তুষার বরণ হালদার

লেখক পরিচিতি 

(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা  সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং  বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।) 

প্রত্নতত্ত্ববিদ নলিনীকান্ত ভট্টশালী (১৮৮৮ – ১৯৪৭)

প্রত্নতত্ত্বকে যিনি জীবনের সাধনার সঙ্গে এক করে দেখেছিলেন এবং আজীবন নিত্যনতুন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান সংগ্রহে নিরলস ছিলেন তিনি হলেন প্রত্নতাত্ত্বিক নলিনীকান্ত ভট্টশালী। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৮৮ সালে অবিভক্ত বাংলাদেশের ঢাকা জেলার নয়নন্দ গ্রামে। ভট্টশালী ছিল তাদের পারিবারিক উপাধি। অতি অল্প বয়সেই তিনি পিতাকে হারিয়ে কাকার কাছে একরকম কষ্টেই বড় হয়েছিলেন। ১৯০৫ সালে তিনি বিক্রমপুরের পানাম হাই স্কুল থেকে বৃত্তি নিয়ে এন্ট্রান্স পাস করেছিলেন। এরপর ১৯০৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতক হয়েছিলেন।এরপর ১৯১২ সালে তিনি ইতিহাস নিয়ে এম. এ. পাশ করেন। এম. এ . পাশ করার পর তিনি বালুরঘাটের একটি স্কুলে শিক্ষকতার চাকুরী গ্রহণ করেছিলেন। এরপর কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ এ কিছুদিনের জন্য তিনি অধ্যাপনা করেছিলেন।
   এই সময়ে তিনি ইতিহাস বিষয়ক পত্র পত্রিকাতে ইতিহাস বিষয়ে বিশেষত প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে লেখালিখি করতে থাকেন। এই সব লেখার কিছু স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এর নজরে আসে। তিনি তাঁকে উৎসাহিত করেন। তাঁরই উদ্যোগে নলিনীকান্ত সদ্য স্থাপিত ঢাকা মিউজিয়ামের অধ্যক্ষের পদে আসীন হয়েছিলেন। এই ঢাকা মিউজিয়াম স্থাপনের একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে। ১৯১২ সালে বড়লাট কারমেল ঢাকার নর্থবুক হলে একটি আলোচনা সভায় যোগদান করেন। উক্ত অনুষ্ঠানে বড়লাটের সামনে তিনি একটি বক্তৃতায় ঢাকাতে একটি মিউজিয়াম স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তাঁর  বক্তব্যে বড়লাট উৎসাহিত হন। তাঁরই উদ্যোগে এবং বড়লাটের সহযোগিতায় পরের বছরই এই মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়। আর পরের বছরই তিনি এর অধ্যক্ষের পদে আসীন হন এবং আজীবন তিনি এর সেবা করে গেছেন। তিনি বাংলার নানা স্থান ঘুরে পাণ্ডুলিপি, শিলালেখ, তাম্রশাসন, পাথর এবং ধাতব মূর্তি প্রভৃতি আবিষ্কার ও সংগ্রহ করে ঢাকা মিউজিয়ামকে সমৃদ্ধি করেছিলেন। ভারতের বহু দুষ্প্রাপ্য অজানা প্রসঙ্গ উন্মোচিত হয়েছিল তাঁর সাধনার মধ্যে।
   ১৯২২ সালে নলিনীকান্ত বাংলার যে সমস্ত স্বাধীন সুলতান ছিলেন তাঁদের মুদ্রা ও সময়কাল নির্ণয়ের জন্য একটি তথ্যপূর্ণ নিবন্ধ লিখে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেছিলেন গ্রিফিত পুরস্কার যে নিবন্ধ পরে ‘Coins and Chronology of the Early Sultans of Bengal ‘ নামে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। তাঁর অপর এক গুরুত্বপুর্ণ কাজ ছিল ঢাকা মিউজিয়াম এ যে সমস্ত মুদ্রা রক্ষিত ছিল তার বিস্তৃত বিবরণ সংকলন করে দুই খন্ডে প্রকাশ করেছিলেন। গুপ্ত যুগের মুদ্রা সর্ম্পকে তাঁর অসাধারণ তথ্যবহুল নিবন্ধ ‘Attribution of the imitation Gupta coins’ নামে ১৯২৫ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে। জানা যায় যে নলিনীকান্ত কি অসম্ভব ধৈর্য আর পরিশ্রম এবং উপস্থিতিবুদ্ধি সহযোগে কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বা কোনো এক অতি রক্ষনশীল পরিবার থেকে দুষ্প্রাপ্য মুদ্রা বা মূর্তি সংগ্রহ করতেন। শোনা যায় একবার পূর্ববঙ্গের একটি গ্রামের পুকুরে বহু প্রাচীন মূর্তি নাকি শায়িত আছে। তিনি টানা  তিন দিন ঐ পুকুরের ধরে থাকলেন সংলগ্ন বাড়ির বাসিন্দাদের সাথে ভাব জমিয়ে। তবে শেষে কোনো কিছুই পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ তিনি কোনো কিছুকেই অবজ্ঞা করতেন না। আবার এমনও হয়েছে গ্রামের মহিলারা কোনো প্রাচীন মূর্তির পূজা করছেন, ভট্টশালী মহাশয় সন্ধান পেলেন কিন্তু মহিলারা তা হাতছাড়া করতে রাজি নন। এমতবস্থায়  ভট্টশালী তাদের কে বললেন যে মূর্তিটা নিয়ে তিনি নিজেই নিয়মনিষ্ঠাভরে পূজা করবেন। এইভাবে সেই অতি মূল্যবান মূর্তি তিনি ঢাকা মিউজিয়াম এ নিয়ে আসেন। ( গতবছরের মাঝামাঝিতে  বাংলাদেশে ছাত্র অভ্যুত্থানের সময় সেই মিউজিয়ামও মৌলবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। ফলে সেই সব প্রাচীন মূর্তি কতখানি অক্ষত আছে বা আদৌ আছে কিনা জানা যায় না)। ১৯২৯ সালে তিনি ঢাকা মিউজিয়ামে রক্ষিত বিভিন্ন পৌরণিক হিন্দু দেবদেবী এবং বৌদ্ধ মূর্তিগুলির পরিচয় সম্বলিত একটি পুস্তিকা ‘Iconography অফ Buddhist and Brahmnical Sculptures in the Dhaka Museum’ নামে প্রকাশ করেছিলেন। নলিনীকান্তর বিরামহীন প্রচেষ্টা এবং অন্তহীন সাধনাতেই বাংলার সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস যে অন্তত দেড় হাজার বছরের প্রাচীন তা প্রমাণিত হয়েছিল। পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার কোটালি পাড়া, ঢাকা জেলার সাভার, রামপাল, বজ্রযোগিনী, কুমিল্লা জেলার লালমাই প্রভৃতি স্থানের প্রাচীন গৌরব উদ্ধারের কৃতিত্ব মূলত তাঁরই।  
    ঢাকা মিউজিয়াম থেকে অবসর নেওয়ার পর কিছুদিন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ অধ্যাপনা করলেও ঢাকা মিউজিয়ামের সাথে ছিল আমৃত্যু সম্পর্ক। জীবনের শেষ দিকে তিনি ঢাকা মিউজিয়ামেই থাকতেন।  ঘটনাটা আকস্মিক হলেও সেই ঢাকা মিউজিয়ামেই ১৯৪৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী প্রয়াত হন প্রায় অনালোচিত এবং খানিকটা উপেক্ষিত এই মহান প্রত্নতাত্ত্বিক। ঢাকা মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ তাঁর প্রয়াণের উনিশ বছর পর ১৯৬৬ সালে তাঁর স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর প্রতি একটা অবহেলাই এতে প্রকাশ পায়। আর বর্তমান প্রজন্ম তো তাঁর নাম শুনেছে কি না সন্দেহ আছে।  প্রতিভাস ম্যাগাজিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *