নির্বাক
আমি কী?
আমি কেমন দেখতে?
আমি নিজেই কি তা জানি?
না, জানি না। আমার পরিচয় আমার কাছে অচেনা।
কী হতে চলেছি সেটাও আমার ধারণায় নেই যদিও আগামী দিনেই আমার বসবাস। আমি বর্তমানেও আছি, তবে কিভাবে আছি সেটা আমার কাছেই পরিষ্কার নয়। আমার উদ্দেশ্যটাও বোঝার ক্ষমতা নেই নিজের। আছি তো আছিই। কিন্তু, কেন, কিভাবে ইত্যাদি সমস্ত প্রশ্ন ভুলে। অবাক হই না নিজেকে দেখে, অবাক হওয়ার কারণও মাথায় আসে না। যা হয়ে আছি এবং যা হতে চলেছি সেসব নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই।
আজ আমি বর্তমানে যেভাবে আবিষ্কার করেছি নিজেকে এবং ভবিষ্যতে যে অবস্থায় দেখতে পাবো তেমন ভাবতে পারিনি অতীতে। হ্যাঁ, আমি অতীতে ছিলাম একসময়। আমার বর্তমান ও আগামী দিনের চেহারা নিয়ে আমার মধ্যে সংশয় থাকলেও অতীতে কেমন ছিলাম বা কিভাবে ছিলাম সেসব পরিষ্কার দেখতে পাই। দেখতে পাই স্মৃতিকে অবলম্বন করে যেহেতু আমার মূল আশ্রয় সে। বর্তমান আর ভবিষ্যৎ স্মৃতির ওপর নির্ভরশীল নয় বলে তারা আমার কাছে অস্পষ্ট। যেহেতু আমি দেখতে ভুলে গেছি, শুনতে ভুলে গেছি। ভাবতে অবশ্য ভুলে যাইনি, বরং ভাবনা আমার জন্য একটা মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। আমি এখন শুধুই অনুভব করতে জানি। অনুভূতিই আমার জগতে অদ্বিতীয় ও শেষ সংবাদ।
আমি কী ছিলাম, কিভাবে ছিলাম, কেমন ছিলাম বা কেন ছিলাম সেগুলি কিন্তু আমার অজানা নয়। অনুভূতি সর্বস্ব জীব যে, ভাবনা তার কাছে বড় বিষয়। স্মৃতিও সেখানে সজাগ থাকে। আমার অতীতের বিচরণ তাই আমি অনুভব করতে পারি। দেখতে পাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। যা চলে গেছে তাকে আবার প্রত্যক্ষ করা যায় না। তাছাড়া আমি বর্তমানে কোন কিছু দেখতে চাই না বলে দেখতে পারি না।
তবে আমার অতীতে আমি দেখতে পারতাম। দেখতে পারার ব্যাপারটা ছাড়া আরোও কয়েকটি বিষয় আমি করতাম তখন। আমি বলতে পারতাম, পড়তে পারতাম, লিখতে পারতাম, শুনতে পারতাম। হ্যাঁ, অনুভব করতেও জানতাম আমি। আসলে আমার শুরুটা হয়েছিল অতীতে অনুভূতি দিয়ে, এখন বাকি সব ভুলে আমি কেবল সেই অনুভূতিকেই আশ্রয় করে বেঁচে আছি।
উত্তর নেই আমার কাছে যেহেতু সেটা আছে ভবিষ্যতে। স্মৃতি দিয়ে ভবিষ্যৎ জানা যায় না। দেখতে ভুলে গেছি বলে ভবিষ্যৎটাকে দেখতেও পারছি না।
স্মৃতি দিয়ে অতীতকে জানা যায় বলে বরং আমার অতীতের কথাই ভাবা যাক। অনুভূতি দিয়ে শুরু করে আমি দেখতে আর শুনতে শিখেছিলাম। বলতেও শুরু করেছিলাম একই সঙ্গে। পরে লিখতে আর পড়তে পেরেছিলাম। নিজেকে তখন ভেবেছিলাম সেরা।
আসলে সত্যিই আমি সেরা হয়ে গিয়েছিলাম। না হলে এখানে এই বর্তমানে আসা সম্ভব হতো না। সেরা হয়েই থাকছিলাম। সেভাবে থাকতে থাকতেই আমি একদিন দেখলাম এমন জায়গায় নিজেকে নিয়ে গেছি যে আমার লেখালেখি করার বা পড়ার কোন দরকার নেই। কথা বলার ব্যাপারটাও বর্জন করার জায়গায় এসে গেলাম। ক্রমশ দেখা এবং শোনার মত একদা অত্যাবশ্যকীয় বিষয়গুলিও আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠলো। আমি দেখলাম, চলতে-ফিরতে খুবই পরিশ্রম হয়। তো আমি তাকে বর্জন করার পন্থা বার করে নিলাম। নানাবিধ কাজ, যেগুলি প্রথমে করতে আমার ভালোই লাগত সেগুলি ক্রমশ আমার পরিশ্রমের কারণ হয়ে যাওয়ায় আমি নানা উপায় অবলম্বন করে সেসব সম্পাদনের ব্যাপারটা সম্পন্ন করে ফেললাম। এভাবেই ছিলাম অনেকদিন। ক্রমশ দেখলাম, আমার কথা বলাতে পরিশ্রম, লেখালিখিতে পরিশ্রম, দেখতে পরিশ্রম, এমনকি শোনাতেও পরিশ্রম। এগুলি বর্জন করে বিকল্প উপায় পাওয়া যায় না জীবন ধারণের? ভাবতে ভাবতে আমি সেই উপায়ও খুঁজে পেলাম। আমি এখন লিখি না, কথা বলি না, দেখি না, শুনি না। বলতে গেলে, কিছুই করি না। আমি কেবল অনুভূতিকে আশ্রয় করে বাঁচতে শিখে গেছি। আমার জগতে এখন অনুভূতিই একমাত্র সত্যি।
উন্নয়নের রাস্তা ধরে চলতে শুরু করেছিলাম আমি। অনেকগুলি বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছি। এভাবে এই জায়গা পেয়েছি। এটাই আমার বর্তমান। হয়তো ভবিষ্যতও। অনুভূতির এই জগৎ।
আমার শুরু হয়েছিল এখান থেকেই, অনুভূতিকে সম্বল করে। আবার সেই অনুভূতি হয়ে উঠলো আমার একমাত্র অবলম্বন। আমার শেষটাও কি তাহলে অনুভূতি সম্বল করেই হবে? তার মানে কি এই যে আমার শেষ সমাগত?
আমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ কি সমাপতিত হয়ে গেল?
প্রতিভাস ম্যাগাজিন | prativas Magazine