংলা চলচ্চিত্রের মাইলস্টোন সত্যজিৎ রায়। ১৯৫৫ সালে ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়। মুখ্য চরিত্র অপুর শৈশবকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ বাংলার নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনযাপনকে চিত্রায়িত করা হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। স্বল্প নির্মাণ ব্যয়ে সরকারি সহায়তায় অপেশাদার অভিনেতা ও অনভিজ্ঞ শিল্পীদের নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্রতী হন আজকের কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায়। 

সুব্রত মিত্র এই ছবির চিত্র গ্রহণ করেন। দুলাল দত্ত ছিলেন সম্পাদনার কাজে। এই চলচ্চিত্রে স্বনামধন্য সেতার বাদক রবিশঙ্কর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের রাগ ব্যবহার করেছেন। ১৯৫৫ সালের ৩ মে নিউ ইয়র্ক শহরে মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টের একটি প্রদর্শনীতে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। ওই বছরেই কলকাতা শহরের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্রটি মুক্তি লাভ করলে গুণীজনদের প্রশংসা লাভ করে। এই চলচ্চিত্রে প্রদর্শিত বাস্তববাদ, মানবতা এবং মানব জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়ের চিত্রায়ন চলচ্চিত্রটিকে অন্য মাত্রা দান করে। 

নিশ্চিন্তপুর নামে বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে হরিহর (কানু বন্দোপাধ্যায়) এবং তার স্ত্রী সর্বজয়া (করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়), তাদের দুই সন্তান অপু (সুবীর বন্দোপাধ্যায়) এবং দুর্গা (উমা দাশগুপ্ত) কে নিয়ে দৃশ্যায়িত হয়েছে একটি ছোট পরিবার। সেই সংসারে হরিহরের দূরসম্পর্কের বিধবা পিসি ইন্দির ঠাকরুণ (চূনীবালা দেবী)-র বসবাস। পেশায় পুরোহিত হরিহর ছিলেন শিক্ষিত মানুষ। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, যাত্রাপালা লিখে সচ্ছল সংসার নির্বাহ করবেন। অভাবের সংসারে ইন্দির ঠাকরুণের সঙ্গে সর্বজয়ার মনোমালিন্যের জেরে ইন্দির ঠাকরুণ মাঝেমাঝেই অন্যত্র চলে যান। আবার এই ইন্দির ঠাকরুণের সঙ্গে দুর্গার ভারি সখ্যতা। গ্রামের বিভিন্ন বাগান থেকে ফলমূল পেড়ে এনে দুর্গা, ইন্দির ঠাকরুণ ও অপু ভাগাভাগি করে খায়। নিখুঁত সেইসব দৃশ্যায়ণ ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটিকে অন্য মাত্রা দান করেছে। 

আবার ভাইবোন অপু-দুর্গার মধ্যেও ভীষণ ভাব। শোলার মুকুট পরে আঁখ চিবতে চিবতে কাশফুলের বনের মধ্যে দিয়ে অপু-দুর্গার প্রথম ট্রেন দেখার দৃশ্যটিকে বাংলা চলচ্চিত্রের আইকন বলা চলে। পরবর্তী সময়ে ভাল উপার্জনের আশায় হরিহর শহরে চলে যান। ইতিমধ্যে অসুস্থ হয়ে তাদের একমাত্র কন্যা দুর্গার মৃত্যু ঘটে। ইন্দির ঠাকরুণও মারা যান। হরিহর ফিরে এলে পৈতৃক ভিটে ছেড়ে একমাত্র পুত্র অপুকে নিয়ে সর্বজয়া ও হরিহর শহরের পথে পা বাড়ান। 

‘পথের পাঁচালী’ একটি জীবনীমূলক ধ্রুপদী উপন্যাস। সত্যজিৎ রায় ‘পথের পাঁচালী’ নামক অংশে শিশু থেকে কিশোর অপুর গ্রামীণ জীবন, শৈশবের সারল্য, শৈশবেই স্বজন হারানোর অব্যক্ত ব্যথা এবং শৈশবে গ্রাম ছেড়ে আসার কাহিনীকে দৃশ্যায়িত করেছেন। চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রহণ শুরু হয় ১৯৫২ সালের ২৭ অক্টোবর। কলকাতার নিকটবর্তী বড়াল গ্রামটিকে নির্বাচন করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। রাতের দৃশ্যগুলি স্টুডিওতে গ্রহণ করা হয়েছিল। 

চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছিল আনুমানিক সত্তর হাজার টাকা। এই টাকা সংগ্রহের জন্য সত্যজিৎ রায় গ্রাফিক্স হিসেবে নিজের কাজ যেমন চালিয়ে যান, পাশাপাশি নিজের জীবন বিমা পলিসি বন্ধক রাখেন, নিজস্ব গ্রামাফোনের সংগ্রহ বিক্রি করে দেন এবং নিজের স্ত্রী বিজয়া রায়ের গয়নাগুলিও বন্ধক রাখেন। এতকিছুর পরেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যয় নির্বাহের জন্য কিছু পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করতে হয়। 

নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টের বিভাগীয় প্রধান মনরো হুইলার ১৯৫৪ সালে কলকাতায় ছিলেন। তিনি এই চলচ্চিত্রের ব্যাপারে যখন শোনেন এবং কিছু কিছু দৃশ্যায়ণ যখন দেখেন, তখন অতি উচ্চ মানের কাজ বলে পরের বছরের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টের প্রদর্শনীতে প্রথম বারের জন্য প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করেন। 

সত্যজিৎ রায় ‘পথের পাঁচালী’ ছবিতে অপুর শৈশব ও কৈশোরকে চিত্রায়িত করেছেন। ‘অপরাজিত’ শিরোনামের চলচ্চিত্রে অপুর ছাত্র জীবন ও যুবক অপুকে চিত্রায়িত করেছেন। ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে অপুর প্রেম ও সাংসারিক জীবনকে চিত্রায়িত করেছেন। এই চলচ্চিত্র দুটিকে নিয়ে পরবর্তী সংখ্যায় আলোচনা করা হবে। 

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *